হিমি পর্ব-৫৪

0
838

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫৪.

বিকেলের শিথিল পরিবেশে উৎসবের উত্তেজনা, উদ্বেগ বেড়ে দ্বিগুন। গেস্ট রুম আর আউট হাউজ দুটোই আত্মীয় পরিজনে পরিপূর্ণ। নিচতলার বড় কক্ষে গানের আসর বসেছে। কয়েকজন উচ্চস্বরে গান গাইছে। তাদের মাঝখানে স্থির হয়ে বসে আছে মিশ্মি। চেহারায় হতাশা না কি লজ্জা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। গায়ের রঙ আগের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। সেই সাথে জড়তা ঘিরে ধরেছে তাকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ক্ষনে ক্ষনেই সবার হাসি ঠাট্টায় অসার হয়ে আসছে শরীর।

অথৈ হিমি আর তাহিরকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে গেলো। সেও এসেছে দুদিন হলো। ইয়াসির হলুদের দিন সকালে আসবে। এতে অবশ্য কোনো রাগ নেই অথৈর। সে দিব্যি লম্পঝম্প করছে। খুশি যেনো ধরছেই না তার। মিশ্মির বিয়ে। সেই ছোটবেলার খেলার সাথি পিচ্চি বোনটার বিয়ে। ভাবতেই ভীষন অবাক অবাক লাগছে তার। শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। অযথাই হাসছে। খুশি হচ্ছে। তার এই খুশিতেই যেনো মিশ্মির হৃদয়ের ক্ষত দ্বিগুন হচ্ছে। আফসোস সেই ক্ষত কারো নজরে পরে না।

-হিমিপু? আসবো?

দরজার বাইরে অথৈর গলা পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো হিমি। ক্লান্ত গলায় বললো,

-আয়।

অথৈ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। হিমিকে কাঁথা জড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতুহলী গলায় বললো,

-তুমি এসময় কাঁথা গায়ে দিয়ে কেনো? ঘুমাচ্ছিলে?

হিমি মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। চোখ টানটান করে বললো,

-মাথা ব্যাথা করছিলো। তাই একটু শুয়েছিলাম। কিছু বলবি?

-চা নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলাম। এসো।

-ইচ্ছে করছে না অথৈ।

-ইচ্ছে করছে না বললে তো হবে না। বিয়ে বাড়িতে এসে এভাবে গুম ধরে বসে থাকলে চলে? চা খেলেই মাথা ব্যথা সেড়ে যাবে। আচ্ছা, বাইরে না যেতে চাইলে এখানে এনে দেই?

হিমি কিছু একটা ভেবে বললো,

-মামু ফিরেছে?

-এখন ফিরবে।

-আসছি তাহলে।

অথৈ মাথা দুলিয়ে ঠোঁট চ‌ওড়া করলো। যেতে গিয়েও পেছন ফিরে আশপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,

-দুলাভাই কোথায়?

হিমি হাই তুলতে তুলতে নিচে নামলো। কাপড় ঠিক করতে করতে বললো,

-ফোন এসেছিলো একটু আগে। নেট‌ওয়ার্ক পাচ্ছিলেন না তাই বোধ হয় বাইরে গেছেন। দেখছি আমি।

__________________

বসার ঘরে হলুদ আর বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো। এমন সময় সদর দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢোকলেন হানিফ শরীফ। হিমি মামুকে দেখেই ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলো। উচ্ছল গলায় বললো,

-মামু?

হানিফ শরীফ কারো সাথে কথা বলছিলেন। কথায় এতোই মগ্ন ছিলেন যে বসার ঘরের কারো দিকেই নজর যায় নি। হিমির গলা কানে আসতেই চমকে সেদিকে তাকালেন তিনি। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঠোঁটে ফুটলো হাসি। হাসি হাসি মুখে বললেন,

-হিমি মা! কেমন আছিস?

হিমি দ্রুত পা ফেলে হানিফ শরীফের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তিনিও একহাতে জড়িয়ে নিলেন ভাগ্নীকে। সিঙ্গেল সিটেড সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো তাহির। হানিফ শরীফ এবার তাহিরের দিকে তাকালেন। সালামের জবাব দিতে দিতে হিমিকে জড়িয়ে রেখেই কয়েক কদম এগুলেন। বললেন,

-কেমন আছো বাবা? তোমার মা কেমন আছেন?

-জি আলহামদুলিল্লাহ।

-তোমরা এসেছো দেখে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বুঝাতো পারবো না।

কথাগুলো বলতে বলতে ঘাড় কাত করে হিমির দিকে দেখলেন তিনি। হিমি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হানিফ শরীফ বললেন,

-এ কি কান্ড করেছো জামাই? আমাদের মেয়ে যে পুরো চেঞ্জ। মাশা আল্লাহ। সেই ছোটবেলায় ফ্রক, স্কার্ট পরে ঘুরতো। তারপর আজ এতোবছর পর এমন ভাবে দেখছি। হা হা, এই মিরাকল কি করে হলো?

তাহির কিছু বললো না। মৃদু হেসে চুপ করে র‌ইলো। হিমি মুখ বাঁকালো,

-এখনো তো কিছুই দেখো নি। মিশুর বিয়েতে দেখো।

-মিশুর বিয়েতে! মিশুর বিয়েতে কি দেখবো?

-সেটা তো সারপ্রাইজ। এখন বলা যাবে না। শুধু বলতে পারি মিশুর বিয়েতে আমার দেয়া সারপ্রাইজ দেখে তোমাদের মাথা ঘুরে যাবে।

হানিফ শরীফ নিঃশব্দে হাসলেন। হিমির মাথায় আলতো করে ডান হাত বুলিয়ে বললেন,

-আচ্ছা।

…………………………

আমিনা বেগম একাই সব দিক সামলাচ্ছেন। রাদিবা বিয়ের কোনো কাজে হাত দেবেন না বলে অনেক আগেই জানিয়েছিলেন। সবার ধারনা ছিলো কথার কথা বলেছেন। বিয়ের সময় হলে এমনিতেই নিজ থেকে সব করবেন। যতোই হোক ছেলের বিয়ে। কিন্তু রাদিবা কথার কথা বলেন নি বরং প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন। বাড়ি ভর্তি মেহমান রেখে তিনি নিজের ঘরে বসে আছেন। কখনো যাও বা ঘরের বাইরে পা রাখছেন তাও নিজ দরকারে। হয় রান্নাঘরে চা জ্বাল দিচ্ছেন নয়তো শ্বশুরকে ঔষধ পত্র দিচ্ছেন। বিয়ে বাড়ির কাজের চাপে আমিনা শ্বশুরের দেখভাল করতে পারছেন না। শ্বশুরের দেখাভালের পুরো দায়িত্ব প্রথমবারের মতো রাদিবার ঘাড়ে। এতে রাদিবা কিছুটা গর্ব অনুভব করছেন।

-ছোট ব‌উমা? বলি কি, ভুলে যাও। রাগ, অভিমান সব ছেড়ে দাও। ছেলে তো তোমার‌ই। ওর মনে কষ্ট দিও না। মাকে কষ্ট দিয়ে কোনো সন্তান ভালো থাকে না। তোমার অভিশাপ লেগে যাতে পারে।

রাদিবা ঔষধের শিশি থেকে বড়ি বের করতে গিয়ে থেমে গেলেন। কিছুক্ষন স্তব্ধ থেকে বললেন,

-আমি কাউকে অভিশাপ দিচ্ছি না বাবা।

-তুমি দিচ্ছো না কিন্তু তোমার এই অভিমান, রাগ, কষ্ট সব যে তোমার ছেলের উপর দিয়ে যাবে না তা কি করে বলতে পারো? নিহানের বৈবাহিক জীবনে প্রভাব ফেলবে এসব। এমনটা করো না। এখানে কারো কোনো দোষ নেই ব‌উমা। যদি থেকেও থাকে তবে সেটা আমার। তুমি আমার উপর রাগ করো। তবুও এভাবে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখো না।

রাদিবা বড়ি দুটো বের করে মতিউর রহমানের হাতে দিলেন। কাঁচের গ্লাসে পানি ঢেলে পরিপূর্ণ করে বললেন,

-আমি এসবে হাত না লাগালেও কিছু আটকাবে না। আপা আছেন। বড় ভাই, মুহিব ভাই, আপনার ছোট ছেলে সবাই আছেন। ওনারা সব সামলাতে পারবেন। আমি রাগ করিনি।

কথা শেষ করে পানি এগিয়ে দিলেন মতিউর রহমানের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাস উঠিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালেন মতিউর রহমান। দু ঢোক পানি খেয়ে রাদিবার হাতে দিলেন গ্লাস। ঘন ঘন শ্বাস টেনে বললেন,

-সামলাতে তো যে কেউ পারবে। সেটা কথা নয়। কথা হচ্ছে বিয়েটা তোমার ছেলের। বিয়ে একবা‌র‌ই হয়। প্রত্যেক মানুষের যেমন নিজের বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তা থাকে তেমনি প্রত্যেক বাবা মায়ের নিজ সন্তানের বিয়ে নিয়ে আকাঙ্খা থাকে। আমি জানি তোমার‌ও আছে। কেনো এসব বলি দিচ্ছো? পরে আফসোস হবে।

রাদিবা মুখ ঘুরালেন। মশারি টানানোয় ব্যস্ত হয়ে চোখের পানি আড়াল করলেন। মতিউর রহমান ভুল বলেন নি। রাদিবার ছেলের বিয়ে নিয়ে আকাঙ্খা ছিলো। ইচ্ছে ছিলো। একমাত্র সন্তান। তার বিয়ে কি যেমন তেমন হলে চলে? ধুমধাম হবে বিয়েতে। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় আসবে। এক মাস ব্যাপী কেনাকাটা, প্ল্যানিং চলবে। ব‌উ হবে রাদিবার নিজের পছন্দের। বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, আয়োজন সব রাদিবা করবেন। নাচ, গান, হৈ হুল্লোর হবে। ছেলের ব‌উকে দেখে তাক লেগে যাবে সবাই। গর্ব হবে রাদিবার। ছেলে ব‌উ ঘরে আসবে। বরণ উনিই করবেন। সবকিছুই উনি করবেন। কোথায় গেলো সেসব পরিকল্পনা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা? কোথায় সেই খুশি রাদিবার? নেই। কিচ্ছুটি নেই। ভাবতে ভাবতেই নিজেকে শক্ত করলেন রাদিবা। তিনি যে রেগে আছেন এবং বিয়েতে কোনো প্রকার মত দেন নি তাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন। সমস্যা হলো মতিউর রহমান ছাড়া আর কেউ ওনার এই রাগ ধরতে পারছে না। রাগকে জেদ ভেবে বসে আছেন সবাই। মতিউর রহমান যেভাবে তাকে বিয়ের কাজে হাত লাগাতে বলছেন আর কেউ বলছে না। ভাবসাব এমন, ‘করলে করো না করলে নাই। আমরা আছি। তোমার এখানে কোনো রাগ, জেদ খাটবে না। সংসারে তোমার স্থান নগন্য!’

……………………………

রাত নটা। বসার ঘরে মোজাম্মেল সাহেব লিস্ট করছেন। ডেকোরেটোরের লোকগুলো ভীষন পাঁজি। ঠিকমতো সাজাচ্ছে না। প্লাস্টিকের গোলাপ না এনে অন্য আরেক ফুল নিয়ে এসেছে। এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেদের মতো করেই সাজাচ্ছে। আশ্চর্য, বিয়েটা কি ওদের? মোজাম্মেল সাহেব আবার‌ও সব ফুল ছুটিয়িছেন ওদের দ্বারা। সেই সাথে আরো হরেক রকম ফুল, ডেকোরেশনের সামগ্রী আনাচ্ছেন। ওনার মতে পুরো বাড়ি লাল রঙের ফুল দিয়ে সাজানো উচিত। লাল গোলাপের সাথে সাদা গোলাপ। লাল সাদার কম্বিনেশন বরাবর‌ই ভালো লাগে ওনার। কিন্তু বাধ সাধছেন আমিনা। ওনার মতে লাল সাদা গোলাপ শুধু নিহানের শোবার ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহার হবে। তাও প্লাস্টিকের না। আসল, সতেজ ফুল। বাকি কোনো ঘর সাজানোর দরকার নেই। বাড়ির বাইরেটা সুন্দর করে লাইটিং করলেই হলো। হলুদ, বিয়ে, রিসেপশন তিনটাই ক্লাবে হবে। সুতরাং শুধু শুধু ফুল দিয়ে ঘর ভরে লাভ নেই। তার‌উপর প্লাস্টিকের ফুল। না সুগন্ধ আর না প্রয়োজন। অযথাই আবর্জনা। এ নিয়ে বার কয়েক কথা কাটাকাটি হ‌ওয়ার পর হার মেনেছেন আমিনা। রাগে গজগজ করতে করতে বসার ঘর ত্যাগ করেছেন। মুহিব রহমান ক্যাটারিং সামলাচ্ছেন। যদিও হলুদের অনুষ্ঠানে কি কি খাবার থাকবে সেটার লিস্ট মোজাম্মেল সাহেব‌ই করেছেন। নেহাল রহমান অফিস থেকে ফিরে আর কাপড় পাল্টান নি। হাত মুখ ধুয়ে চা নিয়ে বসেছেন। সবার কাজ দেখছেন। পাশের ঘর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিহানের মামাতো ভাই বোনেরা নিহানকে নিয়েই পাশের ঘরটায় জটলা পাকিয়েছে। নাচ প্র্যাক্টিস করছে। হলুদ সন্ধ্যায় তাদের খাস পারফর্মেন্স আছে। গোপন তথ্যে জানা গেছে কনে পক্ষ ভয়াবহ কোনো প্ল্যান করছে। নিহানের ধারনা তারা ডান্স পারফর্ম করেই বাজিমাত করতে চাইছে। মিশ্মির কাজিনদের মধ্যে দুজন আবার অসাধারন নাচে। তাদের টেক্কা দিতেই বরপক্ষের এতো আয়োজন।

দু বাড়িতেই হুলুস্থুল চলছে। কাল গায়ে হলুদ। পরদিন বিয়ে। একদিকে নিহান তার ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা। অপরদিকে মিশ্মি তার ভালোবাসা হারিয়ে পাগল প্রায়। কোনো আনন্দ, উচ্ছাস স্পর্শ করছে না তাকে। সব যেনো ফ্যাকাসে।

চলবে,,,,,,,,,

[এবার আর কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না আশা করি। কাল সময় মতো হলুদের অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ র‌ইলো। বিয়ের দাওয়াতটাও আজ দিয়ে দিচ্ছি। পরে আবার বলবেন, ‘খালি হলুদের দাওয়াত😏’!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here