তোকে_ঘিরে ❤ পর্ব_৫৭.

তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৫৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো

( অংশ ০১.)

বাইরে বৃষ্টির অবস্থা এতো প্রবল সেটা স্পষ্ট কানে শোনা যাচ্ছে। আকাশের বাজ যেভাবে পরছে দালানকোঠা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নূরানী হাউমাউ করে কেদেঁ যাচ্ছে। এদিকে চোখের সামনে পূর্বকে ওভাবে যেতে দেখে পূর্ণতা একবার ভাবলো কোনোক্রমেই ওকে আটকাবেনা! পরক্ষনে চিন্তা করলো এতোটা কঠোর হওয়ার কোনো মানে হয়না। ওই লোক যেমনই হোক, পূর্ণতা ওর মতো পাষাণ হতে পারেনা। পূর্ব যেই বাইরে পা দিবে ওমনেই পূর্ণতা চেঁচিয়ে উঠলো,

– ওয়াসিফ পূর্ব !

শব্দটা খট করে পূর্বের কানে অদ্ভুত ভাবে ঠেকলো। পূর্ণতা সহজে পূর্বের পুরো নাম ধরে ডাকেনা। যখন ডাকে তখন একচোট কথা না শুনিয়ে ছাড়েনা। পূর্ব থামলো না। রাগে, ক্ষোভে শরীরের ভেতর সত্যিকার অর্থে আগুন ফুটছে ওর। আছাড় মেরে সবকিছু ভাঙতে পারলে শান্তি লাগতো ওর! পূর্ব আর দাড়ালো না। ভয়ংকর রাগ পুষে সত্যি সত্যি বাইরে পা বারিয়ে চলে যাচ্ছিলো। পূর্ণতা ওর কান্ড দেখে কি করবে উপায় না পেয়ে শেষমেশ নূরানীকে তাড়াহুড়ো করে বললো,

– থামতে বল যা! বাইরে বাজ পরছে !

নূরানী শুনতে দেরি ওমনেই এক ছুট দিয়ে বাইরে দৌড় লাগালো। পূর্ব ততক্ষণে লিফটের দিকে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু পেছন থেকে নূরানী এমনভাবে আসলো, ঠিক পূর্বের সামনে কাকতাড়ুয়া স্টাইলে দুইহাত দুইদিকে প্রসার করে রাস্তা আটকে দিলো। উন্মাদের মতো অনবরত মাথা নাড়িয়ে না সূচকে বললো,

– যাইবেন না ভাই, যাইবেন না। আপা খুব কষ্ট পাইবো। আপনে গেলে আপা কানবো পূর্ব ভাই। আপনে এমুন কইরেন না আপার সাথে।

পূর্ব স্থিরদৃষ্টিতে নূরানীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তখনো চোখে কঠোরতার ছাপ। আজ নূরানীর জায়গায় পুরুষ থাকলে ঠাস করে এক চড় মারতো পূর্ব। কিন্তু নূরানীও এদিকে একচুল হার মারলো না। সে এগিয়ে এসে পূর্বের উত্তপ্ত হাতটা এমনভাবে পেচিয়ে ধরলো একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে পূর্বকে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে ছাড়লো। নূরানীর উপর চরম রাগ উঠছিলো পূর্বের। শুধু ‘মেয়ে’ বলে পূর্ব ইচ্ছাকৃত ভাবে নূরানীকে জোরে ধাক্কা বা থাপ্পর মারতে পারছিলো না, আবার জোর গলায় চিল্লিয়েও কোনো লাভ হচ্ছিলো না। পূর্ব প্রচণ্ড রাগে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকলে পূর্ণতা গমগম গলায় বলে উঠে,

– বেশি তামাশ না করে যেই রুমটায় ছিলেন, ওই রুমটায় চলে যান। বাইরের অবস্থা ভালো না, চুপচাপ ওই রুমে শুয়ে পরেন। আমি আর কোনো ঝামেলা পোহাতে চাইনা। প্লিজ ওই রুমে যান।

পূর্ণতার ঠাসঠাস কথা শুনে পূর্ব চোখ রাঙিয়ে কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলো। পূর্ব তখনও মুখের মাস্ক খুলেনি। সে রাগে তার হাতের মুঠো শক্ত করলে নূরানী চটজলদি সব সামাল দিতে পূর্বকে অতিথি কক্ষে পাঠায়। একটা মোটা কম্বল বের করে বেডের উপর রাখলে পূর্ব মুখের মাস্ক খুলতেই নূরানীকে বলে,

– কম্বল খুলতে হবেনা। আমি বেডে ঘুমাবো না। ফ্লোর পরিস্কার তো? ফ্লোরে ঘুমালে সমস্যা হবে?

পূর্ব আর এক মূহুর্তও দাড়িয়ে থাকতে পারছিলো না। শরীর প্রচুর খারাপ লাগছিলো ওর। মাথা অদ্ভুত ভাবে ঝিমঝিম করছিলো। হাত-পা এমনভাবে অবশ হয়ে আসছিলো যেনো যেকোনো সময় লুটিয়ে পরবে ও। নিজের সর্বোচ্চ শক্তিটুকু খরচ করে সে কঠোর থাকার চেষ্টা করছিলো। নূরানী ম্লান গলায় অসহায় দৃষ্টিতে বললো,

– ভাই আপনে বিছানায় ঘুমান। ফ্লোরে ঘুমাইয়েন না। ফ্লোর বহুত ঠান্ডা। আপনের শরীরে প্রচুর জ্বর। বৃষ্টিতেও পুরা ভিজা গেছেন। এখন যদি এই অবস্থায় ফ্লোরে ঘুমান, তাইলে শরীর আরো খারাপ করবো। আমি পানিপট্টি নিয়া আসি ভাই, আপনে ঘুমান।

পূর্ব চেঁচিয়ে উঠলো নূরানীর উপর,

– আমি তোকে পানিপট্টি আনতে বলেছি? বলেছি আমার খেয়াল রাখ? চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে ঘুমা। আর মনের ভুলেও এই রুমে আসবিনা। বৃষ্টিটা কমলেই আমি বিদায় হবো। আমার খেয়াল রাখতে হবেনা।

পূর্বের জোরালো কন্ঠের চেঁচানি শুনে নূরানী একদম মিইয়ে গেলো। সে চুপচাপ পূর্বের রুম থেকে চলে গেলেও পূর্ণতার রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে, পূর্ণতা বিছানায় শুয়ে আছে। নূরানী বেডের কাছে এসে নিচু কন্ঠেই পূর্ণতাকে ডাকলো। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে আছে। কোনো সাড়া দিলোনা নূরানীকে। নূরানী চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকেও নির্বাকভাবে নিজের রুমে চলে গেলো।

রাত বারোটা। ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজার শব্দ হচ্ছে। পূর্ণতার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। চোখদুটো জানালার ওপাশে অস্বচ্ছ গ্লাসের বৃষ্টির দিকে আটকে আছে। একঘন্টা পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি আর কমেনি। বুকের ভেতর চাপ অনুভূত হচ্ছে পূর্ণতার। মন ছুটে যেতে চাইছে পূর্বের কাছে। মানুষটা ভালো নেই শোনার পর থেকে মাথা কাজ করছেনা ওর। নূরানী বলেছিলো জ্বরে গা পুড়ছে। কিন্তু পূর্ণতা যতদূর জানে, পূর্বের মতো মানুষ নাকি একটানা বৃষ্টিতে দাড়িয়ে থাকলেও ঠান্ডাজ্বর হওয়ার চান্স নেই। আজ কেনো মানুষটা অসুস্থ? মনটা ব্যকুল হয়ে ছটফট করে উঠলো। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করে মোচড়ে আসছে। পেটের ভেতর যেনো সব নাড়া খেয়ে যাচ্ছে। বিছানায় মোটা কম্বল মুড়ে যেখানে পূর্ণতা আরামে ঘুমাচ্ছে, সেখানে অপরদিকে পূর্ব ভালো আছে? পূর্ণতা এপাশ-ওপাশ ফিরেও আর শুয়ে থাকতে পারলো না। কম্বল সরিয়ে গলায় ওড়না দিয়ে চুলে হাত খোপা করতেই ড্রিম লাইটের নীলচে আলোয় দরজা খুলে বের হলো। যতটা নিঃশব্দে পা ফেলা যায় সেটাই পূর্ণতা করলো। চুপিচুপি পূর্ব যে রুমে শুয়ে আছে সে রুমের দরজাটা নিজের ঠোঁট কামড়ানো অবস্থায় হালকা করে খুলে ফেললো। দরজা খুলতেই নিচের ঠোঁট থেকে দাঁত সরে মুখ হা হয়ে গেলো ওর। ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বামকাতে শুয়ে আছে পূর্ব। তৎক্ষণাৎ কপাল কুঁচকে যায় পূর্ণতার। সে দ্রুত পূর্বের কাছে এসে হাটু গুজিয়ে বসতেই বাহুতে হাত রাখলো। শিউরে উঠে চোখ বড় করতেই সজোরে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলো। হাপানো ভঙ্গিতে অনবরত নিশ্বাস টানতেই থরথর করে কাঁপা হাতের দিকে তাকালো পূর্ণতা। এই হাত যেনো আগুনের স্পর্শ পেয়ে কাঁপছে। পূর্ণতা ওই অবস্থায় মুখ হা করে শ্বাসকার্য চালাতেই তাড়াতাড়ি পূর্বের রুম থেকে পালালো। নূরানীর রুমে গিয়ে ওকে টেনে তুলে পূর্বের কাছে জলপট্টি করতে পাঠালো। পূর্ণতা নিজের রুমে এসে তাড়াহুড়ো করে আলমারি খুলে ওয়াসিফ ভিলা থেকে পূর্বের যেই টিশার্ট এনেছিলো সেটা বের করলো। কবিরের অব্যবহৃত নতুন একটা ট্রাউজার নিয়ে নূরানীর হাতে ধরিয়ে বললো পূর্ব যেনো এক্ষুনি পোশাক পাল্টে নেয়। পূর্ণতা আর পূর্বের কাছে গেলো না। রুমে ঢুকে দরজায় পিঠ লাগিয়ে হাটুতে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেদেঁ দিলো। পূর্ব কিভাবে অসুস্থ হয়ে গেলো? কি করেছে নিজের শরীরের সাথে? এই অসুস্থ তো পূর্ণতার জন্য কায়েম, এটা কেনো পূর্বের সাথে হলো? কানের দুইপাশ থেকে চুল টেনে হাটুতে কপাল লাগিয়ে হুহু করে কাঁদছিলো ও।

নূরানী জোর করেও পানিপট্টি দিতে পারলো না পূর্বকে। পূর্ণতার পাঠানো পোশাকও সে দরজার বাইরে ড্রয়িং স্পেসে ছুড়ে মেরেছে। জ্বরের ঘোরে চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে গেছে। পূর্ব শত চেষ্টা করেও দাড়াতে পারছিলো না, ব্যর্থ অবস্থাতেই উঠে দাড়ানোর জন্য শ্রম দিচ্ছিলো সে। পূর্বের জেদীপনা দেখে অস্থির হয়ে নূরানী পূর্ণতাকে জানায়। পূর্ণতা চোখ মুছতে মুছতে পূর্বের সামনে এসে দাড়ালে পূর্ব তখন পরিস্কার দেখার জন্য চোখ ঝাপটালো। পূর্ণতা নূরানীকে যেতে বলে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। ফ্লোরে বসে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে মাথা বিছানায় ছেড়ে দিলো পূর্ব। তাচ্ছিল্যপূর্ণ কন্ঠে হেসে দিয়ে বললো,

– দয়া দেখাতে এসেছো? নাকি দেখতে এসেছো মরে যাচ্ছি কিনা? আরে, চিন্তা নেই। আমি এতো সহজে মরছিনা। মরলে তো সেই হাসপাতালেই মৃত্যু হতো। মরিনি তো। দিব্যি বেঁচে আছি… শান্তিতে বেঁচে আছি।

পূর্ণতা ধীরপায়ে চুপচাপ হেঁটে এসে পূর্বের সামনে বসলো। চোখের সামনে রাশভারী, গম্ভীর স্বভাবের মানুষটা অসুস্থ অবস্থায় কাতরাচ্ছে। নিস্তেজ শরীর নিয়ে ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা হেলে দিয়েছে। পূর্ণতা ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে কেদেঁ দিলো। কান্নার ফিসফিসানি শব্দ শুনে পূর্ব বন্ধ চোখের পাতা টেনে খুললো। বহুকষ্টে মাথা উঠিয়ে সামনে চেয়ে দেখলো পূর্ণতা মাথা নুয়ে আছে। সমস্ত শরীর ওর থেমে থেমে কাঁপছে। জ্বরাক্রান্ত ভারী মাথা নিয়ে টালমাটাল ভঙ্গিতে পূর্ব বললো,

– কাঁদছো কেন? খুশিতে কাঁদছো? জ্বর আনা কিন্তু আমার জন্য সহজ কাজ ছিলো না জানো? টানা তিনদিন আপির রুমের বাথটাবে বরফের পানিতে নাক ডুবিয়ে শুয়েছিলাম। ফিলিংসটা মারাত্মক ছিলো। সারা শরীর ফ্রিজ্ড হয়ে যেতো, নিশ্বাস নিতে গেলে টাইটানিক ফিল লাগতো। কিন্তু আমার তো পাশে কোনো রোজ ছিলো না। জ্যাক যেভাবে রোজের হাতটা ধরেছিলো আমিতো কারোর হাত ধরিনি। মূল তফাতটা এদিকেই… সবই ভাগ্য আসলে।

পূর্বের মাতাল মাতাল কথা শুনে মাথা তুলে তাকাল পূর্ণতা। সেই ধারালো চোখের দৃষ্টি, হাসিহীন চেহারার গম্ভীর ভাব, রাশভারী শক্ত চেতনা নিয়ে পূর্ব যেনো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অপলক চাহনিতে পূর্ণতাকে দেখছে। ওর যেনো জ্বর নেই এমন চাহনিতে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা কান্নার দমকে মৃদ্যু কেঁপে উঠতেই পূর্বের দিকে অশ্রুচোখে তাকায়। জড়িয়ে আসা কন্ঠে নম্র সুরে বলে উঠে,

– শরীরের প্রতি এতো অবহেলা কেন?

পূর্ব ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে দেয়। রুমের মধ্যে পূর্বের হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে শোনা যাচ্ছে। পূর্ণতা নাক টেনে চোখ মুছে জিজ্ঞাসু সুরে বলে উঠে,

– আমার কথায় হাসছো কেন? এটা হাসির?

পূর্ব কোনো জবাব দিলো না। হাসি থামিয়ে আগের মতো মুখ শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নিলো।। নিরবতার সময় যেনো আর লম্বা হলো না, ওমনেই পূর্ণতা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে দুহাতে পূর্বের গালগুলো ধরলো। একদম পূর্বের কাছে গিয়ে আবারও নিজের সমস্ত কঠোরতার বেড়িবাধ ভেঙ্গে পূর্বের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

– নিজেকে মেরে ফেলতে চাও? মরতে চাও তুমি? পাগল হয়ে গেছো? কি করে ওই ফালতু কাজ করতে পারলে?

পূর্ব চোখ স্থির রেখে পূর্ণতার দিকেই তাকিয়ে আছে। কোনো সাড়া নেই, কোনো জবাবও নেই। পূর্ণতার মুখের উপর পূর্বের জ্বরতপ্ত ভারী নিশ্বাস পরছে। লালচে ঠোঁটদুটো জ্বরের প্রকটে আরো লালবর্ণ ধারন করেছে। পূর্ণতা কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকলো শুধু, এরপর তপ্তময় গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিলো সে। বহুদিন পর পূর্ণতার স্পর্শ পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো পূর্ব। মন বলছে, সময়টা থেমে যাক… সময়টা একটু থেমে যাক। এদিকে পূর্ণতা গাল থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের কোমরের কাছে টিশার্ট ধরে সেটা খুলার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। প্রসন্ন গলায় বলে,

– খুলো পূর্ব। আমি টিশার্ট এনে দিচ্ছি।

পূর্ব ক্ষীণদৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকায়। মাথায় ঝিমঝিমানি ভাবটা এতো বেশি হচ্ছে যেনো মাথার ভেতর অজস্র পাখি ডানা ঝাপটা মারছে। সে পূর্ণতার কথায় সায় দিয়ে হাত উঠিয়ে টিশার্ট খুলে ফেললো। পূর্বের উজ্জ্বল ফর্সা শরীরটা লালচে আভায় ছেয়ে আছে। পূর্ণতা গায়ে হাত দিয়ে দেখলো, গরমের তেজ বেশ প্রখর। গায়ে পানি ঢেলে তাপমাত্রা নামাতে হবে! সে তাড়াতাড়ি পূর্বকে উঠার জন্য কিছু বলবে হঠাৎ পূর্ব গা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। আস্তে আস্তে বললো,

– তুমি রুমে যেয়ে শুয়ে পরো পূর্ণ। একটু পর আমি চলে যাবো। বৃষ্টিটা একটু কমুক, আমি সত্যি চলে যাবো। আর কখনো তোমার কাছে তামাশা করতে আসবো না। আর কোনোদিন তোমার ঝামেলা বাড়াবো না। তোমাকে বিরক্ত করবো না ওয়াদা করছি। আমার আজকের ভুলের জন্য আমি ওয়াসিফ পূর্ব ক্ষমাপ্রার্থী।

পূর্ণতা এই দৃশ্য দেখে আবারও ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলো। পূর্ব না চাইলেও সে জোরপূর্বক ওর মাথাটা কোলে তুলে পূর্বের চোখে-মুখে-গালে বারবার চুমু দিলো। পূর্ব দূর্বল হাতে পূর্ণতাকে সরাতে চাইছে কিন্তু সে কোনোভাবেই পারছেনা। পূর্ণতা হাউমাউ করে কেদেঁ দিয়ে পূর্বের মাথাটা শক্তহাতে জড়িয়ে ধরলে চেঁচানো কন্ঠে বললো,

– এতো পাষাণ আচরণ কিভাবে করো তুমি? আমাকে চোখে পরেনা? আমার চেয়ে তোমার কাছে রাগের মূল্য বেশি? প্রতিবার আমি কি তোমার কাছে আসিনা? এবার তুমি এসেও কেনো ফিরে যেতে চাইছো? আমাকে একা ফেলে যেতে চাইছো কেন? কি হাল করেছো নিজের? আমি তোমার এ অবস্থা দেখতে পারছি নাতো! আমার তো এই অবস্থা সহ্য হচ্ছেনা!! প্লিজ তুমি আমার কথা শুনো, একটু উঠো?

পূর্ণতা নিজের গালের সাথে পূর্বের খোচা খোচা দাড়ির গালটা মিলিয়ে নিলো। একহাতে পূর্বের মাথাটা আকড়ে অন্যহাতে পূর্বের পিঠ বুলিয়ে দিচ্ছিলো। পূর্বের গরম দেহটা পূর্ণতার সাথে মিশে আছে। পূর্বের ঠোঁটদ্বয় পূর্ণতার গলাটা স্পর্শ করছে। পূর্ব নিজের তপ্তকর হাতটা ধীরেসুস্থে পূর্ণতার মাথায় রেখে ওই অবস্থায় মৃদ্যু কন্ঠে বললো,

– আমাকে কতদিন পর নিজের শরীরের সাথে মিশিয়েছো? ঠিক কতদিন পর তুমি আমায় একটু আগলে ধরলে পূর্ণ? তোমার নিশ্বাস, তোমার স্পর্শ, তোমার উষ্ণতাগুলো আমাকে জড়িয়ে রাখতো সবসময়। আমার ভেতরে যতো যন্ত্রণাই হোক, তোমার জন্য তোমার সামনে কখনোই সেগুলো প্রকাশ করতাম না। তুমি আমায় বুঝেও বুঝলেনা। নির্দয়ের মতো আম্মার কথাই শুনলে। আমি যে একা একা থাকছি, তোমার আশায় পথ চেয়ে আছি সেটা তুমি কখনোই বুঝলেনা। লোকাল বাসে তোমাকে দেখে কুকুরের মতো ছুটেছি, সেটা তুমি দেখলেনা। তোমার পাশে বসে কতোবার তোমার হাতটা ধরতে চেয়েছি, তুমি শুনলেনা। আমি তবুও তোমার কাছে পাষাণ হয়ে গেছি। তোমার নজরে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বার্থপর ব্যক্তি আমি। পূর্ণ, আমি যদি স্বার্থপর হতাম আজ কারো বুক খালি করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করে ফেলতাম। তোমাকে কাছে টেনে বুকে রেখে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি ওই পথ কখনো মেনে নেইনি। বিশ্বাস ছিলো তুমি আমাকে ছাড়া একরাতও থাকতে পারবেনা। কিন্তু সেই তুমিই আমাকে ছাড়া কতো রাত কাটিয়ে ফেলছো। তুমি আমার গায়ের গন্ধ না টেনে ঘুমাতে পারো না। আমি পাশে না থাকলে তোমার স্বস্তিদায়ক ঘুমটা কখনো আসেনা। সবই তো মিথ্যা ছিলো পূর্ণতা। তুমি সবকিছু আমায় মিথ্যা বলেছো। তুমি আমার চেয়ে তোমার মায়ের কাছেই ভালো আছো। হাসপাতালে তুমি দূর্বল ছিলে অথচ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি কাতরাচ্ছিলাম। সারাদিন চোখে চোখে রাখার পরও কেনো ওইটুকু সময় চোখে রাখলাম না, সেই অনুশোচনায় ধুকছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকেই জঘন্য ব্যক্তি বলে দূরে সরিয়ে দিলে। তুমি কখনো আমার দিক থেকে জানতে চাওনি। কখনো জিজ্ঞেস করোনি আমি কেনো তোমায় হাসপাতালে দেখতে যাইনি। তুমি কি জানো সেদিন রাতেরবেলা ওই ইনসিডেন্ট হওয়া রুমটায় আমি হাউমাউ করে কেদেছিলাম! জানো ওই ঘটনা? আমার সন্তানটা বিনা দোষে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো আমি সেই দুঃখও কাউকে বুঝতে দেইনি। রুমটা থেকে শুষ্ক চোখে সবার কাছে এসেছি। আমি নিজেকে বুঝাতাম, যদি আমি ভেঙে যাই তাহলে তোমাকে সামলাবে কে? তোমার মা-তো তোমার চেয়ে উনার ডিউটিকে বেশি ভালোবাসে। আমার মতোই সমাজসেবক চিন্তাধারার মানুষ। তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যেতাম। তুমি আমার বউ! আমার হক! আমার সব! সেই আমি কিনা তোমার কাছে যাওয়ার অনুমতি পাইনা। আমার সাথে কি নিষ্ঠুর আচরণ হচ্ছিলো তুমি কি কখনো জানতে চেয়েছো? অথচ, দিনশেষে আমি তোমার কাছে পাষাণের আখ্যা পেলাম…

কথাগুলো যত নিঃশব্দে ছিলো তত যেনো বুকের কোথাও ক্ষতবীক্ষত আচড় বসিয়ে দিচ্ছিলো। পূর্ণতা নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে পূর্বকে চেপে ধরেছে। চোখ থেকে টলটল করে অশ্রুধারা বেয়ে পরছে। এক অদ্ভুত যন্ত্রণার শিকার হয়েছে পূর্বের অব্যক্ত কথাগুলো শুনে। মানুষটার চওড়া বুকে এতো কষ্ট কিভাবে লুকায়িত থাকতো? সহ্য করতো কিভাবে? দম বন্ধ লাগতো না? পূর্বের কানটায় চুমু খেলো পূর্ণতা। বামহাতটা থেকে পূর্বের মাথাটা নির্লিপ্তে কোলে রাখতেই দেখলো, পূর্বের দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে কানের কাছে ভিজে আছে। তার চোখ বন্ধ হলেও গাঢ় লালের ঠোঁটদুটো কাঁপছে। পূর্ণতা মুখ নিচু করে পূর্বের চোখের পাতায় গভীর আবেশপূর্ণে ঠোঁট এঁকে দেয়। একে একে দু’চোখের পাতায় ঠোঁট স্পর্শ করে চোখের কিনারা মুছে দেয়। পূর্ব খুবই ধীরভাবে ভেজা পাপড়ির চোখদুটো খুলে তাকালে পূর্ণতা বলে উঠে,

– কমরেড সাহেব? জ্বরটা আগে কমাই?

পূর্ব দূর্বল চাহনিতে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ডান চোখ থেকে আবার একফোঁটা অশ্রু ঝরলো। পূর্ণতা কপালে হাত রেখে আবার বললো,

– আজ আদর করবো তো। জ্বরটা আগে কমাই? একটু উঠো। শরীরে পানি ঢালতে হবে। পানিপট্টি দিলে তাপমাত্রা নামবেনা। আমি আগুনের মতো ঠোঁটে বেশিক্ষন আদর করতে পারবো না পূর্ব। আমার কথাটা একটু রাখো?

পূর্ব চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিললো। চোখ আবার খুলে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে রগ্ন সুরে বললো,

– আমি কমিউনিজম করিনা। আমাকে কমরেড ডেকো না।

পূর্ণতা কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দেয়। পূর্বের শত মানা করা সত্ত্বেও সেই ‘কমরেড’ ডাকেই যেন তার অদ্ভুত সুখ, অদ্ভুত শান্তি। পূর্ব তো জানে তার পূর্ণতার দুষ্টু কারসাজি। সেই হাসিটাই পূর্ব প্রাণভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখছে। প্রিয়তমা তোমার মুখের হাসি, বড্ড বেশি প্রিয়.. বড্ড বেশি ভালোবাসি। দুঃখগুলো তোমার মাটি হোক, সুখের সাগরে ডুবে থাকো তুমি, অবশ্যই তোমার মাঝে আমি সহস্রবার হারাতে যাচ্ছি।

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

( নোট : আমার বিশাল বিশাল পর্ব দেওয়ার কথা হলেও পর্ব আমি যথেষ্ট বড় দেই। চেষ্টা করি সবার তুষ্টি মেটানোর কিন্তু তবুও যেন আপনাদের অভিলাষের কাছে হেরে যাই। আজ মন ও শরীর একইসাথে ক্ষুদ্ধ এবং বিক্ষিপ্ত। গল্প দেওয়ার ইচ্ছে মোটেই ছিলো না। দুঃখিত )

( আপডেট বার্তা : জুকারবার্গ আমার বিশাল বড় লিখাকে পর্ব-৫৭ হিসেবে একসেপ্ট করবেনা। তাই একাংশ হিসেবে শুধুমাত্র পর্ব-৫৭ দিয়েছি। ঘটনা শেষ নয়… )

( #চলবে )❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here