হিমি পর্ব-৬৯

0
1737

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৬৯.

সময় কখনো থেমে থাকে না। নিজ গতিতে এগুতে থাকে। পরিস্থিতি বদলায়। পরিবেশ বদলায়। মানুষজন‌ও বদলায়। বদলে যায় বহু সম্পর্ক। কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়। কেউ পায় কেউ হারায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যেমন মিশ্মির কোল আলো করে নিনিত এসেছে আর অথৈ মা হ‌ওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। গর্ভবতী হ‌ওয়ার সবে দু মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়েছিলো তার। প্রথম বাচ্চা হ‌ওয়ার সুখ পুরোপুরি গ্রহণ করার আগেই সুখ চলে গেলো। শোকে কাতর অথৈ ডিপ্রেশনে চলে গেছিলো। একটা বছরের‌ও বেশি সময় লেগেছে তাকে সহজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।

নিনিতের বয়স দেড় বছর। আধো আধো বুলিতে কথা বলে এখন সে। টলমলে পায়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। মুখ ভর্তি হাসি দিলে ছোট্ট ছোট্ট মুক্তোর মতো দাঁতগুলো দেখা যায়। ফুলে থাকা গাল দুটো অসম্ভব নরম আর তুলতুলে। ঠোঁটটা নিহানের মতোই চিকন। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যা। দাদা, দাদুদের সাথে খেলেই তার দিন পার হয়।

মায়মুনা জামান আর হিমির মধ্যকার সম্পর্ক এখনো আগের মতোই আছে। কোনো উন্নতি নেই। এখনো হিমিকে তার আজগুবি কাজ কর্মের জন্য বকাঝকা করেন মায়মুনা। চোখ মুখ কুঁচকে তাকান। বিরক্ত হন তার উপর। হিমিও তার প্রাণপণ চেষ্টা করে শাশুড়ি কে খুশি করতে। তবে পারে না। কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে মায়মুনা হিমির খুঁত ধরেন। ছোটখাট শাস্তিও দেন ছেলের ব‌উকে। এসব কথা তাহির অব্দি পৌঁছায় না। ব‌উ শাশুড়ির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

হৃদি লন্ডন ফিরে গেছে গত বছর। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝামেলা মিটাতেই তাড়াহুড়া করে গেছিলো। অতঃপর ঝামেলা গুরুতর হলো। হৃদির পরিবার জেনে গেলো তার পাঁচ বছরের পুরনো সম্পর্কের কথা। অবাক করার বিষয় হলো কারো প্রতিক্রিয়াই হৃদির বিরুদ্ধে ছিলো না। সকলেই খুশি মনে হৃদির সম্পর্ক মেনে নিয়েছেন। আগামী বছর তাদের বিয়ে হবে। ছেলের পুরো পরিবার লন্ডন প্রবাসী। শুধুমাত্র বিয়ের উদ্দেশ্যেই দেশে আসবে সে। এতে কারো কোনো আপত্তি নেই। মায়মুনা প্রথমে প্রেম ভালোবাসার বিয়ে মেনে নিতে না চাইলেও হৃদির বাবা মা মেনে নিয়েছেন বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায় দিয়েছেন। যদিও ওনার সায়ে কারো কিছুই যায় আসে না।

আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মিষ্টি করে হাসলো হিমি। শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে দিয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখতে লাগলো। ভালোই লাগছে। যদিও আগের চেয়ে অনেকটা স্বাস্থ্যবতী হয়ে গেছে সে। শরীর ফুলে গেছে। গালে মাংস বেড়েছে। ঘন দীর্ঘ কোঁকড়ানো চুল পরে এক গাছি হয়ে গেছে। গায়ের রঙ আগের চেয়েও বেশি ফর্সা লাগছে। পেট ফুলে বড় হয়েছে। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা হিমি নিজের পরিবর্তনে নিজেই অবাক। বহুদিন পর মেক্সির পরিবর্তে শাড়ি পরতে পেরে তার খুশি যেনো ধরছেই না। অতীতের কথা ভেবে বিস্ময়ে হাসি পেলো তার। যে মেয়ে সালোয়াড় কামিজ পরতে চাইতো না সে শাড়ি পরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। জিন্স টি শার্ট ছাড়া যার চলত‌ই না সে দু বছর যাবত জিন্স পরে নি। অদ্ভুত লাগে তার।

“হয়েছে তোমার?”

মিশ্মির প্রশ্নে পেছন ফিরলো হিমি। উঁচু গলায় বললো,

“ভেতরে আয়।”

মিশ্মি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। হলদে শাড়িতে মোড়ানো হিমিকে দেখে এক চিলতে হেসে বলে,

“কি দারুণ লাগছে আপু বলে বুঝাতে পারবো না। আগের থেকেও অনেক অনেক সুন্দর লাগছে।”

হিমি শাড়ির আঁচল পিন আপ করতে করতে বললো,

“মিশু? ফুল আনা হয়েছে? সব ব্যবস্থা ঠিক ঠাক করা হয়েছে?”

“হ্যা রে বাবা। যেমনটা চেয়েছো তেমনটা হয়েছে সব। ওতো চিন্তা করতে হবে না। বলছি, চুল খোপা করবে?”

হিমি মাথা নাড়লো। সেইফটি পিন দিয়ে শাড়ির আঁচল আটকে বললো,

“এই চুলে খোপা হলে হয়! ছাড়াই থাক। তুই একটু আঁচড়ে দে। ও বাড়ি থেকে সবাই আসবে কখন?”

মিশ্মি জবাবে বলে,

“আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। তুমি কিছু খাবে? তাহির ভাইয়া বলে দিয়েছে কিছুতেই তোমায় খালি পেটে রাখা যাবে না। তার উপর যা ধক‌ল যাচ্ছে।”

হিমি মাথা নাড়ে। আয়না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে কাজলের পেন্সিল হাতে উঠায়। হালকা করে দু চোখে কাজল টানে। মিশ্মি কৃত্রিম ফুলের গয়না পরিয়ে দেয় হিমিকে। বাইরে থেকে ডাক ভেসে আসে। তাহিররা এসে গেছে। হিমির চেহারায় লাজুকতা।

তাহির আর হিমির বিয়েটা আচমকা হয়ে যাওয়ায় কেউই আনন্দ করতে পারে নি। আর না নিজেদের আশ মিটেছে। হিমি আর তাহির‌ও চাইছিলো বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। ধুমধাম করে গায়ে হলুদ, মেহেদী, বিয়ে হবে। হিমিকে আবার‌ও ঘরে তুলবে তাহির। তবে এমন সময় চায় নি সে। ভেবেছিলো বাচ্চা হ‌ওয়ার দু এক বছরের মাথায় করবে। কিন্তু বাধ সাধলো হিমি নিজে। এতগুলো দিন কিছুই বলে নি। বললো প্রেগন্যান্সির ষষ্ঠ মাসে। সে এই প্রেগন্যান্সিতেই বিয়ে করতে চায় তাহিরকে। শুধু তাহির কেনো হিমির এই জেদ কেউ মানে নি। এমন সময় বিয়ের মতো একটা অনুষ্ঠান করা উচিত হবে না। হিমি শুনে নি। জেদ করে গেছে। মুড সুয়িং এর প্রভাবে কান্না কাটি করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করার উপক্রম করেছিলো। বাধ্য হয়েই তার কথা মেনে নিতে হয়েছে। তাহির হিমিকে তার বাপের বাড়ি রাখতে চায় নি। সে চেয়েছিলো নিজ বাড়িতেই বিয়ে হবে। হিমি তার চোখের সামনেই থাকবে। এতেও গাল ফুলিয়েছে হিমি। বিয়ে হবে বিয়ের মতো। কনে বাপের বাড়ি থাকবে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি আসবে। তাহির যখন রাগ দেখিয়ে বকাঝকা করে মানা করে দেয় তখন শুরু হয় হিমির ইমোশনাল ব্লেইকমেলিং। শেষমেষ রাজি হতে হলো। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করে ব‌উকে ঘরে তোলার শর্ত রেখেই আজ গায়ে হলুদ আর মেহেদী হবে। পরদিন দুপুরেই বিয়ে। সমস্ত অনুষ্ঠান হিমিদের বাড়িতে হবে। ক্লাব, কনভেনশন সেন্টার, হল এসবে হিমিকে নিয়ে যাওয়া আসার রিস্ক নিতে চান না কেউ। প্রথম প্রেগন্যান্সি বলে কথা!

বসার ঘরে সোফা সরিয়ে স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানেই বসে আছে হিমি তাহির। হিমির এক হাত তাহিরের হাতের মুঠোয়। জনে জনে সবাই এসে একটু খানি হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে তাদের। ক্যামেরা ম্যানরা প্রত্যেকটি মুহুর্ত ক্যামেরা বন্দী করায় ব্যস্ত। আর হিমি ব্যস্ত প্রত্যেকটি মুহুর্ত উপভোগ করায়। তাহির একটু পর পর‌ই ক্যামেরা ম্যানদের থামিয়ে দিয়ে হিমিকে ফল খাওয়াচ্ছে। তার অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চাচ্ছে। প্রত্যেকবার‌ই হিমি হাসি হাসি চেহারায় তাকাচ্ছে। তার হাসিমাখা মুখ দেখে তাহিরের ঠোঁটে হাসি ফুটছে।

চলবে,,,,,,,

[বি:দ্র: শেষ যেদিন গল্প পোস্ট করি সেদিন ছিলো চার তারিখ। আজ আঠারো। বুঝতেই পারছেন। লম্বা গ্যাপ। এই লিখাটা কিন্তু গত পরশু লিখেছি। পাঁচ তারিখ দু লাইন মতো লিখেছিলাম। আর বাকিটা পরশুদিন। এখনি পোস্ট করতে চাই নি। ভেবেছিলাম আরো কদিন লাগিয়ে বড় করে লিখে তবেই দেবো। তবে আর কবে লিখবো সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাই যতটুকু লিখা আছে ততটুকুই দিলাম। বলেছিলাম অপেক্ষা করাবো না। দূর্ভাগ্যবসত করাতে হচ্ছে। আব্বু এখনো হসপিটালে। অক্সিজেন লেভেল আপ ডাউন করছে। পুরোপুরি সুস্থ না হলে সিলেট থেকে ফিরবেন না। আমরাও ততদিন স্বস্তি পাচ্ছি না। আপনারা অনেকেই অপেক্ষা করছেন হয়তো। হয়তো বা বিরক্ত হচ্ছেন। তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। দোয়া করবেন আব্বুর জন্য। উনি সুস্থ হয়ে গেলেই নিয়মিত হবো। আর দু এক পর্বেই শেষ করতে চাইছি গল্পটা। এতোদিন সাথে ছিলেন আশা করি শেষ অব্দি থাকবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here