হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২২.
চায়ের দোকানের সামনে দুদিকে মুখোমুখি করে পাতা দুটো কাঠের বেঞ্চ। একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছে হিমি তাহির। অন্য বেঞ্চ খালি। দোকানে ছোট্ট কমলা রঙের লাইট জ্বলছে। দোকানি চায়ে জাল দিচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষনের নিরবতা ঠেলে তাহির বলে উঠলো,
‘আপনি তো বলেছিলেন আপনার কিছু মনে নেই। তাহলে পিয়ানো কার কোথা থেকে এলো সেসব কি করে মনে পরলো?’
হিমি মৃদু হেসে দোকানির থেকে দু কাপ চা নিলো। একটা কাপ তাহিরের দিকে এগিয়ে নিজের চায়ে হালকা ফু দিয়ে চুমুক বসালো। বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে বললো,
‘আপনি এক্ষুনি যেসব প্রশ্ন করলেন সেই সকল প্রশ্ন আমিও করেছিলাম।’
‘কাকে?’
‘নিজেকে!’
তাহির বুঝতে না পেরে বললো,
‘কেনো?’
হিমি তাহিরকে চা খেতে ইশারা করে বললো,
‘শার্টের পকেটে হঠাৎ করে পিয়ানো দেখে ভড়কে গেছিলাম। তাই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম এটা কার, কোত্থেকে এলো, কেনো এলো! তারপর একে একে সব উত্তর মেললো। কিন্তু আপনি মিথ্যে বলেছেন।’
তাহির ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
‘আমি আবার কি মিথ্যে বললাম?’
‘আমি যখন বললাম আপনার সাথে কি কি কথা হয়েছে তখন তো বলেন নি, আমি আপনাকে আমার ফেইল হওয়ার কথাটাও বলেছিলাম!’
তাহির নিঃশব্দে হাসলো। এক চুমুক গরম চা খেয়ে বললো,
‘এই কথাটা বললে আপনি ভাবতেন আমি আপনাকে খোঁচা দিচ্ছি বা অপমান করছি। তাই বলি নি।’
হিমি গলা কাশলো। মানুষটা যে কথা এড়িয়ে গিয়ে তাকে সম্মান জানালো সেই কথাটা টেনে এনে নিজেরই অপমান করছে ভেবে রাগ লাগলো হিমির। যখন তখন যা তা বলে ফেলার রোগটার প্রতিকার খুঁজতে হবে। তাহিরের ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে। হিমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। কথা ঘুরিয়ে বললো,
‘চা কেমন হয়েছে? আপনার টেস্ট অনুযায়ি তো!’
‘উহুম! আমি চিনি খাই না। আপনার স্পেশাল চা আবার চিনিতে ভরপুর!’
হিমি গোল গোল চোখে তাকালো। অবাক হওয়া কন্ঠে বললো,
‘চিনি খান না? বললেন যে ব্ল্যাক কফি খান! সেটাও চিনি ছাড়া?’
তাহির মাথা দুলালো। হিমি মুখ ভেঙিয়ে বললো,
‘এইজন্যই কাঠ কাঠ দেখতে আপনাকে। কথা বার্তাতেও কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাব। ইয়াক! ওই বিচ্ছিরি কফি খান কি করে আল্লাহ্ মালুম!’
তাহির এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড হেসে নিজেকে সংযত করলো সে। খালি কাপ বেঞ্চে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। চায়ের দাম দিতেই হিমি ঝট করে দাঁড়িয়ে বললো,
‘চলে যাবেন?’
তাহির শান্ত গলায় বললো,
‘হ্যা। চা খাওয়াও শেষ। এখন তো যেতে হবেই!’
হিমি তার কাপের বাকি চা টুকু এক ঢোকে খেয়ে নিলো। পকেট ঘেটে খুচরা টাকা দোকানির দিকে এগিয়ে দিতেই তাহির বললো,
‘আমি দিচ্ছি তো।’
‘না। আমি দিবো। আমি আপনাকে খাইয়েছি। সুতরাং টাকাটাও আমায় দিতে হবে!’
‘এটা কি কোনো রুলস?’
‘হ্যা সেরকমই!’
হিমি তাহির চায়ের দোকান থেকে সরে এগুতে লাগলো। হঠাৎই দমকা বাতাসের আগমন। সব যেনো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শো শো করে বয়া বাতাসের তোরে হিমির লম্বা কোঁকড়ানো চুল উড়তে লাগলো। দু একটা ঝাপটা লাগলো তাহিরের বুকে, চেহারায়। হিমির তাতে কোনো হেলদোল নেই। অলস পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। তাহির চোখ মুখ কুঁচকে হাত দিয়ে বাতাস আটকানোর চেষ্টায়। আসলে বাতাস নয়, বাতাসের সাথে উড়ে আসা বালি আটকাতেই তার প্রচেষ্টা।
‘মনে হচ্ছে বড় ঝড় হবে। আপনি বাড়ি ফিরে যান।’
তাহিরের উচ্চস্বরে বলা কথায় পেছন ফিরে হিমি। চুলগুলো তার মুখের উপর আছড়ে পরছে। বিরক্তি নিয়ে এক হাতে চুল মুঠো করে ধরে হিমি। কৌতুহলী গলায় বলে,
‘আপনি ফিরবেন না?’
তাহির মাথা নেড়ে বলে,
‘হসপিটালে যেতে হবে। বাইক সাথে নেই আপনার?’
‘তেল ফুরিয়ে গেছে আনি নি সাথে।’
‘তাহলে যাবেন কি করে? এখানে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আরেকটু এগুতে হবে আমাদের।’
হিমি চুলগুলো খোপা করে বললো,
‘আমার চিন্তা করতে হবে না। আমি হেঁটেই যেতে পারবো। আপনি কিসে যাবেন সে ভাবনা ভাবুন। আসুন ওদিকে যাই।’
তাহির হিমি দুজনেই হেলেদুলে চলছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দোকানিরা দোকানের শাটার বন্ধ করছেন। কয়েকজন আবার বন্ধ দোকানের ছাউনিতেই আশ্রয় নিয়েছেন। রাস্তার পাশের গাছ গুলো ঝড়ের সাথে তাল মিলাচ্ছে। আকাশ সমান গাছ হুমরি খেয়ে রাস্তায় পরে আছে। ল্যাম্প পোস্টের আলো নিভেছে। লোডশেডিং হয়েছে আবারও। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। ঝড়ের বেগ বাড়ছে। তাহিরের ফোন বাজছে। ঝড় তুফানে সেই রিংটোনের আওয়াজ শোনা অসম্ভব। তাহিরও শোনে নি। হিমির হাত ধরে আন্দাজে রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠলো সে। চোখে চশমা থাকায় তাকাতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না তার। হিমির চুলগুলো বিনা নোটিশেই খোলে গেলো। শুরু হলো তাদের ছুটাছুটি। কখনো তাহিরের চোখে মুখে, কখনো তার বুকে, কখনো হিমির গায়ে গিয়ে পরছে। বিরক্তিতে কান লাল হয়ে উঠলো হিমির। চুলগুলো খামচে ধরতেই তাহির চুলে হাত রাখলো। হিমির হাত সরিয়ে অন্ধকারেই উষ্কখুষ্ক চুল পরিপাটি করতে লাগলো। হিমি মাথা ঘুরানোর চেষ্টা করতেই তাহির গম্ভীর গলায় বললো,
‘চুপ করে দাঁড়ান।’
কিছুক্ষন পর তাহির বললো,
‘হেয়ার বেল্ট আছে?’
হিমি মাথা নাড়লো। তাহির হিমির ডান হাত উচিয়ে ধরে কব্জির উপর থাকা বেল্ট টা খোলে নিলো। অতি যত্নে চুলে বেল্ট লাগিয়ে বিনুনি গাঁথা সম্পন্ন হলো তার। হিমি হাত বাড়িয়ে চুল ধরলো। চমকে উঠা গলায় বললো,
‘আপনি বিনুনি গাঁথতে জানেন?’
তাহির জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,
‘এতো লম্বা চুল। যত্ন করেন না কেনো?’
এবার হিমিও জবাব দিলো না। ঝড় কমে এসেছে। বাতাসও মৃদু বইছে। এই ঝড় না হয়ে বৃষ্টি হলে বেশ হতো। কিন্তু বৃষ্টির ছিটে ফোটাও হলো না। শুধুই বালি ঝড়! পরিবেশ শান্ত হতেই মানুষজনের আনাগোনা দেখা গেলো। হিমি হুট করে বললো,
‘আমরা এভাবে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি না করে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলেও দৌড়তে পারতাম।’
তাহিরও সম্মতি জ্ঞাপন করলো। কিন্তু করেও কোনো লাভ হলো না। ততোক্ষনে রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট, দোকানের বাল্ব, ছাড়াও আশে পাশের বিল্ডিংএর লাইট জ্বলে উঠেছে। হিমি তাহিরের দিকে তাকিয়ে জিব কাটলো। কাতর গলায় বললো,
‘আপনার পুরো জামা নষ্ট হয়ে গেছে!’
হিমির কথায় তাহির নিজের দিকে তাকালো। কালো কোট টা বালিতে মাখামাখি হয়ে আছে। জুতোর অবস্থা আরো নাজেহাল। ডান হাতে চুল ঝেড়ে আরো এক গাদা বালি বের হলো। হাত পা, কাপড় ঝেড়ে ঝুড়ে দুজনেই রিকশা খুঁজতে লাগলো। অনেক প্রতীক্ষার পর একটা রিকশার দেখা পাওয়া গেলো। তাহির হিমিকে রিকশায় বসতে বললেও সে চড়তে চাইলো না। তার এক কথা হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। তাহিরও ছাড়ছে না হিমিকে। রিকশা করেই হিমিকে বাড়ি পৌঁছাবে সে। হিমি রাগি গলায় বললো,
‘আপনি যান না। আমি চলে যাবো বলছি।’
‘আমিও তো বললাম, আপনাকে ড্রপ করে তারপর যাবো। উঠুন!’
তাহিরের জেদী গলা শোনে হিমির হাসি পেলো। তবে হাসলো না সে। গলা কেশে বললো,
‘আমার বাড়ি এদিকে বাচ্চা ডাক্তার আর আপনি যাবেন ওদিকে। কি করে ড্রপ করবেন?’
তাহির ভ্রু কুটি করে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো,
‘আমি আপনার বাড়ি চিনি হিমি। সেদিন আপনাকে ড্রপ করেছি তাই জানি এদিকে আপনার বাড়ি নয়। আপনি মিথ্যে বলছেন।’
হিমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
‘ওটা আমার দাদুর বাড়ি ছিলো। এখন যেখানে যাবো সেটা আমার মামার বাড়ি।’
‘এই রাতের বেলা হুট করে মামার বাড়ি যাবেন?’
‘আমি এভাবেই যাই। যখন তখন যে কোনো সময়!’
তাহির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মনে পরলো সেদিন জ্বরের ঘোরে হিমির বলা কথা গুলো। সে বলেছিলো কিছুটা বড় হওয়ার পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ বাড়ি ও বাড়ি করতে হয়েছে তাকে। এখন কি ইচ্ছে করেই থাকে? জানতে ইচ্ছে হয় তাহিরের। হিমির থেকে আরো কিছু কথা শুনতেও ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু জড়তার কারনে বলা হয় না। রিকশায় উঠে নিজ গন্তব্যে যেতে গিয়েও পেছন ফিরে তাকায় তাহির। ফুটপাত ধরে দ্রুত পা ফেলে চলছে হিমি। শার্টের হাতা টেনে কনুই অব্দি গুটাচ্ছে। বিনুনি গাঁথা চুলগুলো দোল খাচ্ছে হিমির চলার সাথে সাথে। তাহিরের রিকশা ডান মোরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে পেছন ফিরেই হিমিকে দেখছিলো।
__________________
বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিহান। ডান হাতে মোবাইল অনবরত ঘুরাচ্ছে। চোখ মুখ থমথমে তার। কপালে পরেছে চিন্তার ভাজ। কারন মিশ্মি। অথৈর বিয়ের দিন থেকেই গায়েব হয়ে গেছে সে। নিহান ভেবেছিলো বিয়ের দিনে দু পরিবারের সখ্যতায় কথা বার্তা বাড়বে। হয়তো সে মিশ্মির সাথে আরো একটু ক্লোজ হতো। কিন্তু হলো না। মিশ্মি বিয়েতেই ছিলো না। এরপর থেকে এখনো ভার্সিটি আসে নি। ফেইসবুকে মেসেজ করলেও সীন হয় নি সেগুলো। বহু কষ্টে জোগার করা মিশ্মির মুঠোফোনের নাম্বারে কয়েকবার ডায়াল করলেও অপর প্রান্ত অবলীলায় নট রিচেবল থেকেছে! মিশ্মির সাথে যোগাযোগের আর কোনো রাস্তা নেই নিহানের কাছে। হিমির সাথে মিশ্মির ব্যাপারে কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু হিমি কতোটা গুরুত্ব দেবে সেটাও বলতে পারছে না নিহান। বন্ধুরা বলে দিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রপোজ করতে। পরে যদি মিশ্মি অন্য কারো হয়ে যায়! এই ভয়টাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে নিহানকে। মিশ্মি অন্যকারো কি করে হতে পারে? তার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই? নিয়তি কি এতো নিষ্ঠুর হয়? হতে পারে। নিহানের এক বন্ধুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। ভালোবাসি শব্দটা বলতে এতো দেরি করেছিলো যে মেয়েটার বিয়েই হয়ে যায়। ছেলেটা যদিও নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু নিহান পারবে না। নিশ্চয় পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। নয়তো বড়সড় কোনো ক্রিমিনাল হবে। এসবও সম্ভব নিহানের দ্বারা? বুঝে উঠতে পারে না সে! শুধু ভাবে যে করেই হোক মিশ্মিকে নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে হবে। জানিয়েই ক্ষান্ত হবে না। তাকে নিজেরও করবে। দরকার পরলে জোর করে বিয়ে করবে। তবুও তার করেই ছাড়বে। কলিং বেল বেজে উঠলো। ধ্যান ভাঙলো নিহানের। মোবাইল টাউজারের পকেটে ঢোকিয়ে দৌড় লাগালো সদর দরজার দিকে। হিমি এসেছে হয়তো। আজ আর তাকে ছাড়া যাবে না। সদর দরজা থেকেই হিমিকে পাকড়াও করে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে হবে। এতোসব প্ল্যান ভেস্তে গেলো যখন দরজায় হিমির বদলে নিজের বাবাকে দেখলো সে। নেহাল রহমান গম্ভীর গলায় বললেন,
‘এভাবে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? সর ভেতরে যেতে দে!’
নিহান সরে দাঁড়ালো। দরজা ভেতর থেকে আটকে সোফার কাছটায় এসে দাঁড়ালো। নেহাল রহমান শার্টের দুটো বোতাম খোলে অলস গলায় ডাকলেন রাদিবাকে। আমিনা বেগম বসার ঘর অতিক্রম করে শোবার ঘরে যাচ্ছিলেন। নিহান বড়মাকে দেখেই ছুট লাগালো ওনার দিকে। রাদিবা ভ্রু কুঁচকালেন। নেহাল রহমানও চমকালেন। বললেন,
‘এর আবার কি হলো? হতাশ লাগছিলো মনে হলো!’
রাদিবা কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
‘তোমার ছেলে তুমি জানো। আমায় বলছো কেনো?’
নেহাল বুঝলেন মা ছেলের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে হয়তো। তাই আর কথা বাড়ালেন না। ঘন শ্বাস টেনে ফ্যানের বাতাস গিললেন!
চলবে,,,,,,,,,,,,