ফেরারি প্রেম পর্ব-৫৭

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৫৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“একদম হিসেব বরাবর করতে আসবিনা আমার সাথে! এটা পার্ক না হলে এখন তোর গাল কামড়ে দিতাম আমি! বৌ সেজে বসেছিলাম কারণ আমি জানতাম তুই আসবি! ভাইয়া আমাকে শান্তনা দিয়েছিল যেভাবেই হোক তুই আসবি। তাই আমি টেনশন ফ্রি ছিলাম। একদম ভাব দেখাবিনা আমার সাথে। মনে নেই কাল রাতে যে কামড়টা দিলাম? এখনও তো কালসিটে দাগ পড়ে আছে নাকে! সো বি কেয়ারফুল ওকে?”

হতবাক রূপল! নির্লিপ্ত, নির্বিকার। পার্ক ভর্তি লোকজনের সামনে এই মেয়ে এখন তার কোলে ওঠে বসবে না-কী? লাজ শরমের ফালুদা করে ছাড়বে মনে হচ্ছে। কেন ক্ষ্যাপাতে গেল রূপল এই মাথা ভাঙা উড়নচণ্ডীকে? বড্ড আফসোস হচ্ছে যে! চোখ থেকে তো আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে মেয়েটির। সেই আগুনে নির্দ্বিধায় জ্বলে পুড়ে ভৎস হয়ে যাবে রূপল। এক্ষুণি এই জ্বলন্ত শিখাকে পাশ থেকে সরাতে হবে। ভয়ে ভয়ে কে-ই বা মরতে চাইবে? এছাড়াও এই মুহূর্তে রূপলের হৃৎস্পন্দনের অবস্থা খুবই নাজুক। যেকোনো মুহূর্তে বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা শতাধিক! পুরুষ মানুষের মন বলে কথা! মেয়ে মানুষ এত কাছাকাছি চলে এলে তো তারা বেসামাল হয়ে পড়ে। উত্তেজনা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যায়!

এতটুকুনিতেই এসে রূপল তার ভাবনাচিন্তায় তালা লাগালো। গলা ঝাকিয়ে শার্টের কলারটা ঝেড়ে ঠিক করল। উত্তেজনা হোক বা ভীতসন্ত্রস্ততা কোনোটিই বুঝাতে চাইলনা নীহারিকাকে! গলায় কঠোরতা আনার চেষ্টা করে বলল,

“কী হচ্ছে কী নীহু? এটা একটা পার্ক, পাবলিক প্লেস। তুমি এখানে এসেও আমার পিন্ডি চটকাচ্ছ? সব জায়গায় আমার প্রেস্টিজ পাংচার না করলে তোমার হয়না?”

সম্বিত ফিরে পেল নীহারিকা। টুক করে যেন আকাশ থেকে জমিনে পরল। আশপাশে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল লোকজন তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে চলতি পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তবে কারো মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ তো কারো মুখশ্রীতে দুষ্টু হাসির ছাপ! তাৎক্ষণিক রূপলের পাশ থেকে কয়েক ইঞ্চি সরে এলো নীহারিকা। মাথা নুইয়ে চুল ঠিক করল। দাঁত গজগজিয়ে রূপলকে লক্ষ্য করে বলল,

“আপনি জেচে পড়েই বার বার ইনসাল্ট হতে আসেন ওকে? পাবলিক প্লেসেও বাধ্য করলেন নিজেকে হাসির খোঁড়াক বানাতে। মুখে সারাক্ষণই হট হট মেয়েদের কথা ওঠে থাকে। তাদের নাম জপ করতে করতে মুখে ফেনা ওঠে যায়! এত হট হট মেয়ে চাইলে আবার আমাকে ফোসলাচ্ছেন কেন? আমার ভাইয়ার কাছে সময় চাইলেন কেন? তখনই বলে দিতে পারতেন যে আপনার হট হট মেয়ে পছন্দ। আমার মত জ্বলে পুড়ে আঙরা হয়ে যাওয়া কয়লা কালার মেয়ে নয়!”

“আরে বাবা তুমি সিম্পল জিনিসটা বুঝোনা কেন? তুমি কী আর কম হিটে, কম আগুনে জ্বলে পুড়ে কয়লা হইছ? তোমার মধ্যে হটনেসও যেমন বেশী তেমনি আগুনও বেশী! অন্য মেয়েরা তো শুধু রূপের আগুনে জ্বলে আর তুমি তো শুধু জ্বলোনা রে ভাই তুমিতো রূপের আগুনে জ্বলেপুড়ে কয়লা হয়ে যাও! সাথে পুরুষদের মনকেও কয়লা করে ছাড়ো! এবার বুঝো তোমার রূপের কত উত্তাপ? জাস্ট ইমাজিন, আমি কতটা লাকী?”

রূপলের এই আকাশ ছোঁয়া প্রশংসাতেও সন্তুষ্ট হলোনা নীহারিকা! ভ্রু যুগল কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। দ্বিধাহীন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এসব কী আপনি মন থেকে বললেন? না-কী নিজেকে বাঁচানোর জন্য বললেন? কোনটা?”

নীহারিকার উদ্ভট প্রশ্নে মনের দিক থেকে ধাক্কা খেলো রূপল! রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো প্রশ্নবিদ্ধ নীহারিকার দিকে। আঘাতপ্রাপ্ত গলায় বলল,

“মেয়ে দেখেছি জীবনে অনেক। কিন্তু তোমার মত উদ্ভট মেয়ে দেখি নাই! মন থেকে, হৃদয় থেকে, অন্তর থেকে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এত প্রশংসা করলাম তবুও তোমার মনে সন্দেহ কাজ করছে? আমার ভালোবাসাও কী তোমার কাছে সন্দেহের মনে হয়?”

“ভালোবাসেন কবে বলছেন? জোর করেও কী ঐ ওয়ার্ডটা আপনার মুখ থেকে এই অবধি একবারও শুনতে পেরেছি?”

মৌন রইল রূপল। অযথা কথা বাড়াতে চাইলনা নীহারিকার সাথে। শুধু হাত বাড়িয়ে নীহারিকার হাতটা তার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরল! ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রূপল আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“হার্টবিট কতটা দ্রুত গতিতে বিট করছে বুঝতে পারছ তো? এর থেকেই বুঝে নাও তোমার প্রতি আমার অনুভূতি কতটা গাঢ় ও নিগূঢ়। একে ভালোবাসা বলে না-কী জেচে এনে নিজের সর্বনাশ করা বলে জানিনা আমি! তবে এতটুকুই জানি আমি মুখে মুখে ভালোবাসি বলা এই কথাটিতে বিশ্বাসী নই! ভালোবাসি তা যদি আমি কাজে ক্ষেত্রে বুঝাতে পারি তবে একেই আমি ভালোবাসা বলি। যেদিন তোমাকে আমি বিয়ে করে আমার ঘরে তুলতে পারব হ্যাঁ সেদিনই আমি বুকে সাহস রেখে নির্দ্বিধায় বলতে পারব আমি তোমাকে ভালোবাসি! যাকে আমি ভালোবেসেছি তাকে নিজের করে পেয়েছি। যেদিন তোমাকে নিজের করে পেয়ে আমি পূর্ণ হবো? সেদিন পুরো দুনিয়া আমার ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়ে থাকবে! ভালোবাসি কথাটি তখন মুখে বলে কয়ে বেড়াতে হবেনা। তবে এক্ষেত্রে তোমার কনসেপ্টও ভিন্ন হতে পারে। একেক জনের অনুভূতি একেক রকম হয়। তেমনি ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিও একেক রকম হয়।”

সম্মোহিত চাহনি নীহারিকার। রূপলের পানে সে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ হলো সে রূপলের কথায়। ভেবে দেখল সত্যিই তো, মুখে মুখে ভালোবাসি বলে কয়জনই বা সেই ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে পেরেছে? কাজে প্রকাশ করে দেখানোর মাঝেই তো সত্যিকারের ভালোবাসা নিহিত রয়েছে। যদিও নীহারিকা বহু আগেই প্রমাণ পেয়ে গেছে রূপল তাকে কতটা গভীরভাবে ভালোবাসে! তবুও মুখ থেকে শোনার ব্যাপারটা হলো আলাদা।

কথা শেষে রূপল নীহারিকার পাশ থেকে ওঠে দাড়ালো। অচিরেই নীহারিকা তার হাতটি গুটিয়ে নিলো। হৃদি যে সেই কখন নীহারিকার পাশ থেকে ওঠে পার্কের এদিক থেকে ওদিক ছুটোছুটি করছে সেদিকে কারোর খেয়াল-ই নেই! হৃদি তার মত কয়েকজন সমবয়সীকে দেখে তাদের সাথে মিলেমিশে খেলাধূলা করছে। দৌড়োদৌড়ি করতে গিয়ে না আবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় সেই ভয়ে রূপল সেখান থেকে হৃদিকে ধরে আনল! মন খারাপ করে হৃদি রূপলের পিঠে কিল ঘুষি দিতে লাগল! কান্না করে বলল,

“প্লিজ রূপল বাবা আমাকে ওখানে যেতে দাও। আমি খেলা করব।”

“শাট আপ হৃদি। স্কুলেও আজ অনেক খেলাধূলা করেছ। এত বেশী দৌড় ঝাপ করলে তোমার পা ব্যথা করবে। দৌড়োতে গিয়ে পরে গেলে তো হাত পা ও ছিলে যাবে। তখন কী হবে হ্যাঁ? চুপচাপ এখন আমার সাথে চলো। ঐদিকে তো তোমার নীহা মা তোমাকে ফেলে আইসক্রীম খেয়ে ফেলল!”

আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে রূপল হৃদিকে তার বসে আনল! অমনি হৃদি কান্নাকাটি থামিয়ে দিলো। ব্যস্ত স্বরে রূপলকে বলল,

“আরে বাবা তাড়াতাড়ি হাঁটো না। নীহা মা তো আমাকে ফেলে সব আইসক্রীম খেয়ে ফেলল!”

পার্কে থাকা একটি আইসক্রীমের স্টল থেকে রূপল তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভারের কোণ আইসক্রীম কিনল। রূপলের হাত থেকে হৃদি টেনেটুনে একটি কোণ আইসক্রীম আগেই কেড়ে নিলো। বাকী দুটো আইসক্রীম হাতে নিয়ে রূপল বেঞ্চে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা নীহারিকার দিকে এগিয়ে গেল। আইসক্রীম দুটি রূপল নীহারিকার মুখের সামনে ধরল। ব্যগ্র স্বরে বলল,

“নিন ম্যাম। আপনার ফেভারিট কোণ আইসক্রীম।”

নির্জীব অবস্থায় নীহারিকা রূপলের হাত থেকে আইসক্রীম দুটি নিলো। ভ্যাপসা গরমে বেশ ঘামাচ্ছিল নীহারিকা। সরাসরি রোদের আলো তার চোখেমুখে পরছিল। অথচ এই জায়গাটা কিছুক্ষণ আগেও শিথিল ছিল। রোদের ছিটেফোঁটাও ছিল না। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে রূপল তার টিস্যুর প্যাকেটটি বের করল। প্যাকেটটি নীহারিকার দিকে এগিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,

“ঘামটা মুছে নাও। অনেক ঘামাচ্ছ আজ।”

রূপলের কোলে থেকে হৃদি বেশ জ্বালাতন করছিল! আইসক্রীম ফেলে দিচ্ছিল রূপলের শার্টে। যদিও এতে রূপল বিরক্ত হচ্ছিলনা। শার্ট থেকে আইসক্রীমগুলো হাত দ্বারা মুছে নিচ্ছিল। তখনই হৃদি বিড়বিড় করে রূপলের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“বাবা? আমাকে কিন্তু তুমি আরেকটা আইসক্রীম কিনে দিবে! নীহা মা কে তো দুটো আইসক্রীম দিলে।”

নমনীয় গলায় রূপলও হৃদির কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“তুমি কী নীহু মায়ের সাথে হিংসে করছ মা? যদি করেও থাকো তাহলে বলব পরেরবার থেকে আর তাকে নিয়ে জেলাস ফিল করবেনা! মায়ের সাথে জেলাসি দেখাতে নেই বাবা! বাড়ি ফেরার সময় তোমাকে আমি আরও অনেকগুলো আইসক্রীম কিনে দিব ওকে? কিন্তু এখন তো তোমার আইসক্রীমটা গলে যাচ্ছে হৃদি। একটু কেয়ারফুললি খাও।”

রূপল হৃদিকে আরও অনেক আইসক্রীম কিনে দিবে এই কথা শুনে হৃদি চট করে হেসে দিলো। খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে রূপলের গালে চুমু খেলো। বিড়বিড় করে বলল,

“ঠিক আছে বাবা। আমি আর কখনও নীহা মায়ের সাথে জেলাসি করবনা! তুমি কিন্তু আজ আমাকে অনেকগুলো আইসক্রীম কিনে দিবে।”

রূপলের হাত থেকে টিস্যুটি হাতে নিলো নীহারিকা। পার্কে থাকা কতগুলো মেয়ে রূপলের দিকে কেমন যেন আড়চোখে তাকাচ্ছিল! ইশারায় কী যেন বলছিল তারা! নীহারিকা অনেকক্ষণ যাবত এই ব্যাপারটা নোটিশ করছিল। রেগেমেগে সে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। টিস্যুর প্যাকেট থেকে একটি টিস্যু বের করে সেই টিস্যুটি রূপলের দিকে এগিয়ে দিলো! রুক্ষ গলায় বলল,

“দেখি মুখটা মুছে দিন!”

অবাক হলো রূপল! নির্বোধ দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। তবে প্রশ্ন করলনা! কারন রূপল জানে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া নীহারিকা রূপলকে জনসম্মুখে এই কাজ করতে বলবে না। নীহারিকার মুখ মুছাতে মুছাতে রূপল এদিক ওদিক তাকালো। তখনি দেখল কিছু মেয়ে মুখ ফুলিয়ে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রয়েছে! পিল চমকে গেল তাদের! তাহলে কী ছেলেটির গার্লফ্রেন্ডও আছে? বাঁকা হাসির রেখা নীহারিকার ঠোঁটে। উদ্দেশ্য দারুনভাবে সফল হলো তার! নীহারিকার চালবাজি বুঝে রূপল চাপা হাসল। তবে তা নীহারিকা বা মেয়ে গুলোকে বুঝতে দিলোনা।

রূপলের কোল থেকে নেমে গেল হৃদি। দাড়িয়ে দাড়িয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে আইসক্রীম খেতে লাগল। নীহারিকা একটি আইসমক্রীম মুখে দিতে দিতেই হৃদির আইসক্রীম শেষ হয়ে গেল! তখনি নীহারিকা তার অন্য আইসক্রীমটি হৃদিকে দিয়ে দিলো। খুশি হয়ে গেল হৃদি। নীহারিকার হাতে চুমু খেয়ে বলল,

“থ্যাংকস নীহা মা। তুমি এত্তগুলা ভালো!”

হৃদির পেছনে পেছনে রূপল ও নীহারিকা হাঁটতে লাগল। রূপলকে অনেক জোরাজুরি করেও নীহারিকা আইসক্রীম খাওয়াতে পারলনা। আইসক্রীম তেমন একটা পছন্দ নয় রূপলের! তার মতে আইসক্রীম হলো মেয়েদের খাবার জিনিস। রাস্তায় বের হলে ছেলেদের জন্য তো সিগারেটই সই! এই মুহূর্তে রূপলের সিগারেট খাওয়ার অনেক নেশা উঠল! তবে সুযোগ পাচ্ছেনা সে একান্তে গিয়ে কোথাও দু-এক টান মেরে আসার!

সুযোগ বুঝে রূপল নীহারিকার হাতটি ধরল। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটার মনবঞ্চা তাকে চেপে বসল। অমনি নীহারিকা ঝট করে রূপলের হাত থেকে তার হাতটি ছাড়িয়ে নিলো! আমতা আমতা করে বলল,

“হাত ধরছেন কেন? দেখছেন না এটা একটা পাবলিক প্লেস?”

“ন্যাকামি বন্ধ করো তো! হাতটা দাও।”

“কী বললেন? আমি ন্যাকামি করি?”

“তাহলে হাতটা ছাড়ালে কেন?”

“ন্যাকামি কাকে বলে আপনি জানেন?”

“তুমিই বলে দাও।”

“তাহলে শুনুন। যদি আমি আপনাকে কথায় কথায় বাবু বলে ডাকতাম, চব্বিশ ঘণ্টা ফোন করে আপনাকে জ্বালাতন করতাম আর বলতাম বাবু তুমি কেমন আছো, কী করো, খাইছ, হাগছ? তুমি না খেলে কিন্তু আমিও আজ খাবনা বাবু! অথচ ভেতরে ভেতরে সব খেয়ে সাবাড়! এরপর তো এখন আবার নতুন ট্রেন্ড চালু হয়েছে নিব্বারা না হাগলে নাকী নিব্বিরাও হাগবেনা! আরও আছে। জান তুমি না বললে কিন্তু আমি এদিকে যাবনা ঐদিকে যাবনা। বাবু আমার হাত কেটে গেছে কিসি দিয়ে দাও! সেরে যাবে। এসবকে ন্যাকামি বলে বুঝেছেন?”

“তো করো না একটু ন্যাকামি! ছেলেরা তো এসব বিষয়ে একটু বেশিই মজা পায়!”

রূপলের ঠোঁটে ক্রুর হাসির রেখা দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেল নীহারিকার। ধপাধপ পায়ে হেঁটে সে সামনে আগাতে লাগল। তখনি কাকতালীয়ভাবে লামিয়ার সাথে দেখা গেল তার! কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে এসেছে। যদিও নীহারিকা জানেনা লামিয়া তাকে দেখেছে কী-না! লামিয়াকে এক ঝলক দেখামাত্রই নীহারিকা পিছু ঘুরে গেল! ছুটে গিয়ে রূপলের মুখোমুখি দাড়ালো। রূপলকে আড়াল করার চেষ্টা করল! উজবুক দৃষ্টিতে রূপল নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“হোয়াট?”

“কিছুনা। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরাবেন না একদম! শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকুন।”

“আরে হইছেটা কী বলবা তো?”

“যা বলেছি তা শুনুন। আমার কথার বাইরে গেলে কিন্তু মাথার চুল একটাও থাকবেনা।”

স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে রইল রূপল! নীহারিকার হুমকিতে চুপসে গেল সে! যে মেয়ে সামান্য রাগ থেকে নাকে কামড় বসাতে পারে সেই মেয়ে যে তার কথার এদিক ওদিক হলে চুলও ছিঁড়ে ফেলতে পারবে সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই! এই বয়সে ন্যাড়া হওয়ার শখ নেই তার। নীহারিকা যতই রূপলকে লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন লামিয়া ঠিকই তার বান্ধবীদের রেখে নীহারিকার চোরামি ধরতে তড়তড়িয়ে চলে এলো রূপলের কাছে! নীহারিকাকে উপেক্ষা করে লামিয়া গলা ঝাকিয়ে মৃদু স্বরে রূপলকে বলল,

“আপনি মিস্টার রূপল না?”

তবুও ঘাড় ঘুরালোনা রূপল! দু-একবার চোখের পাতা ফেলে নীহারিকার দিকেই তাকিয়ে রইল। দাঁত কিড়মিড়াতে লাগল নীহারিকা! রাগে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। লামিয়ার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসল। রূপলের জবাবে নীহারিকা বলল,

“হ্যঁ। ইনি মিস্টার রূপল। কেন চিনতে পারছনা?”

তখনই ক্ষিপ্ত গলায় লামিয়া বলল,

“শোন নীহা? তোর সাথে কথা বলতে আমি ইন্টারেস্টেড না! আমি মিস্টার রূপলের সাথে কথা বলতে এসেছি। কথা বলা হয়ে গেলেই চলে যাব।”

তখনও রূপল লামিয়ার দিকে ফিরে তাকালোনা! নীহারিকার দিকেই তাকিয়ে রইল৷ রূপলের দিকে রোষভরা চাহনিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল নীহারিকা। অপকট সুরে বলল,

“নিন কথা বলুন। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছেন ইনি।”

মুভ হলো রূপল! রুদ্ধশ্বাস ফেলে লামিয়ার দিকে তাকালো। রূপলের দিকে তাকিয়ে লামিয়া লাজুক হাসল। সামনে পরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে বলল,

“আজ সকালে কী আপনিই আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন?”

সকাল থেকেই রূপলের ফোনটা হৃদির কাছে ছিল। হয়ত তখনই ফোন ঘাটতে গিয়ে কোনোভাবে লামিয়ার কাছে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট চলে গেছে। তাই রূপল গলা ঝেড়ে বলল,

“হ্যাঁ ঐ আর কী….

রূপলকে বৃত্তান্ত খুলে বলার সুযোগ দিলোনা নীহারিকা! রাগে ফোঁস করে ওঠে সে সামনে হাঁটা ধরল। নীহারিকার রাগের কারণ বুঝতে পেরে রূপল পিছু নিলো নীহারিকার। পেছন থেকে অস্থির গলায় নীহারিকাকে ডেকে বলল,

“আরে নীহু শোনে? আমার পুরো কথা তো শুনে যাবে?”

পেছনে ফিরেও তাকালো না নীহারিকা! দ্রুত পা ফেলে সে পার্ক থেকে বের হয়ে গেল। মাথায় হাত চলে গেল রূপলের। লামিয়ার উপর রাগের মাত্রা বেড়ে গেল তার। পিছু ঘুরে তেড়ে গেল সে লামিয়ার দিকে। ঝাঁজালো গলায় বলল,

“আপনার জন্যই আজ আমার সংসারে অশান্তি বাঁধল! ইউ ইডিয়ট গার্ল!”

লামিয়াকে তাতিয়ে দিয়ে রূপল হৃদিকে কোলে তুলে পার্ক থেকে বের হয়ে গেল। নীহারিকার অস্তিত্বও কোথাও খুঁজে পেলনা সে। ফোন করেও নীহারিকাকে পেলনা। তবে ধরে নিলো নীহারিকা হয়ত বাড়ি চলে গেছে। কিছুক্ষণ পর মারজিনা বেগমের নাম্বারে কল করলেই সে কনফার্ম হবে।

হৃদিকে নিয়ে বাইকে ওঠে রূপল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে নীহারিকার জন্য যেমন চিন্তা হচ্ছিল তেমনি রাগও কাজ করছিল। এই প্রথম নীহারিকার কোনো কাজে রূপল অসন্তুষ্ট হলো। অন্তত তার পুরো কথাটা তো একবার শুনবে? হুটহাট করে রেগে গেলেই কী চলবে?

______________________________________

মাঝখানে কেটে গেল দুইদিন। নীহারিকা এখনও রূপলের উপর রেগে আছে! রূপলের ফোন কল কিছুই তুলছেনা সে। তবে এর পেছনেও একটা কারণ লুকিয়ে আছে! পিয়াসাকে পরীক্ষা করতে চাইছে সে! নীহারিকা যেদিন থেকে রূপলের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছে সেদিন থেকেই পিয়াসা বেশ স্বাভাবিকভাবে আচরণ করছে নীহারিকার সাথে! এই থেকে তার বুঝতে সুবিধা হলো যে পিয়াসা ভেতরে ভেতরে কোনো চাল চালছে! সেদিন রূপলের ফোন থেকে পিয়াসাই হয়ত লামিয়াকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল! পিয়াসা তো সেদিন তার বাপের বাড়িতেই ছিল। তাই এটা অসম্ভব কিছু নয়। আর এই কাজে পিয়াসার সাথে লামিয়াও জড়িত ছিল! ঝামেলা বাঁধানোর জন্য সেদিন লামিয়া উদ্দেশ্যপ্রবণভাবে পার্কে গিয়েছিল। সুযোগ বুঝেই লামিয়া নীহারিকার সামনে সেই প্রসঙ্গটি তুলেছিল। যেন নীহারিকা রেগে যায়। তাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়! সব বুঝেও নীহারিকা এখন চুপ করে আছে! পিয়াসা ও লামিয়াকে সুযোগ দিতে চাইছে। যখন সে দুজনকেই প্যাচে পাবে তখনই সুযোগ বুঝে সে দুজনকে প্যাঁচিয়ে ধরবে!

ইদানিং পিয়াসা সারাক্ষণ লামিয়ার সাথে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকে। বিষয়টা বহুবার নীহারিকার চোখেও পরেছে। বাড়ি থেকেও হুটহাট বের হয়ে যাচ্ছে পিয়াসা। আজ বিকেলের দিকেও পিয়াসা বাসায় নেই। ঘুম থেকে ওঠে নীহারিকা পিয়াসাকে কোথাও খুঁজে পেল না। চা খেতে খেতে নীহারিকা তার মায়ের ঘরে গেল। কৌতূহলী গলায় শুধালো,

“ভাবি কোথায় মা?”

আলমারিতে কাপড় গোছাতে ব্যস্ত মারজিনা বেগম। তাই তিনি বেশ ব্যস্ত সুরেই বললেন,

“বলল তো বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে। আশেপাশের কোনো একটা ফ্লাটে নাকী তার বান্ধবী জামাই নিয়ে উঠেছে। তাই তাকে দেখতে গেছে।”

“ওহ্ আচ্ছা।”

মারজিনা বেগমের কথায় জোর পেলনা নীহারিকা। দ্বিধা নিয়ে সে চা খেতে খেতে ড্রইংরুমে গেল। সোফায় বসে টিভি ছেড়ে দিলো। চ্যানেল পাল্টে পাল্টে মুভি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরল। চারিদিকে তখন মাগরিবের আযান পরে গেল অথচ এখনও পিয়াসা বাড়ি ফিরলনা! বিচলিত হয়ে উঠলেন মারজিনা বেগম। নীহারিকার সন্দেহ এবার প্রগাঢ় হলো। সে তার মাকে কিছু না জানিয়েই এই ভর সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল!

লামিয়াদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে নীহারিকা কলিং বেল চাপল! কাজের বুয়া এসে দরজা খুলে দিলো। বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতেই বুয়া আবার রান্নাঘরে চলে গেল। যেহেতু বুয়া নীহারিকাকে চিনে তাই কোনো প্রশ্ন করলনা নীহারিকাকে। যেতে যেতে শুধু নীহারিকাকে বলে গেল,

“উপরে যান আফা। বাড়ির সবাই উপরেই আছে।”

বিশাল বড়ো বাড়ি লামিয়াদের। লামিয়ার বাবা পেশায় একজন পলিটিশিয়ান। এলাকায় সবচেয়ে বড়ো বাড়ি লামিয়াদের। ক্ষমতাও কম নয় তাদের। সিঁড়ি ভেঙে দু’তলায় উঠতেই পা ধরে গেল নীহারিকার! এই পা ব্যথা নিয়ে নীহারিকা দু’তলায় উঠতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠল! লামিয়ার গোটা পরিবারের সামনে লামিয়ার বড়ো ভাই রাহুল পিয়াসার গালে একের পর এক চ’ড় থা’প্প’র মারছে! কেউ তাকে আটকাচ্ছেও না পর্যন্ত। পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুধু রঙ তামাশা দেখছে! একের পর এক চড় খেয়ে পিয়াসা ব্যথায় কুকড়ে উঠল। নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হতে লাগল। মৃদু চিৎকার করে লুটিয়ে পরল মাটিতে!

এই মুহূর্তে কাউকে মানার সময় নেই নীহারিকার! হাতের কাছে পিছার ঝাড়ু পেতেই নীহারিকা হুড়োহুড়ি করে ঢুকে গেলে রুমে! তেড়ে গেল লামিয়ার বড়ো ভাইয়ের সামনে। উপস্থিত সবাই থতমত খেয়ে গেল! ঝাড়ুটা নীহারিকা রাহুলের মুখের সামনে ধরল। আক্রমনাত্নক গলায় বলল,

“এবার মে’রে দেখান আমার ভাবিকে! দেখব কত বড়ো ক্ষমতা আপনার। ইউর টাইম ইজ স্টার্ট নাও ইউ ব্লা’ডি, বি’চ!”

#চলবে…?

[পিয়াসা শ্যাষ!🥲]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here