তোকে_ঘিরে ❤ পর্ব_৪৭

তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৪৭
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

বাতাসটা শান্তির। ঠান্ডা ঠান্ডা, নির্মল ও পরম শ্রান্তির। বক্ষস্থল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডটা মুখপথ দিয়ে জোরেই বেরুলো যেনো। পূর্ণতা কতক্ষণ যাবৎ জাপটে ধরে আছে সেটাই হয়তো ঘড়িতে তাকিয়ে চিন্তা করছে পূর্ব। মেয়েটা বড়ই পাগল। এমন পাগলামী দেখলে ওর মনটা বড্ড বখাটে আচরণ করে নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে। পূর্ণতা ওকে ছাড়ছেনা। পূর্ব একবার ভাবলো ওকে কি ছাড়তে বলবে? না, থাক। আজ একটু নিয়মশৃঙ্খলা ভেস্তে যাক। অন্তত পূর্ণতার মুখে একটুকরো কিরণফোঁটার মতো হাসি পাক। পূর্ণতা প্রাণভরে মানুষটার গায়ের সুঘ্রাণটা টেনে নিচ্ছে। কৃত্রিম সুগন্ধি ছাড়াও অন্যরকম সুগন্ধ হিসেবে একটা আলাদা যে সুভাষ থাকে সেটা যেনো অনাবিল সৌহার্দ্যে উপভোগ করছে। মানুষটার বক্ষস্থলে ঢ্রিমঢ্রিম আওয়াজে যে ছন্দপূর্ণ শব্দ হচ্ছে পূর্ণতা উক্ত জায়গাতে নিলম্বনে ওষ্ঠযুগল ছুয়িয়ে দিচ্ছে। পূর্ব চমকে যায়। বেশ জোরালো ভাবেই চমকে যায়। মাথা নিচু করে বুকের কাছটায় মাথাটা দেখে। পূর্ণতা সুকৌশলে ধীরেধীরে অভিমানের স্তর যেনো ভেঙ্গে দিচ্ছে পূর্বের। পিঠের শার্টটা খামচে ধরেই হৃদস্থলের জায়গাটায় ক্রমাগত অধর স্পর্শ চালাচ্ছে। পূর্ব ভেবেচিন্তে জিজ্ঞেস করে,

– তোমাকে চাচী কিছু বলেছে?
– উহু,
– মিথ্যাটা একটু কম বলার চেষ্টা করো। পরিণাম অবশ্যই ভালো হবেনা।

পূর্ণতা চট করে মুখ তুলে তাকায়। চোখাচোখি হয়ে যায় পূর্বের তুখোড় দৃষ্টিপাতের দিকে। চোখদুটোতে কিছুটা রাগ, কিছুটা অভিমানের সংমিশ্রন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। একদৃষ্টিতে তীক্ষ্ম চাহনি ফেলে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো গলায় ঢোক গিললো পূর্ণতা। একটু হুঁশ হলে খেয়াল করলো পূর্ব ওকে বিন্দুমাত্র না ছুঁয়ে পকেটে হাত গুজানো অবস্থাতেই দাড়িয়ে আছে। অজানা লজ্জায় হাতের বাধন আলগা করে পূর্বকে ছেড়ে মাথা নুয়ে দাড়িয়ে থাকলো পূর্ণতা। দারুণ বিপাকে পরেছে সে পূর্বকে হুটহাট সামনে পেয়ে। তার উপর যেই দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টিকোণ চোখ রাখতে বুকটা কামড়ে উঠে। পূর্ব গম্ভীর প্রকৃতিস্থ কন্ঠে বললো,

– একা থাকার অভ্যাস আছে?

চকিত দৃষ্টিতে মুখ তুলে পূর্ণতা অবাক কন্ঠে বললো,

– কেনো?
– যেটা জিজ্ঞেস করা হয়েছে সেটার জবাব দাও।
– পারি। আমি আগে একা একাই ফ্ল্যাটে থাকতাম। মা হাসপাতালে চলে গেলে বাবাও সকাল সকাল অফিসে চলে যেতো।
– তার মানে একা থাকতে সমস্যা নেই তাইতো?
– কিন্তু কেনো?
– লাগেজ গুছাও।

পূর্ণতা হকচকিয়ে চেচিয়ে উঠে,

– কিহ্!
– বাংলা ভাষায় বলেছি ‘লাগেজ গুছাও’। আর একটা বাড়তি কথা বলতে যাবা না। লাগেজ রেডি করো আমি মোমিনকে পাঠাচ্ছি।

পূর্ব একই ভঙ্গিতে নাকের ডগায় গম্ভীর ভাবার্য রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পূর্ণতা অবুঝের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নির্দেশ মোতাবেক লাগেজ গুছিয়ে রেডি করতেই পূর্বের ড্রাইভার মোমিন এসে সেটা নিয়ে গেলো। পূর্ব কি করতে চাইছে, কি তার মূখ্য উদ্দেশ্য, কিছুই বোঝা সম্ভব হচ্ছেনা। পূর্ণতা সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখলো পূর্ব সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে সাহেবীপনার মতো বসে আছে। মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়! ছিটেফোঁটা হাসি নেই। হাসতেই পারেনা এমন কাঠিন্য মুখ করে রেখেছে সে। হঠাৎ অচিন্তনীয় কাজ করে বসলো পূর্ব! সবাইকে চিল্লিয়ে জড়ো করে আফরিনকে সকলের সামনেই বলে উঠলো,

– আপনার কি কাজকর্ম নেই চাচী? সমস্যা কি আপনার? নিজেকে থার্ড ক্লাস প্রমাণের জন্য কেনো ঝামেলা করছেন?
– জবান সামলে কথা বলবে পূর্ব! বড়দের সম্মান করতে না জানলে একদম চুপ থাকবে!
– এদিকে সম্মান শব্দটা আসলো কেন? সম্মান দিয়ে কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো?
– আমি কিন্তু চুপ থাকবো না বলছি! চুপ করো!

আফরিনের তিরিক্ষি মেজাজের সুরে পূর্বের রাগ দ্বিগুণ বারিয়ে দিলো। পাশ থেকে পরশ আফরিনের পক্ষ ধরে খেকিয়ে বললো,

– তুমি এই দুদিনের মেয়ের জন্য আমাদের সাথে ঝগড়া করছো? লজ্জা হওয়া উচিত! রাজনীতি করেও বউদের নীল নকশা ধরতে পারছো না, ছিঃ!!

আজ পূর্ণতা শত ইশারা করেও পূর্বকে আটকাতে পারলো না। পূর্ব ভীষণ রাগে কাঁচের টি-টেবিলে এমন লাত্থি মারলো সমস্ত গ্রাউন্ড ফ্লোরে সেই ঝংকার শব্দ সবাইকে শিউরে দিলো! রুম থেকে ছেলের বাজখাই গলার আওয়াজ ও অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতেই নার্সের সহযোগিতায় নিচে নামলেন পলাশ।। এসেই দেখলেন সবাই গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে, আর কেন্দ্রস্থলে পূর্ব দাড়িয়ে রাগে ফোস ফোস করছে। পূর্বিকা আয়েশাকে ধরে রেখেছে আপাতত। পূর্বের রাগের বেলায় কেউ ওকে বোঝাতে গেলে উল্টো ভয়াবহ তেজে ক্ষেপে যায়! পূর্ণতা চুপচাপ নত মাথায় পূর্বের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে দাড়িয়ে আছে। যা-তা ব্যবহার ও অলক্ষুণে ঝগড়ায় নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী ভেবে চোখের পানি ফেলছে। ফ্লোরে লাঠি ঠকঠক করে এগিয়ে আসলো পলাশ। লাঠির আওয়াজে সবাই মুখ ঘুরিয়ে এমনকি পূর্বও সচকিত চাহনিতে দেখলো বাবা এগিয়ে আসছে। রোগাক্রান্ত পলাশ ডানহাতে লাঠি ধরে বামহাতে কেয়ারটেকারের সাহায্য নিয়ে ঠিক পূর্বের সামনে এসে দাড়ায়। ছেলে উনার ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে তা উনি বুঝে গেছেন ইতিমধ্যে। কেয়ারটেকারকে ছেড়ে বামহাতটা পূর্বের কাধে ফেললেন পলাশ। ছেলেকে নিজের দিকে দৃষ্টি আর্কষন করিয়ে নম্র কন্ঠে বলে উঠলেন,

– আমি কি বেঁচে নেই তোর কাছে? মরে গেছি?
– অসম্ভব! কি বলছো এগুলো?
– তাহলে তুই আফরিনের সাথে এমন ব্যবহার করলি কেন? আমি তোকে এগুলো শিক্ষা দিয়েছি?
– আব্বু তুমি যা জানোনা তা নিয়ে কথা বলো না।
– ঘটনা আমাকে বলাটা উচিত না? আমাকে না বলে তুই ঝামেলা বাধাচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে সেটা বল।

পূর্ব স্থির দৃষ্টিতে পলাশের দিকে তাকিয়েই পূর্ণতার দিকে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল ইশারা করলো। আড়চোখে পূর্বের আঙুল নিজের দিকে পরতেই পূর্ণতা চমকিত দৃষ্টিতে কেঁপে উঠে ভেজা সিক্ত মুখখানা উপরে তুলতেই সাথেসাথে নিচে নামিয়ে ফেলে। পলাশ পূর্ণতার দিকে সরু দৃষ্টিতে চোখ ছোট রেখে কি যেনো গভীরভাবে নিরক্ষ করলেন। এরপর আফরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– তুমি ওকে মেরেছো আফরিন?

আফরিন থতমত খেয়ে চোখ নিচু করে কাঁচুমাচু করতে থাকে। পলাশ দুইমিনিট উত্তরের আশায় তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আবার পূর্ণতার মলিন মুখটার দিকে তাকায়। পূর্ব এখনো একদৃষ্টে চেয়ে আছে বাবার কীর্তিকলাপের দিকে। পলাশ যদি এইমূহুর্তে না আসতো তাহলে বিরাট অঘোর কাজ পূর্ব করেই ফেলতো! পলাশ নিরবতার জালে ছিদ্রবহুল করে বললো,

– তুই কি বাড়ি থেকে চলে যেতে চাচ্ছিস?
– কি করবো? পথ আছে কোনো? ওকে তো আমার শান্তি দেওয়া লাগবে আব্বু! উনাদের মতো বিজ্ঞ মানুষের নিকৃষ্ট আচরণ দেখলে আমার নিজেরই গা-পিত্তি জ্বলে উঠে।
– তুই গেলে সব ঠিক হবে? বল?
– শত জিদ উঠলেও আমি ওর উপর হাত তুলিনা, উনি কোন্ সাহসে হাত উঠালো? এই অধিকার কে দিয়েছে উনাকে? এমন নরকতুল্য জায়গার চেয়ে রাস্তার খেকো কুকুরের কাছে থাকা ভালো। ওকে দরকার পরলে আমি পাতালেও লুকিয়ে রাখবো তবুও এ বাড়িতে আমি একটা সেকেন্ড থাকতে দিবো না। এ্যাই পূর্ণ? চলো!

পূর্ব শক্ত চোয়ালে আর একটা শব্দ বললো না। পূর্ণতার কবজি ধরে ওকে টেনেই নিয়ে যেতে লাগলো বাইরে। দরজার বাইরে যেই পা দিবে আবারও মুখ ঘুরিয়ে কঠোর চাহনিতে একে একে সবার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,

– বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি! দুনিয়া ছেড়ে না! আমার আব্বুর সাথে যদি উনিশ-বিশ হয় সবাইকে জবাই করবো! এক্কেবারে জবাই করবো! আমি কাউকে ছেড়ে দেওয়ার মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মাইনি! ভুলো না যেনো।

পা চালিয়ে হনহন করে চলে যেতে লাগলে পূর্বিকা বহুবার পূর্বকে হাক ছেড়ে থামতে বলে। আজ পূর্বের হাটার গতি ছিলো যেনো অদ্ভুত! পূর্বিকা দৌড়ে লন পেরিয়ে পার্কিং সাইডে এসে হাপাতে হাপাতে বলে উঠলো,

– ভাই! প্লিজ থাম্! পূর্ব প্লিজ রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিস না! তুই আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবি? পাগল হয়েছিস? আফরিন চাচীর জন্য তুই কেনো যাবি?

পূর্ব কঠোর মুখেই ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে সরে যাওয়ার ইশারা করতেই পূর্ণতার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দেয়। পূর্ণতা আকুল চাহনিতে পূর্বিকার দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্বিকা কতো জোড়াজুড়ি করছে, কতো আকুতি-মিনতি করছে না যাওয়ার জন্য কিন্তু ফলাফল একেবারেই শূন্য। পূর্ণতাকে দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভিং সিট থেকে এক ধমক দেয় পূর্ব। পূর্ণতা আরেকদফায় চমকে উঠে ভয়জনিত উৎকন্ঠায় সিটে বসে দরজা লাগিয়ে দেয়। পূর্বিকা দৌড়ে এসে পূর্বের জানালায় নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। পূর্ব স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গাড়িতে চাবি ঢুকাতেই বলে উঠে,

– থাপ্পরটা ইনডাইরেক্ট তোর ভাইয়ের উপরই মেরেছে আপি। তুই যে বোকার মতো চুপ করে থাকবি সেটা সত্যিই আমি আশা করিনি। আমাকে মারলে তুই যেভাবে রুখে দাড়াতি, পূর্ণর জন্য সেটা তুই করলি না। রিজন কি জানিস? ও আজ মেয়ে বলে!

শো করে গাড়ি ছেড়ে দিতেই পূর্বিকা নির্বাক চাহনিতে গাড়ির পেছন অংশটা দেখছে। আকাশটা সূর্যের জন্য পড়ন্ত বিকেলের মার্ধুয্যে ছেয়ে আছে। পূর্বের কালো SUV গাড়িটা দৃষ্টিসীমানার বহু বাইরে চলে গেছে। আজ এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো? কি নিয়ে জ্বালা?

.

আকাশের বেগুনি রঙটা ধীরেসুস্থে কালো চাঁদরে ঢেকে গেলো। সারা রাস্তায় পূর্ব টু শব্দ করেনি। পূর্ণতা অনেকবার সাহস জুগিয়ে পূর্বের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু গাম্ভীর্য মুখের গম্ভীর ভাবটা অন্যদিনের তুলনায় বেশি থাকায় সাহসে পেরে উঠেনি। গাড়ির ভেতরে লাইট অফ থাকার কারনে আশেপাশের যানবাহনের লাল, হলুদ, সাদা আলোগুলো একটু পরপর মুখ আলোকিত করে ছুটে যাচ্ছে। পূর্বের দুটো হাত স্টিয়ারিংয়ে এমনভাবে ধরা যেনো ‘কার রেসিং’- এ আছে। পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ণতার স্পষ্ট বুঝতে পারলো এক্সিলেটরে পা কষে পূর্ব গাড়ির স্পিড তুঙ্গে চড়াচ্ছে। ভয়ে ধড়ফড় করছে পূর্ণতার। ওর তাকিয়ে থাকার পরও পূর্ব কেনো বুঝছেনা পূর্ণতা ভয় পাচ্ছে? শুকনো হয়ে থাকা কাঠ-কাঠ গলায় ঢোক গিলতেই জানালার দিকে তাকিয়ে বুকটা ধব্ক করে উঠলো পূর্ণতার! আচমকা এমনভাবে চেচিয়ে উঠলো সারা শরীর যেনো অসাড় হয়ে আসছে সেই দৃশ্য দেখে! জানালা দিয়ে গাড়ির সাইডে থাকা ব্যাক মিররে দেখলো পেছন থেকে একটা ট্রাক স্বহাস্যে ধেয়ে আসছে। মন বলছে ওই ট্রাকটা গাড়ি উল্টে দেওয়ার মতলবে আছে! পূর্ণতা সিটে মাথা হেলে চোখ খিচুনি মেরে অজ্ঞাতসারে কাঁপা হাতটা কোনোরকমে পূর্বের বাহু স্পর্শ করলো। পূর্ব একপলক কম্পমান হাতের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরালো সামনের দিকে। চোখ জানালার বাইরে লেফট মিররে একঝলক স্থির রেখে আবারো এক্সিলেটরে পা চেপে দিলো। পূর্ণতার কম্পনরত হাতটা ধীরগতিতে খামচে আসছে বাহুর উপর। বেকায়দায় স্পিড বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। পূর্ব দৃঢ় কন্ঠে বললো,

– সিটবেল্টটা টাইট দাও পূর্ণ!

পূর্ণতা ভয়ের পরিক্রমায় কিচ্ছু শুনতে পারলো না। থরথর করে অবিরামভাবে কাঁপতে লাগলো। পূর্ব বামে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা বিড়বিড় করে কি যেনো জপছে। এই কঠিন মূহুর্তে ওই দৃশ্য দেখে না হেসে পারলো না পূর্ব। সামান্য এটুকুতেই ‘লা ইলাহা…’ জপমালা শুরু? ফিক করে হেসে দিয়েও হাসি আটকে নিলো পূর্ব। পেছন থেকে আগত ট্রাককে বারবার মিররে পর্যবেক্ষণ করতেই হঠাৎ দুম করে আরো উচ্চ স্পিড বারিয়ে সামনের দুটো গাড়িকে ওভারটেক করে আড়াল হতে চাইলো। পূর্ব আড়চোখে পূর্ণতার নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসি সামাল দেওয়ার কায়দায় আছে। হাসি তো থামতেই চাইছেনা!! বহুকষ্টে নিচের ঠোঁটকে দাঁতে চেপে হাসি আটকানোর ছোট্ট প্রয়াস করলো পূর্ব। এক্সিলেটরে পা হালকা করতেই স্পিড কমে যেতে লাগলো গাড়ির। শহরের বাইরে আসতেই একটা নিরিবিলি জায়গার ভেতর গাড়ি পার্ক করলো পূর্ব।

– এই মেয়ে? চোখ খুলো। দেখো এসে গেছি।

পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতেই পূর্ণতা নিজেকে আলোয় আলোকিত করা সুন্দর শৃঙ্খল শৌখিন বাঙলোর কাছে আবিস্কার করলো।। সদর গেটটা বিশাল বড় এবং পুরো এরিয়াটাও যেনো আলোকিত। কোনো কোলাহল নেই, সাড়াশব্দ নেই, মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই আশেপাশে। শুধু লম্বা লম্বা দম্ভভরে দাড়িয়ে থাকা অনেকগুলো গাছ-গাছালী। বাঙলোটা একতলা বাড়ি। ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো বড় ডাইনিং রুম ও দুটো বেডরুমের অস্তিত্ব। একটা বেডরুমের একদিকের দেয়ালজুড়ে বিশাল বড় কাঁচের জানালা। জানালার থাই গ্লাস টেনে বারান্দায় যাওয়ার পথ। জানালার সাথে লাগোয়া নরম ফোমের বেড। জানালা বরাবর ঠিক ডানদিকে কাপড় রাখার সেট। বামদিকে আরেকটা জানালা তবে সেটা ছোট। পূর্ণতা শোবার জন্য বিশাল জানালার রুমটাই পছন্দ করলো। পূর্ব এখনো চুপচাপ। বিশেষ প্রয়োজনীয় কথাগুলো সে মাথা ঝাকিয়ে নতুবা হু-হা উত্তরেই সেরে ফেলছে। ব্যাপারটা মোটেই সহ্য হলো না পূর্ণতার। ব্যাটা রোমান্টিক প্লেস সিলেক্ট করে চুপ করে থাকবে? উহু…পূর্ণতা সেটা হতেই দিবেনা।

.

আকাশটা যেনো নিগূঢ় অভিমানে হঠাৎ বৃষ্টি ছেড়ে দিয়েছে। প্রকৃতি যেনো বৃষ্টির সাথে সখ্যতা করতে চাইছে। গুড়িয়ে দিতে চাইছে তার ক্ষুদ্রমনার অভিমান। অভিভূত করতে চাইছে নিজের আলিঙ্গনে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে গোসলটা সেরে শান্তি অনুভব হচ্ছে পূর্ণতা। কালো শাড়ির বেশভূষায় ভেজা চুলে তোয়ালে ডলতেই জানালার কাছে এসে থমকে যায়। বৃষ্টির ছন্দতালে আজ মন জুড়িয়ে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। আহ্..প্রকৃতির সেই বৃষ্টি!! ঠান্ডা পরশ জাগানো, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দোল লাগানো টাপুর টুপুর বৃষ্টিতে পাগল মনটা ভিজার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। পূর্ণতা থাই গ্লাস সরিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে দুহাত দুইদিকে প্রসার করে বিলিয়ে দেয় বৃষ্টির মূর্ছনাতে। কতোদিন পর আহ্লাদী বৃষ্টি মনকে শান্ত করছে!! বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় আবার ভিজতে থাকে সে। সদ্য মুখহাত ধুয়ে নেভিব্লু নাইক টিশার্ট পরে রুমে ঢুকতেই থেমে যায় একজোড়া চোখ। হাতের তোয়ালেটা বেখেয়ালে বিছানার উপর রেখে এগুতে থাকে সম্মোহন দৃষ্টিতে। আজ তার পূর্ণতা বৃষ্টির পূর্ণধারায় গা সইয়ে ভিজছে। চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে পা দুটো বারান্দায় গিয়ে পূর্ণতার একদম পেছনে এসে দাড়িয়েছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে পূর্বের দাম্ভিক শরীরটাও। সিক্ত করে দিচ্ছে অভিমানী মুখটা। গাঢ় নীলের টিশার্টটা বৃষ্টিতে ভিজে আরো গাঢ়ত্ব ধারণ করছে। চোখ বন্ধ করে পেছন থেকে হাত বারিয়ে দেয় পূর্ণতার কোমরের দিকে। হুট করে লালবর্ণের নরম ওষ্ঠধর লাগিয়ে দেয় পূর্ণতার চুলের উপর নিজের । কিন্ঞ্চিত চমকিত ভঙ্গিমায় কেঁপে উঠে পূর্ণতা। মাথা কিছুটা নুয়ে দেখে পেছন থেকে পেটের উপর মাংশল দুটো ফর্সাটে হাত আষ্টেপৃষ্টে ধরা। ধ্বক ধ্বক করে বুকে কাপুঁনি উঠতে লাগলো পূর্ণতার। মানুষটার কখন, কিভাবে, কোনসময় পেছনে এসে দাড়িয়েছে একটুও খেয়াল হয়নি। খেয়ালিপনায় বেখেয়ালি হয়ে বড্ড ভুল হয়েছে। উচিত ছিলো রাশভারী লোকটাকে আরো বহুমাত্রায় জ্বালানো। অতো সহজে ধরা দেওয়াটা ওর ঠিক হয়নি । মাথার পেছন দিকে চুলের উপর ওষ্ঠজোড়ার বেগতিক স্পর্শ পাচ্ছে পূর্ণতা। হাতদুটোও বেহায়া হয়ে উঠছে তার। আবারও সেই অদ্ভুত সুঘ্রাণটা তীব্ররূপে নাকে পাচ্ছে সে। সেই নেশা নেশা মাতাল করা অদ্ভুত সুভাষ। তার প্রতিটি স্পর্শ যেনো বুকের ভেতরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্ণতা আবেশের ঘোরে তার হাতদুটোর একটায় জোরে চিমটি কাটে। ব্যথায় অস্ফুট শব্দে ‘উফ..’ করে ছেড়ে দেয় পূর্ণতাকে। ছাড়া পেতেই তার দিকে ঘুরে রেলিংয়ে শরীর ঠেকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে পূর্ণতা। চিমটি দেওয়া জায়গাটায় হাত ডলতেই কপট রাগী চোখে তাকায় পূর্ব। ভ্রুদুটোও বেজায় কুঁচকানো। তার রাগী মুখটা যেনো হাসির ছলকে আরো রাগান্বিত হয়ে উঠছে। পূর্ণতা তা দেখেই আস্তেআস্তে হাসি থামিয়ে চট করে উদাস হয়ে যায়। পূর্ব হাত ডলতে ডলতে পূর্ণদৃষ্টিতে একপা একপা করে এগুচ্ছে ওর দিকে। পূর্ণতা পেছনে রেলিংয়ের উপস্থিতি বুঝতে পারছে। রাঙানো চোখের দৃষ্টিকে প্রচুর ভয় লাগছে ওর। পূর্ব দূরত্ব ঘুচিয়ে রেলিংয়ে দুইপাশে ধপ করে হাত ফেলে। মাঝখানে বন্দী করে ফেলে পূর্ণতাকে। তুমুল বৃষ্টির কারণে পূর্বের দিকে তাকাতেই হিমশিম খাচ্ছে পূর্ণতা। পূর্ব যেভাবে দেখছে নিশ্চয়ই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে? আচ্ছা লাশটা কোথায় রাখবে? টুকরো করবে নাকি জঙ্গলে ফেলে দিবে? কি করবে? নানা উদ্ভট চিন্তার মাঝেই হঠাৎ অকল্পনীয় কাজে মারাত্মক চমকে উঠলো পূর্ণতা! শক্ত মাসেলের একটা হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো কোমরটা! আরেকটা হাতের বিচরণ চলে গেলো গলার কাছে। বৃষ্টির তুখোড় বর্ষনে সখ্যপূর্ণ সৌহার্দ্যে ওষ্ঠযুগল খুজেঁ পেলো আরেক তৃষ্ণার্ত অধরজোড়া। খেয়ালী মস্তিষ্কে বেখেয়ালি চিত্তে উন্মত্ত হলো দুজনের স্পর্শ বদল। অভিমানের পাহাড় গুড়িয়ে বৃষ্টির উন্মাদনায় আপ্লুত হলো তৃপ্তিযুগল ভালোবাসা। ওষ্ঠস্পর্শের দীর্ঘতম সময়টায় চোখ খুললো পূর্ণতা। দেখতে পেলো মানুষটার বদ্ধচোখের মায়া। সেই মায়ায় ডুবে গেলে পুনরায় উঠা মুশকিল। মানুষটার অভিমান সহ্য করার চেয়েও মুশকিল।

-‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here