#Ragging_To_Loving__2
#পর্ব — ১
#লেখা — রিধিরা নূর
অসংখ্য মানুষের ভীড়। সকলের হৈ-হুল্লোড়, চেচামেচির মাঝেও যেন নিরবতা বিরাজ করছে। সকলের নজর ফাঁকা মঞ্চে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কারো প্রবেশের। উপস্থিত সকলের চেহারায় নিরাশের ঝলক৷ নিরাশ হওয়ারই কথা। যার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছে সে-ই যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে নিরাশ হবেই।
মঞ্চের পেছনে চলছে আরেক দফা হৈচৈ। পাঁচজন ছেলে অস্থির হয়ে পায়চারী করছে। একজন চেয়ারে বসে নখ কামড়াচ্ছে (ওয়াসিম। সামান্য বিষয় নিয়েও তার অস্থিরতা বেড়ে যায়।)
একজন চিল মুডে কোল্ড ড্রিংকস পান করছে এবং সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে (আহিল। ভূমিকম্প এসে সব ধ্বংস হয়ে যাক কিন্তু এতে তার কোন ভাবান্তর নেই। অলওয়েজ চিল মুডে থাকে। শখ মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা।)
একজন সব ব্যান্ডের সব আয়োজন দেখছে। (ইয়াশ। শান্তশিষ্ট হলেও একবার রাগলে জ্বালামুখী হয়ে যায়।)
দুইজন ফোন নিয়ে ব্যস্ত কাউকে অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। (আরিফ, রিহান। আরিফ গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। রিহান পাঁচমিশালী। পরিস্থিতি অনুযায়ী মনোভাব পোষণ করে।)
ফোন রিসিভ না করায় রিহান বিরক্ত হয়ে ফোন ছুড়ে মারতে নিলেই তাকে থামিয়ে দেয়।
আরিফ — রিহান কি করছিস। ফোন ছুড়ে মারলে কি সে চলে আসবে? হয়তো কোন ঝামেলায় পড়েছে।
রিহান — ওর কি জানা নেই এই শো তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবনে নাকি তিনটি জিনিস অতি প্রিয়। পরিবার, বন্ধুমহল, মিউজিক। আজকের শো-টা “রিধম মিউজিক কোম্পানি” আয়োজন করেছে। এই শো ওর মিউজিক ক্যারিয়ারে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু মহারাজের কোন খোঁজ খবর নেই। আসুক একবার ওর যদি….
তখনই আরিফের ফোন বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করতেই সকলে অধীর আগ্রহে সেদিকে মনোযোগ দিল।
আরিফ — হ্যালো? আফরান! কোথায় তুই? লাস্ট পারফরম্যান্স তোর। সবাই অপেক্ষা করছে। আচ্ছা ঠিক আছে শীঘ্রই আয়। (ফোন রেখে দিল) মাঝপথে নাকি কিছু ঝামেলা হয়েছিল তাই আসতে সময় লাগছে।
ইয়াশ — আরে ওই দেখ। ধীরে ধীরে মানুষের ভীড় কমছে। বিরক্ত হয়ে একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানও শেষ অপর্যায়ে। আফরানের আসতে দেরি হলে ওর পারফরম্যান্স ক্যান্সেল করে দিবে। (চিন্তিত সুরে)
ওয়াসিম — ওই দেখ শো হোস্ট নিশ্চয় আফরানের পারফরম্যান্স ক্যান্সেল করতে ঘোষিত করতে যাচ্ছে। এতে আফরানের ইমেজে কুপ্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়াও এতে আমাদের ভার্সিটির নামও জড়িত। ভার্সিটি রিপ্রেজেন্ট করতে আফরান নির্বাচন করেছিল। কিছু একটা কর। (অস্থির হয়ে বলল)
হঠাৎ শপাং করে এক জোড়া জুতা উড়ে এলো। আচমকা সবাই লাফিয়ে উঠল। আহিল এতক্ষণ কোল্ড ড্রিংকস পান করছিল একটা জুতা উড়ে গিয়ে পড়ল তার কোল্ড ড্রিংকসে। পানীয়জলের ছিটা পড়ল আহিলের মুখে। আফরান তুফানের গতিতে এসে ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় চারপাশে ঘুরে তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিল। জুতো হাতে নিয়েই মঞ্চের দিকে দৌড় দিল। বাকিরা শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেক বড় সুনামি এসে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে গেল। আফরান ফিরে এসে ইয়াশের হাত থেকে গিটার ছিনিয়ে নিয়ে পূণরায় দৌড় দিল। এই মাত্র কি ঘটলো সব মাথার উপর দিয়ে গেল।
দর্শকের মাঝে বিক্ষোভ তৈরি হতে লাগলো। শো হোস্ট কিছু এনাউন্স করার পূর্বেই আফরান মঞ্চে প্রবেশ করল৷ সকলে নিরুৎসাহী ভঙ্গি করতে লাগলো। কিন্তু আফরান বিনয়ী সুরে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল। এতে সকলে সুধীর হলো।
হোস্ট — এবার আপনাদের অপেক্ষার প্রহর কাটলো। প্রোগ্রামের লাস্ট পারফরম্যান্স। “•••” ভার্সিটিকে রিপ্রেজেন্ট করতে এবার মঞ্চে উপস্থিত হলো আফরান আহমেদ।
“আফরান” “আফরান” আফরানের নাম নিয়ে চিয়ার আপ করছে সকলে।
♪♪♪
” মন ভাবে তারে, এই মেঘলা দিনে
শীতল কুয়াশাতে, তার স্পর্শে” …… (২)
তার রুমঝুম নুপুরের সাজে,
বাতাসে জেন মৃদু সুবাসে
” নিটল পায়ে রিনিক-ঝিনিক,
পায়েলখানি বাজে…
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে
শ্যামা মেয়ে নাচে”……. (২)
চাঁদের অধরে যেন, তোমার হাসির মাঝে
সোনালী আবেশে তবে, সাগর ধারে
হৃদয়ের মাঝে কবে, বেধে ছিলে বাঁধন
ভালোবাসা তবে কেন মনের ওগোচরে
(তুমি কি আমার বন্ধু, আজও কেন বোঝনি
তুমি কি আমার বন্ধু, কেন ভালোবাসনি)
মন ভাবে তারে, এই মেঘলা দিনে
শীতল কুয়াশাতে, তার স্পর্শে
তার রুমঝুম নুপুরের সাজে,
বাতাসে জেন মৃদু সুবাসে
নিটল পায়ে রিনিক-ঝিনিক,
পায়েলখানি বাজে…
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে
শ্যামা মেয়ে নাচে…
নিটল পায়ে রিনিক-ঝিনিক,
পায়েলখানি বাজে…
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে
শ্যামা মেয়ে নাচে…
(২)
♪♪♪
গান শেষে সবার হাত তালি, হৈ-হুল্লোড় প্রতিধ্বনি হতে লাগলো চারপাশে।
আফরানের গান শেষে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম সমাপ্ত হলো। স্টেজ থেকে নেমে ব্যাকস্টেজে গেল। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিল।
আহিল — আফরাইন্না। (চিৎকারে আফরান ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। জুতো ছুড়ে মারলে তা পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে পড়ে।) নে তোর জুতো। শালা ফিক্কা মারার আশেপাশে দেখে মারবি না। তোর জুতোর কারণে আমার কোকাকোলা ভেস্তে গেল।
ইয়াশ — ওই কোকাকোলায় তোকে ডুবিয়ে মারব। এদিকে আফরানের অবস্থা দেখ কীভাবে হাঁপাচ্ছে। আর তুই আছিস কোকাকোলা নিয়ে। আফরান তুই বল কোথায় ছিলি এতক্ষণ? কোন ঝামেলায় পড়েছিলি?
আফরান — এখন ভীষণ ক্লান্ত। কিছু বলার মতো আগ্রহ নেই। বাসায় যাব আমি। কিন্তু উঠার মতো শক্তি নেই।
ওয়াসিম — আমরা আছি কি করতে।
ওয়াসিমের ইশারায় আরিফ বাদে বাকি চারজন আফরানের হাত পা ধরে উপরে উঠিয়ে নিল। আরিফ হাসতে হাসতে আফরানের সমস্ত সামগ্রী তুলে নিল। আফরান বিস্মিত হয়ে অপলক তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আফরানকে সেই অবস্থায় তুলে নিয়ে গেল গাড়ির দিকে। তাদের এমন কান্ড দেখে উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে মেতে উঠল।
আফরান — তোরা কি আমার সাহায্য করছিস নাকি আমাকে লাশ বানিয়ে ধামাচাপা দিতে নিয়ে যাচ্ছিস?
আফরানের এমন বিদঘুটে প্রশ্নে রিহানরা হোহো করে হেসে উঠল।
______________________________
দুই তলা বাস এসে বাসস্ট্যান্ডে থামলো। বাস পরিচালক নেমে সবাই নামতে বলল। বাস থেমে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে সুবাস নিতে লাগলো এক তরুণী। পরনে সাদা রঙের লং কুর্তি, চোখ চশমা। ঠোঁটের কোণে ফুটে থাকা মিষ্টি হাসি। পিছন থেকে মেয়েলী কণ্ঠে একজন চেচিয়ে বলল “তাড়াতাড়ি নেমে আয়” বলতে না বলতে মেয়েটি ধড়াম করে পড়ল দাঁড়িয়ে তরুণীর উপর। তার উপর পর পর আরও দুইজন মেয়ে পড়ল। একজনের উপর আরেকজন পড়ায় সেদিকে মানুষের স্তুপের ন্যায় একটি ছোট পাহাড় তৈরি হলো।
— ও মা গো। আহহ ফকিন্নিরা উঠ আমার উপর থেকে। আমাকে পিষে মারবি নাকি। আমরিন উঠ। দেখলে চিকনি চাকনি হলেও হাতির ন্যায় ওজন তোর। সররর। (চেচিয়ে)
আমরিন — নূর…। হাতি বললি কারে? আমি একা নাকি আমার উপর সিমা পড়ে আছে। সিমা না উঠলে আমি উঠব কি করে? হাতি আমি না এই সিমা। আমাকে একেবারে চেপ্টা করে দিল। উঠ।
সিমা — আমি কি করে উঠব আমার উপর পুষ্প লেপ্টে শুয়ে আছে। পুষ্প সর।
পুষ্প — না। উঠব না। অনেক দিন পর আরামদায়ক তোশক পেলাম। আহ্! শান্তিতে শুয়ে থাকতে দে। (হাত মেলে শুয়ে আছে।)
নূর — উঠবি? নাকি থাপরাইয়া মুতাই দিমু। (রেগে)
পুষ্প — ওরে আমার মুত্র মন্ত্রী রে। মুতানোর এতো শখ কেন?
বাস পরিচালক — এই যে আপনারা উঠবেন নাকি এভাবে শুয়ে থাকবেন? বাকি যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে।
পুষ্প জিবে কামড় দিয়ে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো। বাকিরাও উঠে দাঁড়ালো। নূর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
নূর — দেখে নামতে পারিস না। এই আন্ডা আন্ডা চোখ দুটো কি লুডু খেলার জন্য রেখেছিস নাকি দেখার জন্য রেখেছিস? (রেগে)
সিমা — মার্বেল খেলার জন্য রেখেছি। তোর মাথার ঘিলু গোবরে সার দেওয়ার জন্য রেখেছিস নাকি চিন্তা ভাবনা করার জন্য রেখেছিস? এভাবে মাঝপথে কেন দাঁড়িয়েছিলি? (রেগে পাল্টা জবাব দিল)
দোষটা নূরের ছিল তাই জবাবে কিছু বলতে পারল না।
নূর — দেখ এমনিতেই মাথা ব্যাথা করছে তাই কিছু বললাম না। কিন্তু তোদের জন্য আমার চশমাটা কোথায় যেন পড়ে গেল। এবার খুঁজে দে।
আমরিন চশমা খুঁজে দিল। কিন্তু পড়ে যাওয়ায় চশমার একটি কাঁচ ভেঙে গেল। আমরিন ভাঙা ফ্রেম দিয়ে অপর পাশে সবাইকে দেখছে। এতক্ষণ নূরের রাগ, দুঃখ উভয় গ্রাস করেছিল। আমরিনের এমন কান্ডে ফিক করে হেসে দিল। তার সাথে বাকিরাও হাসিতে যোগ দিল।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজ বাড়ি ফিরল।সাড়ে চার বছর ঢাকায় হোস্টেলে থাকার পর স্থায়ীভাবে নিজ বাসস্থানে, আপনজনের কাছে, নিজের পরিবারের কাছে ফিরে এসেছে। নিজের আপন শহর চট্টগ্রাম। প্রতি তিন মাস অন্তর এক সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি আসতো। এই সময় তারা একে অপরের সাথে দেখা করত না। শুধু ফোনে আলাপ হতো। এক সপ্তাহ ছুটির সময়টুকু শুধু পরিবারের সঙ্গে কাটাতো। কিন্তু এবার যেহেতু স্থায়ীভাবে এসেছে তাই যোগাযোগ রয়েছে। এবার তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো একই ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়া। তার জন্য সবাই অনেক পরিশ্রম করছে।
অবশেষে তারা রওনা দিল বাসার উদ্দেশ্যে।
.
.
.
আফরানের বাসায় পৌঁছে সবাই আড্ডায় মেতে উঠল। এরই মাঝে রিহানের ফোন বেজে উঠল। ফোন আফরানের পাশে থাকায় সেই হাতে নিল। ফোনের দিকে তাকিয়ে বেশ আচমকিত হলো। বিস্মিত সুরে রিহানকে বলল।
আফরান — ফোনের রিমাইন্ডার “আতংক” দিয়ে সেইভ করেছিস কেন?
রিহান দ্রুত আফরানের কাছ থেকে ফোন ছিনিয়ে নিল। ফোনের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে চোখ দুটো বেরিয়ে ফোনের স্ক্রিনের উপর নাচানাচি করছে। ফোনের রিমাইন্ডার দিয়েছিল আতংক। কিন্তু এই আতংকের চাপ তার চেহারায় ভেসে উঠেছে।
রিহান — ওহ নো!
ওয়াসিম — ও ভাই কি হয়েছে? (ভীতু স্বরে)
রিহান — মে তো লুট গেয়া, বারবাদ হো গেয়া।
ইয়াশ — কি হয়েছে বলবি?
রিহান — বাই গাইজ পরে কথা হবে। এখন জান বাঁচানো ফরজ।
বলে দৌড় দিল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার পানে। রিহানের বের হতেই বাকিরাও বেরিয়ে পড়ল।
রিহান দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে চৌকাঠে উষ্টা খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দৌড়ে রান্নাঘরে মায়ের কাছে গেল।
রিহান — মা আতংক এসে পড়েছে? (মায়ের শীতল দৃষ্টিতে ঢোক গিলল) না মানে…
শাহারা হায়দার (রিহানের মা) — হ্যাঁ এসেছে।
রিহান — (তার মানে তুফান আগেই সংগঠিত হয়ে গিয়েছে।) কোথায় সে?
শাহারা হায়দার — কোথায় আবার ওই তার প্রথম বাড়িতে। প্রতিবারই তো বাড়ি এলে সর্বপ্রথম সেখানেই যায়। তাই আগামী তিন ঘন্টা শান্তিতে থাক।
রিহান — ওহ মাই মাদার আপনি তো জানেন না এই শান্তি কোন সাধারণ শান্তি নয়। বরং তুফান আসার পূর্বকালের শান্তি। (বিড়বিড় করে)
.
.
.
চলবে