#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
পর্বঃ১১
–” আমার সেই প্রাক্তনের মতে আমি চরিত্রহীন। অন্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আমার ওরসজাত সন্তান নাকি তার নয়!”
–” হুম তারপর তার সঙ্গে বিচ্ছেদ?”
–“হুম,”
–” তাহলে বাচ্চাটি কার কাছে ?”
–” সে নেই,”
–” নেই মানে? ঐ বাচ্চাটিকে আপনার কাছে আনলেন না কেন? যেখানে তার বাবাই তাকে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় অস্বীকার করেছে। সেখানে ঐ বাচ্চাটা তার বাবার কাছে ঐ পরিবারের কাছে থেকে বাচঁতে পারবে?”
—” সেই বাচ্চাটাই তো নেই, মাতৃগর্ভেই তার নিশ্বাস শেষ!”
স্তব্ধ হয়ে পরল ফাইয়াজ, কি বলবে সে বুঝতে পারছেনা। চেয়ে আছে সে কোমল মেয়েটির দিকে। ঠোট দুটো তিরতির করে কাপছে মেয়েটির। টুপ করে এই বুঝি গড়িয়ে পরল চোখের কোণায় জমা থাকা জল। ফাইয়াজ মেয়েটির চোখে থাকা সেই জল গুলোকে যদি একটু মুছে দিতে পারতো। এমন চোখে যে জল গড়িয়ে পরা নিষেধ। অধিকার থাকলে হয়তো জলগুলোকে সযত্নে মুছে দিয়ে বলতো –
-‘ভিজে যাওয়া চোখে আপনাকে মানায় না বিভাবতী! আপনার ঐ মারাত্মক দুটো চোখ যে প্রাণখুলে হেসে দেওয়ার চোখ! আপনি তো জানেন না আপনি যখন হাসেন আপনার চোখদুটো ও যে হেসে উঠে। ঐ চোখদুটোও কেমন মিটিমিটি করে হেসে উঠে।ভিষণ ভালো লাগে সেই দুটো চোখকে এমন করে হাসতে দেখলে । এভাবে কাদঁলে যে ভালো লাগে না।’ কিন্তু, কিছুই বলতে পারল না সে চেয়ে থাকা ছাড়া যে কিছুই করার নেই তার এই সময়ে।
তাই চুপকরে মেয়েটির নিরব অশ্রুমাখা চোখ জোড়ায় চেয়ে রইল।
বিভা চোখের পানি মুছে বলল –
–জানেন, ভালোবাসা না বড় কঠিন জিনিস!যাকে একবার এই হৃদয়ে স্থান দিয়ে দিবেন। সে কালো, সুন্দর, সাবলম্বি না গরিব না ধনী এগুলো আপনার মনে কখনও আসবে না। তখন আপনি তাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসবেন, ভালোবেসেই যাবেন। আসলে তখন তো আপনার মনে তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আর মুগ্ধতা কাজ করবে। কিন্তু সেই মানুষটা যখন আপনার সেই ভালোবাসার দাম দিবে না তখনই সে হয়ে উঠবে ঘৃণার। ঘৃণাটা হয়তো থাকতো না।
চোখের পানিটা মুছে আবার বলতে লাগল –
“আমি তো তার জন্যই সেখান থেকে চলে এলাম। শুধু মাত্র ঐ একটা ডাক একটা শব্দে কেউ আমাকে ডাকুক। সেই ডাক শুনার জন্যই তো চলে এলাম এই শহরে দেখুন ভাগ্যের কি পরিহাস তাকে আমি রাখতে পারলাম না।
যে সন্তান নিয়ে আমার এতকিছু সেই সন্তানকে কিনা আমার স্বামী মারতে একটি ছক কষেছেন! তবুও আমি কিছু ভাবিনা হয়তো তার মনে আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আমাদের সন্তান এলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তার উল্টো টাই হলো। শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার প্রাক্তন আমাকে হত্যা করার ছক করেছিলেন।
কত কথা যে আমাকে শুনতে হয়েছে তার কাছ থেকে। ও বাড়ি ছেড়ে আসার পর আশ্রিতা হিসেবে ছিলাম, সেখান থেকে বেড় হওয়ার পরেই তো আমার সন্তানকে হারালাম। আমার সন্তানটাকে হারিয়ে যেন আমি উন্মাদ হয়েগিয়েছিলাম জানেন! মনে হতো এই বুঝি সে ডাকছে। খুব করে মা, মা, সুর তুলে ডাকে।
একটা সন্তান যখন গর্ভাবস্থায় মারা যায় তখন যে কত কষ্ট হয় সেই মায়ের আমি আপনাকে বলতে
পারব না। সেই কষ্টের মাঝে একটু সুখের আর ছায়া হয়ে এসেছিল আমার বাবা কিন্তু, তবুও কিছু লোক আমার বাবাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলতো। কারোর তো আমার সামনেই কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে না বসলেই হতো না। প্রচলিত কথা–“অতি সুন্দরী রমনী -না পায় বর ”
“অতি ঘরণী -না পায় ঘর” আমার দশাটা ও না ঐ একই রকম
–“এত গভীর সম্পর্কে কিভাবে এমন হয়?”
–“গভীর তো হয়েছিল তবে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক হয়ে উঠেনি, তাই হয়তো দেখতে দেখতে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ”
–” খুব নড়বড়ে ছিল বিশ্বাস, আপনার প্রাক্তনের কথা বলছি। এত নড়বড়ে বিশ্বাস নিয়ে কাউকে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসলে মন প্রাণ উজাড় করে বাসতে হয়।
যদি সেই মানুষটা ধোকা দেয় তাহলে ভাববেন যে সে কখনই জিতেনি। উল্টো সে হেরেগেছে! আপনি ঠকেননি সে ঠকেছে আপনার হৃদয়ের গভীরে যে স্থান ছিল সে হারিয়েছে। এমন গভীর ভালোবাসার জন্য তার যোগ্যতা নেই। ”
–” হুম হয়তো সেটাই, আপনার এই সুন্দর সকালটা নষ্ট করার জন্য আমি দুঃখিত। হয়তো এমন কিছু শুনবেন বা এমন কিছু জানতে হবে তা আপনি আশা করেননি। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়তো সে ও এমন কিছু আশা করতো না। বা তার ও মন খারাপ হয়েযেত।”
ফাইয়াজ চমকে উঠল বিভার কথা শুনে। বিভার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল বিভা স্বাভাবিক ভাবেই সব বলছে।
ফাইয়াজের হঠাৎ রাগ হলো। এই ধরনের চিন্তা আর মনোভাব কিভাবে একজন মানুষ নিজের মধ্যে পোষণ করতে পারে? সবার সঙ্গে তাকে ও মিলিয়ে দিল? ফাইয়াজ চুপচাপ চা টা খেয়ে উঠে দাড়ালো।
বলল-
–” সব মানুষ এক নয়, এই একতার মাপ কাঠিটা অন্তত সবার সঙ্গে মেলাবেন না।”
–” দেখুন এটা আমি এই জন্য বলেছি, আমি জানি প্রত্যেকটি মানুষ তার জীবনসঙ্গী সমন্ধে সবকিছু জানতে চায় তাই আমি বললাম। ”
ফাইয়াজ বিভার থেকে মুখ সরিয়ে দোকানদারের হাতে চায়ের বিল মিটিয়ে বলল –
মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ কি জানেন?
-সম্মান,লজ্জা, বা চরিত্র!!
তারপর? আর কি হতে পারে? চোখ? নাক? না জিহ্বা?
–“আচ্ছা আমিই বলছি আপনাকে, জিহ্বা! শুনতে অদ্ভুত লাগছে না? জিহ্বা সম্পদ হয়?
হুম হয়,ভেবেদেখুন তো প্রতিনিয়ত আপনাকে প্রায় সবার সাথে কথা বলতে হয়।আপনি কারো সঙ্গে ভালো কথা বলছেন জিহ্বা দিয়েই তো বলছেন!
কাউকে তো আর আঘাত করছেন না।
আপনার প্রতিটা স্বরবর্ন ব্যাঞ্জন বর্নই কিন্তু সেই জিহ্বা দিয়ে চালিত হয়।
আর সেই বাক্য বা কথা দিয়ে আপনি ছুরির মত কাউকে অনায়াসে আঘাত করতে পারবেন। আর এই মুহূর্তে আপনি আমাকে আঘাত করেছেন ও।
এই যে সবার সঙ্গে আমার তুলনা করলেন আর এটাতো আপনার ছুরির মত জিহ্বা দিয়েই।”
বিভা অবাক হয়ে চেয়ে আছে ফাইয়াজের মুখের দিকে। সে কি তার দুঃখের কথা বলবে সব তার মুখেই আটকেগেছে। এই লোকটা এমন অদ্ভুত কেন? সব জায়গায় তার কড়া কড়া উত্তর। কথা যেন বুলেটের গতিকে ও হার মানাবে। বলতে দেরী তার ঠোটের আগায় কথা ফুটতে দেরী না। বিভার দিকে তাকিয়ে ফাইয়াজ বলে উঠলো –
–” আপনার বাসায় মনে হয় সবাই অপেক্ষায় আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরুন।”
–” আপনি? ”
–” আমিও যাচ্ছি, একটু জগিং করে বাসায় ফিরতে হবে, কত কাজ আছে।”
–” আপনি কি রেগে আছেন আমার উপর? না মানে আমার মনে হলো আমার কথাগুলো আপনার পছন্দ হয়নি হয়তো। কিন্তু আমি তো ভুল বলিনি!”
–“প্লিজ, বিভা এই নিয়ে আর কথা বলতে আসলে আমি চাইছি না। আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।”
বিভা বুঝতে পারল ফাইয়াজ ঠিকই রেগেগেছে তার উপর। ফাইয়াজ বিভাকে সঙ্গে নিয়ে হাটতে হাটতে বিভার বাড়ির পাশে নিয়ে এসে বলল -.
–” ভালো থাকবেন, আর ভালো লাগলে কথা বলবেন।”
–” আসুন না বাসায়!”
–” আমি তো আর জামাই নই বলুন হুটকরে কোন এক সকালে বউয়ের বাড়িতে হাটতে হাটতে মন চেয়েছে বলে চলে এলাম। এখন যদি আমি হঠাৎ করে এই সকাল সকাল বাড়িতে যাই। তাহলে আঙ্কেল আন্টি কি ভাববে বলুন তো?
লজ্জায় তো আমারই পরতে হবে। তার চেয়ে বরং কোন বিকেলবেলায় আবার দেখা হবে! বায়!”
ফাইয়াজ কথাগুলো আপন মনে বলতে বলতে চলেগেল। আর বিভা বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলছে লোকটা এই রেগে রেগে কত গুলো কথা বলল। আবার এখন এমন কথা বলেগেল। এমন লোকের পাল্লায় পরলে কপাল খারাপ হয়ে যাবে তার।
চলবে।