চিঠি দিও ২৯

চিঠি দিও
২৯
_____________

হাসপাতাল জায়গাটা অতনুর বিশেষ পছন্দ নয়। অপছন্দের যদিও তেমন কারণ নেই। তবে জটিল সমস্যা না হলে এদিকটা মাড়ানোর চেষ্টা করে না সে। অবশ্য প্রয়োজনও পড়ে না, কারণ হাসপাতাল কোনো ঘোরার জায়গা নয়। এখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে থাকে দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার নামক বিষাক্ত নিঃশ্বাসে। এতখানি সইবার সহনশক্তি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের নেই।
তবে পৃথিবীতে কিছু ব্যাতিক্রম ঘটনাও ঘটে। আমাদেরই আশেপাশে ব্যতিক্রমধর্মী মানুষের বসবাস। দুঃখ-কষ্টকে যারা খুব কাছে থেকে দেখতে চায়। জানতে চায় সে যতটা খারাপ অবস্থানে আছে, তারচেয়ে অধিক শোচনীয় অবস্থায় অন্যকেউ পড়েছে কি না! এই জানার আগ্রহটা মেটানোর জন্য হাসপাতাল একটা অপশন। এখানে এলেই একমাত্র জানা যায় স্রষ্টার সৃষ্ট জগৎটা হরেক রকমের সমস্যায় মোড়ানো। কারোর কাছে হয়তো নির্গমনপথ আছে, কারোর কাছে নেই৷

দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার বিষয়গুলো বেশ বিরক্তিকর লাগে অতনুর কাছে। ওর জীবনে দুঃখ-কষ্টের গল্প তেমন নেই। অতনুর ধারণা জীবনের চড়াই-উতরাই গুলোকে নীর্ভিকচিত্তে পাশ কাটাতে জানে ও, এজন্যই জটিলতায় পর্যবসিত হতে হয় না।

করিডরের শেষ মাথায় পেতে রাখা বেঞ্চে বসে আছে অতনু। যদিও এই মুহুর্তে তার আসমার কাছে বসে থাকা উচিৎ ছিল, তবে বড়বাবার ধমক খেয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ডাক্তার বললেন আসমা নাকি দীর্ঘদিন যাবৎ পিটিএসডিতে ভুগছে;পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার। সাধারণত কোন দুর্ঘটনা, সহিংসতা, মর্মান্তিকভাবে প্রিয় কারো মৃত্যু এরকম কোন ধরনের ভীতিকর ও কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলে এই জটিল রোগটা দেখা দিতে পারে৷ আজকের আসমার অস্বাভাবিক আচরণের কারণও এটাই।
কথাটা শোনার পর থেকেই বড়বাবা ভা”য়ো”লে”ন্ট হয়ে আছেন অতনুর ওপর। তাঁর ধারণা আসমার সকল দুশ্চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু অতনুই। সে যে অপকর্মগুলো করে বেড়ায় কোনোভাবে আসমা তার খবর পেয়েছে এছাড়াও বহুদিন হয়ে গেল মেয়েটার বাবা-মায়ের সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ নেই। সবকিছু মিলিয়ে একটা দ্বিমাত্রিক চাপের কারণে জন্ম নিয়েছে রোগটা।
দায়িত্ব নিতে না পারলে বিয়ে কেন করেছেসহ একগাদা তিক্ত কথা শোনাতে শুরু করলেন বড়বাবা। একে তো আসমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা তার ওপর ওনার কথাবার্তা, ক্রমেই মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল অতনুর।
সে নিজেও তো স্বস্তিতে নেই। আসমা তার স্ত্রী। স্ত্রী কোনো রোগে আক্রান্ত এই খবরটা তো তার জন্যেও বেদনাদায়ক। এক ছাদের নীচে এক ঘরে বসবাস করেও মেয়েটার শরীরের-মনের খোঁজ সে রাখতে পারল না। বিষয়টা অত্যন্ত লজ্জার। দুচিন্তা তো তার একফোঁটা কম নয়। তবে এই মুহুর্তে এতগুলো কথার মানে কি!
আসমার সাথে খোলামেলা যে কথা বলবে তারও সুযোগ নেই। সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ওকে। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই পথে জ্ঞান ফিরেছিল ওর। জ্ঞান ফেরার পর কি অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক সব আচরণ করছিল! “যন্ত্রণা হচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে” শব্দটা আওড়াতে আওড়াতে অতনুকে একপ্রকার খামচে ধরে ঠকঠক কাঁপছিল৷ সাথে আরও কিছু বলছিল বোধহয়, অতনুর বোধগম্য হয়নি। তবে আসমার এসব অদ্ভুত আচরণে ও চমকিত। সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েটার বলা নেই কওয়া নেই এ কেমন আজগুবি রোগে পেয়ে বসল! নাহ্ বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
বসে থেকে সময় নষ্ট করার চাইতে যত দ্রুত সম্ভব ঘটনার তল খুঁজে বের করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করল অতনু।
কেবিনে গিয়ে দেখল আসমা তখনও ঘুমে। পাশে রঞ্জু সাহেব স্টিলের টুলে বসা। একমনে তসবিহ পড়ছেন আর দোয়াদরুদ পড়ে ফু দিচ্ছেন আসমার মাথায়। ছোট্ট শ্বাস ফেলে ইতস্ততভাবে অতনু বলল,
“ইয়ে, বড়বাবা আমি একটু বেরচ্ছি। জরুরী কাজ পড়ে গেছে”
বিনিময়ে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মানে মানে কেটে পড়ল অতনু।
বাইরে বেরতেই মনে পড়ল দীর্ঘক্ষণ যাবৎ সিগারেটের পিপাসা অনুভব করছে। হাসপাতাল বলে সিগারেট বের করার সাহস করেনি তবে এখন বাইরে। পিপাসাটা মিটিয়ে ফেলা যায়। দুঃখজনকভাবে প্যান্টের দু পকেট, পাঞ্জাবির পকেট সবখানে চেক করেও সিগারেটের দেখা মিলল না। নিশ্চয়ই ছেড়ে এসেছে। যা তাড়াহুড়োয় ছিল! অগত্যা জিপ বের করে রাস্তার ওপাশে একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
দোকানদার অতনুকে চেনে। জিপ দেখেই দৌড়ে নেমে এলো সে দোকান থেকে। খুচরো পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় অতনু বোঝালো সিগারেট চায় সে। কোনোরকমে টাকাটা হাতে নিয়ে পুনরায় ছুটে সিগারেট এনে দিলো দোকানদার দেশলাইসমেত; এমনকি কাঠি ঠুকে
সিগারেটটাও জ্বা”লিয়ে দিলো। অতনু খুশীই হলো খানিক। প্রসন্নতায় উপরি বখশিশ জুটে গেল দোকানদারের ভাগ্যে। সালাম জানিয়ে সে সহাস্যে টাকা হাতে দোকানের ভেতর চলে গেল। সিটে হেলান দিয়ে ধীরেসুস্থে সিগারেটে টান দিলো অতনু। নাকেমুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবল সর্বপ্রথম যেতে হবে শ্বশুরালয়ে, মানে আসমার বাবার বাড়ি। যদিও শিওর নয় এই সময়টায় শ্বশুরমশাই উপস্থিত থাকবেন কি না! তবে শাশুড়ী আর শালিকারা তো আছে। তারা থাকলেই হয়ে যাবে। এছাড়া শ্বশুরমশাই না থাকায় সুবিধে বেশি। ভদ্রলোক ভীষণ কাঠখোট্টা। পেশায় উকিল বলে কণ্ঠস্বরটাও রাশভারী। সবসময় মুখ গোমড়া করে থাকেন। ওনার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা অসম্ভবপ্রায়। এমনভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলেন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ চাইলেও ভালোভাবে কথা বলতে পারবে না ওনার সাথে। এমন কাঠখোট্টা ভদ্রলোকের ঘরে কুসুমের মতো কোমল মেয়েটা জন্মালো কি করে! ভেবে পায় না অতনু।
সময় নিয়ে পুরো সিগারেট শেষ করে ফিল্টার ফেলে আরেকটা সিগারেট বের করল প্যাকেট থেকে। দু ঠোঁটের মাঝে গুঁজে দেশলাই জ্বালাবে তখুনি হুট করে চোখ চলে গেল অপজিটে হাসপাতালের সামনে। পা চালিত একটা রিকশা থেকে পরিচিত কেউ একজন নামল বলে মনে হলো অতনুর। সিগারেট নামিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে ভালোমতো তাকানোর চেষ্টা করল সে। ওড়নার আড়ালে মেয়েটার মুখমণ্ডলের এক সাইড দেখা যাচ্ছে, তবে দেহাবয়বের কারণে মনে হচ্ছে অন্যকেউ নয় ও উর্বশী। কিন্তু উর্বশী এখানে কেন? প্রশ্নবোধক চাহনিযোগে আর কিছুটাক্ষণ নিরীক্ষণ করতে চাইলেও ওদিক থেকে সুযোগ দেয়া হলো না। কোনোরকমে ভাড়া মিটিয়ে হড়বড় করে হাঁটা ধরল ওপাশের মানবী। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলেও কি ভেবে গেল না অতনু৷ এই প্রশ্নের উত্তর তো সে পরে খোঁজার চেষ্টা করবে, আগে যে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে তা সফল হোক।

অতনু যতটুকু শুনেছে আসমার মা মানে তার খালা এবং একইসাথে শাশুড়ীর বিয়ে হয়েছিল বরিশালে। কীভাবে এবং কেন দক্ষিণবঙ্গ থেকে উড়ে এসে উত্তরবঙ্গের মেয়েকে বিয়ে করেছিল তার খালু এ গল্প স্পষ্ট নয় অতনুর কাছে। তবে মা বলেছিল অতনুর নানা স্বেচ্ছাচারী একজন মানুষ ছিলেন। মেয়ে সন্তান অপছন্দ করা তাঁর ঘরে তিন তিনটে মেয়ে হলো। কোনোরকমে কৈশোরে পা রাখলেই কন্যা সম্প্রদানের নিমিত্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। বোনেদের মধ্যে অতনুর মা একটু জেদি একরোখা বলে বাপের মতামত তার ওপর খাটেনি। তাই ভাগ্যে জুটেছিল ত্যাজ্য কন্যার তকমা। ভাগ্যিস সেই সময়টাতে অতনুর বাবা এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। শক্ত করে হাতটা ধরেছিল। নইলে ভেসে যেতে হতো শিল্পীকে।
মেয়েদের প্রতি উদাসীনতার কারণেই বোধহয় কে কতটা দূরে চলে গেল এসব দিকে কখনও খেয়াল করার প্রয়োজন মনে করেননি অতনুর নানা। ঘটক যখন যে প্রান্ত থেকে পাত্রের সন্ধান এনে দিয়েছে, ভালো ঘরবাড়ি দেখে কন্যাসম্প্রদান করে দিয়েছেন। ফলে এক খালার শ্বশুরবাড়ি হয়েছে বরিশালে, অন্যজনের ময়মনসিংহ। মা বেরিয়ে এসেছিল বলে এই শহরেই থেকে গেছে।
আজব একটা পরিবার তার মায়ের পক্ষের। ড্রাইভিংয়ের মধ্যেই হেসে উঠল অতনু।
ভাবনার মধ্যে কখন পথ ফুরিয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। বাড়ির সামনে জিপটা দাঁড় করিয়ে লুকিং গ্লাসে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চুলে আঙুল চালিয়ে খানিক পরিপাটি করে নেমে দাঁড়াল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শ্বশুরবাড়িতে পা রাখা। যে উদ্দেশ্যে এসেছে সে উদ্দেশ্যখানা কতটুকু সফল হয় এটাই এখন দেখার বিষয়।
______________

“একটি বিকেল আমার নামে করে দিতে চেয়েছিলে না, আজ ফ্রী?”
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সুপরিচিত গলার স্বরটা ভেসে এলে আবেশে চোখ বুঁজে নিলো উপমা। মিষ্টি করে হেসে মাথা এলিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
— হু।
— এখন তো আড়াইটে। পৌনে চারটা-চারটার দিকে পার্কের মোড়ে অপেক্ষা করব। একা আসতে পারবে?
— তো পারব না! অবশ্যই পারব। বড় হয়েছি তো আমি।
ভ্রু কুঁচকে বলল উপমা। ক্ষীণ শব্দে হেসে উঠল রওনক। কৌতুক সুরে বলল,
— তাই? জলদি এসো তবে। কতখানি বড় হলো আমার প্রিয়তমা সচক্ষে দেখতে চাই।
দয়িতের কথার ভাঁজে লুকোনো দুষ্টুমিটা ধরতে পারল উপমা। মুখ নামিয়ে সলজ্জে হাসলো। তারপর কি মনে পড়ায় সতর্কতার দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলল,
— পার্কের মোড়ে নয় আপনি প্রেসক্লাবে আসুন। পত্রিকা অফিসের দিকটায় আমি দাঁড়িয়ে থাকব। হোন্ডায় ওঠাবেন বলেছিলেন না?
— ওহ তোমার মনেও আছে!
— তো থাকবে না?
— আচ্ছা আসব। বাড়িতে কি বলে বেরুচ্ছ।
— বাড়িতে নেই তো আমি। এখনও মিতালীদের এখানে। একেবারে বেরিয়ে যাব। আপনার সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরব।
— সমস্যা হবে না তো?
ভাবুক হয়ে শুধল রওনক। উত্তরে দু’দিকে মাথা নাড়ল উপমা। বলল,
— উঁহু। ডালিয়া বাড়ি যাচ্ছে। ওর সাথেই বেরিয়ে যাব। আত্মীয়স্বজন নিয়ে ব্যস্ত খালাম্মা। কতদিকে নজর রাখবেন?
— ঠিকাছে সাবধানে এসো। সমস্যা হলে জানিও।
— জানাব।
— রাখি তবে?
— হু।
মুচকি হেসে রিসিভার নামিয়ে রাখল উপমা। তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে গম্ভীর এক নারী কণ্ঠ বলে উঠল,
— কার সাথে কথা বলছিলে।
ভয়ে জমে আত্মাশূন্য হয়ে গেল উপমা। ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে জবাবদিহিতার নিমিত্তে পিছু ঘুরতেই ভয় সরে ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন পড়ল। কারণ পেছনে আর অন্য কেউ নয় ডালিয়া দাঁড়ানো। নিশ্চয়ই এটা তার মজা। বান্ধবীকে বোকা বানাতে পেরেছে নিশ্চিত হয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে সে নিঃশব্দে হাসছে। উপমা ফিরলে নিঃশব্দ হাসিতে শব্দ যোগ হলো। তা দেখে চোখ বড়বড় করে কোমরে হাত রেখে কণ্ঠে রাগ ফোটাবার চেষ্টা করে উপমা বলল,
— তুই দুষ্টামি করছিলি আমার সাথে? বদমাশ।
— ইশশ কি ভয়টাই না পেয়েছিলি তুই!
হাসতে হাসতে উপমার গায়ে ঢলে পড়তে লাগল ডালিয়া। ওর বেণী টেনে মাথায় টোকা মেরে কপট রাগে নাক ফুলিয়ে উপমা বলল,
— মারব কিন্তু তোকে।
— আমারও তখন মুখের আগল ছুটে যাবে। বলে দেব তুই বাসায় ফেরার নাম করে…

এ পর্যায়ে ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ওর মুখ চেপে ধরল উপমা। ঝাড়ি মেরে কিছু একটা বলবে তখনই বাইরের ঘর থেকে মিতালীর আম্মা দু’জনের নাম ধরে ডেকে পাঠালেন দুপুরের খাবারটা সেরে নেয়ার জন্য।
দুই বান্ধবীর খুনসুটি মধ্যিখানে ভাটা পড়ে গেল। তড়িৎ ডালিয়ার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বেরিয়ে গেল উপমা। যাওয়ার সময় চোখ রাঙানি দিতে ভুলল না। ওর চোখ রাঙানিতে ভয় তো পেলই না ডালিয়া উল্টো ওড়না মুখে চাপা দিয়ে নিঃশব্দে হেসেই গেল।
এরপর উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু হলো না। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল দু’জন। মিতালীর মা রিকশা ডেকে দিতে চেয়েছিলেন, পরে কি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেচারি। উপমার সুবিধেই হলো তাতে। খালাম্মা তো অজানা নয় তার বাড়ি কোথায়। শেষে পরিকল্পনা সব ভেস্তে যেত।

কথানুযায়ী রওনক পত্রিকা অফিসের সামনে হোন্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। উপমা গেলে দেখল ঝুপড়ি চায়ের দোকানের সামনে হোন্ডায় হেলান দিয়ে সে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। উপমাকে সামনে পেয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বিনিময়ে উপমার ঠোঁটের কোণেও ফুটে উঠল অবর্ণনীয় হাসির ছটা। চায়ের কাপে ইশারা করে রওনক জানতে চাইল, সে চা খেতে চায় কি না।
মুখে জবাব না দিয়ে সরাসরি রওনকের হাত থেকে চায়ের কাপটা টেনে নিলো উপমা। যেদিক টায় রওনকের ঠোঁটের ছোঁয়া আছে ঠিক ওদিকটায় ঠোঁট লাগিয়ে কুসুমগরম চায়ে চুমুক দিলো। অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল রওনক। কিছু হয়নি এমনভাবে দ্বিতীয়বার চুমুক দিয়ে উপমা বলল,
— চা টা তো ভারী মিষ্টি। কনডেন্স মিল্কে্ বানানো বুঝি!
এরপর বড় চুমুকে শেষ করে খালি কাপ রওনকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
— শেষ।
কাপ হাতে কতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রওনক। মস্তিষ্ক সজাগ হলে উপমার মাথায় আলতো করে হাত রেখে মাথা নেড়ে বলল,
— কি যে করো না তুমি!

কাপ ফিরিয়ে দেয়ার সময় দোকানদার তার পান খাওয়া হলদেটে লাল দুপাটি দাঁত বের করে চোখের ইশারায় উপমাকে দেখিয়ে বিস্তর হেসে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— ভাই, ভাবী নাকি?
মানিব্যাগ থেকে খুচরো পয়সা বের করতে করতে রওনক কেশে উঠল। কোনোরকমে একবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল কি না পয়সাগুলো টেবিলের ওপর রেখে চপল পায়ে হোন্ডার কাছে ফিরে এলো৷ হোন্ডায় ওঠার আগে হুট করে ডান হাত পেতে উপমা বলল,
— দেখি মানিব্যাগটা দিন তো একটা জিনিস দেখব।
— কি দেখবা?
ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করল রওনক। সাথে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতেও ভুলল না। ওর হাত থেকে মানিব্যাগটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি ফোটাল উপমা।
— উফফ বড্ড প্রশ্ন করেন আপনি। যা করছিলেন করুন না।

ওকে আর ঘাটানোর প্রয়োজন মনে করল না রওনক। ছোট্ট শ্বাস ফেলে ব্যাগটা বেঁধে নিলো হোন্ডার সাথে। পাশে থেকে উপমা দুষ্টুমি করে বলল,
— মনে হচ্ছে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।
কথাটা কানে এলো রওনকের। ঠোঁট প্রসারিত হলো ঠিক, তবে বিনিময়ে কিছু বলল না।
হোন্ডা স্টার্ট দিয়ে তবেই বলল,
— যা দেখতে চেয়েছিলে দেখা হয়েছে? ওঠো তাহলে। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
— হু দেখা শেষ। এই যে আমার ছবিটা লাগিয়ে রেখেছেন মানিব্যাগে। সেটাই দেখলাম।
— আনন্দ হয়েছে?
সহাস্যে প্রশ্ন করল রওনক। মানিব্যাগটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উপমা জবাব দিলো,
— ভীষণ।
এরপর হোন্ডার পেছনে উঠে বসতে বসতে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
— মানিব্যাগে মানুষ কার ছবি রাখে জানেন? স্পেশাল মানুষের। আমি আপনার স্পেশাল মানুষ রওনক?
— তোমার কি মনে হয়?
রওনক যেন মজা পাচ্ছে প্রশ্নগুলোতে। বুঝতে পেরে ওর কাঁধে আলতো চাপড় দিয়ে উপমা বলল,
— আপনার প্রশ্নের উত্তর তো আমার মনে থাকার কথা নয়। আপনার উত্তর আছে আপনার মনে।
— আচ্ছা তাহলে মনের উত্তরটা মুখে উচ্চারণ করে শুনিয়ে দিই “তুমি হলে আমার আপন মানুষ; একান্ত আমার মানুষ” হয়েছে?

কাঙ্ক্ষিত উত্তরে প্রশান্তির হাসি হাসলো উপমা। রওনকের কাঁধের ওপর চিবুক রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে সলজ্জে বলতে ইচ্ছে করল,
— আজ তেপান্তরে হারিয়ে যাব রওনক। বাতাসে প্রেমের ঘ্রাণ দু’হাতে জড়ো করে আপনার বুকের খাঁচায় লুকিয়ে পড়ব। বহুদিনের শখ একটা একক আলিঙ্গনে বেঁধে পড়ার। প্রেমালিঙ্গণে। ইচ্ছে ঐ প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে হৃদয় অঙ্গনের সমস্ত প্রেম খুঁজে নেয়ার। সজলনেত্রে আপনার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলার, “ভালোবাসি, ভালোবাসি”

ইচ্ছে থাকলেও মুখে উচ্চারণ করে বলা হলো না। অপরিসীম লজ্জা কন্ঠরোধ করে রাখল ওর।
তবে রওনকের ইচ্ছেও বোধহয় তেপান্তরে হারানোরই ছিল। মূল শহর ছেড়ে বেরিয়ে অনেকটা পথ চলে এলো সে। প্রকৃতির কাছে নিবিড় ছায়ায় কোনো অজানা তেপান্তরে সরোবরের ধারে ছাতিম গাছের তলে। হোন্ডা থেকে নেমে মুগ্ধতায় হা হয়ে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগল উপমা। যতদূর চোখ যায় সবুজে সবুজ চারিদিক। ছোট্ট সরোবরকে ঘিরে রেখেছে চেনা-অচেনা কতশত গাছ। তমাল, হিজল কিংবা নীলগিরি।
এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো যেন পথের ধারে বনের ভেতর হারিয়ে গেছে তারা। হোন্ডা স্ট্যান্ডে রেখে উপমার পেছনে এসে দাঁড়াল রওনক। দু হাত পকেটে পুরে জানতে চাইল,
— জায়গাটা ভালো লেগেছে?
জবাবে মাথা কাৎ করে সায় জানিয়ে আবেগে রওনককে জাপ্টে জড়িয়ে ধরল উপমা। বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসের সাথে বলল,
— অসম্ভব। মনে হচ্ছে অলীক কোনো বনের ভেতর হারিয়ে গেছি আমরা।
— হারাতে চাইলেই কি হারাতে দেব?

দাঁতে ঠোঁট কামড়ে একহাত দিয়ে উপমার কোমর জড়িয়ে ধরল রওনক। স্পর্শে খানিক কেঁপে উঠল উপমা। লজ্জা পেলো বোধহয়। লজ্জাটাকে ঢাকতে তড়িৎ সরে গিয়ে ছাতিমের গাছের ছড়িয়ে যাওয়া শেকড়ের দিকটায় ইশারা করে বলল,
— চলুন বসি?
অপেক্ষা না করে নিজেই ছুটে গিয়ে বসল। আশেপাশে কতগুলো ইটের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টুকটুক করে সব কটা কুড়িয়ে নিলো হাতের মুঠোয়। পানির মধ্যে ছুড়ে দেবে।

নৈশব্দিক পরিবেশটা খানিক পর মুখর হয়ে উঠল পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। গাছের ডালে নাম না জানা কতগুলো পাখপাখালি বসা ছিল। পানির শব্দে তারাও ডানা ঝাপটে উড়ে যেতে শুরু করল।
পেছনে দাঁড়িয়ে ক্ষণ কতক দৃশ্যটা অবলোকন করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রওনক। জুতো খুলে একদম গা ঘেঁষে বসল উপমার।
মুষ্টি খুলে ইটের টুকরো রওনকের দিকে এগিয়ে দিলো উপমা। পথ অনুসরণে রওনকও কয়েকটা ইটের টুকরো ছুঁড়ল পানির মধ্যে। বালকসুলভ পাগলামিতে দু’জনেই একসাথে হেসে উঠল।
একসময় ইটের টুকরো ফুরিয়ে গেলে পানির শব্দ কমে এলো।
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে রওনকের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো উপমা। রওনক চট করে আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে রাখল। তখুনি উপমার নজরে এলো রওনকের কবজির কাছে বেঁধে রাখা রুমালটার দিকে যা ও প্রথম দেখা হওয়ার দিন দেখেছিল এবং কখনো রওনকের হাত থেকে খুলতে দেখেনি৷ সাগ্রহে ধরে রাখা হাতটা উঁচিয়ে মৃদু কণ্ঠে শুধল,
— এটা সবসময় বেঁধে রাখেন কেন? স্টাইল?

প্রতুত্তরটা মুখে করল না রওনক। অল্প হেসে হাত উল্টে বাঁধন খুলে ফেলল চট করে।
উপমাও তৎক্ষনাৎ হাত ছাড়িয়ে স্থির হয়ে বসল। অবাক নেত্রজোড়া আকর্ষণ করল রওনকের হাতে অসংখ্য পোড়া দাগে। কিছু লম্বাটে, কিছু গোল; নানা আকৃতির। জিজ্ঞেস করতে হলো না। রওনক নিজ থেকেই বলতে শুরু করল যা বলার জন্য বহুদিন যাবৎ অপেক্ষা করে আছে ও।
“একসময় কষ্টের বহিঃপ্রকাশ বলতে এসবকেই বুঝতাম। ঘৃণা করতাম নিজেকে। খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করত এই শরীরটাকে।
বেশি নয়, বছর সাড়ে পাঁচ কিংবা ছয় পর্যন্ত আমার জীবনটা খুব সুন্দর ছিল, রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর। চার জনের ছোট্ট একটা সংসার। অবর্ণনীয় আদর, ভালোবাসা, সুখ। সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
মানুষ বলে অনেক সুখের পর অনেক দুঃখ আসে। আমি তো সুখ জিনিসটাকে ঠিকমতো উপলব্ধিই করতে পারিনি তার আগেই কালবৈশাখী ঝড়ের মতো একরাশ দুঃখ নেমে এলো আমার জীবনে, আমাদের জীবনে। যে দুঃখের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আমার মা”

একটু থামল রওনক। বহু কষ্টে শ্বাস টেনে ভেঙে ভেঙে বলল,
— এমনই এক ঝকমকে দিনের আলোয় হুট করে আমাদের দোকানের ক্যাশিয়ারের সাথে পালিয়ে গেল আমার মা। তারিখটা ছিল আমার জন্মদিনের। বাবা’র সাথে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম দাদা-দাদির দোয়া নিতে। মা-ই পাঠিয়েছিল জোর করে। আমিও দাদা-দাদি বলতে পাগল দ্বিমত করিনি৷ তখন আসলে বুঝতে পারিনি আমাদের পাঠিয়ে দিয়ে সে…

কথাগুলো বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রওনকের। রাগ হচ্ছে, অসহ্য লাগছে। সবটাই উপলব্ধি করতে পারছে উপমা। কীভাবে ওর কষ্ট লাঘব করতে পারে জানা নেই, তবে পাশে আছে ভরসায় দু-হাত দিয়ে রওনকের হাত শক্ত করে চেপে ধরল একসময়। রওনক যেন সত্যি সত্যি সাহস পেলো এতে। উপমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
— ভাইয়া ছিল স্কুলে। বাড়ি ফিরে মাকে দেখতে না পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিল ও। তখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত নয়। গরুর গাড়ি করে যেতে হয় গ্রামের বাড়িতে। দীর্ঘ সাত-আট ঘণ্টার পথ। এতটা সময় ও একা দুশ্চিন্তা করেছে, খুঁজেছে। মায়ের জন্য কেঁদেছে। ততক্ষণে পাড়ায় রটে গেছে মা পালিয়েছে ক্যাশিয়ারের হাত ধরে। আমি আর বাবা যখন ফিরেছি তখন অনেক রাত। একলা বাড়িটাতে শোকে পাথর হয়ে আছে ভাইয়া।
আমরা ফিরে সবটা যখন শুনলাম, বাবা সহ্য করতে পারেনি উপমা। শক্ত সামর্থ্য মানুষটা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ভাইয়ার চাইতে তখন বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম আমি। মধ্যরাতে আমাদের বাড়িতে মরাকান্নার রোল উঠেছিল যেন। এত বছরের জীবনে সেই রাতের মতো আঁধার রাত্রি আমি আর কক্ষনও দেখিনি।

বলতে বলতে রওনকের কণ্ঠস্বর বুঁজে আসতে চাইল। চোখের কোলে জলটাকে কোনোরকমে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো সে। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষণ কতক নিশ্চুপ রইল। উথলে উঠতে চাওয়া কষ্টটার সাথে বোঝাপড়া করে নেয়ার পর পুনরায় বলতে শুরু করল,
— এরপর দিন কতক কেটে গেছে। তখনও আমি বুঝতে পারিনি কি হচ্ছে আমাদের সাথে, কেন হচ্ছে। হাসিখুশি পরিবারটাতে এভাবে ঝুঁপ করে নিস্তব্ধতা নেমে এলো কেন? মা নেই, বাবা একা একটা ঘরে মূর্তির মতো বসে দিন কাটায়। বাইরে বেরোয় না। আমাকে কাছে ডাকে না। খাওয়া, ঘুম কোনো কিছুর ঠিক নেই। ভাইয়া যতটা পারে করে রেখে দেয় এলেবেলেভাবে। বাইরে গেলে লোকে কটু কথা শোনায়, গালিগালাজ করে। এসবের কারণ কি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না আমি। অবুঝ আমার শুধু মা’কে প্রয়োজন ছিল। মা ছাড়া যে থাকার অভ্যেস নেই। কান্নাকাটি করতাম, অনুরোধ করতাম কিন্তু বাবা কিংবা ভাইয়া কেউ মা’কে এনে দিতো না। কখনো রেগেমেগে চড় মেরে ভাইয়া বলতো, মা নেই মরে গেছে।
শুনে আমি আরও বেশি বেশি কাঁদতাম।
এই করে করে মাস কয়েক কাটার পর একদিন হুট করে মায়ের সাথে দেখা হলো। ভাইয়ার সাথে ওর স্কুল থেকে ফিরছি। তেঁতুলতলা মোড়ে বাসস্ট্যান্ডে ক্যাশিয়ার মামার সাথে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে মা। লোকটাকে আমি মামা বলে সম্বোধন করতাম তখন।
ভাইয়াকে ডেকে বাসস্ট্যান্ডে ইশারা করে মাকে দেখালেও ভাইয়া আমার কোনো কথা শুনছিল না।
উল্টো আমার হাত টেনে নিয়ে অন্যদিকে যেতে চাইছিল। আমি শুনিনি ওর কথা। জোর করে হাত ছাড়িয়ে মা মা ডাকতে ডাকতে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম।
বাস বোধহয় তখন স্টার্ট দিয়েছে। মা উঠছে বাসে। আমি গিয়ে মায়ের আঁচল টেনে ধরেছিলাম। বিপরীতে মা কি করেছিল জানো? অচেনার মতো আমার দিকে তাকিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল আমাকে।
মা আমার এখানে ধাক্কা মেরেছিল উপমা।

তর্জনী দিয়ে বাঁ কাঁধের দিকটায় ইশারা করল রওনক। ওর দুচোখ বেয়ে অথৈ জলের ধারা নামতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে।
তার মধ্যেও বলে গেল,
— চোখের সামনে দিয়ে একটা পরপুরুষের হাত ধরে চলে যেতে দেখেছি নিজের মাকে। তাহলে এই জীবনটার প্রতি ঘৃণা আসবে না কেন বলতে পারো? ট্রমাটাইজ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সবটা বুঝতে শেখার পর পৃথিবীর সবকিছুর ওপর ঘৃণা এসে গিয়েছিল আমার। মা শব্দটাকে ঘৃণা করতাম আমি, ঘৃণা করতাম মা নামক ঐ মহিলাটাকে;সমস্ত পৃথিবীকে আর..
এবারেও কথা অসম্পূর্ণ রাখল রওনক। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
— চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আজকের এই দাগগুলো। শুধু এগুলো নয় সারা শরীরজুড়ে আরও অসংখ্য ক্ষতের দাগ আছে। তার থেকে অধিক গভীর দাগ আছে এই মনে। শরীরের ক্ষত তো সেরে যায় উপমা। মনের ক্ষত কিসে সারে?
একটা ঘৃণা, একটা ক্রোধ প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমাকে আঘাত করে। খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়। এই ক্ষতটার প্রলেপ আমি পাই না উপমা। আমার, আমার কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট হয়।
কম্পমান গলায় হতাশার শ্বাস ফেলে মাথা নত করে নিলো রওনক।
এতদিনের বজ্রকঠিন অবয়বের মানুষটাকে এমন গলিত বরফের চূড়ার ন্যায় ভেঙে পড়তে দেখে খুব খারাপ লাগল উপমার। রওনকের এ নতুন রূপ তাকে পুরোদমে নির্বাক করে দিলো। কিছু বলার কিংবা সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা সে খুঁজে পাচ্ছে না।
উপমাকে নিশ্চুপ দেখে হঠাৎ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে উঠল রওনক। হেয়ালি করে বলল,
— এখন তুমিও আমাকে ছেড়ে যাবে তাই না? একজন প্রতারকের রক্ত আমার শরীরে বইছে। আমি নিজেও তো অমানুষ হয়ে গেছি। রাজ্যের অভিশাপ আমার মাথায়, আমার নামের সাথে জড়িয়ে। আর পাঁচটা মানুষের মতো এখন তুমিও আমাকে ঘৃণা করবে। করাটাই স্বাভাবিক। আমি তো..
এ পর্যায়ে রওনকের ঠোঁটজোড়ার ওপর আঙুল চেপে ধরল উপমা। বাকি কথাকে অন্দরে হারিয়ে যেতে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
— শশশ্! আমি কোত্থাও যাব না আপনাকে ছেড়ে। কক্ষনও না, কোনোদিনও না। কোত্থেকে উদয় হলো এই প্রশ্নটার? অদ্ভুত!
আপনি কার ছেলে, কিসের অভিশাপ আপনার মাথায় এসব দেখে তো আমি ভালোবাসিনি আপনাকে রওনক। আমি ভালোবেসেছি চামড়ার নীচে প্রকোষ্ঠের ভেতরের আপনার মনটাকে চিনে। যে মনে অধিকার করে আছি শুধু আমি। এই উপমা।
আলতো করে রওনকের বুকের বাঁ দিকে হাত রাখল উপমা। বলল,
— ভাঙাচোরা জীবন তো আমারও রওনক। আপনি এসেছেন বলে নিজেকে পূর্ণ লাগে আমার। এই মাঝপথে আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাব বলতে পারেন? যাওয়ার জায়গা আদৌ আছে আমার!
পৃথিবীর বুকে আপনিই তো আমার শেষ ঠিকানা।

হাত সরিয়ে আলতো করে রওনকের বুকে মাথা রাখল উপমা। দু’হাতে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা স্বরে বিড়বিড় করে রওনক বলে উঠল,
— যেও না উপমা। কেউ কাউকে ছাড়া মরে যায় না, কিন্তু আমি যাব। তুমি না থাকলে পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব, হারিয়ে যাব এই ধরার বুক থেকে। তুমি যে আমার বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ। এতখানি বছর কেটে যাবার পর তোমার ভালোবাসা মৃতপ্রায় আমাকে পুনরায় বাঁচার আশা জুগিয়েছে। তুমি ছাড়া নিজেকে কল্পনা করলেও দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। উপমা বিনে রওনক ধ্বংস হয়ে যাবে, স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাবে।
— আপনার নামের মোহর লাগিয়েছি আমি আমার অন্তরে। মৃত্যু না হওয়া অবধি এই নাম মুছে ফেলা অসম্ভব। তবুও যদি বিশ্বাস না হয়, যদি মনে হয় ছেড়ে যাব তাহলে বলে দিচ্ছি সত্যি সত্যি কখনও সেই দিনটা এলে আমার নিঃশ্বাসটাকে অধিকার করে নেবেন। আপনার বুকে মাথা রেখেই যেন আমি বিদায় নিই।
— সেদিনটা তবে আমারও শেষ দিন হবে উপমা। আমারও শেষ দিন হবে।

হারানোর আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত রওনক আরেকটু নিবিড়ভাবে প্রিয়তমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। উপমার অভিযোগ নেই। দয়িতের বাহুবন্ধনে সেও একরাশ স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে।
প্রকৃতির এই সময়টাকে বলা হয় গোল্ডেন আওয়ার;গোধূলি লগ্ন। সূর্যের পশ্চিম কোণে মিলিয়ে যাওয়ার সন্ধিক্ষণ। রৌদ্রের রঙ এই সময় থাকে খাঁটি সোনার মতো চকচকে, মসৃণ। ছাতিম হেমন্তের ফুল। রৌদ্রের মিলিয়ে যাওয়ার সাথে এর একটা সংযোগ আছে। সোনা রোদ মিলিয়ে যাওয়ার ক্ষণটা ও বুঝতে পারে। ফুলে ফুলে সুসজ্জিত গাছটা যখন বাতাসের সঙ্গে মিলে যায় চাপা সুঘ্রাণে মাতিয়ে তোলে চারিদিক। রোজকার নিয়ম মেনে আজও ছাতিম তার চমৎকার ঘ্রাণ বাতাসে মিশিয়ে দিতে শুরু করছে ধীরে ধীরে। স্নিগ্ধ, শান্ত পরিবেশটা হুট করে একরাশ প্রেম সমীরে ভরে উঠছে। প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে দুই মানব মনে প্রেমের তীব্রতা গভীর থেকে গভীরতর তল ছুঁয়ে ফেলছে অবলীলায়। আজকের প্রেমের রূপে ভিন্নতার আমেজ। আজকের সব প্রতিজ্ঞা দৃঢ় হচ্ছে চোখের ভাষায় আর ঠোঁটের ভাঁজে।
দেখা যাক এই পাগলপারা প্রেমের গতিটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে মেলে!
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here