প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৪৮

0
2020

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ, অপ্রসন্ন মন মস্তিষ্কের দোলাচলে থিতিয়ে থাকা অন্তঃকরণে অবিধেয় চিন্তা চেতনার বিচরণ আয়েন্দ্রিকে নিশ্চুপ করে রেখেছে। উত্তরোত্তর ঘটে যাওয়া উৎকট সব ঘটনায় সে মর্মাহত।
জানালার গ্রিলে হাত রেখে উদাসচিত্তে চেয়ে আছে উত্তরের সে ঘন জঙ্গলে। আমগাছটার মধ্যে বসে থাকা সাদা আর কালোর মিশেলের পাখিটা লেজ নাড়িয়ে শুধু ঘুরে যাচ্ছে। আয়েন্দ্রির করুণ, ক্লান্ত চাহনি। তদ্দণ্ডে তার কটিদেশে উষ্ণ ছোঁয়ায় শিহরিত হওয়া দেহে শ্বাসরুদ্ধ করে ফিরে তাকায় আয়েন্দ্রি। তার অধরে লেপ্টে যায় কিয়ৎপলের ব্যবধানে নিষ্প্রাণের সরু, শুষ্ক ওষ্ঠাধর। আয়েন্দ্রি নির্লিপ্ত। জিজ্ঞাসু নেই তার চোখে। সে পূনরায় উদাসীন হয়ে ফিরে তাকায় জানালার ফাঁক গলিয়ে। কটিদেশে চাপ প্রতীত হলেও ভাবান্তরহীন আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ নৈঃশব্দে তার চিবুক রাখে আয়েন্দ্রির কাঁধে। আলগোছে ছুঁইয়ে দেয় আয়েন্দ্রির স্থির কপোল, শ্রবণেন্দ্রিয়, গলদেশ। অপ্রসন্ন আয়েন্দ্রি। তার চিত্তে কোনোরূপ প্রভাব বিস্তৃত হলো না। আয়েন্দ্রিকে নিজের বক্ষপুটে চেপে ধরে নিষ্প্রাণ। তার বক্ষস্পন্দনের প্রতিটি গুঞ্জন আয়েন্দ্রিকে আহত করছে।

সিক্ত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“রেগে আছিস আমার ওপর? সরি রে।”

আয়েন্দ্রি বাকহীন। ইচ্ছে হলো না তার কথা বলতে। নিষ্প্রাণের স্বীকারোক্তির সুর—

“বললাম তো সরি। তোকে আমি সাজতে বলেছি বল? কেন সেজেছিলি ওভাবে? তাও আবার অন্য একজনের মতো! তুই তো আমার ধ্রুবতারা। তোকে কারো মতো সাজতে হবে না। তুই আমার কাছে সবসময় একই। তারাদের সাজতে হয় না। তাদের আলো আপনাআপনি ঝলসে দেয় কারো চোখ, বিদীর্ণ করে হৃদপ্রকোষ্ঠ, আলোকিত করে তমসা। তাদের কৃত্রিম সাজের প্রয়োজন নেই।”

আয়েন্দ্রি মলিন হাসে। ফিরে তাকায় ঝকঝকে নীলাভ্রের বুকে। শুভ্র থোকা থোকা জলদ। ক্ষয়ে নিচ্ছে নীলাভ মায়াকে। সেখানের স্থির চোখ রেখে ম্লান গলায় বলল—

“তুই তাকে ঘৃণা করিস? কেন?”

আয়েন্দ্রিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। শীতল চোখে কিছুসময় চেয়ে রইল। আয়েন্দ্রি বুঝল না। জানালা দিয়ে আসা ফিনফিনে পবনে আয়েন্দ্রির ক’গাছি চুল উড়ে এলো তার চোখে, মুখে। নিষ্প্রাণ অতলান্ত মায়ায় তা মুখ থেকে সরিয়ে দেয়। কপালে উষ্ণ ফুঁ দিতেই সরে যায় ছোটো কেশ। আয়েন্দ্রি নিভুনিভু চোখে নিষ্প্রাণকে দেখে। ছেলেটা এমনিতে কত স্বাভাবিক। কিন্তু রেগে গেলে! আর ভাবতে চায় না আয়েন্দ্রি। তার গায়ে এভাবে হাত তুলবে নিষ্প্রাণ তা আয়েন্দ্রির কল্পনাতীত।

আয়েন্দ্রির ভাবনার ঘোর কাটে তার গলায় ভেজা স্পর্শে। তার নরম গালে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। শুষ্ক গলায় বলল—

” আমার মা সুইসাইড করেছে ধ্রুবতারা।”

নিষ্প্রাণের এই কথায় কী যেন ছিল। আয়েন্দ্রিকে প্রমত্তা সাগরে ভাসিয়ে নিতে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। আয়েন্দ্রি ভারাক্রান্ত গলায় বলল—

“তিনি সুইসাইড কেন করেছেন?”

নিষ্প্রাণ ঝরা হাসল। কেঁপে উঠল আয়েন্দ্রির বুক। এমন কথায়ও কেউ হাসে!
হেয়ালি গলায় বলল—

“আমি যদি আবার বিয়ে করি তাহলে তুই কী করবি?”

চমকিত হয় আয়েন্দ্রি। ঝট করেই নিষ্প্রাণের কলার চেপে ধরে বলল—

“মেরে ফেলব তোকে।”

নিষ্প্রাণ গা দুলিয়ে হাসে। মেয়েটা তাহলে তাকে সত্যিই ভালোবাসে! নিস্পৃহ গলায় ফিসফিসিয়ে বলল নিষ্প্রাণ—

“আমার মাও বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল।”

শঙ্কিত হয় আয়েন্দ্রির দৃষ্টি জোড়া। সে স্তম্ভিত, নিভৃত, চকিত।

নিষ্প্রাণ গাঢ় গলায় বলে উঠে—

“দুদিনের মধ্যে আমরা ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। ঝামেলা করিস না। একদম বাড়ির বাইরে যাবি না। আমার কথার যেন নড়চড় না হয়। প্রাণকে নিষ্প্রাণ বানাস না ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রিক জড়িয়ে ধরে তার নিবার্ক অধরে দীর্ঘ চুমু খায় নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণের বুকে শিয়র গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। আচমকা গা গুলিয়ে ওঠে তার। মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে যেতেই ব্যগ্র হয়ে ওঠে নিষ্প্রাণ। উদ্বিগ্ন গলায় চেঁচিয়ে ওঠে—

“ধ্রুবতারা, কী হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস?”

মুখভর্তি বমি করে আয়েন্দ্রি। বুকপাজরে ব্যথা হয়। একটু ধাতস্থ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই নিষ্প্রানের চঞ্চলা মনের অস্থির প্রশ্ন—

“কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?”

নিষ্প্রাণের ব্যাকুলতায় আচম্বিতে তাকায় আয়েন্দ্রি। ক্লান্ত স্বরে বলল—

“না, আমি ঠিক আছি। একটু অস্থির লাগছিল। তেমন কিছু না। রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“ওকে। তুই রেস্ট নে। কিছু লাগলে তালাব চাচাকে বলিস। আমি একটু বাইরে গেলাম। কাজ আছে।”

আয়েন্দ্রি নীরব সম্মতি দেয়।

নিষ্প্রাণ যেতেই সচল হয় আয়েন্দ্রির মন, মস্তিষ্ক। বিছানার কোণায় পড়ে থাকা মোবাইলটা নিয়ে কল করে কাউকে। রিসিভ হতেই ভয়ার্ত গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“প্রাণ মাত্রই বাইরে গেছে। আমার ভয় করছে। আপনি প্রাণকে ভুল ভাবছেন।”

মিশকাত গুমোট শ্বাস ফেলে বলল—

“দেখো আয়েন্দ্রি, প্রথমে তুমি যে ভয়টা পাচ্ছ তা পাওয়া বন্ধ করো। জাস্ট রিল্যাক্স।”

আয়েন্দ্রি শ্বাস গিলে নেয়। নমনীয় গলায় বলল—

“আপনার কেন মনে হয় প্রাণ তার পরিবারকে খুন করছে? ও মাত্র দশ বছরের ছিল। ওইটুকু বাচ্চা…। আপনি ভুল ভাবছেন মিশকাত।”

“হয়তো। কিন্তু সবটা মিথ্যে হতে পারে না। তুমি বলেছ নিষ্প্রাণ তার রাগের বশে এমনটা করেছে। রাগের বশে খুন! তাও এভাবে! আয়েন্দ্রি তুমি এখনো ওকে চিনতে পারনি। ”

আয়েন্দ্রি ফুঁপাতে থাকে। সে কিছুতেই মানতে চায় না নিষ্প্রাণ তার পরিবারকে খুন করেছে। মিশকাত দৃঢ় গলায় বলল—

“আমি খবর নিয়েছি। সেদিন রাজন শিকদার বা নিষ্প্রাণ কেউ ই মসজিদে ছিল না। তারা বাড়িতেই ছিলেন। হঠাৎ আগুন লাগাতে সবাই ছুটে যান সেখানে। রাজন শিকদার কেস করতে চাননি। কেস করেছেন তার-ই কর্মচারী হেকমত। তুমি-ই বলো কেন করেননি রাজন শিকদার কেস? তার তো নিজে আসা উচিত ছিল!
ঘটনার ধামা চাপা পড়তেই নিষ্প্রাণকে রাতারাতি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বারো বছর পর ফিরে আসে সে। আচ্ছা বলোতো, তোমার কী একটুও মনে হয়নি নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক নয়? আমি তোমার ফ্রেন্ড তৃণার সাথে কথা বলেছি। নিষ্প্রাণের আচরণ সম্পর্কে শুনে আমি রীতিমতো হতবাক! আয়েন্দ্রি…নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক নয়।”

বুক কাঁপিয়ে জল বর্ষন হচ্ছে আয়েন্দ্রির চোখের কোটর থেকে। সাজানো গুছানো কথাগুলো দলা পাকিয়ে গেল গলায়। মিশকাতের কর্ণকুহর হলো সেই অবিশ্রান্ত ধারার ঝুমঝমু শব্দ। গলা পরিষ্কার করে বলে উঠে সে—

“শান্ত হও আয়েন্দ্রি। সারক আমাকে সব বলেছে। নিষ্প্রাণ রাগের বশে কিছু করেনি। ওর সবকিছুই সাজানো। নিজেকে সামলাও আয়েন্দ্রি। তুমি ছাড়া কেউ ওকে ভাঙতে পারবে না। ও কোনো প্রমান রাখেনি। ওদের বাড়িতে নয়নতারা নামের একটা মেয়েও ছিল। আগুন লাগার একসপ্তাহ আগে মেয়েটি মারা যায়। কিন্তু তারও আগে থেকে মেয়েটাকে ওই বাড়িতে দেখা যায়নি। মেয়েটা রোজ পাশের একটা মাদ্রাসায় যেতো। আমি অনেক কষ্টে সে সময়ের মাদ্রাসার শিক্ষককে খুঁজে বের করেছি। কী হয়েছিল মেয়েটার সাথে? সে নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পরেই আগুন লাগে। নয়নতারার মৃত্যু কী কারণে ঘটেছে তা কেউ জানে না। ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার মানে নেই। কারণ বাড়ির কাজের লোকদের অন্দরমহলে যাওয়ার এতটা সুযোগ তখন ছিল না। নিষ্প্রাণের কারণে ছাদের দরজা বেশিরভাগ সময় লাগানো থাকত। আয়েন্দ্রি, ওই বাড়িতে কী হয়েছে তা একমাত্র নিষ্প্রাণ আর ওর দাদু জানে। আর এর সত্যতা তোমাকেই বের করে আনতে হবে।”

আয়েন্দ্রি ঝুমঝুম বৃষ্টিস্নাত গলায় বলল—

“আমি কী করব? কাকে বিশ্বাস করব আমি? প্রাণ যতটা শান্ত ততটা ভয়ংকর। ও যদি কিছু করে বসে!”

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আয়েন্দ্রি। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে কী করা উচিত মিশকাতের সে বুঝতে পারছে না। সারক সুস্থ হয়ে আয়েন্দ্রির বাবা -মায়ের সাথে দেখা করে সবটা জানে। সারকের চতুর মস্তিষ্ক বলছে তার এই কিডন্যাপিং এ নিষ্প্রাণেরই হাত। সে এমন কাউকে খুঁজছে যে টক্কর দিতে পারবে নিষ্প্রাণকে। তখন খোঁজ পায় মিশকাতের। সদ্য ট্রেনিং শেষ হয়েছে তার। মিশকাতের ঠিকানা দেয় আয়েন্দ্রির ভাই আরাজ। মিশকাতের সাথে সবটা আলোচনা করেই একটা স্বচ্ছ প্ল্যান ফাঁদে তারা। আয়েন্দ্রির নাম্বার আরাজের কাছ থেকেই নিয়েছে মিশকাত। শাড়ি পড়ার প্ল্যানটাও মিশকাতের দেওয়া। আর তার বিপরীতে নিষ্প্রাণের ভয়ংকর ব্যবহার আয়েন্দ্রিকে ভাবতে বাধ্য করেছে নিষ্প্রাণ আসলেই স্বাভাবিক নয়।

মিশকাত গাঢ় গলায় বলল—

“তোমাকে রাজন শিকদারের কাছেই যেতে হবে। তিনিই পারবেন তোমাকে সাহায্য করতে।”

“দাদু তো ঠিক করে কথা বলতে পারে না।”

“জানি। আমি যা বলছি তা মনোযোগ দিয়ে শোনো।”

মিশকাত এক অবিশ্বাস্য বুদ্ধি দিয়ে দেয় আয়েন্দ্রিকে। কী করে সে রাজন শিকদারের কাছ থেকে নিষ্প্রানের সত্যতা বের করতে পারবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here