হিমি পর্ব-৫১

0
817

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫১.

ক্লাস শেষে মাঠের কোনায় গিয়ে বসলো ইমন আর সূর্য। চোখে মুখে ক্লান্তি। বন্ধুমহলের বাকিরা বিশেষ কিছু কাজে আটকে পরে ক্লাস করতে আসে নি। দেখাও হয় নি তাই। সূর্য গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে কপাল কুঁচকালো। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকালো। ইমন ঘাড় কাত করে বললো,

‘রেগে থেকে আদৌ লাভ আছে?’

‘আমি রাগি নাই।’

‘তোকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে ব্যাপক রেগে আছিস। দেখ সূর্য, হিমি তো ইচ্ছে করে কিছু করে নি। হুট করে হয়েছে সব। নাহলে অবশ্য‌ই আমাদের জানাতো। বিয়েতে ওর জ্যাঠু ছাড়া পরিবারের আর একজন সদস্য‌ও ছিলো না। ভাব একবার, কিভাবে হয়েছে বিয়ে!’

সূর্য বিরক্তি দেখিয়ে বললো,

‘আমি ভাবতে পারুম না। আর ভাইবাই বা কি হ‌ইবো? যা হ‌‌ওয়ার তো হ‌ইছেই!’

‘সেটাই তো বলছি। যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে। এখন তো আর সেটা চেঞ্জ হবে না। রেগে না থেকে কথা বল ওর সাথে।’

‘আমার এতো ঠেকা পরে নাই। তোর মন চাইলে তুই কথা ক। আমারে জোর করবি না।’

‘তুই এক্সেক্টলি কোন বিষয় নিয়ে আপসেট একটু বলবি?’

‘ধুর বাল। আমি আপসেট না। কতবার কমু শালা। একে তো হারামী বেঈমানী করছে আর এখন তুই আরেক প্যাচাল নিয়া আছোত।’

ইমন কৌতুহলী গলায় বললো,

‘কে বেঈমানী করলো?’

‘কেন? তোগো হিমি!’

‘হিমি এখন আমাদের হয়ে গেলো? তোর কিছু না?’

‘কথা ঘুরাবি না। শালা বলে কি না জীবনে বিয়া করবো না। প্রেম তো দূরের কথা। বিশ্বাসঘাতক। ওই ডাক্তারের লগে ঘন ঘন যোগাযোগ দেইখাই আমি বুঝছি কিছু একটা চলতাছে। নাইলে বিয়া করতে ক‌ইলো আর ধেই ধেই ক‌ইরা হিমি বিয়া করবো? অসম্ভব। তোরা বিশ্বাস করলেও আমি করি না মামা। আগে থাইকাই ওই ডাক্তারের লগে সম্পর্ক আছিলো। হারামীটারে একবার পাই খালি, দেখিস কি করি। না একটা কল, না মেসেজ। বেদ্দপ মাইয়া বিয়ার দুইদিন পর জানাইতাছে বিয়া ক‌ইরা জামাইয়ের ঘরে আছে। মনডায় চায় খুন ক‌ইরা দেই!’

সূর্যের কথার বিপরীতে হাসলো ইমন। সূর্যের উরুর উপর হাত রেখে শান্ত হতে বলে বললো,

‘সব কথার একটা নেগেটিভ দিক তুই বের করেই ছাড়বি? আজব! ‌হিমি এমন না সূর্য। সেটা তুই‌ও খুব ভালো করে জানিস। পরিস্থিতিই এমন ছিলো যে জানাতে পারে নি। সময় সূযোগ পেয়ে তবেই না জানালো। আর তুই জেদ ধরেছিস কথা বলবি না ওর সাথে? শালা এতো জেদ কিসের তোর?’

সূর্য জবাব দিলো না। মেজাজ তিরিক্ষি তার। কলেজ লাইফ থেকে বেস্টফ্রেন্ড বলে দাবি করা এক একটা বন্ধু অনায়াসে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে কথা বলছে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এসব তো মানা যায় না কিছুতেই! ইমন আর কথা বাড়ালো না। পড়া নিয়ে টুকটাক আলোচনা করে নিজের পথ ধরলো। তার বড়খালা হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পরেছেন। ওনার সাথে ইমনের আরো একটা সম্পর্ক আছে। বড়খালা ইমনের হবু শাশুরি। সুপ্তির মা। মেয়েটা অতিরিক্ত ভেঙে পরেছে। সময় অসময়ে ইমনকে ফোন করে কাঁদছে। অযথাই ভয় পাচ্ছে। ইমনের এখন সুপ্তিকে আর তার পরিবারকে সময় দেয়া উচিত। তাদের পাশে থাকা উচিত। ভবিষ্যত জামাই বলে কথা। সূর্যের রেগে যাওয়ার বিষয়েও জানে ইমন। হিমির বিয়ের ব্যাপারটা জানার পর থেকে বাকি বন্ধুরা যেমন বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তেমনি সূর্য রেগে আগুন হয়ে আছে। তার ধারনা হিমি ডাক্তারের সাথে আগে থেকেই প্রেম করতো। এই প্রেমটাই বিয়ে অব্দি গড়িয়েছে। কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারনে বন্ধুদের থেকে কথাগুলো লুকিয়েছে হিমি। অদ্ভুত, কল্পনাতীত কিছু ভাবনা নিয়েই মাঠের কোনায় বসে আছে সূর্য।

……………………………

হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে সোহিনী। রাতের রান্না বসিয়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালো সে। বেতের সোফায় বসে আছে মেঘ। তার দৃষ্টি ম‌্যাগাজিনে স্থির। ম্যাগাজিনটা পুরনো। সোহিনী ছোট্ট টেবিলটার মাঝখানে সুন্দরের জন্য সাজিয়ে রেখেছিলো। মেঘ এখন সেটাই পড়ছে। ইতিমধ্যে একবার পড়া শেষ করেছে যদিও তবুও পড়ছে। আসলে অবসর সময় পার করছে।

বিকেলের দিকে ইমনের থেকে সোহিনীর ঠিকানা যোগার করে এখানে এসেছে মেঘ। সোহিনীর সাথে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা বলার তাগিদেই এসেছিলো। কিন্তু আসার পর বিশ্রী ভাবে অপমানিত হয়েছে সে। সেই সাথে সোহিনীকেও অপমানিত হতে হয়েছে। প্রতিবেশীরা বাড়ির মালিককে আগেই খবর দিয়েছিলো বোধ হয়। নাহলে মেঘ সোহিনীর ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তিনি কোত্থেকে উদয় হলেন? সবার কথার তীরে বিচলিত হয়ে পরছিলো মেঘ। ভেবেছিলো সোহিনী কেঁদে ভাসাবে। রাগ করবে। ব্যাগপত্র নিয়ে অন্যত্র পারি দেবে। নয়তো মেঘকেই তাড়িয়ে দেবে। অথচ সেসব কিছুই করে নি সোহিনী। অতি সাধারন ভাবে মিথ্যে কথা বলে দিলো। সবার সামনে গলা উঁচিয়ে বলে দিলো,

‘মেঘ আমার স্বামী। আমাদের বিয়ে হয়েছে কয়েক মাস হয়েছে। ওর কাজের জায়গা দূরে হ‌ওয়ায় আমার সাথে দেখা করতে পারে না। আগামীকালের ছুটি নিয়ে তবেই এসেছে দেখা করতে। আমাদের বিয়ের ছবি, কাবিন নামা, রেজিস্ট্রি পেপার দেখবেন?’

থতমত খেয়ে গেছিলেন সবাই। হয়তো কেউ প্রমান চাইতো কিন্তু তার আগেই বাড়ির মালিক থামিয়ে দিলেন। সোহিনীর পক্ষ টেনে বললেন,

‘এই মেয়ে সত্যিই বলছে। আমার এক ভাতিজা ওর বন্ধু। মিথ্যে বললে ওর থেকেই জানা যেতো। আপনারা ভুল বুঝে শুধু শুধু ওদের অপমান করছেন। ওদেরকে ওদের মতো ছেড়ে দিন। স্বামী স্ত্রী যখন তখন একসাথেই থাকবে। এখানে কারো কোনো কথা খাটে না।’

মেঘ অবাক হয়ে দেখছিলো সোহিনীকে। এই মেয়ে তো এমন ছিলো না। কয়েক মাসের ব্যবধানে এতো পরিবর্তন! মেঘকে ঘরে এলেও তার এখানে আসার কারন জানতে চায় নি সোহিনী। শুধু একবার জানতে চেয়েছে চা খাবে কি না। মেঘ হ্যা না কিছুই বলে নি। সোহিনী তবু চা বানিয়েছে। মেঘ কোনো কথা না বলে চা খেয়েছে। তারপর থেকেই একমনে ঘর দেখছে, ম্যাগাজিন পড়ছে সে। সোহিনীর ফ্ল্যাটে ঢোকেই বসার ঘর। বড় নয়, মাঝারি। পাশেই ডাইনিং টেবিল। মাঝখানে কোনো পার্টিশন নেই। ডাইনিং টেবিলের একদিকে বেসিন, অপরদিকে ফ্রিজ। বেসিনের সাথে লাগোয়া দেয়ালের অপর প্রান্তে রান্নাঘর। বসার ঘরে পাঁচটা বেতের সোফা, একটা ছোট বেতের টেবিল। একটা কর্নার র‌্যাক। তাতে কিছু ফুলদানি আর শোপিস রাখা। সোফার পেছনেই জানালা। তাতে ঝুলছে মোটা পর্দা। ডাইনিংএ একটা লাইট জ্বলছে। তাতেই পুরো ঘর আলোকিত। সোহিনীর শোবার ঘর দেখে নি মেঘ। হয়তো একটু ভেতরে। খাবার ঘর আর বসার ঘরের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাকা রয়েছে। সেই ফাকা জায়গা থেকেই একটা ছোট্ট বারান্দা মতো গেছে। সরু জায়গা। দুদিকে দেয়াল। বামদিকে বাথরুম। ডানদিকে হয়তো শোবার ঘর। সোহিনী নিশ্চয় ওখানে থাকে। আবার নাও থাকতে পারে। ভেতরে আরো রুম থাকতে পারে। জানা নেই মেঘের। সে এখন আড়চোখে সোহিনীকে দেখছে। তার কাজকর্ম দেখছে। মেঘকে বসিয়ে রেখে নিরবতায় কাজ করে চলেছে সে। কখনো রান্নাঘরে যাচ্ছে, কখনো টেবিল ঠিক করছে, কখনো ফ্রিজে কিছু রাখছে, কখনো ফ্রিজ থেকে কিছু বের করছে। মেঘের মনে হচ্ছে তার জন্য বিশেষ কিছু রান্না করছে সোহিনী। কিন্তু খাওয়ার সময় তার সে ধারনাও ভুল প্রমাণিত হলো। টেবিলে বিশেষ কিছু নেই। পাঁচ ছটা রুটি, ছোটখাট বোলে ভাত, এক বাটিতে ডাল, অন্যটায় সবজি ভাজি। দুটো প্লেইট রাখা দুদিকে। মেঘ খেতে বসে উপলব্ধি করলো এই সাধারন খাবারটাও অসাধারন লাগছে তার কাছে। সোহিনী এতো দারুণ রাঁধতে জানে তা সে জানতো না।

খাওয়া শেষ হতেই স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো সোহিনী,

‘এখন চলে যাবি না কি আরো একটু সময় থাকবি?’

মেঘ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

‘আমি কেনো এসেছি জানতে চাইবি না?’

‘তোর বলার হলে বল। শুনবো।’

‘এতক্ষন ধরে শুনতে মন চায় নি?’

সোহিনী টেবিল গোছাচ্ছিলো। মেঘের দিকে ফিরে বললো,

‘আমার তো এখনো শুনতে মন চাইছে না। তুই জিজ্ঞেস করলি তাই বললাম। অনেক রাত হয়েছে। বাড়ি ফিরবি তো।’

মেঘ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে স্থির চোখে দেখলো সোহিনীকে। তারপর সোফায় বসে পরলো। হাত পা টানটান করে বললো,

‘ভাবছি আজ বাড়ি ফিরবো না।’

‘তো কোথায় থাকবি?’

‘কেনো? এখানে থাকবো। আমার ব‌উয়ের কাছে।’

চমকে উঠলো সোহিনী। হাতের কাজ ফেলে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এলো মেঘের দিকে। বিস্ময়ি গলায় বললো,

‘মানে?’

দুষ্টু হাসলো মেঘ। বললো,

‘তুই না আমার ব‌উ। ব‌উকে ছাড়া বর একা কি করে থাকবে বল তো? আমি তো পারবো না। তাই ভাবছি এখন থেকে তোর সাথেই থাকবো। কাল গিয়ে আমার যাবতীয় জিনিস নিয়ে আসবো। বুঝলি!’

সোহিনীর চোয়াল ঝুলে যাওয়ার যোগার।

‘আবোল তাবোল কি বলছিস মেঘ?’

‘আবোল তাবোল না তো। সত্যি বলছি ব‌উ। তুমিই না আগে সবার সামনে বললে আমি তোমার স্বামী। অনেকদিন পর দেখা করতে এসেছি। আজকের রাত থাকবো।’

‘তুই তো জানিস, ওসব মিথ্যে বলছিলাম মেঘ! সবাই যেভাবে বলছিলো তাই না পেরে নিজের শেষ আশ্রয়টুকু বাঁচাতে বলেছি।’

মেঘ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠোঁট চ‌ওড়া করে হেসে বললো,

‘মিথ্যে কিসের ব‌উ। যা বলেছো সব তো সত্যিই।’

‘কোনটা সত্যি?’

রাগে কটমট করে তাকালো সোহিনী। দু হাত কোমরে বেঁধে তাকালো মেঘের দিকে। মেঘ ধীর পায়ে সোহিনীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

‘ইউ নো হুয়াট সোহু, তুমি যেদিন আমায় বিয়ের প্রপোজাল দিলে সেদিন‌ই তো আমাদের মন, আত্মা এক হয়ে গেছে। আমরা দুজন একে অপরকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি। আজ তুমি সেটাই বললে সবার সামনে। সব যখন সত্যিই তাহলে মিথ্যেটা কোথায়? ‌আমি তোমার বর তুমি আমার ব‌উ। চলো বাসর করি।’

ভড়কে গেলো সোহিনী। এতক্ষন মেঘের এগুনো দেখে পিছাচ্ছিলো সে। এবার থমকে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললো,

‘মজা করছিস আমার সাথে? এটা মজা করার মতো কথা হলো? ইডিয়েট!’

‘ছিহ! কি তুই তুই করছো? বরকে কেউ তুই করে বলে সোনা ব‌উ?’

সোহিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। মেঘ কি পাগল হয়ে গেছে? না কি ইচ্ছাকৃত ভাবে সোহিনীকে হেনস্তা করতে চাইছে? বুঝে উঠার আগেই সোহিনীর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো মেঘ। শক্ত হাত জোড়া দিয়ে সোহিনীকে আবদ্ধ করে তার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো মেঘ। সোহিনী ছুটোছুটি করছে না। অস্থির হচ্ছে না। চুপ করে মেঘের কাছে বন্দী হয়ে র‌ইলো।

‘প্রেম প্রেম পাচ্ছে সোহু।’

‘আমার বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।’

চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here