#Journey
#২২
খুব ভোরে পাখির কিচিরমিচিরে জেসমিনের ঘুম ভাঙে।চোখ মেলে দেখে,আকাশ নীলাভ বর্ণ ধারণ করেছে।পাশেই রাইফ শুয়ে আছে বিছানায় ঘাড় বাঁকা করে রেখে ফ্লোরে বসে,ওর বাড়িয়ে রাখা হাতে এতক্ষন শুয়ে ছিল জেসমিন।ঘুমন্ত রাইফকে যে কত সুন্দর লাগছে,সেটা আজ এই প্রথম দেখার ভাগ্য হল ওর।ইচ্ছে হচ্ছে ছুঁয়ে দিতে।চারপাশে তাকাতেই ওর গতরাতের কথা মনে পড়ে যায়।
যখন পুলে নামতে নামতে দুজনেই ভিজে উঠে আসে,তখন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে রাইফ ওকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।এসির বাতাস নাকি আসন্ন ভালোবাসার ঝড়ের আভাসে জেসমিন কেঁপে ওঠে। কিন্তু রাইফ ধরে নেয়,এটা এসির জন্যেই।
“আমি এসি বন্ধ করে আসি?”
“না,থাকুক না”
“তোমার তো শীত লাগছে,ইশ,কি কাজটাই না করলাম,এত সুন্দর ড্রেস শখ করে কিনলাম তোমার জন্য,ভেবেছিলাম এই ড্রেসে তোমাকে দেখব,কিন্তু ভিজিয়ে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! দাঁড়াও,একটা তোয়ালে দেই…”
রাইফ বড় একটা তোয়ালে এনে জেসমিনকে জড়িয়ে দেয়।ওর চুলগুলো হাল্কা মুছে দেয়।
“তোমার শীত লাগছে না?তুমি প্যান্ট শার্ট বদলাবে না?”
“আমি? আমার এত শীত লাগছে না…লাগলেও সমস্যা নেই…”
বলতে বলতেই রাইফ গায়ের টিশার্ট খুলে ফেলে।জেসমিন লজ্জায় নিচের দিকে তাকায়,রাইফের কি লজ্জা শরম সব মরে গেছে?কিভাবে এটা করল…!
সামনে থাকা আরেকটা টিশার্ট তুলে গায়ে পড়ে।ঠিক তখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল! জেসমিন খানিকটা চমকে ওঠে,এটা কি হল!
“এখন হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল কেন!”
“কি জানি!বুঝলাম না…দাঁড়াও,টেকনিশিয়ানকে ডাকি…”
“এই না!আমাকে এভাবে অন্ধকারে রেখে চলে যাবা নাকি!আমার ভয় লাগে!”
“এত্ত বড় মেয়ে হয়ে ভয় পাও তুমি?!”
“এইটা তো অপিরিচিত যায়গা,ভয় পাব না কেন?”
“Point to be noted!”
“আচ্ছা,এখানে ক্যান্ডেল নেই?আমরা তো ক্যান্ডেল জ্বালিয়েও কথা বলতে পারি,পারি না?”
“ভাল বুদ্ধি”
রাইফ খুঁজে খুঁজে বের করে দুটো মোমবাতি, যদিও এগুলো পানিতে রাখা ছিল সাজানোর জন্য,আপাতত সেগুলো বোল সহ ওদের সামনে রাখা।বিছানার সামনের মাটিতে দুজন পা ভাঁজ করে বসে পড়ে,সামনে মোমবাতি রাখা। রাইফ জেসমিনের কাছ ঘেঁষে বসে,জেসমিন হাসে।দুজন গল্প শুরু করে,তাতে মিশে থাকে রাজ্যের যত দুষ্টুমি,পাগলামি,হাসাহাসি আর খানিকটা রোমান্স।এসব করতে করতে দুজন যে কে কখন ঘুমিয়ে পড়ে যাচ্ছিল,তখনই জেসমিন রাওফের রাখা হাতে মাথা ঠেকিয়ে কি কি যেন বলছিল,বলতে বলতেই ঘুমের দেশে পগারপার,ওদিকে রাইফ তো আরও আগে ঘুমিয়ে গেছে।
ঘুম ভেঙে সব মনে পড়তেই জেসমিনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। আস্তে করে রাইফের আরো কাছে যায়।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“নামায পড়তে ওঠো,আমাদের কিন্তু নামাযের কথা ভুললে চলবে না”
রাইফ ঘুমের ঘোরে মাথা নাড়ায়। জেসমিন উঠতে গেলে খেয়াল করে রাইফ ওর এক হাত ধরে রেখেছে। জেসমিন হাত ছাড়িয়ে উঠতে গেলে রাইফ ওর কোমর চেপে ধরে।
“উঠব না আমি?!”
রাইফ চোখ বন্ধ করেই হাসতে হাসতে দুপাশে মাথা নাড়ায়,ও উঠতে দিবে না।কাছে টেনে আনে বৌকে,কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। আস্তে করে বলে,
“এইটুকু সকাল সকাল দিতেই পারি,না?”
জেসমিন হেসে রাইফকে জড়িয়ে ধরে।
ভালোবাসার রঙ সবে মাত্র ওদের মাঝে ছড়াতে শুরু করেছে,আকাশেও লাল আবির রঙা ছাপ পড়তে শুরু করেছে।স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে নামাজ পড়া শেষ করে বিছানায় এসে বসে। জেসমিন বলে,
“আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে ”
“আমারও। ডাইনিং এ গিয়ে খাবে,নাকি এখানেই দিতে বলব?”
“এখানেই দিতে বল।বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না”
খাওয়া দাওয়ার পর জেসমিন বিছানার আশেপাশে ঘুরঘুর করে,বিছানায় শোবে নাকি শোবে না,সে নিয়ে সংশয় কাজ করছে। রাইফ এসে এর মাঝে দুম করে শুয়ে পড়ে।
“শুবে না?রাতে তো ঘুম ভাল হল না!”
“হুম…কিন্তু…”
“আরে,লজ্জা পাচ্ছো? ঠিক আছে,তুমি এই পাশে ঘুমাও,আমি ঐ পাশে”
জেসমিন হেসে ফেলে…
…………………….
মাসেক পাঁচেক পর…
আজ জেসমিন সিসিলি চলে যাবে,এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজন দু শহরে থাকবে না।জেসমিনের পিএইচডি করা শেষ। এখন আর এখানে বসে থেকে লাভ নেই,সিসিলি ওকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে,সেখানে সংসার পাততে হবে তো!
মাঝখানের এই পাঁচ মাস খুব কষ্টে গেছে।দুজনের মাঝে শুরুতে অনেক দ্বিধা থাকলেও এখন তার লেশমাত্র নেই।বন্ধু থেকে স্বামী স্ত্রী হওয়াটা যে খুব মজার,তা ওদের দুজনকে দেখলে বোঝা যায়।হুটহাট ঘুরতে যাওয়া,দুষ্টুমি,খোঁচাখুঁচি, ঝগড়া,আবার তার মজার মজার সমাধান,সব কিছু দিয়ে ওদের সংসার ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।জেসমিন আর রাইফের জীবনের যে অন্ধকার গহ্বর ছিল,তা ওদের নব্য ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে গেছে।জেসমিন ওর ভাইয়াকে কল করেছিল,রাইফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।আলআমিন খুব খুশি হয়েছে বোনের এত বড় একটা সুখবর পেয়ে।ভেবেছিল,বোনটা বুঝি আর স্বাভাবিক হতে পারবে না,রাইফকে দেখে সেই ভুল ভেঙেছে।অনেক অনেক দুয়া করেছে ওদের জন্য।
রাইফ ওর জন্য খুব পাগলামী করতে জানে।বাসায় আসলেই ওকে একা রান্না করতে দিবে না,নিজেও রান্নাঘরে ঢুকে যাবে।তারপর এটা ওটা মাখাতে মাখাতে সেগুলো জেসমিনের গালে হাতে মুখে মাখাবে,রান্নার মাঝে এটা ওটা খেয়ে নিবে।জেসমিন তখন ঠেলে বের করে দেয় পাঁজি বরকে।সে কি আর মানে?ঘুরতে ঘুরতে আবার এসে ঢুকে।তখন বৌ যেদিক যায়,বর তার কোমর ধরে সেদিকেই যায়,চুল খুলে দেয়।ওকে যতভাবে এলোমেলো করতে পারে,সে চেষ্টায় নিজের সব বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে বসে থাকে! অবশ্য নব দম্পতির মাঝে এ আর নতুন কি? তার ধর্মই হচ্ছে চুম্বকের মত ওকে অপরকে টেনে ধরে রাখা।তবে ওদের মাঝে বাঁধা এক্টাই,তা হল দুজনের আলাদা আলাদা কর্মস্থল।রাইফ চাইলেও জেসমিনকে সেভাবে সময় দিতে পারেনি,তাহলে আবার চাকরি থাকবে না।জেসমিনও যেতে পারেনি সিসিলিতে,কাজের চাপ অনেক ছিল।
ওদের সংসারে যার অভাব ছিল,তা হল একজন নির্ভরশীল মুরুব্বীর,যার দায়িত্ব খুব সুন্দরভাবে পালন করেছে জাফার।ওদের খেয়াল রাখা,জেসমিন আর রাইফের ঝগড়ার মিটমাট করা,উপদেশ প্রদান,স্নেহ করা,সব সে করেছে।তার সাথে সেলিম নামের বিনোদন ফ্রি! আজকাল এই ছেলে খুব পেকেছে।ওর কমিডিয়ান কাজ কারবার দেখে সবাই হেসে লুটিয়ে পড়ে।কিছুদিন আগে সেলিম জেসমিনকে বলে,
“আন্টি,তুমি আংকেলের সাথে প্রতিদিন ঘুমাও না?”
“হ্যাঁ,ঘুমাই তো,তোমার আংকেল এখানে যখন থাকে,তখনই ঘুমাই।কেন বাবা?”
“তাহলে তোমাদের বেবী আসছে না কেন?!”
“মানে!ঘুমালে বেবী আসে এটা কে বলল!”
“আমার পাপা বলেছে! বিয়ের পর যে সবাই ঘুমায়,এজন্য আল্লাহ বেবী দেয়।কিন্তু তোমার বেবী কই?আল্লাহর কাছ থেকে আনছ না কেন?তাড়াতাড়ি একটা বেবী আনো,আমি ওর সাথে খেলব! আল্লাহ বেবী পাঠালে কিন্তু আমাকে বলবা,আমি খেলব…!”
জেসমিন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,ওদিকে জাফার আর রাইফ হেসে কুটি কুটি। সেলিম আবার ঘুরে এসে বলে,
“আর হ্যাঁ আন্টি,তুমি কিন্তু আল্লাহকে বলবা ছেলে বেবী দিতে।আমি মেয়েদের সাথে কথা বলি না!”
সেলিম,জাফার,রাইফ,আর জেসমিন,ভালই চলছে সবার জীবন।এক জীবনে যতটা ভালবাসা অনেক মানুষ পায় না,আগে ওরাও পায়নি,তার সবটুকুই বিধাতা ওদের দিয়ে রেখেছেন।
এসব ভাবতে ভাবতে জেসমিন দেখে রাইফের নাম মোবাইলের স্ক্রিনে।
“হুম,বলো”
“আর কতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকব বল তো?তোমার লাগেজ গোছানো কি এখনও শেষ হয়নি?”
“হয়েছে তো!আমি নামছি”
নিচে নেমে সবাই গাড়িতে ওঠে।ওরা নিজেদের গাড়ি দিয়ে সিসিলি যাবে।যদিও রাইফ ড্রাইভ করতে চেয়েছিল,কিন্তু জাফার বাঁধা দেয়।বলে,পরে নাহয় রাইফ ড্রাইভ করবে।জাফার পাশের সিটে রাইফ বসে,আর পেছনে বসে জেসমিন সেলিমকে নিয়ে।গাড়িতে উঠে সবাই গল্পে মশগুল হয়ে যায়।গাড়িটা ভেনিস ছেড়ে এখনও ছাড়িয়ে যায়নি।জেসমিন জানালা খুলে মাথা বের করে দেয়।কি সুন্দর শহরটা!খারাপ লাগছে,কতদিনের স্মৃতি,দুই বছরেরও বেশি।বুকের ভেতর সবকিছু মিলিয়ে মোচড় দিচ্ছে।মানুষের জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে যাবে,তা কেউ জানে না।এই যেমন দেশে থাকতে কখনো ভাবেনি ইটালি আসবে,ইটালি এসে ভাবেনি ভেনিস ছেড়ে যাবে।তবে আল্লাহ যা করেন মঙ্গল করেন।ভেনিসের মত বড় শহর না হলেও সিসিলি অন্য রকম সুন্দর একটা শহর।মনে মনে জেসমিন ভাবতে থাকে কিভাবে ওদের বাসা সাজাবে,কোথায় কি দিবে,আসবাবপত্রগুলো কোনটা কোথায় রাখবে,সারাদিন কি কি করবে…
ভাবতে ভাবতেই কানে যায় জাফার চিৎকার।হঠাৎ কি হল?! রাইফ ওদের মাথা নিচু করতে বলে।জেসমিন সতর্ক হয়ে যতক্ষণে ঘুমন্ত সেলিমকে বুকের সাথে চেপে ধরেছে,তার পর পরই ওদের গাড়িটা রাস্তার ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে…
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria