ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ৪৬ .

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৬
.
আদ্রিয়ান এতোটা কাছে চলে এসছে যে আমার চোখে মুখে ওর নিশ্বাস আছরে পরছে। আমি আর নিজের চোখ খোলা রাখতে পারলাম না, চাদর খামছে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেও পারছিনা শরীরে ব্যান্ডজ তার সাথে এতো ব্যাথাও আছে। আর সেই সুযোগটা মশাই খুব ভালোভাবেই নিচ্ছে। আদ্রিয়ান আমার সামনে থাকা চুলগুলো সব আলতো হাতে সরিয়ে নিয়ে আমার কপালে চুমু দিলো। আমি পুরো শক্ত হয়ে আছি। হঠাৎ ও আমার মুখে ফু দিতেই আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। ও মুচকি হেসে আমার নাকে নাক ঘষে বলল,

— ” সুস্থ নও তাই আজ ছেড়ে দিলাম। বাট, এরপর কারো সাথে লাগতে আসার আগে এটা ভেবে নিও যে কার সাথে লাগতে আসছো? হুম?”

আমি একটা ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। ও হেসে বলল,

— ” তুমি বলোনা যে আমার ভ্রু বাঁকানোর স্টাইলটা বিখ্যাত? কিন্তু তুমি কী জানো তোমার মুখ ভেংচি দেওয়ার স্টাইলটাও বিখ্যাত?”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ও আমার নাক টিপে দিয়ে বলল,

— ” অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পরো।”

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ও আমার ওপর হাত রেখে আমার গলায় মুখ গুজে শুয়ে রইল। আমি কিছু বললাম না কারণ হাত পায়ে ইঞ্জুরি থাকায় ওর বুকে শুতে পারিনা আমি। কিন্তু তাতে কী ইন্ডিয়া তে যেমন টিকটক ব্যান হওয়ার পর তার রিপ্লেসমেন্টে ইন্সটাগ্রাম রিল ব্যবহার করছে। ঠিক তেমনি আমায় বুকে নিতে পারছেনা তো কী হয়েছে? এটা ঠিক অন্যভাবে পুশিয়ে নেয়। তবে ওর এসব কাজ আমার ভালোই লাগে। চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে যেই হাতটা ভালো আছে সেটা দিয়েই আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।

__________________

দেখতে দেখতে দুইটা মাস কেটে গেছে। এখন আমি পুরোপুরি ভাবে সুস্হ। আর আমি এখন হাটতে চলতে কথা বলতে সব কিছুই করতে পারি। আমি যখন পুরোপুরি ক্লিয়ারলি কথা বলতে পারি তখন আদ্রিয়ান আমাকে হতাশ কন্ঠে বলেছিল, ” আমার শান্তির দিন শেষ হয়ে গেল।” আমি ওপর দিয়ে রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে একটুও রাগিনি কারণ আমি জানি আমার ভয়েজ ফিরে আসায় সবচেয়ে বেশি ওই হয়েছিল।

আজ আপি আর ইফাজ ভাইয়ার ফার্স্ট ম্যারেজ এনিভার্সিরি। আপির বিয়ের সুত্রেই তো আদ্রিয়ান এই পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় কীভাবে একটা বছর পার হয়ে গেল ভাবতেই পারছিনা। সত্যিই সময় কত দ্রুত চলে যায়। আজ আপি আর ইফাজ ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্লান ছিল আমাদের। ও বাড়ি থেকে কাব্য, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, মলি আপু, মিলি আপু, দুলাভাইরা মানে প্রায় সবাই এসছে সাথে সৃষ্টি আপুও। এদিকে জাবিন, আদিব ভাইয়া, আদ্রিয়ান আর আমিতো আছিই। আজ ওদের দুজনকেই কাজের বাহানায় বাইরে পাঠিয়ে সবাই মিলে ছাদ সাজিয়েছি সুন্দর করে। এত সুন্দর করে সাজিয়েছি। ওরা এলেই ওদের সারপ্রাইজ দেবো সেটাই ছিলো প্লান। ওরা দুজন আসতেই আমরা সবাই মিলে একসাথে উইশ করে সব দেখিয়ে ওদের চমকেদিয়েছি। এরপর সবাই মিলে সেলিব্রেশন করলাম। সবাই যখন একসাথে খেতে বসেছি তখন দাদী দুষ্টুমি করে বলল,

— ” কীরে আমার একজনের একবছর পূর্ণ হয়ে গেলো আরেকজনের প্রায় হয়ে এলো ভালো খবর কবে দিবি তোরা?”

সবার সামনে দাদীর এমন লাগামছাড়া কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম, আপিও লজ্জা পেয়েছে নিঃসন্দেহে। আদ্রিয়ান আমার কাধে হাত রেখে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” বউমনির খবর ভাইয়া জানে। কিন্তু আমার বউ এখনও নিজেই বাচ্চা দাদী। বাচ্চা পালার বয়স ওর এখনও হয়নি। যখন হবে তখন দেখো একটা ক্রিকেট টিম বানিয়ে তবেই দম নেবো।”

আমার কাশি শুরু হয়ে গেল আদ্রিয়ানের কথা শুনে। বাকি সবাই যারা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনছিল তারাও এখন গলা ঝেড়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমি কোনোরকম মুখে কটা গুজে ওপরে চলে এলাম। এভাবে সবার সামনে বলতে হয়? লজ্জায় মাটিতে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার।

এসবকিছুর মাঝে ভুলেই গেছিলাম ঐ টেরোরিস্টদের কথা। সবকিছুই তো স্বাভাবিকভাবেই চলেছে এতোদিন। জানিনা পরবর্তীতে কী হবে? কিন্তু যতদিন ভালো সময় যাচ্ছে সেটাকে ভালোভাবেই উপভোগ করতে চাই। তবে আজ আদ্রিয়ান এতো খুশি থাকলেও কালকের দিনটা নিয়ে ভয়ে আছি আমি। কালতো ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যু বার্ষিকী। কাল ওকে সামলাতে যে অনেক বেগ পেতে হবে সেটা জানি। আল্লাহর কাছে এটুকুই প্রার্থনা। ও যাতে নিজেকে সামলে নিতে পারে।

___________________

সকালে রোদের আলো চোখে মুখে পরতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান নেই। আজ ও আর আমি দুজনেই সকালে একসাথে ফজরের নামাজ পড়েছি। ইশরাক ভাইয়ার জন্য দোয়া করেছি। আমি বেড থেকে নেমে ধীরপায়ে ব্যালকনিতে গেলাম। গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান রেলিং ধরে একদৃষ্টিতে আকাশ দেখছে। আমি ওর চোখে হালকা ছলছলে ভাব আছে। আমি ওর কাধে হাত রাখতেই ও তাকিয়ে আমাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

— ” ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। আজ ও বাড়িতে যাবো। আর হ্যাঁ হালকা কালারের ফুল হাতা কোনো একটা স্যালওয়ার সুট পরো আজ।”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। একটা সাদা রং এর স্যালওয়ার সুট পরে।ভালোভাবে রেডি হয়ে নিলাম। আদ্রিয়ানও সাদা পাঞ্জাবী, টুপি পড়েছে। এরপর বাড়ির সবাই বেড়িয়ে গেলাম ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি আঙ্কেল গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আন্টি নিরবে চোখের জল ফেলছেন। আর নূর আপু ইসরারকে কোলে নিয়ে বসে চুপচাপ বসে আছে। হুজুররা আসেননি এখনও। আদ্রিয়ান আর আদিব ভাইয়া সব কিছু কতদূর ব্যবস্থা হয়েছে, হুজুররা কখন আসবে এসভ দেখতে গেলেন। আমি নূর আপুর পাশে গিয়ে বসলাম। ইসরার ঘুমিয়ে আছে তাই ওকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তারপর নূর আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” কান্না আটকে রেখোনা আপু। তোমার। আজকে নিজের মন মত কেঁদে নিজেকে হালকা করো।”

নূর আপু অসহায়ভাবে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। এমন কান্না যা শুনলে যেকারো হৃদয় কেঁপে উঠবে। আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টায় আছি।আমি ইশরাক ভাইয়াকে মাসখানেকের মতই দেখেছি। একমাসেরই পরিচয় আমাদের। কিন্তু আমাকে সবসময় বোন বলত। এত মিশুক, প্রাণচ্ছল মানুষ আমি জীবণে খুব কম দেখেছি। ওনার সেই অট্টোহাসি, আড্ডার মহল তৈরী করা সব ভীষণ মনে পড়ছে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ের আমার এতো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওদের কাছের মানুষদের মনের অবস্থা কতটা ভয়াবহ সেটা ভাবলেই আমার আত্মা কেঁপে উঠছে। সারাদিনটাই আজ এক নিরব হাহাকারে কেটেছে। আজ সবার মনটাই বিষন্ন। কিন্তু আমি শুধু আদ্রিয়ানকেই দেখেছি। বাইরে দিয়ে স্বাভাবিক থেকে সব সামলে যাচ্ছে কিন্তু মনের খবর তো আমি জানি। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে ওর। কীভাবে পারে একটা মানুষ মনে এত হাহাকার নিয়ে বাইরে দিয়ে নিজেকে সামলে রাখতে?

রাতে ওকে রুমে আসতে না দেখে আমি নিজেই ছাদে গেলাম ওকে ডাকতে। গিয়ে দেখি এক কর্ণারে চুপচাপ বসে আছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর পাশে গিয়ে বসে ওর হাত জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ঘুমাওনি?”

আমি ওর কাধে মাথা রেখে বললাম,

— ” তুমি জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসেনা।”

— ” ওহ।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,

— ” সব সময় আবেগ অনুভূতিগুলো চেপে রাখা ঠিক নয়। মাঝেমাঝে প্রকাশ করলে মন হালকা হয়।”

ও কিছু না বলে আমায় জড়িয়ে ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ঘাড়ে তরল কিছু অনুভব করে বুঝলাম কাঁদছে। এটাই ওর অনুভূতি প্রকাশের পদ্ধতি হয়তো। আমি থামাইনি ওকে শুধু আকড়ে ধরে রেখে বুঝিয়েছি ” আমি আছি তোমার সাথে।”

____________________

মাঝে আরও দুটোদিন কেটে গেছে মেডিকেলে তে এখন নিয়মিতই যাতায়াত করছি আমি। সামনে পরীক্ষাও আছে কিন্তু সমস্যা হলো এবার অসুস্থতা, ক্লাসমিস সব মিলিয়ে প্রিপারেশন খুব বেশি ভালো না। তবুও দেখা যাক কী হয় সামনে। বিকেলে বাড়ির সবাই মিলে স্নাকস খাচ্ছি আর আড্ডা দিচ্ছি। তখন বাবা বলল,

— ” আপাতত সব ঝামেলা তো শেষ? আর মামনীও এখন ঠিক আছে। তো তোমরা যাও গিয়ে কদিন ঘুরে এসো? বিয়ের এতোদিন হয়ে গেল। তুমি বা ইফাজ কেউই ওদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলেনা?”

সবাই কৌতূহলী চোখে আদ্রিয়ান আর ইফাজ ভাইয়াকে দেখছে। ইফাজ ভাইয়া বলল,

— ” আমি তো ওলওয়েজ রেডি ছোটআব্বু? বরং তোমার ছেলেকে বলো।”

আদ্রিয়ান খেতে খেতে বলল,

— ” নেক্সট মান্থ অনির এক্সাম। এক্সামের পর পরই ভ্যাকেশন পরবে তখনই যাই?”

বাবা বলল,

— ” ফাইনাল?”

আদ্রিয়ান খেতে খেতেই বলল,

— ” হ্যাঁ একদম।”

তো এটাই ডিসাইড হলো যে আমার এক্সামের পরেই আমরা ঘুরতে যাবো। যাকে বলে হানিমুন। কিন্তু বিয়ের এতোগুলোদিন পর কে হানিমুনে যায় সেটা আমার জানা নেই। আপি আর জাবিনের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুমে এসে দেখি আদ্রিয়ান ল্যাপটপ অন রেখে ওয়াসরুমে গেছেন। হঠাৎ একটা নটিফিকেশের আওয়াজ এলো। আমি একটু কৌতুহল নিয়েই চেক করার জন্যেই ল্যাপটপের সামনে বসে ওটা চেক করতে ক্লিক করলাম কিন্তু পেজ ওপেন হওয়ার আগেই কেউ আমার হাত ধরে এক টানে দাঁড় করিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান রেগে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম ওর চোখ দেখে। কিছু একটা বলব তার আগেই আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,

— ” ল্যাপটপ তোমার খেলার জিনিস হ্যাঁ? কোন সাহসে হাত দিয়েছো এটায়? বলো?”

ওর আচরণে আমি অবাক এর সাথে ভয় ও পাচ্ছি এমন কেন করছে? আমি কাঁপা গলায় বললাম,

— ” আমিতো জাস্ট…”

ও আবারও থমকে বলল,

— “হোয়াট? কারো জিনিসে হাত দেওয়ার জন্যে তো পার্মিশন নেওয়া লাগে তাইনা? এটুকু ম্যানার্স তো থাকা উচিত তোমার। হ্যাঁ আ’ম ইউর হাজবেন্ড বাট তার মানে এটা না যে তুমি আমার সবজিনিসেই হাত দেবে। আমার নিজেরও ব্যাক্তিগত কিছু স্পেস থাকে। ইউ সুড আন্ডারস্টান্ড দ্যাট!”

বলে ল্যাপটপটা বন্ধ করে হনহনে পায়ে বেড়িয়ে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে অবাধ্য একফোটা জল গড়িয়ে পরল। ল্যাপটপৈ একটু হাত দিয়েছি বলে এভাবে বলতে পারলো ও আমাকে? এমন কী করেছি আমি? একটাবার ভাবলো অবধি না ওর এই আচরণে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here