অজানা পর্ব-৬১

0
996

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৬১

💖

আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে। নাবিলার বয়স ১বছর তখন। একদিন রাতে আমি নিজের মেয়ে নাবিলাকে নিয়ে সোফায় বসে ছিলাম। হঠাৎ করে দেখি বাড়ির ভিতরে জাকির আর আফজাল প্রবেশ করলো। নাজমুল টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলো। ওদের দেখেই রেগে দাড়িয়ে গেলো। কারন ওরা আমাদের কম্পানির সব ডিটেইলস অন্য কম্পানিকে গোপনে টাকার বিনিময়ে দিয়েছিলো। তাই নাজমুল ওদের চাকরি থেকে বের করে দিয়েছিলো। ওইদিন ওদের দেখে খুব রেগে যায়। নাজমুল রেগে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে।

“তোমরা? আমার বাড়িতে এত রাতে কি করছো?”

মি. জাকির আস্তে করে বললো।

“আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দিন। আমরা এই ভুল আর করবো না স্যার!”

নাজমুল রেগে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“ওটাকে ভুল বলে না। ওটা হলো বেইমানী! বেইমানদের স্থান আমার কাছে নেই। বেরিয়ে যাও!”

মি. আফজাল মি. জাকিরের দিকে তাকিয়ে বললো।

“মনে হয় এ সোজা কথায় কান দিবে না।”

“তাহলে তো আঙ্গুল টা বাকাতেই হয়।”

মি. জাকির হালকা হেসে কথাটা বললো। মি. নাজমুল হক কিছুই বুঝতে পারলো না। তিনি গার্ডদের ডাকলেন কিন্তু রাত হয়ে গেছে বলে তেমন কেউ ছিলোনা। হয়তো যারা ছিলো তাদেরকে ওরা মেরেছে না হয় টাকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। নাবিলাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যাচ্ছিলাম হঠাৎ করেই মি. জাকির টেবিল থেকে ফল কাটার ছুড়ি নাজমুলের পেটে ডুকিয়ে দেয়। এটা দেখেই আমি ভয় পেয়ে যাই। দৌড়ে উপরে যাচ্ছিলাম নিজেদের রুমের গোপন রুমে ঢুকতে। আমি প্রায় ভিতরে চলে গিয়েছিলাম কিন্তু দরজা আটকানোর আগেই ওরা আমায় দেখে ফেলে। আমায় টেনে ওখান থেকে বের করে। নাবিলা খুব কাঁদতে ছিলো। মি. আফজাল আমায় মারতে গেলে জাকির তাড়াহুড়ো করে বলে।

“ভাই থামো। সম্পত্তিতো সব এই মহিলার নামে। একে মারা যাবেনা।”

মি. আফজাল তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো।

“তাহলে এর থেকে সই নিয়ে ওকে মেরে দেই?”

“ওর থেকে সই নেওয়া যাবেনা। এখানে লিখা আছে ওর মেয়ের ১৮ বছর হলে ওর মেয়ের নামে সব ট্রানেস্ফার হবে। যদি ওর বউ ওর মেয়ের ১৮ বছর হওয়ার আগেই মারা যায় তবে সব সম্পত্তি শান্তিনিকেতন এতিম খানার নামে চলে যাবে যেখানে ওর মেয়ে থাকবে। তাহলে আমরা ফতুর?”

মি. জাকিরের কথা শুনে মি. আফজাল বললো।

“চল ওকে এই ওদের রুমেই বন্দী করে রাখবো। আন্জু তো সন্তান সন্তান করে। ওকে এই মেয়েটা নিয়ে দিয়ে দে। ১৮ বছর হলে দুজনকেই মেরে দিবো। এখন ওদের সম্পত্তি নিজেরা চালাই সবাইকে বলি মি. নাজমুল হক তার পরিবার নিয়ে লন্ডন চলে গেছে। এসব আমাদের দেখে রাখতে বলেছে।”

তখন থেকেই শুরু হয় আমার বন্দী জীবন। মাঝে মাঝে এসে আমার থেকে সই নিয়ে যেতো। আমি ভাবছিলাম আমার মেয়েকে মেরে দিয়েছে। কিন্তু ওই কাগজ দেখার পর জানতে পারি ও বেঁচে আছে। আরশ আসার পর আমার কষ্ট একটু লাঘব হয়। ও আমায় বলে যে আমাদের দুজনকেই ও বাঁচাবে।

কথাগুলো বলে মিসেস আয়শা চুপ করে রইলো। সজল আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“শুনছেন ওনার কথা? স্যার আপনাদের বাঁচিয়েছে। নাহয় আপনারা অনেক আগেই মরে যেতেন। স্যার ছোট থেকেই আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। একদিন মি. জাকির আর মি. আফজালের কথা সব শুনে ফেলে আরশ স্যার। তারা বলছিলো আপনাকে আর আপনার মাকে মেরে দিবে। আরশ স্যার জানতো আপনি তার পালক মেয়ে। কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না স্যার। পরে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সাথে হাত মিলাবে তাহলে সব প্লান জানতে পারবে আর আপনাকেও বাঁচাতে পারবে। তাই গিয়ে নিজের বাবা আর কাকাকে ব্লাকমেইল করে যদি তাকে দলে না নেয় তাহলে সবাইকে বলে দিবে এই কথা। সেই ভয়ে আরশ স্যারকে দলে নেয়। যেদেন আপনি ওই স্টোর রুমে পৌছে গিয়েছিলেন ওই দিন স্যারেই আপনায় অজ্ঞান করে নিয়ে আসে। পরে মিসেস আয়শাকে ওখান থেকে সরিয়ে ওখানে মিথ্যে দেওয়াল দিয়ে দেয়। যাতে আপনি জানতে না পারেন। আপনি জানলে মি. জাকির আর আফজাল আপনায় মেরে দিতো। আপনার ১৮বছর হওয়ার পর আপনায় অনেক মারার চেষ্টা করে। ট্রাক দিয়ে চাপা দিতে চায় কিন্তু স্যার কালো মুখোশ পরে আপনায় বাঁচিয়ে নেয়। মি. জাকির স্যারকে সন্দেহ করে এজন্য স্যার আমায় তার মতো পোশাক পরে আপনায় গুলি করতে বলে যাতে তাদের বিশ্বাস হয় ওই কালো পোশাক পড়া লোকটি স্যার না। ওইদিনও স্যার আপনায় বাঁচিয়ে নেয়। তবুও মি. জাকির স্যারকে সন্দেহ করে। পরেরবার স্যারকে ছাড়াই প্লান করে তাইতো আপনাকে ওইদিন বাঁচাতে পারেনি আপনার এক্সিডেন্ট হয়। স্যার ওইদিন পাগলের মতো করেছিলো আপনার জন্য। আপনার মাকে আর আপনাকে তাদের হাত থেকে স্যার সব সময় বাঁচিয়েছে। আর আপনি তাকে মেরে দিলেন?”

আরিবা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মিসেস তারিন নিজেও অবাক। তার অগোচরে কত কি হয়ে গেছে। আরিবা হঠাৎ করেই বললো।

“তাহলে ওই ভিডিও কি করে এলো? যেখানে ভাইয়া বলছে আম্মকে খুন করতে?”

সজল নিজের ফোন বের করে বললো।

“ওই রুমে মি. জাকিরের মতো স্যারও ক্যামেরা লাগিয়েছে। এই দেখুন ওখানে জাকির ও ছিলো। তারা বলছিলেন মিসেস আয়শাকে মেরে দিবে সেই কথা। মি. জাকির নিজের কথা কেটে আপনাকে বোকা বানিয়েছে। স্যার তো পরে আপনার মাকে বাঁচিয়েছে৷ কিন্তু মিসেস আঞ্জুমান কে বাঁচাতে পারলেন না। কারন আরশ স্যার জানতেন না তিনি মারা যাবেন। স্যার আজেই জানতে পেরেছিলেন মি. জাকির মিসেস আঞ্জুমানকে মেরেছেন তাও শুধু তিনি সব যেনে গিয়েছিলেন বলে। স্যার আজেই মি. জাকিরকে শাস্তি দিতেন কিন্তু তার আগেই আপনি..”

সজল আর কিছুই বললো না। অন্য দিকে চলে গেলো। আরিবা কিছুক্ষণ চুপকরে বসে থেকে চলে গেলো। কোথায় গেলো কেউ জানেনা। আরিবা আগে মি. আফজাল আর পরে মি. জাকিরকে খুন করে এসেছে। ও সবার প্রতিশোধ নিয়েছে কিন্তু যে মানুষটা ওকে সব কিছু থেকে রক্ষা করেছে তাকেই মেরে দিলো ও? তাকে রক্ষা করতে পারলো না ও।

—————————–

হঠাৎ গাড়ি থামতেই আরিবা কল্পনা থেকে বের হয়ে আসে। তাকিয়ে দেখে ওর গন্তব্যে চলে এসেছে। চোখে হাত দিয়ে দেখে ওর চোখে পানি। চোখটা মুছেই গাড়ি থেকে বের হলো। তাড়াতাড়ি করে শান্তার কেবিনের কাছে যেতেই শুনলো ভিতরে হাসির ছড়াছড়ি। আরিবা নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিলো। যেনো কেউ বুঝতে না পারে ওর মনে কষ্ট আছে। আরিবা হাসি মুখে ভিতরে প্রবেশ করলো। ওকে দেখেই তূর্য বলে উঠলো।

“আসছে মিস বিজি ম্যাম! হায় রে আমাদের আসতে বলে নিজেই লেট করলো।”

আরিবা তাকিয়ে দেখলো ভিতরে জিসান তৃনা ওদের পাঁচ বছরের ছেলে জয় ও আছে। শাহীন নিজের ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। শাওন আর তূর্য পাশেই দাড়ানো। আরিবা আস্তে করে বললো।

“রাস্তায় জ্যাম ছিলো। আর একটু শপিংয়ে গিয়েছিলাম।”

কথাটা বলেই শান্তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে কয়টা শপিং ব্যাগ দিলো। শান্তা হাত বাড়িয়ে ওগুলো নিয়ে বললো।

“আবার কষ্ট করতে গেলি কেনো বলতো?”

আরিবা হাসি মুখে বললো।

“আমাদের চার বন্ধুর এক ছেলে কিছু তো দিতেই হয় তাইনা? একেবারে খালি হাতে তো আসাই যায়না। ”

কথাটা বলেই আরিবা হাত বাড়িয়ে শাহীনের কোল থেকে বাচ্ছাটা নিতে নিতে বললো।

“মাশাল্লাহ অনেক কিউট একদম শান্তার মতোই হয়েছে।”

শাওন আরিবার কাছে এসে বললো।

“শান্তার মতো হলে কিউট হয় কিভাবে রে? শান্তা কি দেখতে কিউট? হয়েছে শাহীন ভাইয়ার মতো। শুধু ওর ভাগ্য ভালো শাহীন ভাইয়ার মতো এত কিউট একটা বর পেয়েছে তাইতো ওর ছেলেটাও কিউট হইছে!”

শান্তা গরম চোখে ওর দিকে তাকালো। সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। শান্তা রেগে বললো।

“তোর জন্য আমার থেকেও কোটি কোটি গুন খারাপ মেয়ে এনে দিবো দেখিস!”

“আমি কি বলছি যে আমি তোর পছন্দে বিয়ে করবো যে তুই মেয়ে এনে দিবি? আমি তো নিজের পছন্দে কিউট মেয়ে বিয়ে করবো।”

শান্তা নাক ফুলিয়ে শাওনের দিকে তাকালো। শাওন ভাব নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেলো। জিসান শাহীনের পিঠে একটা কিল মেরে বললো।

“কি করলি শালা? একটা মেয়ে জন্ম দিতে পারলি না? আমি কত করে ভেবে রেখেছি তোর মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিবো কিন্তু তা আর হলো না। থাক আরশের মেয়ে হলে ওর সাথেই…”

কথাটা বলতে বলতে থেমে গেলো জিসান। বুঝতে পারেনি কি বলতে কি বলে ফেলেছে। সবাই চুপ হয়ে গেলো। আরিবা এদিক ওদিক তাকিয়ে জোর পূর্বক হাসলো। জিসান নিরবতা ভেঙে বললো।

“শাহীন আমি যাই! আবার পড়ে আসবো। চলো তৃনা! আরিবা আসি!”

কথাটা বলেই জিসান চলে গেলো। সবাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও হাসি মজা করতে লাগলো। সবার মাঝে হাসলেও আরিবার একেবারেই হাসি আসছেনা। তবুও একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাসছে ও। হঠাৎ করে আরিবার ফোনে একটা কল এলো। আরিবা ফোনটা কানের কাছে ধরেই হতাশ হলো। ওর চোখে জল গড়িয়ে পড়লো। আরিবা তাড়াহুড়ো করে যেতে নিলো। তূর্য পিছন থেকে বললো।

” কিরে কোথায় যাচ্ছিস?”

“হসপিটালে যাচ্ছি জরুরি! ”

যেতে যেতে কথাটা বললো আরিবা। সবাই হতাশ দৃষ্টিতে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

💝

ইনশাআল্লাহ চলবে….

(সব রহস্য শেষ। আজ তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here