ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৫

0
1560

#ধূসর_অনুভূতি
পর্ব:১৫
মালিহা রেস্টুরেন্টে বসে আছে।তার সামনে বসে আছে ঝিনুক আর যুথি… অনেক ক্ষন ধরেই নিশ্চুপ তিনজন।মালিহা তিনদিন ধরে তার বাবার বাসায় এসেছে। আজ সকালে সাহস করে যুথিকে ফোন করেই ফেলেছে।বলেছে তিতলির সাথে দেখা করতে চাই।
যদিও দেখা করতে ঝিনুক আর যুথি এসেছে শুধু।তিতলি আসেনি।
তিনজনের মধ্যে প্রথম কথা বললো ঝিনুক। খুব সুন্দর করে হেসে বললো,
– তো মিসেস ফারহান কেমন আছেন আপনি? আপনার স্বামী কেমন আছে?
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।বললো, ঝিনুক আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই তাই ক্ষমা চাইবোও না।আমি শুধু তিতলিকে একবার দেখতে চাই। এরপর আমি চলে যাবো।
ঝিনুক বললো,তিতলিকে কেন দেখতে চান ?আমরা তো তিতলিকে যার তার সাথে দেখা করাই না। বোঝেনই তো কত খারাপ মানুষ চারপাশে। এদের সাথে মিশে যদি তিতলির মনটা বিষিয়ে যায়…
মালিহা বললো, ঝিনুক আমি তিতলির মা হই।
ঝিনুক তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
বললো, ও আচ্ছা আপনি যে মা ভুলে গেছিলাম।তিনবছরের মেয়েকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় কোথায় ছিল আপনার মাতৃত্ব?
মালিহা চোখের পানি মুছলো।”প্লিজ ঝিনুক একবার দেখা করে আমি চলে যাবো। দূর থেকে দেখবো একবার দয়া করো।”
– আমি বেঁচে থাকতে আপনার মতো অসৎ মহিলার ছায়াও আমার তিতলির গায়ে পরতে দিবো না।
মালিহা অসহায়ের মতো যুথির দিকে তাকালো।যুথিও মাথা নিচু করে ফেললো।
ঝিনুক আবার বললো,কোন সাহসে আপনি তিতলির সাথে দেখা করার কথা চিন্তা করলেন? আপনি এখনো আমাকে চিনেন নাই।আমি ভালোর সময় যেমন ভালো,তেমন খারাপের সময় আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ নাই।
যুথি ঝিনুক কে শান্ত হতে বললো। এরপর মালিহার দিকে তাকিয়ে বললো,ভাবী তিতলি এখন তোমাকে অনেকটাই ভুলে গেছে। তোমার জন্য আর কাঁদে না। এখন তুমি যদি আবার ওর সামনে যাও ওর পুরানো ক্ষতটা আরো বাড়বে। তুমি তো আর সবসময় ওর সাথে থাকতে পারবে না।মায়া বাড়িয়ে তো লাভ নেই।
মালিহা কেঁদে উঠলো।সে তিতলির জন্য তিতলির প্রিয় চকলেট এনেছে দুই বক্স,খেলনা এনেছে।
চোখের পানি মুছে যুথির হাতে বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো, দেখা যখন করতে দিবাই না তাহলে আর কি করার… এইগুলো তিতলিকে দিও।
যুথি বক্স গুলো হাতে নেওয়ার আগেই ঝিনুক সেগুলো ক্ষিপ্রভাবে নিজের হাতে নিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিলো।
বললো, আপনাকে কিছু দিতে হবে না।তিতলির কিছু লাগলে আমরাই দিতে পারবো বুঝেছেন?
মালিহা বললো,আমি দোষ করছি আমি মানছি। কিন্তু তিতলি তো আমার মেয়ে।ওকে আমি কিছু দিতেও পারবো না?
যুথি বললো,আপু একবার দেখা করতে চাইছে দাও না…
ঝিনুক কোনো কথাই বললো না। অনেক ক্ষন আবার নীরবতা।
মালিহা আশা করে বসে আছে ঝিনুক এর হয়তো মন গলবে।
অনেক ক্ষন পর বাদশার প্রসঙ্গ উঠলো।
ঝিনুকের দু’চোখে পানি জমলো। বললো,ভাবী তুমি ভাইয়াকে ছেড়ে গেছিলা কিসের জন্য বলবা? আমার তো মনে হয় আজকালকার যুগে আমার ভাইয়ের মতো ছেলে পাওয়া মুশকিল। তুমি চলে যাওয়ার আগে যে চিঠি লিখে গেছিলা আমাদের সবার নামে একগাদা দোষ সেই চিঠিতে লিখে গেছিলা….
মালিহা বললো, পুরানো কথা কেন তুলছো?
– না ভাবী পুরানো কথা তুলতে হবে। তুমি আমাদের অনেক দোষ,ত্রুটি লিখছিলা সেটা পড়ার পর আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের খুব নিচু মনে হতো। আশেপাশের মানুষজন বলতো,বউটার উপর মনে হয় বাদশাহ অনেক টর্চার করছে এর জন্য না পেরে বউটা পালাইছে। আমার ভাই এইসব কথা শুনে শুনে মানসিক ভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। তোমার চিঠিতে তার এতো দোষ পড়ে সে অবাক হয়ে গেছে যে তোমার তার প্রতি এতো বিতৃষ্ণা ছিল ,এতো ঘৃনা ছিল…সে সহ্য করতে পারে নাই।তো,ভাবী আমি জানতে চাই এখন কি তোমার মনের মতো স্বামী পাইছো?সেই স্বামী কি সর্ব গুণে গুণান্বিত?
ঝিনুকের চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে।
মালিহা মাথা নিচু করে বসে রইলো। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকাচ্ছে সে।বললো,আমি ভুল করছি ঝিনুক কতবার বলবো…
ঝিনুক তার ব্যাগ থেকে মালিহার লিখে যাওয়া চিঠিটা বের করলো।সেটা মালিহার সামনে ধরলো।
হেসে বললো, ভুল না তুমি অন্যায় করছো অন্যায়,পাপ।ভাবী তুমি চিঠিতে লিখছো আমি আর যুথি নাকি তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিচ্ছি। তোমার সব কিছুতে আমরা হাত দিই। তোমার শখের জিনিস নষ্ট করি। তোমার কোনো প্রাইভেসি নাই। আচ্ছা ভাবী প্রাইভেসি যদি নাই ছিল তুমি ফারহান ভাইয়ের সাথে প্রেম করছো কিভাবে? তোমার তো যথেষ্ট প্রাইভেসি এবং স্বাধীনতা ছিলো যার কারণে তুমি উনার সাথে পরকীয়া চালাতে পারছো বছরভর।রইলো বাকি আমরা তোমার সবকিছু তে ভাগ বসাতাম।আহারে ভাবী কসম করে বলতেছি বুঝতে পারি নাই তুমি আমাদের এইসব ব্যবহার অপছন্দ করো।তোমাকে বড় বোনের মতো মনে করছিলাম।তাই, তোমার কানের দুল, চুলের ফিতা নির্দ্বিধায় নিজের ভাবছি। কিন্তু,বুঝি নাই ভাবী তো বড় আপু হয় না।যদি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারতাম তাহলে তোমার রুমেও যাইতাম না। শেষের দিকে এমনিতেও যেতাম না তোমার কাছে। বুঝতাম পছন্দ করো না। কিন্তু, শুরুতে বুঝতাম না। বুদ্ধি-শুদ্ধি কম ছিল তো তাই। তুমি তো মনে করো সব দোষ আমাদের। তুমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হইছো, কিন্তু তোমার ধারণা ভুল ভাবী। আমাদের দোষ আছে মানছি কিন্তু তোমার দোষ সবচেয়ে বেশি। আমার ভাইকে তুমি দোষী করছো ভাবী,আমি আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো ছেলে আর কোথাও কোনোদিন দেখি নাই। ছোট বেলার থেকে সে ছায়ার মতো আমাদের আগলে রাখছে।তার বিরুদ্ধে যখন তুমি এত্তোগুলো অভিযোগ করলা আমি মানতে পারি নাই ভাবী। আমার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো আমি মানছি, মায়ের দোষ আছে আমি জানি। কিন্তু, আমার ফেরেস্তার মতো ভাইরে তুমি অমানুষ বলছো, জানোয়ার বলছো।
ঝিনুক জোরে শ্বাস নিলো। এরপর আবার বলতে শুরু করল, ভাইয়ার অনেক দোষ তোমার চিঠি পড়ে জানছি এইবার আমি একটু তার গুণগুলো বলি কেমন…. তুমি ভাইয়ার বউ হয়ে যখন আসছো তখন ভাইয়ার কোনো চাকরি ছিল না, বেকার ছিলো। ভাইয়া বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে তবু তোমাকে বিয়ে করছে।কয়টা ছেলের এমন বুকের পাটা থাকে বলো তো…প্রেম করে, সর্বনাশ করে পরিবারের দোহাই দিয়ে চলে যায় ছেড়ে। আমার ভাই তো তা করেনি। আমার ভাই তো মদ-গাঁজা খায়না।এমনকি তোমার জন্য সিগারেট খাওয়াও বাদ দিয়ে দিছিলো।কোনো বাজে নেশা ছিল না।কোনো মেয়ের দিকে তাকাতোও না।কয়টা পুরুষ দেখাইতে পারবা এমন চরিত্রবান?তার কি দোষ ছিল বলবা?সে তার বোনদের ভালোবাসতো,মা-বাবাকে ভালোবাসতো এটা দোষ?তোমাকে কি ভালোবাসতো না?তোমাকে ফারহান ভাইয়ের সাথে নোংরামি করতে দেখে যুথি যখন ভাইয়াকে বিচার দিছিলো তখন ভাইয়া উল্টা যুথিকেই ধমকাইছিলো। বলেছিলো,ভাবলি কি করে মালিহার নামে এতো খারাপ একটা কথা বিশ্বাস করবো আমি?পরের বার এমন কথা বললে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো।’আহ খোদা কত বিশ্বাস ছিল তোমার উপর। তুমি পালিয়ে যাওয়ার পরেও বিশ্বাস করে নাই ভাবছিল বিপদে পরছো।সেই বিশ্বাস তুমি ভেঙে দিলা?মন ভাঙা তো মসজিদ ভাঙার সমান ভাবী। তোমার শাড়ি আমরা পছন্দ করলে ভাইয়া আমাদের দিয়ে দিতো? আচ্ছা, এরপর কি ভাইয়া তোমাকে কিনে দিতো না?আরে, আমাদের জন্য কিনে আনা কিছুও তুমি পছন্দ করে দেখতা ভাইয়া সাথে সাথে বলতো, তোদের ভাবীকে দিয়ে দে এটা তোদের জন্য আরেকটা কিনবো।ভাবী এইসব ছোট ছোট কারণে মানুষ সংসার ভাঙে? আমার মা তো আমাদের গায়েই হাত তুলতো কথায় কথায়। তুমি তো কোন ছাড়… শ্বাশুড়ির উপর জেদ করে সংসার ভাঙলা? সংসার কি শ্বাশুড়ির সাথে করতা নাকি স্বামীর সাথে?আমরা সবাই বুঝতাম ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে অনেক শুধু তুমি ই বুঝতা না।বুঝবা কেমনে তুমি তো ভালোবাসায় মগ্ন ছিলে পরপুরুষের সাথে। ফারহান ভাই কি আমার ভাইয়ের চেয়েও ভালো? অনেক সুখী এখন তুমি?
ঝিনুক কেঁদে উঠলো।মালিহা আর যুথিও কাঁদতে লাগলো।
ঝিনুক চোখের পানি মুছে বললো,ভাবী তুমি না হিংসা করছো ভাইয়া কেন আমাদের পিছনে টাকা খরচ করে…আজ দেখো ভাইয়ার বিপদে তুমি পাশে নেই, পালিয়ে গিয়ে সুখে আছো। কিন্তু,আমি তো পালায় যেতে পারছি না আমার ভাইকে ফেলে। আমার ভাই যে পাগল হয়ে গেলো। হাসপাতালে ভর্তি, তুমি কই এখন?আমার তো জান বেরিয়ে যাচ্ছে একা একা সংসার টা টানতে। এখন আসো হিংসা করতে…
মালিহা চোখের পানি ফেলে অবাক হয়ে বললো, বাদশার কি হইছে?
ঝিনুক বললো, তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। তুমি তো কেউ না। তোমাকে বলে লাভ কি….চল যুথি।
ঝিনুক উঠে চলে গেল।
যুথি কি বলবে ভেবে পেলো না। তার ঝিনুক আপু ইদানীং এতো রাগী হয়ে গেছে।
যুথি বললো,ভাবী তিতলি ভালোই আছে। তুমি চিন্তা করো না।আমরা ওর খেয়াল রাখি।
মালিহা বললো, বাদশার কি হইছে?
যুথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বললো।
মালিহা সব শুনে পাথরের মতো হয়ে গেল।
যুথি বললো,ভাবী আমাদেরও দোষ ছিল, শুধু তোমার একার না।আমরাও বুঝাতে পারিনি যে আমরা তোমাকে ভালোবাসি। ।
যুথি কাঁদতে লাগলো।
মালিহা যুথিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো,আমি ভালো নাই যুথি আমি ভালো নাই।
যুথি কাঁদতে কাঁদতে বললো,আমরাও ভালো নাই।
মালিহা বললো,তিতলির এখনকার তোলা একটা ছবি দেখাবা?
যুথির ওয়ালপেপারেই তিতলির ছবি সেইভ করা ছিল।
যুথি দেখালো।মালিহা ফোনের মধ্যেই চুমু খেয়ে ফেললো।
পরদিন তিতলির সাথে দেখা না করেই সে ফিরে এলো একরাশ কষ্ট নিয়ে।

ঝিনুক-কে এখন কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।যুথি চিনতে পারে না নিজের বোনকে।মাকেও চিনতে পারে না।সবাই বদলে গেছে।আর, বাদশাহর অবস্থা তো আরো খারাপ।সে তো তাদের কাউকেই চিনে না।এমনকি তিতলিকেও না…..
একটার পর একটা কষ্ট এসে সবাই কে বদলে দিয়েছে।
এখনো যে আরো একটা বড় কষ্ট পাওয়া বাকি তারা তো জানেও না।
.
লেখক- শাপলা
চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here