প্রাণস্পন্দন•বোনাস_পর্ব

0
1946

#প্রাণস্পন্দন
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ঘরময় পায়চারী করছে আয়েন্দ্রি। মোবাইলটা সমানতালে গুঁতিয়ে যাচ্ছে। যতবার আলফাজ সাহেবকে কল করছে বারংবার কেটে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে প্রচন্ড। এখানে নেটওয়ার্ক কেন পাওয়া যায় না?

আয়েন্দ্রিকে কথার বলার জন্য নিষ্প্রাণের মোবাইল ব্যবহার করতে হয়। ভীষণ বিরক্ত সে। আজও নিজের নাম্বার দিয়ে অনেকবার ট্রাই করেও কল কানেক্ট করতে পারল না আলফাজ সাহেবের নাম্বারে। মেজাজ একশতে একশত!
,
,
,
নিষ্প্রাণের সামনে তৃপ্তিকর হাসিতে আচ্ছন্ন মিশকাত। এই এলাকার নতুন এস আই। কৌতূহলী হয়ে ছুটে এসেছেন রাজন শিকদারের সাথে দেখা করতে। নিষ্প্রাণকে তা জানাতেই তার সরল উত্তর।

“দাদু অসুস্থ। আপাতত তিনি আপনার সাথে কথা বলতে পারবেন না। আপনার যা প্রশ্ন করার আমাকে করুন।”

অধর বিস্তৃত করল মিশকাত। জানার আগ্রহ নিয়ে বলল—

“আসলে কিছুদিন হলো আমি জয়েন করেছি। পুরোনো আনসলভড কেস ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আমি একটা জিডির কপি পেয়েছি। কয়েকবছর আগে সম্ভবত আপনাদের পাশের বিল্ডিং এ আগুন লাগে। রাজন শিকদারের পুরো পরিবার সেই আগুনে মারা যায়। আপনি তো তার নাতি? আপনারা সেদিন কোথায় ছিলেন?”

লম্বা শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। নির্ভয়চিত্তে বলল—

” মসজিদে। দোআ মাহফিলে।”

“কতজন মারা যায় বলুন তো? আর আগুনটা লেগেছিল কী করে?”

নিষ্প্রাণ মোলায়েম হাসল। সপ্রতিভ গলায় বলল—

“প্রায় নয়, দশ জনের মতো হবে। শর্টসার্কিট হয়েছিল।”

“আপনি এত দৃঢ়তার সাথে কী করে বলছেন? আপনি তো তখন খুব ছোটো!”

নিষ্প্রাণ সচেতন চোখে চেয়ে ঝরা হাসল। তেজহীন গলায় বলল—

“এখন তো আর ছোটো নই। বুঝতেও শিখেছি আর মনে রাখতেও শিখেছি।”

নিষ্প্রাণের কথার ধার মিশকাত বুঝল না। বিমূঢ় গলায় বলল—

“আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

নিষ্প্রাণ সোজা হয়ে বসল। আবেশিত গলায় বলল—

“হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ পড়েছেন? আমি ছোটবেলায় ছবিটা দেখেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি। সেদিন রাতে রাবেয়ার সাথে কী হয়েছিল তার একটু ধারণাও আমি করতে পারিনি। মন্টু কেন মাস্টার কাকাকে মারল তাও বুঝতে পারিনি। তবে এখন বুঝতে পারছি। কেন বলুন তো?
কারণ আমি এখন আর দশ বছরের নিষ্প্রাণ মুনতাসির নই। আশা করি আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?”

বিমূঢ় চাহনি মিশকাতের। হতভম্ব সে। নিষ্প্রাণ কী বুঝাইতে চাইল? সে কী তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছে?

সিঁড়ি বেয়ে গুটগুট করে নেমে আসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ ছাড়াও যে অন্য কেউ সেখানে আছে তা ঠাওর করতে পারল না সে। নিমগ্ন দৃষ্টি তার অসহ্যকর মোবাইলে। আদুরে গলায় বলে উঠে—

“দেখ না প্রাণ, সে কখন থেকে ট্রাই করেই যাচ্ছি, কল ঢুকছেই না।”

নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়ায়। আয়েন্দ্রির হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে মৃদু গলায় বলল—

“এখানে গ্রামীনের টাওয়ার নেই। তাই নেটওয়ার্কের বারোটা। আমার মোবাইল নে।”

“না। তুই আমাকে নতুন সিম কিনে দে। বারবার তোর মোবাইল নিতে পারব না।”

“আচ্ছা, দেবো।”

“আয়েন্দ্রি!”

অপরিচিত পুরুষ কন্ঠে চেতন ফিরে আয়েন্দ্রির। অক্ষিপুট কিঞ্চিৎ অশিথিল করে চেয়ে পুরুষটিকে চেনার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। পূর্ণ নজর ক্ষেপন করে স্থির রইল।
মিশকাত প্রফুল্ল হেসে বলল—

“চিনতে পারনি? আমি। মিশকাত। ঝুমু ভাবির দেবর। তোমার কাজিন।”

চমকে মনে পড়ল আয়েন্দ্রির। তার ফুফাতো বোন ঝুমুর একমাত্র দেবর মিশকাত। আয়েন্দ্রি উৎফুল্ল গলায় বলল—

” ও মনে পড়েছে। আপনি! এখানে?”

মিশকাত অধর ছড়িয়ে হাসল। হৃষ্ট গলায় বলল—

“চিনতে পেরেছ তাহলে! এই এলাকার নতুন এস আই। গত সপ্তাসে জয়েন করেছি। কিন্তু তুমি এখানে?”

” শি ইজ মাই ওয়াইফ।”

নিষ্প্রাণের প্রশ্বস্ত গলায় তার দিকে মনোযোগ দিলো মিশকাত। কিছুটা অবাক হলো সে। বিস্ময়ভরা গলায় বলল—

“আপনি আয়েন্দ্রির হাজবেন্ড? কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি আয়েন্দ্রির বিয়ে কোনো প্রফেসরের সাথে ঠিক হয়েছিল।”

গা দুলিয়ে হেসে ওঠে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির অপ্রতিভ চাহনি। দাম্ভিকতার সাথে বলল নিষ্প্রাণ—

“জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে…তিন বিধাতা নিয়ে। যা ওপরওয়ালা লিখেছে তাই হবে। বুঝলেন মি. এএএএস আই।”

চমৎকার করে হাসল মিশকাত। নিষ্প্রাণের সাথে একমত পোষণ করে বলল—

“দিস ইজ রাইট। আচ্ছা, আসি আজ তাহলে। হাজার হোক, নতুন একটা সম্পর্ক তো তৈরি হয়েছে। আই উইশ, আমাদের আবার দেখা হবে!”

“অফকোর্স, হোয়াই নট?”

নিষ্প্রাণের সাথে হ্যান্ডশেক কথে বিদায় নেয় মিশকাত।
,
,
,
বিছানায় সটান হয়ে শুয় আছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি নিজেকে পরিপাটি করছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। মাথাটা একটু উঁচু করে আয়েন্দ্রিকে দেখে নিয়ে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ে নিষ্প্রাণ—

“ছেলটার সাথে কতবার দেখা হয়েছে তোর?”

আয়েন্দ্রি ফট করে পেছন ফিরে বলল—

“কেন?”

“এমনি।”

আয়েন্দ্রি শাড়ির পাড়টা টানটান করে আঁচল কাঁধে ওঠায়। খেয়ালিপনায় বলল—

“একবার। আপুর বিয়ের সময়। এরপরে আর কখনো দেখা হয়নি।”

“কত বছর হয়েছে বিয়ের?”

“প্রায় পাঁচ বছর।”

“পাঁচ বছর পর তোকে দেখেই চিনে ফেলল?”

আয়েন্দ্রি ডাসা ডাসা চোখে চেয়ে বলল—

“কারণ ও তোর মতো গবেট মস্তিষ্কের না। এস আই বুঝলি। পুলিশ।”

আয়েন্দ্রি ততক্ষণে বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কোমল হাতে এক টান মারতেই আয়েন্দ্রির কোমলাঙ্গ দেহ নিষ্প্রাণের বুকে উপর এসে পড়ে। তাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় নিষ্প্রাণ।

“আমি গবেট?”

“হুম।”

আয়েন্দ্রির কপালে চুমু আকে নিষ্প্রাণ। মায়াময় গলায় বলল—

“এই গবেট তোকে ভালোবাসে।”

আয়েন্দ্রি চিলতে রোদের মতো হাসে। নিষ্প্রাণের নাকের সাথে নাক ঘষে বলল—

“আমিও।”

হৃদয় ভেজা হাসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে। মায়াবী, কুহেলিকা চাহনি। ফট করেই হেসে ফেলে আয়েন্দ্রি। হাসি হাসি ঠোঁটে বলল—

“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

“তোকে দেখি।”

“ওরে আমার পিচ্চি বর! ছাড় !”

“তবুও তোর থেকে দুই বছরের বড়ো আমি।”

“জি… উদ্ধার করেছেন আমাকে।”

চোরা হাসল নিষ্প্রাণ। হাতের বেড় শক্ত করতেই আয়েন্দ্রি মিশে গেল নিষ্প্রাণের বুকের পাটাতনে। নৈঃশব্দে গহন শ্বাসক্রিয়ায় চলছে একে অন্যকে বিদীর্ণ করা তীক্ষ্ম প্রেমময় বাণ। কেমন অদ্ভুত, আবেশিত, সিক্ত চোখে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। কন্ঠনালীতে সহস্র দিবস ধরে জমে থাকা অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে অনুরক্তির সুরে বলল—

“আমি তোকে ভালোবাসি। সত্যিই ভালোবাসি ধ্রুবতারা। আমার যুগ ধরে চলা হাজারও মিথ্যের মায়াকাহনে একমাত্র সত্য তুই। আমার মোহাচ্ছন্ন উদ্দেশ্যহীন জীবনের একমাত্র গন্তব্য তুই। তুই আমার ধ্রুবতারা। শুধু আমার।”

আয়েন্দ্রি ঘোর লাগা চোখ নত হয় কিয়ৎপলেই। নেমে আসে উজ্জ্বল আলোয় প্রেম বিলাসের মাহেন্দ্রক্ষণ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here