#Journey
#৩৬
ভোরের আলোয় জেসমিনের ঘুম হালকা হয়ে আসে।চোখ পিটপিট করে চেয়ে দেখে রাইফের বুকে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।ওর শার্টবিহীন বুকে মুখ চেপে গাঢ় নিঃশ্বাস নেয়,যাতে গত রাতেই দুজনের শরীরের ঘ্রাণ মিশে একাকার হয়ে গেছে।তারপর রাইফের গলা জড়িয়ে ঝাঁকায়।
“এই!সকাল হচ্ছে,উঠবা না?”
রাইফ ঘুম ঘুম চোখে তাকায়।সকালের আবছা আলোয় বুকের সাথে তার প্রিয় স্ত্রী লেপ্টে আছে,সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানা একেবারে কাছে,এতটা কাছে যে নাকের ছোট্ট তিলটাও দেখা যাচ্ছে।মন চাচ্ছে মুখ উঁচু করে ওর নাকে নাক ঘষে দিতে।কিন্তু বালিশ থেকে মাথা তুলতেই ইচ্ছা করছে না।
“আজ না উঠলে কি হয়?”
“না উঠলে নামায পড়া হবে না,গোসল করে তারপর ফযর এর…”
“ওহো!নাআআআআ!গোসল করতে কষ্ট লাগ তো! উঠব না!”
“না উঠলে ভাল হবে না,আমি ঠান্ডা পানি ঢেলে দিব কিন্তু!”
“ঠিক আছে,উঠতে পারি,এক শর্তে”
“কি শর্ত?”
কানের কাছে মুখ নিয়ে রাইফ ফিসফিস করে বলে,
“একসাথে গোসলে যেতে হবে!”
“অসভ্য! যাও!”
“ওরে মা!বিয়ের আট মাস পর এই কথা! কিভাবে!চলো চলো,নাহয় আমার সকাল হবে না!”
বিছানা থেকে গড়িমসি করে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় জেসমিন খেয়াল করে, বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।রাইফের হাত ছেড়ে আস্তে করে এগিয়ে ট্যারিসে চলে যায়।ভোর বেলার বৃষ্টিমুখর সকাল,মেঘে মেঘে আকাশ কালো থাকার কথা ছিল।কিন্তু পুব আকাশ কালো নয়,বরং মেঘের উপর লাল সূর্যের আবীর রঙ মেখে টকটকে গোলাপী রঙ ধারণ করে আছে।এক দিকে বৃষ্টি আরেকদিকে আকাশের এমন অদ্ভুত সৌন্দর্য মাখা রূপ।মাঝে মাঝে সকালের আকাশ দেখলে জেসমিনের মনে হয় জান্নাতের আরেকটা রূপ এই পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে।জেসমিন দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গান ধরে,
♪যদি ডেকে বলি,
এসো হাত ধরো,চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে।
এসো গান করি মেঘমল্লার,
করূণাধারার দৃষ্টিতে।
আসবে না তুমি,
জানি আমি জানি।
অকারণে তবু কেন কাছে ডাকি?
কেন মরে যাই তৃষ্ণাতে…♪
রাইফ পেছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে গালের সাথে গাল মিলিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“কে বলল আমায় ডাকলে আমি আসব না?আমাকে ডাকলে কখন?”
“এটা তো শুধুই একটা গান!”
“ওহ,তাই নাকি? তা,গোসল কি তবে এখানেই হচ্ছে আমাদের?”
“ছিঃ সরো!কিসব আজেবাজে বল,লজ্জা একেবারেই নেই দেখছি!”
রাইফ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসে।ওর দিকে জেসমিন মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।ছেলে মানুষের হাসি যে এত সুন্দর হয় তা এই ছেলের প্রেমে পড়ার আগে জানা ছিল না।মায়াবী হাসির অধিকারী ছেলের চুল ধরে এলোমেলো করে দেয়,আর কাছে এনে বলে,
“শোনো,আমার মনে হয় আমাদের এখন আর অপেক্ষা করা ঠিক না!”
“হুম,চলো চলো,ওয়াশরুমে যাই”
“ধুর,তাই বললাম নাকি?কিছুই বোঝো না তুমি”
“তাহলে?”
“বলছি,আমাদের এখন তিনজন থেকে চারজন হওয়া চাই!”
“ও ও ও ও আচ্ছা!তা আগে বলবা না!”
দুষ্টুমি আর খুনশুটিতে দুজন মেতে ওঠে। সেদিনের পর থেকে ওদের মাঝের দূরত্ব আরও কমে আসে।জেসমিন কারণে অকারণে রাইফের সাথে ঘুরে,জড়িয়ে ধরে, দুষ্টুমি করে।রাইফও কম যায় না।সেলিম সামনে থাকলেও মাঝে মাঝে এমন সব কান্ড করে বসে যে জেস লজ্জায় লাল হয়ে যায়। এরমাঝে ওরা বেবী নিয়ে নানারকম প্ল্যান করতে থাকে।বেবী ছেলে না মেয়ে হবে,মেয়ে হলে নাম কি রাখবে আর ছেলে হলে কি রাখবে।কোন কাপড়ের স্টোড়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কাপড় দেখিয়ে দেখিয়ে বলে যে এটা কিনব,ওটা কিনব।
এভাবেই কাটে তিন মাস।এক সকালে জেসমিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়।বাইরে রাইফ দাঁড়িয়ে আছে,অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জেসমিনের মুখ থেকে কাঙ্খিত খবর পাওয়ার জন্য।উদগ্রীব চোখে জেসমিনের রিএকশনের জন্য ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।জেসমিন ঠোঁট উলটে দুদিকে মাথা নাড়ায়।রাইফের মুখ পাংশু হয়ে যায়।জেসমিন দুহাত ওর কাঁধে দিয়ে কাছে টানে।
“খারাপ লাগছে?”
মুখ গোঁজ করে রাইফ বলে,
“আমার চাইতে তোমারই তো হতাশ হওয়ার কথা,তোমার খারাপ লাগছে না?”
“উম, নাহ!”
“ছিঃ,তুমি এমন কেন?”
“কারণ…আমি তো মা হচ্ছি!”
“কি!তার মানে…তার মানে…তার মানে পজিটিভ?!”
জেসমিন হেসে মাথা নাড়ায়।রাইফ বিশ্বাস করতে পারে না।প্রেগ্ন্যাসি স্ট্রিপ হাতে নিয়ে চেক করে,লাল রঙের দুটো দাগ বেশ স্পষ্ট। খুশিতে বৌকে কোলে নিয়ে ফেলে।
“উফ,কত দিন ধরে এই দিনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম!ফাইনালি আল্লাহ কবুল করেছে!ইয়েএএএএএএএএ!!!”
জেসমিন দুহাতে শক্ত করে স্বামীকে ধরে রাখে।কোল থেকে নেমে এলোপাথাড়ি অনেকগুলো চুমুতে ওর সারা মুখ ভরিয়ে দেয়।আস্তে করে তারপর মাথা নিচু করে বলে,
“মাকে কি বলবে এই কথা?”
রাইফ অনেক রেগে যায়।
“তোমাকে না বলেছি ঐ মহিলার নাম মুখে না নিতে,হ্যাঁ?! আমার বাচ্চা কাচ্চা দূরে থাক,আমার বাঁচা মরা নিয়েও তার জানার কোন দরকার নেই! এই মহিলার জন্য গতকালও আমার সবচেয়ে প্রিয় মামী,যে বলতে গেলে আমার সত্যিকারের মা,তার ফোনও ধরিনি! আমার জীবনটা…ধুর,মেজাজটাই খারাপ করে দিলা!!”
রাগ করে রাইফ বেডরুমে চলে যায়,পেছন পেছন জেসমিনও দৌড় দেয়।পেছন পেছন যেতে নিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে দিয়ে দরজা ধরে কোনমতে পতন ঠেকায়।রাইফ পেছন ফিরে এই অবস্থা দেখে দৌড়ে আসে।
“এরকম মরার মত দৌড় দিলে কেন বুঝলাম বা তো! আমার পিছে পিছে আসার কি আছে?আমি কি পালাচ্ছি কোথাও? এদিকে আসো!”
জেসমিনকে টেনে এনে বিছানায় বসে।ঠিক এই সময় সেলিম দৌড়ে ঘরে ঢুকে।ওকে দেখে রাইফ টেনে কোলে নেয়।
“জানো বাবা,তোমার একটা ভাইয়া আসছে”
“তাই?কোথায় ভাইয়া?কবে আসবে?”
“আসবে…আমরা হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসব।ওখান থেকে…”
“তোমরা কি নিউ বেবী আনার কথা বলছ আন্টি আংকেল?”
“হ্যাঁ বাবা”
“কিন্তু বেবী তো হাসপাতালে কিনতে পাওয়া যায় না!বেবীরা আম্মুদের টামিতে থাকে!”
জেসমিন সেলিমের পাকনামি দেখে মুখ টিপে হাসে।রাইফ অবাক হয়ে বলে,
“তুমি কিভাবে জান!এসব তোমাকে কে বলল?”
“আমি জানি তো,আমার বন্ধু আছে,ডেবিডের মা,তার টামিতে বেবী আছে।তার পেট এখন এত বড় হয়ে গেছে!আমি শুনেছি,বেবী টামির ভেতর নড়ে,লাথিও মারে।আংকেল,আন্টির টামিতেও কি বেবী আছে?”
রাইফ জেসমিনের দিকে তাকায়।জেসমিন নিঃশব্দে মুখে হাত চেপে দুলে দুলে হাসছে,আর রাইফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।চোখ বড় বড় করে বলে,
“আজকালের পিচ্চি গুলা এত পাকনা ক্যারে!!”
এরপর ধীর গতিতে,খুব ধীরগতিতে জেসমিনের প্রেগন্যান্সির সময়টা এগিয়ে যাচ্ছে।কখনো মজা,আনন্দ,কখনো কষ্টে সময়গুলো কাটে।মাঝে একবার বাবুটা উলটে গিয়েছিল।সাধারণত বাচ্চাদের মাথা নিচে থাকে আর পা উপরে থাকে।কিন্তু যখন মাথা উপরে উঠে যায়,তখন মায়েরদের চলতে খুব কষ্ট হয়।যা খায়,তাই বের হয়ে যেতে চায়,নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়,ঠিকভাবে শুতে পারে না,বসতে পারে না,দাঁড়িয়েও শান্তি নেই।এত কষ্ট করে একটা ছোট্ট দেহকে একজন নারী তার নিজের দেহের ভেতরে ধারণ করে কাটায় দীর্ঘ ৯টা মাস।আল্লাহ তো শুধু শুধু মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত দেয় নি!
রাইফ আর সেলিম মাঝে মাঝেই জেসের পেটে মাথা রেখে বেবীর নড়াচড়া বোঝার চেষ্টা করত।বেবী কিক দিলে সবচেয়ে বেশি খুশী হতো সেলিম।ও তাই বেশিরভাগ সম জেসের আশেপাশে ঘুরঘুর করত,এই বুঝি বেবী কিক দিল! একদিন ওদের বলে,
“আন্টি,আমি যখন মাম্মির টামিতে ছিলা,তখন কি আমিও এরকম কিক দিতাম?”
জেসমিন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“হ্যাঁ বাবা,সবাই আমরা দিয়েছি”
“আন্টি,আমার মাম্মি কেমন ছিল?”
জেসমিন আর রাইফ মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।লিলির কোন ছবিই ওদের কাছে নেই,জাফারে গুটিকতক ছবি আছে শুধু।ছোট ছেলেটা ওর বাবা মাকে প্রায় ভুলতে চলেছে।জেসমিন ওকে বুকে চেপে বলে,
“তোমার মাম্মি আমার মত ছিল,এই যে,আমিই তোমার মাম্মি!”
রাইফ দুজনের কপালে চুমু খায়।
“আমার এক ছেলে তুমি,আরেকটা ছেলে তোমার আন্টির কাছে”
সেলিম কি বুঝল কে জানে,মাথা নেড়ে দুজনের গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে খেলতে চলে যায়।বাচ্চা মানুষ,এখনো বুঝ হয়নি,হয়ত বড় হয়ে বুঝবে,তখনের ওর কাছে জীবনের মানে অন্য রকম হবে।
এরকম আবেগ,অনুভূতি আর অনেক কষ্টের মাঝ দিয়ে ওদের আকাঙ্ক্ষিত সময় চলে আসে।জেসমিন এর ওয়াটার ডেলিভারী হবে।ওয়াটার ডেলিভারী হচ্ছে একটা পানি ভর্তি টাবে মায়েরা বাবাকে সহ সন্তান প্রসব করে থাকে।তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ এবং অনুমতি থাকতে হয় কারণ সব মায়ের প্রেগনেন্সির কন্ডিশন এক থাকে না।যারা প্রাকৃতিকভাবে কোন ক্রটিক্যাল অবস্থা ছাড়া সুস্থ থাক,তারাই এভাবে সন্তান জন্ম দিতে পারে।ডাক্তারের পরামর্শেই আজ এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে প্রায় পুরোদিন ধরেই জেসমিনের পেইন।ব্যথা কমছে,আবার বাড়ছে।কেমন যেন অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা,না বলা যায়,না সওয়া যায়।বাচ্চা হওয়ার আগে পর্যন্ত নাকি এই ব্যথাও কমবে না।আর শুধু পানির পিপাশা পাচ্ছে,মনে হচ্ছে গ্যালন গ্যালন পানি একবারে শেষ করে দিতে পারবে।ব্যথাটা সমস্ত শরীরে প্রিটা শিরায় শিরাট ছড়িয়ে যাচ্ছে।
টাবের ভেতর জেসমিন সহ রাইফ বসে আছে।সেখানে বসে বারবার প্রেশার দেয়ার পরও জেসমিনের বেবী আসছেনা।ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।টাবের একপাশে দুহাত রেখে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করে যাচ্ছে,আর দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
রাইফ ওর কোমর ধরে রেখেছে।এই আট মাসের মাঝে এত দ্রুত মেয়েটা বদলে গেছে!আগের জেসমিন আর নেই।মোটা হয়ে গেছে,শরীরের বেশ ফাটা দাগ,বেশ উঠেছে,কালো হয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি জমেছে,আর সমস্ত শরীর জুড়ে অবসাদ।
জেসমিন কেঁদে উঠে আবারো।
“আমি পারছি না…অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার!”
রাইফ ওর পিঠে ঠোঁট ঠেকায়।পিঠে এক হাতে মালিশ করতে করতে বলে,
“আরেকটু চেষ্টা কর,জেস,প্লিজ।আরেকটু চাপ দাও,আমি আছি।একদম ভেবো না।আর কিছুক্ষণ,তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে”
জেসমিন রাইফের কোলে বসে ওর বুকে হেলান দেয়।সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।ওর মনে হচ্ছে,এই বাচ্চা জন্ম দিতে ও কিছুতেই পারবে না।রাইফ ওর হাতে মালিশ করতে থাকে,মুখের ঘাম মুছে দেয়।পাঁচ মিনিটের মত বসে থেকে জেস আবার চেষ্টা করে।পুরো একটা মানুষ শরীর থেকে বের হওয়া কি চাট্টিখানি কথা?! জেসমিনের বারবার মায়ের কথা মনে পড়ে।এত সহজ না মা হওয়া,সন্তান জন্ম দেয়া!নয় মাস ধরে নিজের রক্ত,খাবার,জল সব দিয়ে একটা প্রানকে তিল তিল করে বড় করে জন্ম দেয়া আর শরীরের বায়ান্ন জোড়া হাড় ভাঙার কষ্ট এক!
এদিকে রাইফ ওকে ধরে রেখে বারবার সাহস দিচ্ছে।হঠাৎ জেসমিন অনেক জোরে চিৎকার করে ওঠে!
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria