এক_প্রহরের_খেলা মোর্শেদা হোসেন রুবি ২৪

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

২৪||

চোখ মেলতেই সামনের সবকিছু ঝাপসা ঠেকলো। চোখের পাতা এতো ভারী যে খোলা রাখতে অসুবিধে হচ্ছে। বন্ধ করলেই ঘুম এসে যাচ্ছে। কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলো সে তুলনায় অনেকটাই সজাগ। রুমের ভেতর কারো ফিসফিসানী শুনতে পেলাম। কিন্তু চোখ মেলে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
শরীরটা অসাঢ় লাগছে সাথে হালকা ব্যথা বোধ। দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে যেরকম ব্যথাবোধ হয় অনেকটা সেরকম। আপনা থেকেই বাম দিকে কাত হয়ে হেলে গেল মাথাটা। চোখটা অবচেতনেই খুলে গেলো। আর তখনই চোখে পড়লো আম্মুকে। তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে। আহ্, কতদিন পর আম্মুকে দেখলাম। তারপর আপনা হতেই পাশের জনের দিকে চোখ পড়লো আমার। খুব চেনা মনে হলো ওকে। তবে মাথায় বেশী চাপ দিতে হলো না। চিনতে পারলাম। ওটা নায়লা। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, ‘ নায়লা এখানে যেন কেন।’ পরক্ষনেই মনে হলো,নায়লা তো আমার বন্ধু। এজন্যেই নায়লা এখানে। ভাবনা এলো, নায়লাকে কী আম্মুকে চেনে ? উত্তরটা নিজেই খুঁজে নিলাম। না চেনার কী আছে। আর তখনই অদ্ভুত প্রশ্নটা এলো মনে এলো , আচ্ছা, আমার কী বিয়ে হয়েছিলো? নায়লার সাথে? ও কী আমার বউ ? বিয়ে হলে তো ও তো আমার বউই হবে । স্মৃতির পাতা ওল্টাতে শুরু করে দিয়েছি ইতোমধ্যেই। মন বললো, নায়লাই তো সেদিন ট্রে তে করে নাস্তা নিয়ে এসেছিলো! বেশিদিন আগের কথা নয়। এই তো সেদিন। ওটা কী আসলেই নায়লা ছিলো ? নায়লার সেদিনের মুখটা ভাবতে চেষ্টা করলাম। ভাসা ভাসা মনে পড়তেই মিলিয়ে গেলো চেহারাটা। লম্বা বেণী। ধণুকাকৃতির গোল গলার আধাভেজা কামিজ। নাহ্, নায়লা তো ফতুয়া জামা পড়ে। ওটা সম্ভবত নায়লা ছিলো না।
ভাবতে গিয়ে মনে হলো চোখ সহ পুরো মাথাটা ব্যথা করছে। মেয়েটার চেহারা মনে করতে পারছি না।
মাথার উপর চাপ দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে পড়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। আর তখনই আম্মুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
কোমল স্বরে ডাকছেন তিনি, ” ঋভূ….! ঋভূ বাবা ! আব্বু…..? ও বাবা….!”

আহা, এতো আদরের ডাক। সাড়া না দিয়ে পারা যায় না। আমিও থাকতে পারলাম না। সামান্য চেষ্টা করতেই চোখটা খুলে গেলো। আম্মাকে দেখলাম ঝুঁকে আছে আমার মুখের ওপর। আমি ঠোঁট নাড়াবার চেষ্টা করলাম। চড়চড় করে উঠলো ঠোঁটের উপরটা। মনে হচ্ছে কথা বলতে গেলেই ফেটে যাবে ঠোঁটটা। তারপরেও উচ্চারণ করলাম, ” মা….” বলে।
আম্মার চোখে খুশির ঝিলিক। আমার শতেক পাইপের নল এড়িয়ে মাথায় গালে হাত বুলাবার চেষ্টা করলেন তিনি। একই সাথে টপটপ করে চোখ থেকে জল ঝরছে তার। আমি ফের চোখ বন্ধ করতেই পরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনলাম। ঋভূ ঋভূ করে ডাকছে কেউ। চোখ নায়লাকে দেখলাম। নায়লা। আমার একসময়ের সহপাঠী। আমার বান্ধবী। একই সাথে মনে পড়লো নায়লা রাগী আর গোঁয়ার। নায়লার সাথে আমার পরিচয় ইকোনোমিক্সর ক্লাসে। হ্যাঁ, ঠিক। আমার মনে পড়ছে। আমি নিজেই তো ইকোনমিক্সের তুখোড় ছাত্র ছিলাম। নায়লা আমার কাছে প্রায়ই পড়া বুঝতে আসতো। তারপর একদিন ও আমাকে বলে বসলো,” প্রেম করবি আমার সাথে ? ”
-” আমিও বোকার মতো হ্যাঁ করে দিলাম। তারপর থেকেই আমরা একসাথে। ”

-” চিনতে পারছো আমায় ? ” নায়লা তাকিয়ে আছে হাসিমুখে। সামান্য মাথা নাড়লাম। যার অর্থ হ্যাঁ না দুটোই হতে পারে। বললাম,” তুমি নায়লা।”
-” গুড। এই তো পেরেছো । এখন বলো তো, কেমন লাগছে তোমার ? ”
-” ভালো। ” ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম আমি। কথা বলতে বড় আলসেমি লাগছে আমার। কেবলি মনে হচ্ছে কী যেন একটা ভুলে যাচ্ছি। কী যেন একটা মনে পড়ছে না।

পরবর্তী এক ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার সহ বাবা, প্রীতি, রবিন এসে দেখা করে গেলো । কিন্তু মনের তৃষ্ণা মিটলো না। অবচেতন মনটা এমন কাউকে খুঁজছে যাকে সে মনে করতে পারছেনা। আসলে সে জানেই না যে, কাকে খুঁজছে । খোলা জানালার দিকে তাকালাম। জানালা দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে আমার বিছানায়। আজ আমাকে কিছুটা আধশোয়া করে বসানো হয়েছে। একটু আগেই আমার মাস্কটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ডাক্তার বলে গেছেন। আগামী কয়েক ঘন্টা স্যাচুরেশন নাম্বার ঠিক থাকলে নাকেরটাও খুলে ফেলবেন। আমি চির অভ্যেসবশত: আলতো হাতে নিজের চুলগুলোয় হাত বুলালাম। আর ঠিক তখনই ধাঁ করে বিদ্যুত চমকের মতো মনে পড়ে গেলো একটা ভয়াবহ মুহূর্তের কথা। যে মুহূর্তে আমাদের বাসটা পড়ে যাচ্ছিলো। আমি তখন বাসের ভেতর ছিলাম। বাসের ভেতরের সমস্বরের চিৎকারে পরিবেশটা তখন নরকতূল্য মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আমি তো সেখানে একা ছিলাম না। আমার শার্ট খামচে ধরে রেখেছিলো একজন। আমার খুব আপন কেউ। কিন্তু এতো দুরের কেন মনে হচ্ছে ওকে ! সে হঠাৎ ছিটকে সরে গিয়েছিলো আমার বুক থেকে। আর সে ছিলো একটা মেয়ে….! ”
-” ওহ্….!” মাথাটা হঠাৎ চাপ দিয়ে ব্যথা করে উঠলো আমার। মনে হলো ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছিনা। কয়েকবারের চেষ্টাতেই হাঁপিয়ে উঠলাম।
একটু জোরের সাথেই ডাকলাম, ” মা ! আম্মা ? ”
আমার ডাক শোনামাত্রই আম্মা ছুটে এলো। আমাকে অস্থির হতে দেখে দ্রুত ডাক্তার ডাকতে বললো। আমি তখন সমানে গা মোচরাচ্ছি। পায়ের কাফ মাসলগুলো যেন খিঁচ ধরে গেছে। পা গুলো সবেগে শূণ্যে ছুঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। হয়ত ছুঁড়ছিও। বলতে পারবো না। কেবল বুঝতে পারছি, সমস্ত শরীরে এক নিদারুণ অস্বস্তি। তার একটু পরেই টের পেলাম কয়েকজন মানুষ আমাকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দিয়েছে। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। একসময় বিষম ক্লান্তি এসে গ্রাস করলো আমাকে। ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাবার আগে অজান্তেই ডাকলাম, ” রুমু…!”

=====

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বা বেহুঁশ ছিলাম তা বলতে পারবোনা। তবে এবার আর চোখ খুলতে বেশী বেগ পেতে হলো না। চোখ মেলার সাথে সাথেই একে একে মনে পড়ে গেলো সবকিছু। মনে পড়লো নিজের দুর্ভাগ্যের কথা। মনে পড়লো ঝিনেদা থেকে বাসে করে ঢাকা আসছিলাম আমরা। আমি আর রুমকি। হ্যাঁ, রুমকি। আমার হঠাৎ পাওয়া ভালোবাসা। যাকে খুঁজে ফিরছিলাম এক জীবন ধরে। আর সে মিলে গিয়েছিলো কোন এক কঠিন অবসরে। তখন আমি বোকার মতো নায়লার এ্যাফেয়ারকে প্রেম ভেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে বসেছিলাম। ঠিক সেরকমই একটা দ্বিধামনস্ক মুহূর্তে আমার সাথে রুমকির পরিচয়। পরিচয় তো নয়, সোজা বিয়ে। মাত্র কয়েক ঘন্টার পরিচয়েই ধরে সোজা বাসরঘরে। আমি তখন কঠিন ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি নায়লার কথা বলার জন্য। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেরাতে আমরা গল্প করে কাটিয়েছিলাম। গল্পের কথক ছিলো রুমকি একা আর আমি ছিলাম মুগ্ধ শ্রোতা। ভাবনাটা কলজে খামচে ধরলো আমার।
সভয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, ” রুমকি কোথায় এখন ? সে কি তবে মারা গেছে ? আর কোনোদিন ঐ জোড়া দাঁতের হাসি আমি দেখতে পাবো না ? আপনা হতেই চোখটা জলে ভরে এলো। বুকটা ভেঙ্গে আসতে চাইলো আমার। সম্ভবত আমার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। আমি টের পাইনি। কারণ অনুভূতিগুলো সব এখন রুমকির স্মৃতিচারণে ব্যস্ত। তখনি নায়লার কণ্ঠ পেলাম।
-” কাঁদছো কেন ঋভূ ? ” কোমল সুরে বলছে নায়লা। সেদিকে তাকিয়ে নিজেকে কোনমতে সামলে নিলাম। রুদ্ধশ্বাসে বললাম, ” রুমকির কী খবর নায়লা ? ও কেমন আছে ? ও তো আমার সাথেই ছিলো। ওর কী অবস্থা নায়লা ?” ভয় পাওয়া গলার বললাম ।

নায়লা খানিক থমকে গিয়ে বললো, ” রুমকির কথা এখনও মনে আছে তোমার ? সে তো তোমার জীবনের এক কালো অধ্যায়। বিয়ে করে একটা মাসও গত হয়নি এরই মধ্যে কত দুর্ঘটনা ! আঙ্কেলের স্ট্রোক, প্রীতির বিয়ে ভাঙ্গা, তোমার আমার ভুল বোঝাবুঝি, সর্বোপরি এই ভয়ংকর রোড একসিডেন্ট। এরপরেও মেয়েটার নাম উচ্চারণ করো কিভাবে ? ধরে নাও, রুমকি মরে গেছে। ব্যস, কেচ্ছা শেষ।” শেষ লাইনটা যেন আমাকে চাবুকের মতো আঘাত করলো। মনে পড়লো রুমকির ব্যপারে নায়লার আচরণগুলো। রাগে কষ্টে কথা বন্ধ হয়ে এলো আমার। ধরে নাও মরে গেছে কথাটার মানে কী ? এটা কী ধরণের কথা !
ক্লান্ত স্বরে বললাম, ” আম্মুকে ডাকো।” নায়লা আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, কী বলবে আমাকে বলো। আমি তো তোমার সামনে আছি। তোমার এতোবড় বিপদ দেখে থাকতে পারিনি। ঠিকই চলে এসেছি। চেয়েও অকৃতজ্ঞ হতে পারিনি।”
-” কেন এসেছ সেটাও বলো? ” রাগে মুখ দিয়ে আপনা হতেই উচ্চারিত হলো আমার। নায়লা বিস্মিত।
সে আহত স্বরে বললো, ” কেন এসেছি তুমি বোঝো না ? ”
-” না বুঝিনা। এবার আমার আম্মাকে একটু ডেকে দাও প্লিজ।”
-” দেবো, তার আগে বলো। তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো ? ”
-” কিসের ক্ষমা ? ”
-” সেদিন তোমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তোমাকে অপমান করার জন্য ক্ষমা। সত্যি বলতে সেদিন রুমকির সতীন হতে বলায় মাথাটা চড়ে গিয়েছিলো তাই ব্রেকাপ করে ফেলি। কিন্তু আজ তোমার…!”
-” কিন্তু আজ আমি তোমাকে ফিরিয়ে নেব কে বললো ? ”
-” ঋভূ, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি ঋভূ।”
-” ভুল। এটা কোনো ভালোবাসা ছিলো না। আমরা পরস্পরকে মোটেও ভালোবাসিনা। ভালোবাসা এমন হয় না। এটা একটা এ্যাফেয়ার ছিলো যা আমরা দুজনেই বোঝার মতো কেবল বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। তারপরেও সম্পর্কের দায় এড়াতে চাইনি বলেই তোমাকে প্রস্তাব করেছিলাম। বাট ইউ ইগনরড মি।”

-” আজ আমি নিজেই সেই প্রস্তাব গ্রহন করতে চাই। রুমকি বেঁচে ফিরুক বা না ফিরক। …!” বলেই থেমে গেলো নায়লা। কিন্তু ততক্ষণে আমার অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে। আমি বললাম, ” কী বললে তুমি ? ইউ মিন টু সে, রুমকি বেঁচে আছে ? ভালো আছে ? ”
নায়লা আমতা আমতা করে বললো, ” না মানে। না থাকার সম্ভাবনাই….!”
-” আচ্ছা, আমার আম্মুকে ডাকছো না কেন তুমি বলোতো ? তোমাকে তো বেশ কয়েক বার বলেছি যে আম্মুকে ডাকো।”
-” আগে আমাদের কথা শেষ হোক তারপর! ‘

নায়লার কথা শেষ হবার আগেই আমার অক্ষত হাতটা দিয়ে মিটসেফে রাখা গ্লাসটা ধরেই ছুঁড়ে মারলাম টাইলসের দেয়ালে। গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে ছুটে এলেন আম্মু। নায়লা তখন হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি আম্মুকে দেখেই আমার বাম হাত বাড়িয়ে দিলাম। আম্মু প্রায় ছোঁ মেরে আমার হাত ধরে আমার কাছে এলেন, ” কী হয়েছে বাবা ? গ্লাস ভাঙ্গলো কী করে ? ”
আমি সে কথার জবাব না দিয়ে বললাম, ” আম্মু রুমকী কোথায়? ”
আম্মু থেমে গেলেন। বোকার মতো একবার নায়লার দিকে তাকিয়ে তারপর আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ” শুনলে তুই কষ্ট পাবি বাবা।”
-” কষ্ট পাবো ? কেন ? রুমকি কী মারা গেছে মা ? ”
-” না, এটা সঠিক জানিনা। তবে তোর বাবা বললো, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে একজন মাত্র মহিলা৷ ছিলেন । আর ঐ মহিলার লাশও নাকি ওর আত্মীয়রা নিয়ে গেছে। বাকি সব মহিলা জীবিত। সে হিসেবে হয়তো রুমকি বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তোর বাবা ওকে দেখেনি। তোর তখন অবস্থা এতো বেশী খারাপ যে তোর বাবা আর ডানে বামে তাকাবার সময় পায়নি। তোকে নিয়ে ঢাকা ছুটে এসেছে।”
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। মা এখনও আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কীসব বলে চলেছেন। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা। রুমকি এখন তাহলে কোথায় ? কী অবস্থায় আছে।

পরদিন ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। আমার পালস বিপি স্যাচুরেশন সব কিছু চেক করে মনে হলো তিনি সন্তুষ্ট। নাক থেকে অক্সিজেনের পাইপ খুলে আমার দিকে তাকালেন।
-” ব্রিদিং এ কোনো প্রবলেম হয় ? ”
-” অজান্তেই স্বাভাবিকের চেয়ে দুবার শ্বাস বেশী টানলাম। হালকা চাপ পড়লো বুকে। মাথা নাড়লাম আমি। বললাম, ” সামান্য।”
শুনে ওটা জায়গামতো বসিয়ে দিয়ে বললেন,
-” ওটা এক্সারসাইজ করে ঠিক করতে হবে। আপাতত আমি ফ্লো কমিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এটা থাকবে। বিকেলে নার্স এলে এটা খুলে দেবে। তখন কেবিনের বারান্দায় হাঁটবেন দশ মিনিট। লম্বা করে শ্বাস নেবেন না। ছোট ছোট শ্বাস নেবেন ফেলবেন। ফুসফুসের ওপর বেশী চাপ দেবার দরকার নেই। বাই দা ওয়ে, আপনি কী নামাজ পড়েন ? ”
– ” জি, তবে এই কদিন পড়িনি।’
-” আজ পড়বেন। আর সিজদায় একটু বেশী সময় থাকার চেষ্টা করবেন। এসময় ফুসফুস খুব ভালো অবস্থায় থাকে। সম্পূর্ণ সংকুচিত হয় বলে পুরো বাতাসটা সে টেনে নিতে পারে। ইটস আ গুড প্রাকটিস ফর ব্রিদিং।”
-” আমি জার্নি করতে পারবো কবে ডক্টর?” মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম কথাটা। ডাক্তার বিস্মিত। চেঁচিয়ে ইঠলেন প্রায়।
-” পাগল হয়েছেন ? আপনার মাথার আঘাতটা বেশ গুরুতর। আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। থ্যাঙ্কস গড যে আপনার সেরেব্রাম অক্ষত আছে। তবে এটা ঠিক প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়েছিলেন আপনি।”
-” আমাকে ঝিনাইদহ যেতে হবে ডক্টর। টু ফাইন্ড মাই ওয়াইফ !” ডাক্তারের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম।
-” ওহ নো নো….এখন তো একদম না। জার্নির ধকল নেবার মতো ফিজিকাল কনডিশন এখন আপনার নেই।”

প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন। নায়লা তখনও রুমের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।
আমি আম্মুকে বললাম, ” মা আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি। ”
-” আচ্ছা, তুই বিশ্রাম নে। আমরা বারান্দায় যাচ্ছি।” বলেই আম্মু বেরিয়ে গেলেন। নায়লা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সেও বেরিয়ে গেলো। আমি মনে মনে হতাশায় ভেঙ্গে পড়লাম প্রায়। বুকের ভেতর এক অশান্তির দাবানল অথচ আমি কী নির্বিকার মুখ করে বসে আছি। এক লহমার জন্য মনে হলো সব ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে যাই রুম থেকে। কারো কোনো বাধা না মেনে। একটা সময় বাংলা সিনেমায় দেখতাম, নায়করা হাসপাতালে পড়ে থাকতো। আর জ্ঞান ফিরলেই স্যালাইন ছিঁড়ে, ক্যানুলা টেনে খুলে ফেলে এক বজ্র হুঙ্কারে চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে পড়তো নায়িকাকে উদ্ধার করতে। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে যেন ঐ ভূমিকায় দেখতে পেলাম আমি। তাদের মর্মবেদনা আজ নিজ মরমে উপলব্ধি করতে পারলাম যেন। তবে এটাও সত্যি, এতো বড় একটা কষ্টকে তারা কোনোদিনই কষ্টদায়ক করে উপস্থাপন করতে পারেনি বরং পুরো ব্যপারটাকে হাস্যকর করে ফেলতো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় কাত হলাম। কষ্ট আর হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে যাবার আগ মুহূর্তে অস্ফুটে কেবল এতোটুকুই বলতে পারলাম, ” রুমকি। কোথায় তুমি? ভালো আছো তো রুমু।” একইসাথে অন্তর নিংড়ানাে দু’আ করলাম, ইয়া আল্লাহ। আমার রুমুকে যেখানেই রাখো। সুস্থ রেখো। সম্মানের সাথে রেখো।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here