#Mr_Calculus (পর্ব – ৮)
রিফাত প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল শ্বাস নেবার জন্য। তার দম ফুরিয়ে আসছিল প্রায়… সে জোরে চিৎকার করতে চাইল আবার কিন্তু পারল না… হাত পা ছুড়তে চাইল সেটাও পারছিল না। তখন আবার চেষ্টা করল চিৎকার করতে আর তখনই তার ঘুম ভেঙে গেল! চোখ মেলে দেখে এসির মধ্যেও তার গা প্রায় ঘাম দিয়ে উঠেছে! তারপর খেয়াল করল পুষ্পর ডান হাতটা তার নাক মুখের উপর এমনভাবে চেপে পড়ে আছে যে সে শ্বাস নিতে পারছিল না। তার কাছে দু:স্বপ্নের কারণটা স্পষ্ট হল তখন। সে আস্তে করে হাতটা নামিয়ে আনে। তারপর পুষ্পর দিকে ফিরে ওর দিকে তাকায়। মোমের আবছা আলো তখনো ঘরময় ছরিয়ে ছিল। দেখল, পুষ্প গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন… একগাছি চুল তার কপাল বেয়ে মুখের উপর পড়ে আছে, শাড়ির আঁচলটাও ঠিক নেই… এমন বেসামাল হয়ে ঘুমায় কেউ! রিফাত আস্তে করে চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিল। তারপর মোবাইলে দেখল ৪.২০ বাজে। ভোর হয়ে আসছে। সে ফোন রেখে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে রইল। কী আশ্চর্য, কিছুদিন আগেও মেয়েটা তার কেউ ছিল না আর এখন সে তার ব্যক্তিগত সম্পদ। তার বেডরুমে তার বিছানায় তার পাশে তারই গা ঘেঁষে জায়গা দখল করে ঘুমাচ্ছে! কী অধিকার না? পুষ্পর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিফাত নিজেও ঘুমে তলিয়ে যায়।
বেলা ৮টার দিকে পুষ্পর ঘুম ভাঙে। আজ তার ঘুম ভালো হয়নি। ছাড়া ছাড়া আজেবাজে স্বপ্ন দেখে রাত গেছে। সারা রাত স্বপ্নে এ্যাসাইনমেন্ট করেছে। অবশ্য করেছে বললে ভুল হবে, করার জন্য শুধু দৌড়াদৌড়ি করেছে। কখনো কাগজ খুঁজে পায়নি, কখনো কলম খুঁজে পায়নি, কখনো সময়ের সাথে পেরে ওঠেনি… উফফ কী একটা রাত গেল! সে উঠে বসে দেখে রিফাত তার দিকে ফিরে ঘুমাচ্ছে। তার ডান হাতটা রিফাতের হাতের মুঠোয়। পুষ্পর তখন মনে পড়ল এইজন্যই স্বপ্নে তার হাত বাঁধা বলে মনে হচ্ছিল। তখন কিছু একটা মনে পড়ে গিয়েছে মনে হতেই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সব ঠিক আছে কিনা? নাহ সব তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে! উফফ এই ঠিক রাখার চক্করে যেটুকু সময় ঘুমিয়েছে সেটুকুও ঘুম বলে কিছু হয়নি। যা হয়েছে তা সব দু:স্বপ্ন। এভাবে আর্মিদের মত এটেনশন মুডে ঘুমানো যায়? তারপর আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিল। পুষ্প ফ্রেস হয়ে এসে বসে রইল। রিফাত তখনও ঘুমাচ্ছে। সে কী করবে খুঁজে না পেয়ে উঠে বারান্দায় গেল, গিয়ে দেখল সেখানে কিছুই নেই। বারান্দা থেকে সামনে খোলা জায়গা দেখা যায়, যেখানে কিছু গাছও আছে। বারান্দায় একটা চেয়ার তো অন্তত রাখা যায়? মাঝে মাঝে এখানে বসে চা খেতেও ইচ্ছে করে তো না নাকি? “চা” এর কথা মনে হতেই তার চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেল। কী করবে এখন… সে আবার ঘরে চলে এলো। বিছানায় বসে ভাবছে, রিফাতকে কী ডাকবে? পারবে না। কিন্তু চায়ের কথা মনে হতেই তখন ইচ্ছা করে ঘরে শব্দ করতে লাগল। চুল আঁচড়ে চিরুনী ঠাস করে নামিয়ে রাখল, পানি খেয়ে গ্লাস জোরে টেবিলের উপর রাখল। রিফাতের কানের কাছে চুড়ি পরা হাতটা অযথাই ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বালিশ ঠিক করার চেষ্টা করল। তবে এবার কাজ হল। রিফাত তাকাল, তাকিয়ে বলল-
-সকাল হয়ে গেছে?
-আসছে সকালের খোঁজ নিতে, জিজ্ঞেস করুন দুপুর হতে আর কয় মিনিট বাকি?
-রিফাত ফোনে দেখল ৯টা ১৫ বাজে। আজ ৯টা বাজেই দুপুর হয়ে গেল! আমি কী আমেরিকায় চলে এসেছি?
পুষ্প রিফাতের পাশে দুহাত দূরে বিছানায় বসে বলল- চাকুরিজীবীদের জন্য সকাল ৯টা মানেই দুপুর।
রিফাত পুষ্পর কোলে মাথা রেখে বলল- আর ছাত্রীদের জন্য?
-ভোর।
-আচ্ছা… নিজের ভাগ ১৬আনা তাই না?
-উফফ উঠুন তো। চা খাব, ব্যবস্থা করুন। ঘুম থেকে উঠে চা না পেলে আমার মাথা ধরে যায়।
-এই কথাটাই একটু রোমান্টিকভাবে বলতে হবে।
পুষ্প সাথে সাথেই রিফাতের মুখের উপর ঝুকে পড়ল, তার খোলা চুলগুলো রিফাতের মুখের চারপাশ ঘিরে ফেলল… খুব সুন্দর একটা বুনো গন্ধ এসে রিফাতের নাকে ধাক্কা খেল। পুষ্প তার ডান হাতটা রিফাতের বুকের উপর রেখে ফিসফিস করে বলল-
“Mr. calculus, দু’কাপ ধোঁয়া ওঠা চা, দুটো উষ্ণ চুমুক… ঝড় উঠুক চায়ের কাপে… ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে যাক আজকের সকাল”
রিফাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে মোটেও আশা করেনি পুষ্প এমনটা বলবে! তার ইচ্ছে হল টুক করে পুষ্পর গালে একটা চুমু খেয়ে নিতে… সে পুষ্পর মুখের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিচ্ছিল পুষ্প রিফাতের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সোজা হয়ে গেল তারপর বলল-
-সূত্রমতে এখন আপনার চায়ের ব্যবস্থা করার কথা।
-রিফাত মনে মনে আহত হল। আহত অনুভূতিটা চেপে গিয়ে বলল- এটা খুব একটা রোমান্টিক হয়নি।
পুষ্প রিফাতকে কোল থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়ে বলল- রোমান্টিক হয়নি?
-না।
-আপনার ফোনের লকটা খুলে দিন।
-কেন?
-কাজ আছে। রোমান্টিকতা দেখাচ্ছি। নিন খুলুন?
রিফাত মোবাইলের লক খুলে পুষ্পর হাতে দিল। পুষ্প মোবাইলটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়ে বলল- নিন আপনার ফোন। যতক্ষন না আমার কথা ঠিকঠাক শুনছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই পাসওয়ার্ড বলব না।
রিফাত চূড়ান্তচাবে ধরা খেয়ে গেল। মেয়েটা যে এমন কিছু করে বসবে সেটা ভাবেইনি। বলল- ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে তুমি, I like it… আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি কিন্তু সেটা তোমার রোমান্টিকতায় নয়। সে চায়ের জন্য চলে গেল।
সকালের নাশতা করার পর রিফাতের মা আর বড় চাচী এলেন রিফাতের ঘরে। পুষ্পকে ঘিরে ছোটরা সবাই তখন গল্প করছিল। বড় চাচী এসে সবাইকে বলল-
-এই তোরা সব একদিকে সর। নতুন বউয়ের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। সবাই সরে গিয়ে বড়দের বসতে দিল। বড় চাচী তানিয়া আর পুষ্পকে কাছে এসে বসতে বলে একটা বক্স বের করে সেখান থেকে বেশ বড়সড় একটা দুই ভরি ওজনের লকেটসহ সোনার চেইন বের করল। তারপর পুষ্পকে সেটা পরিয়ে দিলেন। পুষ্পর চিবুক ছুঁয়ে হাতের আঙুলে একটা চুমু খেয়ে বললেন “মাশাল্লাহ”। শোনো বউ, আজকে কিছু কথা বলব তোমরা দুইজন মন দিয়া শুনবা। তারপর বলতে শুরু করেন-
-আমিও এবাড়ির বড় বউ ছিলাম। যখন বউ হয়ে আসলাম এরা বাকি ভাই বোনেরা সব ছোট। আমার নিজের বয়সও তখন মাত্র ১৯ ছিল। সেই বয়সেই সংসারে ঢুকে পড়লাম। আমার শ্বাশুড়ি আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিল। আস্তে আস্তে বাকি বউরা যখন আসল ততদিনে আমার শ্বাশুড়ি মা আর বেঁচে নেই। আমি সবাইকে আমার শ্বাশুড়ির মত আগলায় নিলাম। তার মত করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলাম। মাশাল্লাহ কারো সাথে কারো কোনদিন লাগালাগি হয়নি। সবাই একসাথে শান্তিতে থেকেছি। আমাদের যুগ তো চলেই গেছে। আমাদের যুগ অনেক অন্যরকম ছিল এখনকার ব্যাপার স্যাপার সব আলাদা। তবে যত যাই বদলাক না কেন সম্পর্ক কিন্তু বদলায় নাই! সম্পর্ক সব আগের মতই আছে। এবাড়িতে তানিয়া প্রথম আসছে সম্পর্কেও সে তোমার বড় তাই সব কিছুতে তার অধিকার আর সম্মানটা বেশি। সেটা কখনো ভুলে যাবা না। তাই বলে নিজেকে ছোট মনে করারও কিছু নাই। দুইজন সব সময় মিলেমিশে থাকবা। আর তানিয়া তোমাকেও বলে রাখি, তুমি এবাড়িতে আগে আসছ এবাড়ির সব কিছু এতদিনে তোমার আয়ত্তে এসে গেছে তাই পুষ্পকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়ার দায়িত্বও তোমার। এই দায়িত্বে কখনো কমতি রাখবা না। এখন দুইজন সংসার সামলাবা আর তোমাদের শ্বশুর শাশুড়ি ঘুরে বেড়াবে। তাড়াতাড়ি নাতি নাতনির ব্যবস্থা করে ফেল তানিয়া। বুড়া বুড়ির সময় কাটানোর জন্য কাউকে তো লাগে নাকি? তানিয়া এই কথায় লজ্জা পেয়ে গেল। তার ফর্সা মুখ ঈষৎ লাল হয়ে উঠল। বড় চাচী হেসে ফেললেন সেটা দেখে। বললেন-
-ওই দেখ, বউ এখনই লজ্জা পাইতেছে! বিয়ের তো হইল অনেকদিন আর দেরি না করে একটা বাবু নিয়ে ফেল। পুষ্পর তো পড়া শেষ হইলে তখন পুষ্পও বাবু নিয়ে ফেলবে। আমি আর বেশি কিছু বলব না। তোমরা দুইজনই শিক্ষিত ভালো ঘরের মেয়ে তোমাদের এত কথা বলারও নাই। তোমাদের শ্বাশুড়ি যতদিন আছে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা তারে দিও। তারে তো একবারে বেকার বসায় রাখা যাবে না তাই না? রিফাতের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল- এই মেয়েটা এত ভালো একটা মানুষ যে, সেই বউ হয়ে আসার পর থেকে আজও যেকোনো কিছু করার আগে আমার অনুমতি নিয়ে নেয়! অথচ আমি তারে কোনদিন এই ব্যাপারে বলিও নাই। বরং উল্টাটাই বলেছি। কিন্তু সে কখনো শোনে না। আমি বুঝি, সে আমাকে বড় বোনের মত, মায়ের মত দেখে তাই আমাকে ছাড়া সে কিছুই কল্পনা করতে পারে না। আমি একটু অসুস্থ হইলে এই মেয়ে আমার সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্য আমার কাছ ছাড়া হয় না! আমি এর জন্য সব সময় খাসদিলে দোয়া করি আল্লাহর কাছে। কথাগুলো বলবার সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন… তার চোখে পানি এসে গেল। রেহানা তখন বলল-
-আজ এসব থাকনা আপা। অন্য কোনদিন বলা যাবে। তাছাড়া পুষ্পকে পার্লারে যেতে হবে। নয়ত দেরি হয়ে যাবে।
-আজ আর অন্যদিনের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে রেহানা। কথাগুলা আজই জানা উচিত ওদের। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল- তোমাদের আর বিশেষ কিছু বলার নাই। যা বললাম মনে রাখবা। আচ্ছা যাও পার্লারে যাও। বড় চাচী যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই পুষ্প তার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল-
-দোয়া করবেন বড় চাচী, আমরা দুজন যেন আপনাদের মত হতে পারি।
-বড় চাচী খুব খুশি হলেন। তিনি পুষ্পর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- তোমাদের জন্য আল্লাহপাকের কাছে সব সময় দোয়া।
বড় চাচীকে পুষ্পর খুব পছন্দ হয়েছে। আসলে এবাড়ির মানুষগুলো সবাই খুব চমৎকার। এমন সময় রিয়ানা এসে বলল-
-ভাবি চলো, পার্লারে যাবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-হুম চলো।
ওরা পার্লারের জন্য বের হতে যাবে এমন সময় রিফাত এসে বলল- এই ফুল শুনে যাও তো?
পুষ্প রিফাতের কাছে এগিয়ে এসে বলল- কী?
-পাসওয়ার্ড?
-পুষ্প একটা বিভ্রান্তিমূলক হাসি দিয়ে বলল- “একটু রোমান্টিক ওয়েতে বলুন স্যার, শুনতে ভালো লাগবে।”
রিফাত ৩০ সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে থেকে বলল- “হামারি বিল্লি হামিসে ম্যাও!”
-“যোগ্য শিক্ষার্থী হতে পেরেছি তাহলে?” বলে মুচকি হেসে পুষ্প আর দাঁড়াল না রিয়ানার সাথে চলে গেল। সে চায় রিফাত আরও অনেকটা সময় ফোনের ঝামেলায় রাগে চিড়বিড় করুক।
ব্যাপারটা রোমান্টিক হলেও রিফাত রোমান্টিক ফিলটা নিতে পারছিল না। কারণ আজ বাড়িতে বৌ-ভাতের আয়োজন চলছে এর মধ্যে ফোন অতি জরুরি বিষয় অথচ সে সেটা কাজে লাগাতে পারছে না! বার বার তাকে পুষ্পর কাছে গিয়ে ফোনের লক খুলিয়ে নিতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তার ভাইয়াকে গিয়ে বলে- ভাইয়া আমার ফোনে একটু ঝামেলা হয়েছে তুমি তোমার একটা ফোন আমাকে দুইদিনের জন্য ধার দিতে পারবে?
-আচ্ছা নে। দুইদিন আমি নাহয় সামলে নেব। কিন্তু ফোনের আবার হুট করে কী হল?
-খুলতে পারছি না। ঠিক করাতে নিয়ে যাব দেখি। দুইদিন লাগবে না আমার তবু কখন সময় পাব তাই সময় বেশি চেয়ে নিলাম।
-“ঠিক আছে।” বলে রাইয়ান তার একটা ফোন সিম খুলে রেখে রিফাতকে দিয়ে দিল।
বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে রিফাত তার শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় রাইয়ান এলো। রিফাত বলল- ভাইয়া আমি এখনই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম…
-কিছু বলবি?
-তেমন কিছু না। আমার তো বিয়ে করার অভিজ্ঞতা নেই ওবাড়ি গিয়ে কী করব এই আর কী…
-ও… তুই তো নতুন জামাই আজ প্রথম যাচ্ছিস তাই ওবাড়ি গিয়ে খুব বেশি কিছু তোকে করতে হবে না। শুধু আজ রাতে ঘুমাবার আগে মশারি টানাবি আর সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়ে ফেলবি, চা বানিয়ে ওবাড়ির সবাইকে খাইয়ে বাজারে চলে যাবি। যাবার আগে অবশ্যই কার কী পছন্দ কাগজে ভালো করে লিখে নিয়ে যাবি। বাজার থেকে এসে রান্নাঘরে পুষ্পর আম্মুকে সাহায্য করবি। ভালো কথা, তুই বাজার করতে পারবি তো?
-তুমি এসব কী বলছ হরবর করে! ওবাড়ি গিয়ে এসব করতে কেন হবে আমাকে?
পুষ্প মুখ চেপে হাসতে লাগল।
রাইয়ান পুষ্পর হাসি দেখে আবার বলতে শুরু করল- “এসব করতে হবে কেন” মানে কী? এগুলো রিচ্যুয়াল। আমাকেও করতে হয়েছে, বাবাও করেছে এখন তোকে করতে হবে। জীবনে তো কোনদিন বাজারে যাসনি আমি শিওর বাজারে গিয়ে তুই ঝামেলা পাকাবি। মাছ তো কিনতেই পারবি না। কোনটা মোরগ আর কোনটা মুরগী সেটা তো তুই জানিসই না। আর হ্যাঁ বাজারে কিন্তু লুঙ্গি পরে যেতে হবে। একটা লুঙ্গি নিয়ে যাস সাথে করে। লুঙ্গি কন্ট্রোল করতে পারবি তো?
এই পর্যায়ে এসে পুষ্প আর হাসি চেপে রাখতে পারল না, সে শব্দ করে হেসে ফেলল। রিফাত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল সেও হাসতে শুরু করেছে। রিফাত বুঝে ফেলল ভাইয়া তার সাথে মজা নিচ্ছে। সে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল- very funny… না? তুই কী আমার ভাইয়া?
রাইয়ান আরও কিছুক্ষণ হাসল তারপর রিফাতকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল- তুই হচ্ছিস নতুন জামাই। তোর জন্য যা করার ওরাই করবে। তুই শুধু সবার সম্মান রক্ষা করে চলবি। আর কাল সকাল সকাল বাজারে চলে যাবি।
-ভাইয়া আমি তো কখনো বাজার করিনি!
-জানি। চিন্তা করিস না। বাজারে তো তুই একা যাবি না, সাথে নিশ্চই কেউ যাবে। সে তোকে হেল্প করতে পারবে। এই কাগজটা রাখ।
-কী এটা?
-বাজারের লিস্ট। কাল সব কিছু গুছিয়ে কিনে ফেলিস। বলে রাইয়ান রিফাতের চুল ঠিক করে দিয়ে বলল- সাথে পর্যাপ্ত ক্যাশ আর ক্রেডিট কার্ড দুটোই নিস। প্রচুর শালা-শালী থাকবে, মাঝে মাঝেই তাদের এটা ওটা আজাইরা সব আবদার মেটাতে হতে পারে।
-বিয়ে করা এত ঝামেলা জানলে পালিয়ে যেয়ে কাজী অফিসেই মামলা ডিসমিস করে ফেলতাম।
রাইয়ান হাসল। বলল- কোন কিছুই এত সহজ নয়। সেক্ষেত্রে বাবার দুই নলা বন্দুকের মুখে পড়তে হত তোকে। সেটার চেয়ে বরং এটাই বেটার অপশন। পুষ্প ওয়েট করছে, কথা না বলে তাড়াতাড়ি যা এখন। বলে রিফাতকে একবার জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপরে দিল রাইয়ান। রিফাত ভাইয়ার ঘর থেকে বের হয়ে এসে পুষ্পকে নিয়ে মা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল।
রিফাতের মোবাইলের পাসওয়ার্ড এখনো উদ্ধার করা যায়নি। সে অবশ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে বসেও চেয়েছে কিন্তু পুষ্প দেয়নি। বাসায় পৌছাবার পর একগাদা শালা-শালী এসে পাকড়াও করেছে। সবার সাথে খুব আড্ডা চলল অনেক রাত অব্দি। আড্ডা ভালো লাগলেও এই মুহূর্তে রিফাত সেটা এজনয় করতে পারছে না। সে চাইছে কখন পুষ্পকে একা পাওয়া যাবে? কেউ বোঝে না কেন বউ ছাড়া অন্য কারো আড্ডা তার পছন্দ হচ্ছে না এখন! সেই সময় পুষ্পর মা এসে তাকে উদ্ধার করল। তিনি সবাইকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। পুষ্পকে বললেন রিফাতকে নিয়ে ঘুমিয়ে যেতে। রিফাত সাথে সাথেই বলল- হ্যাঁ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে… বলে একটা হামিও তুলল। অমনি সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল। পুষ্প আর বসল না উঠে চলে গেল। রিফাতও তার পিছু নিল।
পুষ্প ঘুমাবার জন্য একটা ঢোলা পাজামা আর গোলাপি টিশার্ট পরেছে। রিফাত ওকে দেখে বলল-
-পাসওয়ার্ড দেবে?
-আমি তো মানা করিনি। সামান্য একটা শর্ত দিয়েছি মাত্র। সূত্রমতে শর্ত পূরণ করা ছাড়া পাসওয়ার্ড মিলবে না।
-ক্যালকুলাস বুঝবার জন্য তো তোমাকে আমার কাছেই আসতে হবে তাই না? যদিও আমি এসব মনে রাখতে চাই না কিন্তু আমার মনের কথা বলতে পারি না সে যদি হুট করে এসব মনে রেখে দেয়?
-পৃথিবীতে আপনি একাই ক্যালকুলাসে PHD করে বসে আছেন আর বাকি সব ঘাস খেয়ে বেড়ায় এই ধারণা বাদ দিন। অন্য অনেক স্যার আছে আমার বন্ধুরা আছে।
-তোমার বন্ধু! কে? ঐ যে টেন টু দি পাওয়ার ফোরকে চল্লিশ বলেছিল ওরাই তো তোমার বন্ধু, না?
পুষ্প রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠল। আপনার পাসওয়ার্ড আমি অর্থপেডিক ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিব। ওটার আশা এবার চিরতরে ছেড়ে দিন। বলে সে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। রিফাত সাথে সাথে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিকভাবে জড়িয়ে ধরায় পুষ্প রিফাতকে ঝাড়ি দেবার জন্য ঘুরতেই রিফাত টুক করে ওর গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। পুষ্প তখন হতবিহ্বল হয়ে গেল। রিফাত বলল-
-এত রাগ নিয়ে ঘুমাতে গেলে দু:স্বপ্ন দেখবে। সেই দু:স্বপ্নে আমিই তোমাকে ইচ্ছে মত জ্বালাতন করব।
-আমি আমার স্বপ্নে যাকে তাকে আসতে দেই না। ছাড়ুন আমাকে?
-আমিও যার তার স্বপ্নে যাই না। আমি যার, কেবল তার স্বপ্নেই যাই।
দুজনে আরও কিছুক্ষণ খুনসুটি চালিয়ে গেল তারপর ঘুমিয়ে গেল। পুষ্পর গতরাতে ভালো ঘুম হয়নি তার উপর দুদিন ধরে টানা রেস্টলেস যাচ্ছে তাই আজ নিজের বিছানায় শুতেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল রিফাতের। পুষ্প ঘুমের ঘোরে রীতিমত রেসলিং শুরু করে দিয়েছে একটু পরপর রিফাতের গায়ে হাত তুলে দিচ্ছে পা তুলে দিচ্ছে… শুধু তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না একবার লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দেবার জোগাড় করল! চুল এসে নাকে মুখে ক্রমাগত সুড়সুড়ি তো দিচ্ছেই। হাত পা নামিয়ে দিলে সাথে সাথে আবার তুলে দিচ্ছে। কখনো পাশবালিশের মত ধরে রাখছে। উফফ কী বিশ্রী অবস্থা! মেয়েটা কী এভাবেই ঘুমায়? গতরাতে তো এমন হয়নি? অবশ্য গতরাতে তেমন ঘুমার সুযোগই হয়েছে কোথায়? নাহ এর সাথে তো পারা যাচ্ছে না… রিফাত তখন নিজেও একটা ঠ্যাং ওর উপর তুলে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করল। পুষ্প যদি রেসলিং খেলে ও কেন জুডো, কারাত পারবে না?
পুষ্পর ঘুম ভাঙতেই তাকিয়ে দেখে ও রিফাতকে পাশবালিশ মনে করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। আর রিফাতও গুটিশুটি ঘুমাচ্ছে তার হাত পায়ের কঠিন বেষ্টনীতে! সে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। রিফাতের ঘুম ভেঙে গেল। সে তাকাতেই পুষ্প বলে উঠল-
-এভাবে আমাকে ধরে ঘুমাচ্ছিলেন কেন?
-আমি!
-নয়ত কে?
-রাতে তোমার ঘুম ভিডিও করে রেখেছি দেখাব?
পুষ্প অবাক হয়ে বলল- এসব কী বলছেন? এই ক্রাইমের ফল কিন্তু জঘন্য হবে।
-জঘন্য ফল কখনো টেস্ট করবার সুযোগ হয়নি। ভাবছি সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করব না। আচ্ছা উঠি… ফ্রেস হয়ে আসার আগে আমার চা চাই, বলে রিফাত উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। পুষ্পর ইচ্ছে হচ্ছে ডাক ছেড়ে কাঁদে, এই লোকটা এত পাজি কেন…?
রিফাত ফ্রেস হয়ে এসে দেখে বিছানার পাশে তার জন্য চা রাখা। সে চায়ের কাপ নিতে যেতেই দেখে একটা নীল কাগজ ভাজ করা… কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখল তাতে লিখা- “আজকের সকালটা খুব রোমান্টিক হতে পারে। হতেই পারে ভালোবাসাবাসির কয়েক টুকরো মুহূর্ত… বিনিময়ে পাওয়া যেতে পারে একটা পাসওয়ার্ড একটা ভিডিও ক্লিপের ডিলিট। হবে কী….?” রিফাত মুচকি হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলল- “আব আয়া উট পাহাড় কি নিচে।”