অজানা পর্ব-৬০

0
895

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৬০

💝

শীতের সকাল। ধোঁয়া উঠানো কফির মগ সামনে নিয়ে বেলকনিতে ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে আছে আরিবা। কুয়াশায় মোড়ানো সকাল। চারদিকে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। কিছুই দেখা যায়না। আবছা আবছা পাতা বিহীন গাছগুলো দেখা যাচ্ছে। শীতের জন্য সব পাতা ঝরে গেছে। আরিবারর জীবনটা একেবারেই ঝরা পাতার মতো হয়ে গেছে। কাউকে বলার মতো বা দেখানোর মতো না ওর কষ্ট। তবুও সব সময় সবার মাঝে হাসি খুশি থাকে। আরিবা এখন আর আগের মতো নেই। গম্ভীর হয়ে গেছে। আরশের সাথে সাথে যেনো ওর চঞ্চলতা সব হারিয়ে গেছে। বেলকনিতে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আরিবার চোখে জল চলে এলো। ও ভেবে পায়না আর কখনও কি ওর জীবনে খুশি আসবেনা? কেনো এমন হলো? হঠাৎ আরিবার ফোনটা বেজে উঠলো। ওর একটুও ফোন ধরতে ইচ্ছে করছেনা। অনেকক্ষন ধরে রিং হয়েই যাচ্ছে। ফোনের শব্দ শুনে মিসেস আয়শা আরিবার রুমে এলেন। ফোনটা হাতে নিয়ে আরিবার কাছে গিয়ে বললেন।

“এভাবে আর কতদিন? এবার নিজেকে একটু গুছিয়ে নে। ওটা দেখে আমরাও একটু শান্তি পাই। আমাদের হাশি মুখ দেখালেই আমরা ভাববো তুই ভালো আছোছ?”

আরিবা কথার উওর দিলো না। চোখের পানিটা মুছে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। মিসেস আয়শা রেগে চলে গেলেন। আরিবা দিন দিন খুব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথা বললে উওরেই দেয়না। আরিবা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো শান্তার নম্বর থেকে কল এসেছে। আরিবা এটা দেখেই ঘাবড়ে গেলো। তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করলো। কল দিতেই কল ধরে ওপাশ থেকে শাহীন বলে উঠলো।

“আলহামদুল্লিলাহ তোমার বান্ধবীর ছেলে হয়েছে।”

আরিবার মুখে হাশি ফুঠলো। স্বল্প স্বরে হেসে বললো।

“অভিনন্দন ভাইয়া। কখন হয়েছে? শান্তা আর ওর ছেলে সুস্থ আছে?”

” আলহামদুল্লিলাহ সুস্থই আছে। ফোন দিবো? শান্তার সাথে কথা বলবা?”

“না ভাইয়া থাক। আমি একটু পড়েই আসছি ওকে দেখতে।”

কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলো আরিবা। তাড়াতাড়ি করে কফিটা শেষ করে রেডি গয়ে নিচে নামলো। আরিবাকে এত সকালে বের হতে দেখে মিসেস তারিন আর মিসেস আয়শা আবাক হলেন। মিসেস তারিন আরিবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

“কিরে এত সকালে কোথায় যাচ্ছিছ?”

আরিবা সামনে আগাতে গিয়েও থেমে গেলো। মিসেস তারিনের দিকে তাকিয়ে বললো।

“হসপিটালে যাচ্ছি। কেনো কোনো দরকারি কাজ আছে?”

হসপিটালের কথা শুনেই ভয় পেলেন মিসেস তারিন। তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞাসা করলেন।

“কেনো কি হয়েছে? ও ভালো আছে?”

আরিবা গম্ভীর হয়ে বললো।

“শান্তার ছেলে হয়েছে। ওকেই দেখতে যাচ্ছি।”

মিসেস তারিন ও মিসেস আয়শা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মিসেস তারিন হাসি মুখে বললেন।

“আলহামদুল্লিলাহ! এতো খুব খুশির খবর। শান্তা আর ওর ছেলে সুস্থ আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ দুজনেই ভালো আছে।”

মিসেস তারিন আর কিছুই বললেন না। মিসেস আয়শা আরিবার দিকে তাকিয়ে বললেন।

“সবাই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। সবাই সবার জায়গায় সুখি আছে। তুইও এবার একটু নিজেকে গুছিয়ে নে! সময় যেতে যেতে তো পাঁচ টা বছর তো চলে গেলো। আর কত?”

আরিবা আর দাড়ালো না। সামনে আাগাতে আাগাতে বললো।

“আমি অনেক গোছানো আছি। আমার নিজেকে আর গোছানো লাগবে না। এই কথা দ্বিতীয় বার যেনো না শুনি!”

মিসেশ আয়শা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মিসেস তারিনের দিকে তাকালেন। তারিন চোখের পানিটা মুছে নিজের কাজে চলে গেলেন। তার গোছানো সংসার এক নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

———————————-

গাড়িতে করে মেডিকেলের দিকে যাচ্ছে আরিবা। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। আরিবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। এখনও কুয়াশায় ঘেরা চারদিক। সকালের সূর্য পূর্বাকাশে উকি দেয়নি এখনও। আরিবা বাইরের ঘোলাট পরিবেশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো। মনে মনে ভাবলো কি ভাবে যে ৫বছর কেটে গেলো ও বুঝতেই পারেনি। আরশের ইচ্ছে ছিলো আরিবা ডক্টর হবে কিন্তু সে ইচ্ছে আরিবা পুরন করতে পারেনি। বিভিন্ন ঝামেলা আরশের ওই অবস্থায় খুব ভেঙে পড়েছিলো আরিবা। তাই আর ডক্টর হয়ে উঠা হয়নি। নিজেকে গুছিয়ে অনেক কষ্টে অনার্স শেষ করেছে আরিবা। এখন নিজেদের বিজনেস দেখাশুনা করছে ও। আরিবার মতো শান্তাও মেডিকেলে পড়তে পাড়েনি। ওর এইচএসসি রেজাল্ট বের হওয়ার কদিন পড়েই বিয়ে হয়ে যায়। তাই ও মেডিকেল বাদ দিয়ে অনার্স করেছে। তূর্য আর শাওন মেডিকেলে পড়েছে। ওদের পড়া শেষ শুধু ইন্টার্নি বাকি। ওদের কথা মনে পড়তেই আরিবা ওদের কল দিয়ে মেডিকেলে আসতে বললো।
মোবাইলেই দিকে তাকাতেই ওয়ালপেপারে আরশের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটি ভেসে উঠলো। আরিবা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ভাবলো আরশকে হসপিটালে নেওয়ার দিনের কথা।

—————————

আরশকে আইসিইউ তে ডুকানো হলো। বাড়িতে খবর দিতেই মিসেস তারিন কেদে ফেললেন। মি. জাকিক আর মি. বফজাল জরুরী মিটিংয়ে আছে। খবর শুনে কেঁদে কেঁদে তাড়াতাড়ি করে হসপিটালে আসলেন মিসেস তারিন। ছেলের জন্য হাউমাউ করে আরিবাকে জিজ্ঞাসা করলেন।

“কিরে মা? আমার ছেলের এই অবস্থা কে করেছে?”

সজল রেগে আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“যে আপনার ছেলের এই অবস্থা করছে তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন?”

কথাটা কানে যেতেই বিদ্যুতের মতো চমকে উঠলেন মিসেস তারিন। আরিবা নিরব হয়ে বসে আছে। মিসেস তারিন কেঁদে কেঁদে আরিবাকে জিজ্ঞাসা করলেন।

“কেনো এমন করলি মা? আমার ছেলে কি দোষ করেছে?”

কথাটা শুনেই আরিবা নিচের দিকে তাকিয়ে বললো।

“আমার আম্মুকে মেরে ফেলেছে আরশ ভাইয়া!”

কথাটা শুনে আরও চমকে গেলো সবাই। সজল কথাটা শুনে রেগেমেগে বললো।

“আপনার আম্মুকে কে মেরেছে? আপনার আম্মু বেঁচে আছে।”

আরিবা আর মিসেস তারিন আবাক হয়ে তাকালেন। আরিবা কান্না ভেজা কন্ঠে বললো।

“আমার আম্মুকে আমি নিজ চোখে কবরে রেখে আসতে দেখছি। আর আপনি বলচেন বেঁচে আছে? ”

সজল জোর গলায় বললো।

“বেঁচে আছে বলেই বলছি বেঁচে আছে! দাড়ান আমি এখুনি প্রমান দিচ্ছি।”

কথাটা বলেই সজল একজনকে ফোন করলো। কথা বলা শেষে বললো।

“একটু পরেই উনি আসছেন।”

আরিবা আর মিসেস তারিন চুপ করে রইলেন। কিছুই বললেন না। দুজনের মনেই আঘাতে জর্জরিত। কিছুক্ষণ পরেই সজল বললো।

“ওই যে আপনার মা!”

সজলের ইশারা অনুশরন করে তাকাতেই আরিবা অবাক হয়ে গেলো। দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললো।

“আরে আপনি ওই গুপ্তঘরের মহিলা না? আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? কি যেনো আমায় বলতে চেয়েছিলেন?”

মহিলাটি আরিবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস তারিন আবাক হয়ে ভাবলেন তাহলে গুপ্তঘর সত্যি ছিলো? সজল সবার নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো।

“হ্যাঁ, উনিই আপনাদের গুপ্তঘরে বছরের পর বছর বন্দী ছিলো। উনি এতদিনে মরেই যেত যদি আরশ স্যার না থাকতো।”

কথাটা বলেই একটু থামলো সজল। আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“আরশ স্যার না থাকলে আপনি এবং আপনার মা মিসেস আয়শা এতদিনে পরপারে চলে যেতেন।”

“আপনার মা” কথাটা শুনেই চমকে গেলো আরিবা ও মিসেস তারিন। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে দুজনেই। মিসেস আয়শা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে আরিবাকে দেখছে। কত বছর পর নিজের মেয়েকে দেখছেন। মিসেস আয়শা আরিবার গাল হালকা করে ধরে বললেন।

“একদম দেখতে তোর বাবার মতো হয়েছিস। ওরা তো তোর বাবাকে মেরে দিয়েছে। একদম মেরে দিয়েছে।”

আরিবা রেগে ওনার হাতটা ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো। জিদ নিয়ে চিল্লিয়ে বললো।

“আপনি আমার আম্মু না। আমার আম্মু আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আপনি কিছুতেই আমার আম্মু হতে পারেন না। আমার আব্বু মারা যায়নি বেঁচে আছে। পাগলের মতো কথা বলবেন না আপনি!”

সজল আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“ম্যাম আপনি শান্ত হন। বিশ্বাস না হলে আপনি মিসেস তারিনের কাছে জিজ্ঞাসা করে দেখেন।”

কথাটা শুনেই মিসেস তারিন এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। আরিবা রেগে সজলের দিকে তাকিয়ে বললো।

“জিজ্ঞাসা করার কিচ্ছু নেই। উনি আমার আম্মু না!”

কথাটা বলতেই সজল মিসেস তারিনের দিকে তাকিয়ে বললো।

“ম্যাডাম! দয়া করে আর চুপ করে থাকবেন না। আপনার কথায় একটা মেয়ে তার জন্মদাত্রী মাকে পেতে পারে। প্লিজ সত্যিটা সবাকে বলুন! আমি জানি আপনি অবশ্যই কিছু না কিছু জানেন। প্লিজ ম্যাডাম বলুন!”

মিসেস তারিন আরিবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। হতাশ গলায় বললো।

“আমরা আগে সিলেটে থাকতাম। জাকির আর আফজাল ঢাকায় চাকরি করতো। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার ছিলাম। আরশের তখন ৭বছর। জাকির বিয়ে করেছে পাচ বছর কিন্তু ওদের কোনো সন্তান ছিলোনা। আন্জু দিনরাত সন্তানের জন্য কাঁদতো। হঠাৎ একদিন আফজাল আর জাকিরের চাকরি চলে যায়। ওরা সিলেটে চলে আসে। আমাদের সংসারে শুরু হয় অভাব। এসব দেখে কদিন পর ওরা আবার ঢাকায় যায়। দুদিন পর একটা একবছরের মেয়ে নিয়ে ফিরে যায়। জাকির ওটা আন্জুর কোলে দিয়ে বলে এটা তোমার মেয়ে। জাকির আর আন্জু ওইদিন থেকে খুব খুশি ছিলো। জাকির নিজের থেকেও মেয়েকে বেশি ভালোবাসতো। আন্জুও খুব যত্নে রাখতো মেয়েটাকে। বাড়ির সবাই খুব ভালো বাসতো ওকে। আরশ সবার থেকে বেশি পাগলামো করতো ওকে নিয়ে। আন্জু আর জাকির নিজেদের নামের সাথে মিলিয়ে মেয়েটির নামও রাখে জান্নাতুল ফেরদৌস আরিবা।”

এটুকু বলেই থেমে যান মিসেস তারিন। আরিবা অবাক হয়ে তাকালো। তাহলে এতদিন যাদের মা বাবা যেনে আসছে তারা ওর মা বাবাই না? আরশ ঠিকই বলতো ওকে পালতে আনছি! আরিব আস্তে করে চেয়ারে বসে পড়লো। সজল মিসেস আয়শাকে আরিবার পাশে বসালো। মিসেস তারিন পাশেই বসা ছিলেন। সজল মিসেস আয়শার দিকে তাকিয়ে বললেন।

“আপনার সাথে কি হয়েছিলো সব খুলে বলুন!”

মিসেস আয়শা আরিবার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন।

💖

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

(রি চেইক করিনি। এগুলো সব কল্পনা। কালকের পর্বে অতীত ক্লিয়ার করবো ইনশাআল্লাহ। সবাই বেশি রেসপন্স করলে তাড়াতাড়ি গল্প দিবো। রেসপন্স না পেলে গল্প লিখার মুড থাকেনা। শুভ রাত্রি গাইস্)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here