Mr. Calculus (পর্ব – ৬)
প্রফেসর আমানত উল্লাহ খান বড় ভাইকে না বলে কখনো কোন সিদ্ধান্ত নেন না। ছেলের বিয়েতে তিনি যাবতীয় কাজের সিদ্ধান্ত বড় ভাইয়ের থেকেই নিয়েছেন। এই কারণেই কিনা জানি না, আমানত উল্লাহ সাহেব সকল কাজেই বরকত পেয়েছেন। বরকত সাহেব মাঝে মাঝে “এত বয়স হইছে, সিদ্ধান্ত তো সব নিজেই নিতে পারো?” বলে কপট রাগ দেখালেও তার প্রতি ছোট ভাইয়ের এই ভরসা, সম্মান আর ভালোবাসা তাকে ভীষণভাবে সিক্ত করে। দূরে থাকলেও এদের সবার মাঝেই পারিবারিক বন্ধন খুব গাঢ়। বড় চাচাকে দেখেই রাইয়ান শিখেছে কী করে ছোট ভাই-বোনকে আগলে রাখতে হয়। রিফাত আর রিয়ানা শিখেছে কী করে বড় ভাইকে বাবার মত সম্মান করতে হয়। এখনকার পরিবারগুলোতে এসব খুব একটা দেখা যায় না বলেই পরবর্তী জেনারেশনের ভেতর আদব-কায়দা ব্যাপারটা একেবারেই অনুপস্থিত!
বিয়ে বাড়ির পূর্ণ আমেজে ভাসছে দুই পরিবার। রিফাতদের বাড়ি আত্মীয়স্বজন দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। এত লোকের খাওয়া দাওয়ার আয়োজনে ৩দিনের জন্য আলাদা বাবুর্চি রাখা হয়েছে। একটা বিয়ের আয়োজন হলেই তো এত মানুষের সমাগম হয়। তাই রেহানা ইসলাম কোনভাবেই চান না কোন কিছুতে কোনরকম ত্রুটি থাকুক। সারাদিন সারাবাড়ি ব্যস্ত… এই ব্যস্ততা সবাই বেশ উপভোগ করে। ওদিকে রিফাতের সাথে পুষ্পর সম্পর্ক এখনো ঝগড়া ঝগড়া টাইপ রোমান্টিক।
এদিকে সাজসজ্জার সাথে সাথে বিয়ের দিন জামাইর পকেট থেকে কত ভাবে টাকা খসাতে হবে সেই প্ল্যান নিয়েই পাপড়ি সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। পুষ্প নিজেও তাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট হেল্প করছে। তার সকল বন্ধুদের লাগিয়ে দিয়েছে আইডিয়া জমা করতে। এ্যাসাইনমেন্টের শোধ এভাবেও নিতে হবে কিছুটা। তাছাড়া জামাইয়ের টাকায় এদের হালাল হক আছে তো। তবে মনে মনে সে এটাও ভাবছে, রিফাত যে পরিমাণ বুদ্ধি রাখে মাথায় তাতে তার সাথে পেরে উঠবে তো এরা?
***
বর এসে পড়েছে শোনা মাত্রই পাপড়ি তার দলবল নিয়ে গেটে হাজির। লাল ফিতা দিয়ে গেট আটকে দেয়া হয়েছে। গেটের এ প্রান্তে কনেপক্ষের একঝাক সুন্দরী প্রজাপতি। সাথে অবশ্য পুষ্পর গাধামার্কা ছেলে বন্ধুগুলোও আছে আর অপর পাশে বরযাত্রী। রিফাতের বন্ধুরা সব তার পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কনেপক্ষের মেয়েগুলো অযথাই ভাব নিচ্ছে। আজকাল যদিও “দুলাভাই” ডাকের প্রচলন একেবারেই কমে গেছে তবু এরা সব কয়টা সব কথার শুরু আর শেষে আহ্লাদে গদগদ হয়ে সুর করে করে “দুলাভাই” লাগিয়ে যাচ্ছে। রিফাতের বন্ধু ফিতা কাটার কাঁচি চাইতেই গেট ধরার টাকা নিয়ে মূলামুলি শুরু হয়ে গেল। পুষ্পর বন্ধু তারেক তখন বলে উঠল দশ হাজারের এক টাকাও কম হবে না। সেটা শুনে রিফাতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুকে রিফাত কানে কানে কী একটা বলল তারপর সে তারেকের দিকে তাকিয়ে বলল-
-আপনি এত কথা বলছেন কেন? কে আপনি?
-পুষ্পর ফ্রেন্ড। একইসাথে পড়ি আমরা।
-ও… তাহলে বলুন “টেন টু দি পাওয়ার ফোর ইকুয়ালটু কত?”
-তারেক থতমত খেয়ে গেল। এ কী জ্বালা! এখানে কেন পড়া ধরছে?
রিফাতের বন্ধু তাগাদা দিল- কী হলো বলুন?
-40.
-40! এই ছেলে ম্যাথে পড়ে? নকল করে পাস করলেও তো 40 বলার সাহস হবার কথা না। বরপক্ষের সবাই ততক্ষণে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে আর কনে পক্ষের সবাই চূড়ান্ত বিরক্তি আর অপমান নিয়ে তারেকের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। তারেক ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ করে বলল-
-“সরি… ১০ হাজার বলতে চেয়েছিলাম।” তারেকের ইচ্ছে করছিল নিজের পেছনে নিজেই কষে একটা লা*থি মারে। কী করে এটা বলে ফেলল? নিজেকে আনান্তা জলিলের আত্মা মনে হচ্ছে এখন!
-কোথায় “তালতলা আর কোথায় শকুন্তলা” বলে বরপক্ষের সবাই আবার হাসতে লাগল।
রুপক তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলল- তোর ভুলের *** বাকিটা আর বলা গেল না। অবশেষে সাত হাজার টাকায় ফিতা কাটার পারমিশন পাওয়া গেল। “আগে টাকা পরে ফিতা কাটা” তাই টাকাটাই আগে দিতে হল। কিন্তু এত বড় আর ভারী টাকার ব্যাগ দেখে সবাই সন্দিহান হয়ে গেল। সন্দেহ মোচন করতে ব্যাগ খুলে দেখে ব্যাগ ভর্তি কয়েন! মুহূর্তেই সবাই চিৎকার করে উঠল… “কী এসব?”
রিফাতের বন্ধুরা বলল- আপনাদের দাবী রক্ষা করলাম।
পাপড়ি ঝাঁজের সাথে বলল- আমরা টাকা চেয়েছি, কয়েন না?
-কেন কয়েন বলে কী এই সমাজে তার কোন মূল্য নেই? আর শুধু কয়েন তো না টাকাও আছে।
-সব দুই টাকা পাঁচ টাকার নোট!
-দশ টাকা বিশ টাকার নোটও তো আছে ২/৩ টা।
-মেয়েগুলো সব রাগ সামলাতে পারছে না। বলল- ঠিক আছে গুনে দিন কত আছে এখানে?
-টাকা গুনে নেয়া সুন্নত। আপনারা সুন্নত আদায় করুন আমরা ভেতরে যাই। টাকার পরিমাণ বেশি হলে বলার দরকার নেই কম হলে জানাবেন। ভেতরেই যখন থাকছি পালিয়ে যাবার সুযোগ নেই। আমাদের সামনেও গুনতে পারেন, we don’t mind.
কিন্তু কনেপক্ষ কেউ সেটা মানতে নারাজ। তারা সাফ জানিয়ে দেয় “কয়েন নয়, টাকা চাই” নয়ত কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না। এমন সময় পুষ্পর দাদা সেখানে চলে আসেন। এসেই মেয়েগুলোকে রাম ধমক দিয়ে বসেন। মেয়েদের এসব করা তিনি একদমই পছন্দ করেন না। পাপড়ি প্ল্যান করে তাকে অন্য কাজে বিজি করে দিয়ে এসেছিল কিন্তু দাদার চুল তো শুধু বয়সে না, অভিজ্ঞতায় পেকেছে। তাই তিনি ঠিকই চলে এসেছেন এখানে। মেয়েগুলোকে উপরে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি বরযাত্রী নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
পাপড়ি উপরে এসে মেজাজ খারাপ করে বসে আছে। পুষ্প ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল-
-কিরে কী হয়েছে?
-কী আর হবে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো এমন কেন?
-কী করেছে?
-গেটে টাকা চেয়েছি বলে পড়া ধরতে শুরু করেছে তারপর তারেক ভাইয়ার কী ভয়ংকর উত্তর! ইসস কী বিশ্রী অবস্থা… মান সম্মানের ফালুদা… না, ফালুদা না, একেবারে ডিসেন্ট্রি করে ছেড়েছে। তার উপর দিয়েছে এক বস্তা কয়েন! ভাবা যায়?
-এগুলো আমার শ্বশুরবাড়ির লোকের কাজ নয়। সব রিফাতের কাজ। ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছি। কয়েনের ব্যাগটা কোথায়? আমার কাছে দিয়ে যা।
-তোমার কাছে দিব কেন?
-রিফাতকে দিয়েই এই কয়েন টাকা বানিয়ে দিব তোদের। বউ হয়ে যাচ্ছি না? রিফাত ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি, ওকে সেই ফাঁদে আটকে আমি শঁঙ্খরাজের নৃত্য দেখাব।
পাপড়ি হা করে পুষ্পর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে- তুই জীবনে কোনদিন তেলাপোকার নৃত্য দেখেছিস যে শঁঙ্খরাজের নৃত্য নিয়ে ভাবছিস?
-তোর টাকা লাগবে? নাকি না?
পাপড়ি তখন কয়েনের ব্যাগটা ওকে দিয়ে দেয়। আর তখনই পুষ্পর ফোনে রিফাতের ম্যাসেজ আসে-
“পাপড়ির জন্য খারাপ লাগছে। কি আর করা… তোমার বন্ধুগুলো এত অপদার্থ! যা হোক ওকে বলে দিও কয়েন নিয়ে যেন না ভাবে এটা জাস্ট মজা করার জন্য। ব্যাগটা তোমার কাছে রেখে দাও যাবার সময় কয়েন পাল্টে ওদের ডিমান্ড অনুযায়ী টাকা দিয়ে যাব।”
ম্যাসেজটা দেখে পুষ্পর মন নরম হয়ে গেল… ইসস ছেলেটা এতটাও খারাপ না! সে তখন পাপড়িকে বলল- বিয়েবাড়িতে এমন টুকটাক মজা সবাই করে, তুই একেবারে এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেন? একেবারে বিচার নিয়ে এসেছিস? দুলাভাইরা শালা-শালীদের সাথে একটু মজাও করতে পারবে না নাকি?
-কী ব্যাপার! তুমি হুট করে এমন পল্টি খাওয়া কথা বলছ কেন?
-পল্টি খাওয়া কথা বলছি না। নিরপেক্ষ কথা বলছি।
-উহু, তোমার আচরণ সন্দেহজনক! দুই মিনিট আগের বয়ানের সাথে এখনকার বয়ানের কোন মিল নেই!
-আমার বয়ানের পোস্টমর্টেম না করে ওদিকে কী হচ্ছে গিয়ে দেখ। টাকা খসানোর বাকি উপায়গুলো না আবার হাত ছাড়া হয়ে যায়?
-ধুর, উপায় থাকলেও লাভ নাই।
-কেন?
-আরে দাদাভাই সব জায়গায় আমাদের জন্য তার বাজপাখির নজর দিয়ে বসে আছেন। আমরা যেখানেই যাচ্ছি কীভাবে কীভাবে যেন গন্ধ শুকে শুকে ঠিক হাজির হয়ে যায় আর হুংকার দিয়ে বলতে থাকে, “কিরে তোরা সব গুষ্টিশুদ্ধা আবার ছ্যামরাগো সাথে গলাবাজি করতেছোস? ভিতরে যা বেশরমের দল।” বিয়ের একটা দিন শান্তিতে কোন কাজই করতে দিচ্ছে না! আনন্দ তো বাদই। সারাক্ষণ “এই ওদিকে কই যাস? এত সাজছিস কেন? লিপিস্টিক কী বোতল উল্টায় ঢাইলা দিছস? বোতল উল্টায় চুলে একটু তেল দিতে পারোস নাই? চুলে তেল দিয়া মাথায় কাপড় দে যা।” আশ্চর্য বাড়িতে একটা বিয়ের উৎসব চলছে আর আমি সেখানে মাথা তেল জবজব করে ঘোমটা দিয়ে কপিলা সেজে বসে থাকব? উফফ… বাবা কেন যে দাদাকে এখানে নিয়ে এসেছে? বিয়ের দিনটা তাকে পাগলাগারদ ভিজিট করতে পাঠানো দরকার ছিল। নিজের বন্ধুদের সাথে ভালো কিছু সময় কাটিয়ে আসতে পারত।
পুষ্প হাসি চেপে বলল- দাদাভাইকে নিয়ে এমন উল্টো পাল্টা কথা বলবি না একদম। মুরুব্বি মানুষ, তিনি সেটাই বলেন যেটা আমাদের জন্য ভালো এবং সঠিক। মুরুব্বি মানেই মাথার উপর শান্তির ছায়া। এরা আছে বলেই জীবনে কলুষতা জায়গা নিতে পারে না। এদের সব কথা মানতে হয়, সম্মান করতে হয়। তোর কাছে খারাপ লাগছে কিন্তু তিনি তার জায়গায় সঠিক। বিয়েবাড়িতে এমন মজা করতে গিয়ে অনেকেই অনেক বিপদে পড়ে। কারণ মজা করার সময় সবাই লিমিট ঠিক রাখতে পারে না। কখনো কখনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। আমাদের সকলকেই শালীনতা বজায় রেখে চলতে হয়। এইজন্যই দাদাভাই এসব পছন্দ করেন না।
-হুম এবার তুমিও জ্ঞান ঝাড়ো। বলে সে উঠে গেল সেখান থেকে। পুষ্প তখন ভাবতে লাগল, মেয়েটা বড় হচ্ছে… একে এগুলো শেখানোটা জরুরি।
দাদাভাইয়ের জন্য পুষ্প কিছু করতে পারবে না সেটা বুঝতেই পারছিল। তার রাগ হলেও আপুর বলা কথাগুলো মনে করে নিজেকে সংবরণ করে নিল। আপু তো ভুল কিছু বলেনি। এটা তার নিজেরই বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু বিয়েবাড়িতে মজা হবে না, কয়েন দেয়ার শোধ হবে না সেটা তো হয় না। কী করা যায়? সে তখন প্ল্যান করল আপুর ছেলে বন্ধুগুলোকে কাজে লাগাবে। কিন্তু ওগুলোও একেকটা গাধা। অবশ্য গাধামি করবেই বা না কেন? রিফাত ভাইয়া এদের স্যার হয়, এতদিন যে নাকানিচুবানি দিয়েছে সে তাতে তার সামনে গেলে এমনিতেই সবকটার ভয়ে কাপাকাপি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কিছু করার নেই… এদের দিয়েই কাজ চালাতে হবে!
পাপড়ি বরের স্টেজের দিকে গিয়ে দেখে দাদাভাই সেখানেই বসে আছে। সে দাঁড়িয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল তিনি ওখানে কী করছে? তারপর যা দেখল…
-দাদাভাই পুষ্পর বন্ধুদের বলল, এমন ভ্যাবলার মত না থেকে রিফাতের সাথে গিয়ে গ্রুপ ছবি তুলতে। ফটোগ্রাফার কী এমনি আনা হয়েছে? দাদাভাইয়ের কথা শুনে রিফাতকে ঘিরে থাকা তার সব বন্ধুরা সরে গেল আর পুষ্পর সবকটা বন্ধু স্টেজে উঠে গেল। দাঁড়িয়ে থেকে অনেক পোজে ছবি তুলল। এরপর বসে ছবি তুলতে চাইল। সবাই বসে একটা ছবি তোলা মাত্রই রিফাতের পা থেকে জুতা খুলে নিয়ে দৌড়! ঘটনার আকস্মিকতায় রিফাত আর তার বন্ধুরা অবাক। ওদিকে দাদাভাই হাসতে হাসতে শেষ। এবার সবাই মিলে জুতার জন্য টাকা দাবী করতে লাগল। আর দাদাভাই নিজে গিয়ে সেখানে তাল দিচ্ছে! এসব দেখে পাপড়ির চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড়। দাদাভাইয়ের সাথে তো আর টাকা নিয়ে বেশিক্ষণ মূলামুলি করা যায় না। তাই সহজেই ৫ হাজার দিয়ে দিতে হল। তিনি টাকা হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলতে লাগল-
-সবাই খেতে চলুন। খাবারের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। এই তোরা সব জামাইকে নিয়ে যা খাওয়াতে। সবাইকে খেতে পাঠিয়ে দিয়ে তারেককে ডেকে বলল- এই এদিকে আসো। তারেক এসেই বলল-
-দাদাভাই আপনি তো সেই দিলেন! আপনার জন্যই ৫হাজার সম্ভব হল নয়ত দুইহাজারও নিতে পারতাম না।
-হুম। কিন্তু কথা হইল জুতা চুরির টাকা তোমরা একটাও পাবা না। এগুলা সব আমার। এখন যাও জামাইকে ভালো করে যত্ন নিয়ে খাওয়াও তারপর হাত ধোওয়াও। সেইখান থেকে যা পাবা সব তোমাদের। জামাইর যেন কোন অযত্ন নাহয়। আমি ওদিকে গেলাম কিন্তু আসতেছি এখনি।
-তারেক হা হয়ে গেল দাদার কাজ দেখে। কিন্তু কিছুই বলা হল না। পাপড়ি মনে মনে বলল-
দাদাভাইকে বকে এতক্ষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম আর এ তো… কেমন করে সব টাকা নিজে গাপ করে দিল! আপুকে জানাচ্ছি তার জানের মুরুব্বি দাদাভাই কী লাড্ডু খাওয়াচ্ছে সবাইকে। তার খুব মেজাজ খারাপ হতে লাগল।
পাপড়িকে দেখে পলিন বললেন- কিরে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী হয়েছে?
কী আর হবে? তারপর সে দাদাভাইয়ের সব কথা জানাল। পলিন তখন হাসি চেপে বলল-
-আমরা সরাসরি অনেক কিছুই দেখি যা আসলে তা না। এর পেছনেও কিছু থাকে কখনো কখনো। ঠিক আছে চিন্তা করিস না। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যেতে দে, সবাই চলে গেলে আমি দেখছি সব। ঠিক আছে? যা এখন, এসব নিয়ে দাদাভাইকে কিছু বলবি না।
পাপড়ি আর কিছু বলল না। সে তার বন্ধু আর কাজিনদের কাছে চলে গেল। ভেবেছিল নতুন জামাইয়ের পকেট থেকে মোটা টাকা খসিয়ে সবাই মিলে মজা করবে… কী ভেবেছিল আর কী হচ্ছে! কী ফুটো কপাল তার…
খাওয়ার পর জামাইকে হাত ধুইয়ে পুষ্পর বন্ধুরা মাত্র ১হাজার টাকা পেয়েছে! সেই নিয়ে তাদের মুখ চুন হয়ে আছে। দাদাভাই এবার কোন সাহায্যই করেননি তাদের। বুড়োটা কী চালাক!
পুষ্পর বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল। পুষ্পকে বিদায় দিতে গিয়ে পাপড়ি ভীষণ কান্না করল। আসলে ছোটবেলা থেকেই দুই বোন একসাথে বড় হয়েছে… পুষ্প তার বড় বোন কম বন্ধু ছিল বেশি। একসাথেকার প্রতিটা মুহূর্ত… পাপড়িকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। পুষ্প নিজেও অনেক কষ্ট পাচ্ছে। পাপড়ি তার একমাত্র বোন তাও আবার ছোট। তাকে সে কোলে পিঠে করে কত আগলে রেখেছে… জন্মান্তরের সম্পর্ক যে!
পুষ্প চলে যাবার পর এতক্ষণ আনন্দে ঝলমল করা বাড়িটা মুহূর্তেই নীরব হয়ে গেল। যেন পুষ্প সাথে করে সব আনন্দ নিয়ে গেছে। পলিন এতক্ষণে কেঁদে ফেললেন। পুষ্প, পাপড়ি দুইটা মেয়েই তার ভীষণ লক্ষ্মী। মেয়েরা চলে যাওয়া মানে ঘর শূন্য হয়ে যাওয়া, ঘরের সৌন্দর্য চলে যাওয়া। এবাড়ির সব কিছুতে পুষ্পর ছোঁয়া রয়ে গেছে… বাড়ি ভর্তি মানুষের ভীড়ে পুষ্পর শূন্যতা পলিনকে গ্রাস করে ফেলছে! তাকে আর পাপড়িকে সবাই মিলে শান্ত করার চেষ্টা করছিল।
রাত ১০টার দিকে পাপড়ির দাদাভাই এসে সবকটা মেয়েকে ডেকে বলল- এই তোরা সব এদিকে আয়, দেখে যা… পাপড়ির সব কাজিনরা এসে দেখে দাদাভাই এত্তগুলো আইসক্রিম নিয়ে এসেছে! ওদের দেখে বলল- এই পাপড়ি কোথায়? আইসক্রিম গলে যাবার আগে জলদি ডেকে নিয়ে আয় ওকে।
পাপড়িকে নিয়ে সবাই দাদাভাইয়ের কাছে হাজির হল। তিনি সবাইকে গোল হয়ে বসতে বলল। তারপর সবাইকে আইসক্রিম দিয়ে বলল- তোদের আজ বকাঝকা করেছি এবার আইসক্রিম খা তারপর তোদের টাকাগুলো ভাগ করে নে।
সবাই খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠে। দাদাভাইয়ের উপর যত অভিমান ছিল সব এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। তারপর দাদাভাইকে ঘিরে জমজমাট আড্ডা হল। তিনি তার নিজের বিয়ের গল্প করলেন, তার লালটুকটুক বউয়ের গল্প করলেন। সবাই তার গল্পে হেসে কুটিকুটি হল। একটু আগের মন খারাপ বাড়িটা এখন কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পেল। মুরুব্বিরা আসলেই চমৎকার কিছু। কী চমৎকারভাবে সব কিছু সামলে নেন!