আমি শুধু তোমার পাঠ-৬

#আমি_শুধু_তোমার
#লেখনিতেঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি
#ষষ্ঠ_পর্ব

✘কপি করা সম্পূর্ণ নি/ষিদ্ধ✘
ঘড়িতে আনুমানিক রাত দেড়টা নাগাদ হবে। যদিও আমি সিওর না। কারণ, আমার কাছে ঘড়ি নেই। আর, আমার ফোন? সে বেচারা চার্জের অভাবে বহু আগেই ই/ন্তেকাল করেছে। তাই, এক্সাক্ট সময়টা আমার জানা নেই। আপাতত আমি দোলনায় বসে পা ঝুলাচ্ছি। আমার আ/সামি মহাশয়ের কোনো খবর নেই। দোলনাটা রেস্টুরেন্টের পাশেই। রুমগুলো থেকে একটু দূরে বলা যায়! এখানে আশেপাশে তেমন কেউ নেই। রেস্টুরেন্টের ভেতর ৩ জোড়া কাপল দেখা যাচ্ছে। আরেক জোড়া হচ্ছে কটেজের বারান্দায়। আমার কাছাকাছি বলতে গেলে কেউ নেই। এতক্ষণ সাহস পেলেও এখন সময়ের সাথে সাথে একটু ভয়ও বাড়লো। কারণ, কিছুক্ষণের মাথায় রেস্টুরেন্ট থেকে সেই কাপলগুলো বেরিয়ে এলো। এদিকে আমার ফোনটাও অফ। ফোন টিপে যে সময় কাটাবো, তারও সুযোগ নেই। অন্যদিকে, রুমে যে যাব? সেই সাহসও হচ্ছে না। সব নীরব! কোথা থেকে যেন জোনাকিদের ডাক ভেসে আসছে। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবেশ নীরব হচ্ছে। ওনাকে কল করাও সম্ভব নয়। আর, এই মানুষটাও না! এতটা বেখেয়ালি কেউ হয়? একটা মেয়েকে অচেনা জায়গায় একা রেখে কেউ এতক্ষণ থাকে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার ভেতর থেকে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো। আমি শ্বাস ফেলে পাশে থাকা নদীর দিকে চাইলাম। কতটা নিশ্চুপ! কতটা নীরব! রাত বাড়ার সাথে সাথে প্রকৃতিও গভীর নীরবতায় ডুবে যায়।

আমার ভাবনার মাঝেই কেউ আমায় ডাকলো। আমি ফিরে তাকাতেই তখনকার সেই ছেলেটি আমার হাতে একটা খাম ও একটি ডায়েরি ধরিয়ে দিলো। সেই সাথে তাজা দু’টো গোলাপও ছিল। সেগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নম্র স্বরে বলল,
“এগুলো স্যার আপনাকে দিতে বলেছেন, ম্যাম। স্যার আপনার জন্য রিসোর্টের পেছন দিকটাতে অপেক্ষা করছেন। আপনাকে যেতে বলেছেন।”

ছেলেটির নম্রতা আমার বেশ ভালো লাগলো। তার কথার উত্তরে আমি মুচকি হেসে বললাম,
“আপনি যান। আমি আসছি।”

ছেলেটি সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। আমি এবার নিজের হাতে চোখ রাখলাম। কিছু সময়ের মাথাতেই আমি ডায়েরিটা চিনতে পারলাম। এতো আমার ডায়েরি। আমার সবচেয়ে প্রিয় ডায়েরি! এটা উনি কোথায় পেলেন? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ গেল খামের গায়ে গুটি গুটি অক্ষরের লিখাটায়। সেখানে লিখা, ‘জীবনের প্রথম কাউকে চিঠি লিখেছি। সেটাও খুব যত্নে করে। খুলে দেখো, অনেক প্রশ্নের জবাব পাবে।’

লিখাটা দেখে আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। কোন প্রশ্নের জবাবের কথা বলছেন উনি, জানতে ইচ্ছে হলো। তাছাড়া, ডায়েরিটা ওনার কাছে এলো কী করে? আমি তৎক্ষনাৎ খামটা খুললাম। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা নীল রঙের কাগজ। অর্থাৎ, চিঠিটা! আমার ঠোঁটের কোণে অকারণেই হাসি ফুটলো। চিঠিটা খুলতেই আমার চোখ পড়লো সেখানে থাকা সম্বোধনে। আমি যেন থমকে গেলাম। এত চমৎকার সম্বোধন হয় বুঝি? হয়তো হয়! নিজেই নিজেকে জবাব দিলাম। তারপর, একটুও দেরি না করে চিঠিটা পড়তে লাগলাম। সেখানে লিখা,
“শোনো, ইচ্ছেবতী?
আমি জানি, তোমার ভীষণ ইচ্ছে! কোনো এক পূর্ণিমার রাতে তার হাতে হাত রেখে ছোট একটা ডিঙি নৌকোয় ওঠার। তোমার ইচ্ছে, জ্যোৎস্না স্নানে গা ভিজিয়ে নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানোর। ইচ্ছে, নদীর শীতল জলে পা ভেজানোর। আমি জানি! তুমি সেদিন লাল শাড়ি পরনে, রেশমি চুরির রিনঝিন শব্দ করে তার শরীরে নদীর শীতল জল ছেঁটাতে চাও। কাজল কালো মায়াবী চোখে তাকে দেখে অবাক হতে চাও। লিপস্টিকে রাঙানো লাল ঠোঁট প্রসারিত করে খিলখিলিয়ে হাসতে চাও। যেই হাসির তালে, তোমার খোলা চুল গুলো বাতাসে দুলে উঠবে। ইচ্ছেবতী? তোমার ভীষণ প্রিয় ইচ্ছে, সে তোমার হাতে ধরিয়ে দেবে সাদা পদ্ম। একমুঠো কাঠগোলাপেও তোমার নেই আপত্তি। বরং, তুমি তার চেয়েও খুশি। তোমার আরও একটা ইচ্ছে ছিল, ইচ্ছেবতী। তুমি চেয়েছিলে, তোমার নৌকার মাঝিটি সেদিন কালো রঙা পাঞ্জাবি পরবে। তার ঠোঁটের বেলকনিতে ঝুলিয়ে রাখবে একবিন্দু হাসি। যেই হাসিতে তুমি শত শতবার ঘায়েল হতেও রাজি। সেই মাঝিটি হবে, সে! যাকে তুমি খুব ভালোবাসবে। যে শুধুই তোমার হবে। সে তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবে আর হাসবে। তার হাসিতে থাকবে এক হ্রাস মুগ্ধতা। তার মুগ্ধ চাহনিতে তুমি হবে লজ্জা রাঙা। শোনো, ইচ্ছেবতী! আমি তোমার নৌকার মাঝিটি বলছি। তোমার হাতের পদ্মগুলো দেওয়ার দায়িত্বটা নিয়েছি। শোনো, স্বপ্নবিলাসী? আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। তবে, আমি তোমার স্বপ্ন পুরুষ হতে পারিনি। আমি তোমার সে হতে পারিনি। তুমি আমার নও। তাই, আমি শুধুই তোমার হয়েও চিরকালের জন্য তোমার হতে পারিনি।

ইতি,
তোমার নৌকার মাঝি”

চিঠিটা পড়ে আমি বুঝতে পারলাম, উনি এতকিছু কী করে জানলেন! আমাকে এই ডায়েরিটা দেওয়ার কারণটাও স্পষ্ট হলো। এই ডায়েরিতেই আমি নদী ভ্রমণ নিয়ে নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। এক জ্যোৎস্না রাতে ডায়েরির পাতায় পাতায় রটিয়ে দিয়েছিলাম আমার ইচ্ছের গল্প। লিখেছিলাম স্বপ্নের কথা! সেই স্বপ্নটাই উনি পূরণ করেছেন। সেই গল্পটা উনি সত্যি করেছেন! কিন্তু, চিঠির শুরুটা আমার কাছে যতটাই আনন্দময় ছিল, সম্বোধনটা আমাকে যতটা খুশি করেছে, চিঠির শেষটা আমার সেই সবটুকুই আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। কেন জানিনা শেষের তিনটা লাইন আমার মুখের হাসিটুকু কেড়ে নিয়েছে। এত সুন্দর সম্বোধন, এত চমৎকার চিঠিটা পেয়েও কেন যেন আমি খুশি হতে পারছি না। কোথাও একটা কমতি থেকে যাচ্ছে। কোথাও একটা দুঃ/খ দুঃ/খ লাগছে!

নিজের মনে কথাগুল ভাবতে ভাবতে আমি রিসোর্টের পেছন সাইডে গেলাম। সাথে সাথে আমার চোখ চড়কগাছ! জায়গাটা কি সুন্দর করে লাল বেলুন এবং ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো। একটা ছোট্ট টেবিল। সেখানে একটা কেক! তার চারপাশে গোলাপের পাপড়ি। চার কোণে ক্যান্ডেল। সব মিলিয়ে দারুণ! আমি যখন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম, তখন কেউ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“হ্যাপি বার্থ ডেইট, স্বপ্নবিলাসী! তোমার জীবনের ছোট বড় সব স্বপ্নগুলো পূর্ণ হোক। সবসময় তোমার চোখে মুগ্ধতা আর ঠোঁটের হাসি বহমান থাকুক! তুমি অনেক ভালো থাকো। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি তুমি হও, চঞ্চল হরিণী। আমি সবসময় দোয়া করি!”

একের পর এক কথা বলে থামলেন উনি। তখনই উপর থেকে আমাদের উপর গোলাপ বর্ষণ হলো। বাজি ফাটলো। আমি চমকে উঠলাম। উনি মুচকি হাসলেন। তখনই সেই ছেলেটা হাতে কিছু একটা নিয়ে এদিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি আসতে তার হাতের জিনিসটা চিনতে পারলাম আমি। ওটা ফানুশ! আমি চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে চাইলাম। উনি এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কাছ থেকে ফানুশটা নিয়ে প্যাকেট খুলে বের করলো। তারপর, তাতে হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে আমাকে ইশারা করলো। আমি তখনও এক অন্যরকম দৃষ্টিতে তার পানেই তাকিয়ে। কি অদ্ভুত এই মানুষটা! তারই স্ত্রী তাকে না অন্যকাউকে ভালোবাসে। এটা জানার পরও তাকে খুশি রাখার জন্য কত আয়োজন এই মানুষটার! মানুষ বুঝি এমনও হয়? এতটা ভালো? আমার কোনো হেলদোল না দেখে উনি বললেন,
“ধরো।”

আমার ধ্যান ভাঙলো। আমি এগিয়ে গিয়ে ফানুশটা ধরলাম। উনি ফানুশে আ/গুন দিলেন৷ তারপর, আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার দিকে ফিরে। আমার চোখে তাকিয়ে মোহনীয় কন্ঠে বললেন,
“তোমার বিষন্নতা সকল যাক উড়ে,
ফানুশ হয়ে দূরের ঐ আকাশে
ছোট ছোট খুশিগুলো সব,
ফিরে আসুক হাসি হয়ে ঠোঁটের কোণে!”

একে একে চারটি লাইন ব্যক্ত করে ফানুশটা ছেড়ে দিলেন উনি। ছাড়লাম আমিও। ফানুশটা উড়ে গেল। প্রথমে একটু দূর। তারপর, আরেকটু। এরপর, আরেকটু। সবশেষে, অনেকটা দূরে চলে গেল। ফানুশটা চোখের আড়াল হতেই আমি ওনার দিকে ফিরে চাইলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিলেন। আমি কিছু বললাম না। উনি এগিয়ে গেলের টেবিলের দিকে। ওনার চোখেমুখে বেশ আনন্দের ছাঁপ। আমাকে বারংবার চমকাতে পেরে সে আনন্দিত তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে, আমি চেয়েও আনন্দিত হতে পারছি না। কোথাও একটা মন খা/রাপের আভাস যেন লেগেই আছে। যেটা আমি ধরতে পারছি না। কারণটা বুঝতে পারছি না। ওনার ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। মুচকি হেসে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।

~~~~~~~~~~

বিছানায় ডাক বক্সটা হাতে বসে আছি আমি। কিছুক্ষণ আগে কেক কা/টার পর উনি এটা আমায় দিয়েছেন। সাথে বলেছেন,
“যখনই মন খারাপ থাকবে, নিজেকে একা লাগবে? একটা চিঠি লিখে ফেলবে। তারপর, সেটা এখানে রেখে দিবে। আমাদের বিয়ের তারিখে সবগুলো চিঠি আমাকে পাঠাবে। আমি পড়ব। এতটুকু আবদার তোমার কাছে করতে তো পারি। পারি না?”

আমি জবাব দিতে পারিনি। আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট্ট কাঠের ডাক বক্সটার ওপর চোখ রাখলাম। বক্সটার গায়ে খোদাই অক্ষরে লিখা, ‘বিচারকের চিঠি আ/সামির জন্য’। আমি আলতো হাত বোলালাম লিখাটার উপর। আচমকাই আমি অনুভব করলাম, আমার কান্না পাচ্ছে। অকারণে? নাকি, কোনো গোপণ কারণে? ভাবতে ভাবতেই আমার গাল বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তখনই ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন উনি। আমি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম। আমাকে নীরব দেখে উনি এগিয়ে এলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মন খা/রাপ কেন?”

আমি আঁতকে উঠলাম! কি আশ্চর্য! যেটা আমি বুঝলাম না, সেটা এই অদ্ভুত লোকটা কী করে বুঝে ফেলল? আমার ভাবনার মাঝেই উনি আমার পাশে বসলেন। বললেন,
“অভ্রর সাথে তখন রাগারাগি করেছো, সেজন্যে? কথা বলবে এখন?”

ওনার কথাটা শুনে আমি যতটা অবাক হলাম তার থেকে বেশি আমার মেজাজটা চটে গেল। কিছুক্ষণ আগের কান্নাটা এখন না থাকলেও ভীষণ রাগ হলো। আমি কঠিন চোখে ওনার দিকে তাকালাম। বললাম,
“সেটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আপনাকে না ভাবলেও চলবে। দয়া করে আজকের পর থেকে আমার পার্সোনাল কোনো ব্যাপারে আপনি মাথা না ঘামালে খুশি হবো।”

কথাটা শেষ করে সেখান থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলাম। আসার সময় একবারও পেছন ঘুরে তাকালাম না। আমি জানি, আচমকা আমার এমন ব্যবহারে সে আশ্চর্য হয়েছে। আচ্ছা, আমি কি বেশি রিয়েক্ট করেছি? উনি খুব ক/ষ্ট পেয়েছেন? পেলে পাক! ওনার ক/ষ্ট পাওয়া উচিৎ। এত বোঝে কেন?

~~~~~~~~~~

দরজা খোলার শব্দে আমার ধ্যান ভাঙলো। বেরিয়ে এলাম অতীতের অদ্ভুত দিনের স্মৃতিচারণ থেকে। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। সেই রাতে সত্যিই আমি ওনাে সাথে খুব খা/রাপ ব্যবহার করেছিলাম। ওনাকে ক/ষ্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু, তারপরও সে একটা অভিযোগ করেনি। বরং, নিজে আমাকে সরি বলেছে। ক্ষ/মা চেয়েছে। ভুল না থাকার পরও নিজের ভুল স্বীকার করেছে। একটা মানুষ কতটা ভালো হলে এরকমটা করতে পারে আমার তা জানা নেই! তবে, আমার তার জন্য খুব খা/রাপ লাগে। এত ভালো একটা মানুষের জীবন আমার জন্য ন/ষ্ট হচ্ছে। ভাবতেই নিজেকে অপ/রাধী লাগে।

তার কন্ঠস্বরে ভাবনার ছেঁদ হলো আমার। আমি পেছন ফিরে চাইলাম। উনি বললেন,
“বিকেলে রেডি থেকো। উকিলের চেম্বারে যাব। কাগজ রেডি।”

ওনার কথার উত্তরে বলার মতো কোনো কথা আমি খুঁজে পেলাম না। মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

#চলবে..?

(রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here