মন মুনিয়া পর্ব-২৭

0
1613

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৭

সকালের মিষ্টি আলোয় আলোকিত চারপাশটা অপরুপভাবে সেজেছে আজ। সোনালী রোদের ঝলকানিতে সে সাজ আরো সুদৃশ্য হয়েছে দেখতে। বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে মিষ্টি রোদের আলো বিলাশ করছে নীল। খুব ভালো লাগছে তার। এতোটা বছর পর আজ নিজ দেশের মনোরম পরিবেশে প্রভাত বিলাশ করার আনন্দ মনে তার জেকে বসেছে।

বারান্দার গ্রিল দিয়ে বাইরের সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। নীল দেখলো, এক এক করে কোচিং এর ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করছে। দেখতে ভালোই লাগছে। দেখতে দেখতে “নীলাশায় আলোর দেখা” য় ছাত্রছাত্রীতে মুখরিত হয়ে উঠেছে, বাচ্চারা হইচই করে ক্লাসে ঢুকছে। নীলের খুব ইচ্ছে হলো ছোটবেলায় ফিরে যেতে। সেই সাথে এক রাশ আফসোস তার বুকে এসে বাধা বাধলো, “কেন সে বড় হতে গেলো, এই ভাবনাটা তাকে ভিতর থেকে কষ্ট দিচ্ছে।

নীল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুপা এগিয়ে গেলো। হটাৎ ই চোখ গেলো তার সদর দরজার বাইরে। একটা কালো রঙের শাল গায়ে জড়িয়ে কোচিং টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মনি। নীলের খুব জানতে ইচ্ছে করলো, সে কেন ওখানে যাচ্ছে।

মনের ইচ্ছেকে মনে পুষতে না দিয়ে সে দৌড়ে গেলো মনির কাছে। হটাৎ মনির কাছে এভাবে চলে আসায় কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো মনি। তবে সেটা নীলকে বুঝতে না দিয়ে সে বললো
-কি?
হন্তদন্ত হয়ে স্পষ্ট কন্ঠে নীল বললো
-এই পুঁচকে মেয়ে, এই সকাল সকাল তুমি নীলাশায় কেন যাচ্ছো?
-আমি পুঁচকে নয়। গম্ভীরমুখে বললো মনি।
-তুমি পুঁচকেই। এবার বলো ওখানে কেন যাচ্ছো তুমি?
-ওখানে আমি গেলে আপনার কোনো সমস্যা হবে?

নীল মনির কথায় দাঁড়িয়ে পরলো। আপাদমস্তক মনিকে একবার দেখে বললো
-বয়সের দিক থেকে তুমি সত্যি সত্যিই পুচকে, কিন্তু কথার দিক দিয়ে আমার চাইতেও অনেক বেশি এগিয়ে।
-এ দুনিয়ায় চলতে গেলে কোনো না কোনো দিক থেকে এগিয়ে থাকতে হয়। তা নাহলে প্রকৃতি গ্রহণ করেনা, ছুড়ে ফেলে দেয়।
-নীলাশায় যাচ্ছো কেন?
-আমি ওখানে পড়াই।
-কিহ!!
-কানে সমস্যা আছে?
-না, তবে তুমি কিভাবে পড়াতে পারো?
-কেন আমি পড়াতে পারি না?

নীল কিছুক্ষণ ভেবে বললো
-তোমার ট্যালেন্ট আছে বলতেই হবে। এই পুঁচকে বয়সে তুমি কোনো এক পুঁচকের মা হতে যাচ্ছো৷ এতো এতো পুঁচকেদের লেখাপড়াও শেখাচ্ছো। ভাবা যায়।
-এতো ভেবে কাজ কি?
-হুম তাই। আর ভাববোনা।

মনি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। নীল আবারও দৌড়ে মনির কাছে গিয়ে বললো
-এই পুঁচকে, তুমি আমাকে পড়াবে?
-আমি পুঁচকে বাচ্চাদের পড়াই। কোনো পুঁচকে বুড়োদের নয়।

নীলের মাথার উপর দিয়ে গেল কথাটা। সে ভাবতে লাগলো, “পুঁচকে বুড়ো মানে কি?”

ক্লাস শুরু করার সাথে সাথে মনির নামের ছেলেটি ধরফরিয়ে এসে ক্লাসে ঢুকলো। মনি অবাক হলো, কিন্তু কিছু বললোনা।

মনির বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করলো
-তুমি কাল আসোনি কেন?
-পার্সোনাল কিছু সমস্যা ছিলো তাই আসতে পারিনি।
-তোমার পার্সোনাল প্রব্লেম পার্সোনাল ভাবেই রাখোনা কেন, আমাকে তোমার জানানো উচিত ছিলো। কাল সবগুলো ক্লাস নিতে আমার কতোটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছিলো জানো?

মনি বই এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো
-কোচিং টা যাদের তাদের জানিয়েই আমি কাল কোচিং কামাই করেছি।
মনির রেগে রেগো। ঝাঝালো গলায় বললো
-কোচিং এর ক্লাসগুলো তো আর ওরা করায় না, আমাকে করাতে হয়। তাই এইসব ছুটি চলবেনা, এইবার ছাড় দিলাম। আরেকবার যদি এমন হয় ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো বলে দিলাম।

মনি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মনিরের দিকে। ঠোঁটগুলো কাপছে তার। হয়তো খুব ধারালো কোনো কথা ওর মুখ থেকে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইদানীং কেন জানি নিরবে কিছু সহ্য করতে একদমই ইচ্ছে হয়না ওর। মনে হয় বলে দেখ শরীর জ্বালা করা কয়েকটা কথা।

মনির মুখের কথা মুখেই থেকে গেলো। ওর কথা বেরোবার আগেই দরজার পাশ থেকে কেউ বললো
-কাকে তুমি ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে মনির?
মনির চমকে তাকালো দরজার দিকে। মনিও তাকালো সেদিকে। নীল দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।

মনির একটা জোরপূর্বক হাসি মুখে টেনে বললো
-আরে নীল যে, কখন এলে?
-এসে বুঝি তোমার কাজে বাধা দিলাম।
-মানে?
-কাকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছো তুমি?
-আরে তুমিও যে কি না। কি শুনতে কি শুনেছো। আমি অন্য একটা বিষয়ে আলাপ করছিলাম ওর সাথে।
-ওহ আচ্ছা। তা কি বিষয়ে?
-তুমি কবে এসেছো?
-গতকাল এসেছি। আর মনি আমাকে রিসিপ করতে গিয়েছিলো আমার ফ্যামিলির সাথে। না জেনে ওকে এভাবে এই ভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি তোমার।

মনি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকালো নীলের দিকে। মনিরও হতবাক হলো। আবারও জোরপূর্বক হাসি টেনে আমতাআমতা করে সে বললো
-আমি জাস্ট জিজ্ঞাসা করছিলাম শুধু। ওই তো ঠিক করে কিছু বলছিলোনা, শুধু পার্সোনাল প্রব্লেম দেখাচ্ছিলো। এটাতো কোনো পার্সোনাল প্রব্লেমের মধ্যে পরেনা।
-ওটা ওর ব্যাপার। ওর ব্যাপারে ঘাটাঘাটি করার কোনো অধিকার নিশ্চয়ই তোমার নেই। নেক্সট টাইম এইসব বলার আগে কয়েকবার ভেবে নিবে। তোমারই ভালো হবে।

নীল চলে গেলে মনির নামের ছেলেটা আবারও মনির দিকে তাকালো। চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ তার বুঝাই যাচ্ছে।। তবে সে রাগটাকে যথেষ্ট কন্ট্রোলে এনে বললো
-বাড়াবাড়িটা তুমিই করেছো। আমি জিগ্যেস করা মাত্রই তোমার বলে দেওয়া উচিত ছিলো।
-আপনার সাথে কথা বলতে আমি ইচ্ছুক না। আপনি প্লিজ আপনার কাজে যান।
মনির ছেলেটা চরমভাবে অপমানিত হলো। সে মনির দিকে রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে ক্লাসরুম ত্যাগ করলো।

______
কোচিং ছুটির পর ছাত্রছাত্রী বিদায় নিলে মনি শালটা শরীরে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বের হলো। আজ রোদ উঠেনি, তার উপর অতিরিক্ত ঠান্ডা। জমে যাবার মতো অবস্থা প্রায়। মনি ধীরপায়ে রুমে এসে ঢুকলো। ঘরে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে হাতমুখ মুছে নিলো ভালো করে। রান্নাঘর থেকে সকলের কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মনি রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হটাৎ করে মাথাটা ঘুরে গেলো। মাথা ঘুরানোর চোটে প্রায় পরে যাবার মতো অবস্থা।

মনি কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালে চেপে দাড়ালো। দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো সে কয়েক মুহূর্ত। অন্যদিনের তুলনায় আজ দীর্ঘ সময় ধরে মাথা ঘুরাচ্ছে। মনি অস্পষ্ট ভাবে ডাকলো
-আশাপু, আশাপু।
মনির ডাক ওদের কান পর্যন্ত গেলোনা। সে আবারও ডাকলো
-আন্টি, ভাবী……
এখনো কোনো সাড়া পেলোনা মনি। দেয়ালে ধরে ধরে সে দাঁড়ানো থেকে ফ্লোরে বসে পরলো।

কিছুটা সময় বাইরে ঘোরাফেরা করে সবেমাত্র বাসায় ফিরেছে নীল। এতোদিন পর নিজের এলাকায় হাটাহাটি করার পর তার মাইন্ড এখন ফুল ফ্রেশ হয়ে আছে। সে ফুরফুরে মেজাজে শীশ বাজাতে বাজাতে ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলো আশার রুম থেকে গুঙ্গানোর আওয়াজ আসছে। নীল বিস্ময় নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো।

ফ্লোরে একরকম ঝিমানোর মতো করে বসে আছে মনি। আর অস্পষ্টভাবে বার বার আশা আর ভাবিকে ডেকে চলেছে অনবরত। মনির হটাৎ এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো নীল। সে আশা আর হিমাকে জোরে ডাক দিলো রুমে আসার জন্য। ওরা আসার আগেই নীল মনিকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। সেদিকে কোনো হুশ নেই মনির। নীল মনির গালে হাত দিয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলো
-এই পুঁচকে মেয়ে, কি হয়েছে তোমার?

এর মধ্যে আশা আর হিমা এসে ঢুকলো ঘরে। পিছন পিছন রাবেয়াও এসে ঢুকলো। মনিকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আর ওর গুঙ্গানো শুনে ঘাবড়ে গেলো ওরাও। বিস্ফোরিত কন্ঠে নীলকে বললো
-ওর কি হয়েছে ভাইয়া?
-আমি জানিনা। ঘরে ঢুকেই গুঙ্গানো শুনলাম। এসে দেখি ফ্লোরে পরে আছে আর তোদেরকে ডাকছে।
-আমরা তো শুনতে পাই নি, কি হয়ে গেলো ওর হটাৎ? ভয়ার্ত গলায় বললো হিমা।

আশা গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসলো তৎক্ষনাৎ। নীল ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে মনির চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো। রাবেয়া বলল
-মেয়েটাকে একটা ডাক্তার দেখানো দরকার। এমনিতে বাচ্চা পেটে, তার উপর বয়সটাও কম। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করেনা। হয়তো তাই এমন হয়েছে।
-এটাই হবে মা। চিন্তিত গলায় আশা বললো।

কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর হুশ ফিরলো মনির। সে ধীরে ধীরে উঠে বসলো বিছানায়। আশা ওর পাশে গিয়ে বসে বললো
-কি হয়েছিলো তোর মনি?
-জানিনা আশাপু। হটাৎ মাথাটা ঘুরলো কেন বুঝতে পারছিনা।
-তুই এখন থেকে একটি সাবধানে চলিস মনি। তোর শরীরের কন্ডিশন খুবই খারাপ। শরীরের ওজনও বাড়ছে আস্তে আস্তে।
-হুম।

কয়েক সেকেন্ড সকলেই নিরব থাকার পর রাবেয়া বললো
-আচ্ছা আমি একটু রুমে যাচ্ছি।
হিমার হটাৎ মনে হলো চুলায় তরকারি বসিয়ে এসেছে। সে চিন্তিত গলায় বললো
-এই রে, আমার তরকারিটা বোধহয় পুড়েই গেছে। এই আশা আয় তো একটু।
রাবেয়া চলে গেলে হিমার পিছুপিছু আশাও ছুটলো রান্নাঘরের দিকে।

নীল চিন্তার ভঙ্গিতে বসে আছে আর কিছু ভাবছে। মনি এক পলক নীলের দিকে তাকালো। এরপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো
-আপনি মনির ভাইকে কেন বললেন আমি আপনাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম?
নীল অন্যমনস্ক হয়ে বললো
-কখন?
-এর মধ্যে ভুলে গেলেন?
নীলের সম্ভিত জ্ঞান ফিরলো। সে বললো
-তুমি আমাকে পুঁচকে বুড়ো কেন বলেছিলে?
-ইচ্ছে হয়েছে তাই বলেছি। আপনি কেন মনির ভাইকে এইসব বললেন?
-আমারও ইচ্ছে হয়েছে, তাই বলেছি।
মনি রাগী চোখে তাকালো নীলের দিকে। নীল সে দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে মুচকি হাসলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here