তোকে_ঘিরে ❤ পর্ব_৬০.( অংশ ০২.)

তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৬০.( অংশ ০২.)
#ফাবিয়াহ্_মমো

শহরের উপর এখন হিম হাওয়া চলছে। সেই হাওয়ায় গা যেনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। শীতটা জাকিয়ে না এলেও আগমনের বার্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর ঢাকাশহর সহসা থমকে গেছে যেনো। এখন কোনো হৈচে, শোরগোল, মাতামাতি হচ্ছেনা। মানুষের মধ্যে আর কোনো অস্থিরতা কাজ করছেনা। সব কেমন নিস্তেজ, নিসাড়, নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। রাত এখন এগারোটা বিশ বাজে। পূর্ণতার চোখ ছাপিয়ে বড় বড় ফোঁটায় অশ্রু পরছে। পূর্ব পাশে নেই ওর। সে এখন ভোটকেন্দ্রের ওখানে। সকল ভিড় যেনো পূর্বকে ঘিরে, রাস্তায় যতো মিডিয়ার লোক ছিলো সবাই এখন ওর ব্রিফ নিচ্ছে। পূর্ণতা সোফায় বসে টিভির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আয়েশা একটু পরপর হিজাবের প্রান্তভাগে চোখ মুছছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী ইবরাহিম খান মুখ কালো করে এককোণায় দলবল নিয়ে বসে আছে। একটু আগে ঘোষণা হয়েছে ডানপন্থী দলের ওয়াসিফ পূর্ব বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি পদে বিজয়ীর আসনটা দখল করেছে। এবারের নির্বাচনে জনগণের স্বর্তঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিলো মাইলফলক স্পর্শের মতো! তিনভাগের দুইভাগই পূর্বের ব্যালেটে জয় হিসেবে পাল্লা ভারি করেছে। অপরদিকে ইবরাহিম খান একভাগ ভোট পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুকৌশলে তিনি ঘুষ দিয়ে ভোটের ব্যবস্থা করেছেন। খবরটা গোপন হলেও কোনো শক্ত প্রমাণ না থাকায় আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। উত্তপ্ত জনতা পূর্বের মুখ থেকে বিজয়ের উল্লাস শুনতে উদগ্রীব হয়ে আছে। সবার মধ্যে নিশ্চুপ অবস্থা বিরাজ করছে। লাইট, ক্যামেরা ও মাইকের পেচানো তারের জন্য পূর্বের সামনে হুলস্থুল অবস্থা হলেও পূর্ব তার কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,

– আসসালামুয়ালাইকুম,

চুপ করে থাকা জনতার মধ্য থেকে হঠাৎ চিল্লিয়ে জবাব এলো ‘ওলাইকুমসসালাম’। পূর্ব উত্তর শুনে মাথা নিচু করে হেসে ফেললো। পরক্ষনে মাথা উঠিয়ে উপস্থিত সকলের দিকে ডান থেকে বামে চোখ বুলিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বললো,

– আপনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আজকের এই বিজয় আপনাদের জন্যই সম্ভব হয়েছে এবং আপনাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমাকে অতিমাত্রায় সিক্ত করেছে। আমি আপনাদের মতোই একজন ঢাকাবাসী, একজন সাধারণ মানুষ, একজন নাগরিক। দেশ ও মানুষের সেবা করাটা আমার মূল ধর্ম এবং কর্ম। এখানে যতোপ্রকার সমস্যা আছে আমাকে আপনাদের একজন ভাই হিসেবে বিবেচনা করে বলবেন। কোনো নেতা বা এমপি হিসেবে না। আমি রাজনীতিতে শুধু আপনাদের জন্যই এসেছি, জনগণের জন্য অবশ্যই আমি নিয়োজিত। কিন্তু সরকার অনুমোদিত একটা পলিটিক্যাল পাওয়ার আমার দরকার ছিলো। একটা সরকারি সাপোর্ট আমার প্রয়োজন ছিলো। আজ সেই ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নটা আপনারা আজ বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলেছেন। আমাকে বড় কিছু না ভেবে নিজেদের কাছের মানুষ ভাবুন। মন খুলে আমার কাছে সব সমস্যা নিয়ে আসুন। আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা চালাবো। আমার স্বপ্ন ছিলো সমাজের জন্য কিছু করা, সেটার একমাত্র বাস্তবায়ন সম্ভব হবে আপনাদের সহযোগিতা দ্বারা। মনে রাখবেন, আমরা এমন একটি দেশের নাগরিক যারা প্রয়োজনে হিংস্র বাঘের মতো আচরণ করতে পারি, তাই নিজেদের সাহস ও উদ্দীপনা এমন হওয়া উচিত আমরা অন্যায় মানবো না, আমরা দূর্নীতি সহ্য করবো না। অন্যায় সর্বপ্রথম আমাদের বাসাবাড়িতে হয়, আপনাদের কাছে অনুরোধ রইলো এই ‘অন্যায়’ শব্দটিকে একদম মুছে দিন। একদম ভুলে যান। নিজেরা ভালো থাকুন, পরিবারকে ভালো রাখুন, বাকিটা আপনাদের দেখাদেখি সমাজ শিখে নিবে। আল্লাহ্ হাফেজ।

মিডিয়ার মানুষদের মধ্যে একপ্রকার যুদ্ধ শুরু হলো প্রশ্নাত্মক আচরণ নিয়ে। পূর্ব সেটা আপাতত স্থগিত রেখে সব ডিসমিস করতে চাইছে। পূর্বের ফোনে একের পর এক কল আসছে দলের বিভিন্ন নেতাদের কাছ থেকে। সবাই একইসুরে ‘অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা’ বার্তা জানাচ্ছে। সবশেষে ডানপন্থী দলের সরকার তথা মূখ্যমন্ত্রী থেকে ‘অভিনন্দন’ পেলো পূর্ব। টিভির প্রতিটি চ্যানেল এখন মুখরোচক শব্দ দ্বারা লাইভ টেলিকাস্টে সংবাদ পাঠ করছে। পূর্ণতা লাখ লাখ শুকরিয়া জ্ঞাপন করে শাড়ির আচঁলে চোখ ও গাল মুছে নিলো। আয়েশার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো আয়েশা মোনাজাতের ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়িয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় কিছু বলছেন। আকাশী রঙের হিজাব দিয়ে হাটু অবধি ঢাকা আয়েশার। সোফায় পা গুটিয়ে বসে এতোক্ষন ছেলের বক্তৃতা শুনে এখন যেনো শোকর গুজার করছেন তিনি। চোখের নিচে কালি জমার কারনে উনার ফর্সা মুখটা প্রচুর ক্লান্ত দেখায়। বয়সের ভারে হাতের চামড়া বেশ কুঁচকে আছে যেনো। আয়েশা দুহাতের তালুতে মুখ মাসেহ করে মোনাজাত শেষ করতেই পূর্ণতার দিকে তাকালেন। পূর্ণতা নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। বড় বড় নেত্রজোড়া অশ্রুর কারনে মায়াবী লাগছে। পুরো মুখটাই যেনো কান্নার কারনে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। আয়েশা হাত এগিয়ে পূর্ণতার গাল স্পর্শ করে বললেন,

– জিতে গেছে তো। আর কেঁদো না। চলে আসলে খেতে দিও। আজ সারাদিন কিছু খায়নি তো, এলে দুধ গরম করে খেতে দিও। শরীরে শক্ত আসবে। আমি তাহলে তোমার শ্বশুর আব্বার কাছে যাই মা। ও বেশি দেরি করলে তুমি আর জেগে থেকোনা। ঘুমিয়ে পরো।

আয়েশা কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে পূর্ণতার চোখদুটো আবার মুছে দিলেন। পূর্ণতা এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও শ্বাশুরির স্নেহ আদরে যেনো সৎবিৎ ফিরে পায়। আয়েশা ততক্ষণে তার রুমের দিকে চলে গেছে। পূর্ণতা গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে রুমে যেয়ে দখিন দিকের জানালাটা খুলে দিলো। দুম করে এক পশলা ঠান্ডা বাতাস পূর্ণতার শরীরে হিম জড়িয়ে দিলো। পূর্বের সেই ভীত চেহারা নিয়ে প্রচুর টেনশন হচ্ছে পূর্ণতার। যার মধ্যে রাশভারী অবস্থা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না সেই ব্যক্তি আজ কিভাবে অতো শঙ্কিত মুখ করেছিলো? শুধুই কি নির্বাচনের চিন্তায়? মনে হয়না। পূর্বের এই ভীত চেহারা ওর স্বকীয় চেতনার সাথে বড্ড বেমানান। কেনো জানি মনেহচ্ছে পূর্ব শুধু একারনে ভয় পেয়েছিলো সে হয়তো পূর্ণতার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। কেননা, পূর্বের কিছু হলে পূর্ণতার দেখভাল এবং নিরাপত্তা দেয়ার মতো মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। খোদেজা ও কবির যতোই মেয়েকে আগলে রাখুক, পলিটিক্যাল ম্যাটার হলে কেউ কখনো ছাড় পায়না। পূর্ণতা এখনো শান্ত হতে পারেনি, পূর্ব যে দিনদিন নিজের শক্ত খোলস ছাড়িয়ে ভীত খোলসে গা ঢাকা দিচ্ছে, এটা পূর্বের জন্য খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। চিন্তার দুনিয়ায় নানা বিচিত্র ভাবনার আনাগোনা হতেই দরজায় খটমট শব্দ হলো। পূর্ণতা সাথেসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো পূর্ব ক্লান্ত দেহ নিয়ে পান্ঞ্জাবীর বোতাম খুলতেই ভেতরে ঢুকছে। দুজনের চোখাচোখি হতেই পূর্ব একপেশে হাসি দিয়ে পূর্ণতার কাছে এসে দাড়ালো। পূর্ণতার নেত্রগোলকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,

– তাড়াতাড়ি মিষ্টিমুখ করার জন্য চলে এলাম। ওখানে যেই ভিড়! নিশ্বাস আটকে আসে একদম। তুমি কি রাগ করে আছো? রাগ করো না প্লিজ। তুমি আর দশ মিনিট ওখানে থাকলে নির্ঘাত ধরা খেতে। আমি রিস্ক নিয়ে সত্যিই ভুল করেছি জানো। কেন যে তোমাকে আসতে বলেছিলাম ভেবেই পাইনা।

পূর্ব নিজের মতো করে কথাগুলো বলতে থাকলে পূর্ণতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু। চোখের পলক ফেলা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো কাজ করেনা সে। টেনশন নিয়ে মানুষ জীবিত থাকে ঠিকই কিন্তু পূর্বের মতো মানুষ কিভাবে নিজেকে শান্ত রেখে হাসিমুখে কথা বলছে ভাবা যায়না। এই মানুষটার এক ছটাক টেনশনও পূর্ণতা দূর করতে পারেনা। যদি সে পারতো? একটু যদি টেনশন থেকে বিরতি দিতে পারতো? পূর্ণতা উদাস হয়ে যায়। এদিকে পূর্ব যা কিছু বলছে সবই নির্বাচন এড়িয়ায় যা যা হয়েছে ওসব নিয়ে। হঠাৎ পূর্ণতা ওর কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে একটা অভাবনীয় কাজ করে বসলো। পূর্বের দুইগাল চেপে মাথা নিচু করে কাঙ্ক্ষিত মিষ্টিমুখ হিসেবে ওষ্ঠযুগল মিলিয়ে দিলো। পূর্ব তখন হাতের ঘড়িটা সদ্য খুলছিলো এমন কান্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। বাম কবজি থেকে ব্যালেন্স বিগড়ে ঘড়িটা ফ্লোরে পরে গেলো। পূর্ণতার এমন চান্ঞ্চল্যকর অবস্থার জন্য বহুদিনের ব্যবহার করা পছন্দসই ঘড়িটা বোধহয় ভাঙ্গলো এবার। পূর্বের সকল চিন্তা যদি নিজের ভেতরে টেনে আনা যেতো তাহলে পূর্ণতা নিজেকে উপযুক্ত মনে করতো পূর্বের জন্য। কিন্তু সে কিছুই করতে পারেনা। অক্ষম লাগে নিজেকে তখন। কিছুক্ষণ পর পূর্ণতা চোখ খুলে নিরবে পূর্বের ক্লান্তিকর চেহারায় অজস্র ঠোঁট এঁকে দিলো। চোখের পাতায় এখনো সেই ভয় জড়ানো মুখটার কথা মনে পরছে ওর। সেটা তীব্র ভাবে মনে পরলে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে যেনো। পূর্ব শান্ত দৃষ্টিতে সব কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতেই নরম গলায় বললো,

– আমি খুব টেনশন দিয়ে ফেলেছি না?

পূর্বের উত্তরে পূর্ণতা ওর দিকে একপলক তাকিয়ে আর কোনো জবাব দিলো না। ঠোঁটের উপর পরপর ক’বার চুমু দিয়ে পূর্বের বুকে মাথা রেখে জাপটে ধরলো। পূর্ব ওর অবস্থা দেখে নিজের ঘামার্ত দেহ থেকে পূর্ণতাকে সরানোর স্পর্ধা পেলো না। জড়িয়ে ধরতেও দ্বিধাপূর্ণে ফেসেছে পূর্ব। এই ঘামযুক্ত শরীর যেখানে নিজের কাছেই অস্বস্তিকর সেখানে পূর্ণতা কিভাবে জড়িয়ে ধরে শান্তি অনুভব করে, পূর্ব হিসাব মিলাতে পারেনা।

.

আয়মান টিভির সামনে বসে রিমোট ঠোঁটে চেপে চুপচাপ খবর দেখছিলো। পূর্ব নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এই খবর শুনে খুশি হতে পারছেনা। একটু আগে আফিয়া জানিয়ে গিয়েছেন এ সপ্তাহের মধ্যে সাবিহাকে শিকদার বাড়ির বউ হিসেবে ঘরে তুলবে। প্রচণ্ড রাগে তীব্র ক্ষোভে রাতের খাবারও খায়নি আয়মান। আয়মানের বাবা আনোয়ার শিকদার পরিস্কার শব্দে জানিয়ে দিয়েছেন এ বাড়িতে উত্তরাধিকার চাই এবং সেটার জন্য আফিয়া যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই যেনো অটলাবস্থায় থাকে। আয়মানের ইচ্ছে করছে ঘরের সব জিনিস তামা তামা করে ভেঙ্গে ফেলতে! যে বাড়িতে নিজের মতের কোনো মূল্য নেই, সেখানে তার থাকা চলেনা। আয়মান দোতলায় উঠে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। রাত এখন যতোই হোক ওই সাবিহার বাচ্চাকে একচোট গালিগালাজ করতে ইচ্ছে করছে ওর! কোন্ সাহসে বিয়ের পিড়িতে বসার জন্য মত দিতে গেলো? কতো বড় বুকের পাঁঠা আয়মানও খবর নিয়ে ছাড়বে! স্টাডি টেবিলের উপর থেকে আফিয়ার রেখে যাওয়া একটা কাগজ নিলো সে। সেখানে সাবিহা নাম্বার এবং অন্যান্য তথ্য লিখা আছে। আয়মান একমূহূর্ত দেরি না করে পটাপট কল করলো সাবিহাকে। গ্রামের বাড়িতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে সাবিহা। আজও ব্যতিক্রম হয়নি শুতে কিন্তু এমন উদ্ভট টাইমে কল পেয়ে তড়াক করে ফোন হাতে নিলো। ঘুমুঘুমু চোখ কচলাতেই দেখতে পেলো ‘আয়মান’ নাম দিয়ে সদ্য সেভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। সাবিহা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়মান বাজখাই গলায় একনিশ্বাসে বলে উঠলো,

– তোর মতো হারামি আমি আজ পযর্ন্ত দেখিনাই! তোর এতো শখ ক্যামনে জাগলো হ্যাঁ? আমারে বিয়ে করার পিতলা শখ ক্যামনে জাগলো আমারে ভালোমতো খুইলা বল! তোর কি লজ্জা নাই? শরম নাই? বদ কিসিমের মাইয়া কোথাকার! সামনে পাইলে ঠাডায়া এক থাবড়া মাইরা তোর ব্রেন উল্টায়া দিতাম! তুই আমার সামনে কালকের মধ্যে আসবি! শুনছোস তুই? তুই আমার সামনে আমার অফিসের বাইরে কালকের মধ্যে উপস্থিত হবি!

সাবিহা চোয়াল ঝুলিয়ে আশ্চর্য হয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে ঠিকমতো স্ক্রিনে ভালোমতো দেখলো। আয়মান নাম দিয়ে সে কোনো ভুলভাল নাম্বার সেভ করেনি কিন্তু এ কোন্ আয়মান? আয়মান তো মুখ খারাপ করে কখনো শ্রুতিকটু শব্দে কথা বলেনা। সাবিহা ভয় ভয় কন্ঠে অনেকটা সঙ্কোচের সুরে বললো,

– আয়মান ভাইয়া, আমি কি করেছি সেটা তো বুঝলাম না। আপনি বেহুদা আমাকে বকছেন কেন? সমস্যা কি?

আয়মান প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

– থাবড়ায়া শালী তোর চান্দি ঘুরায়া দিমু! তুই আমার মায়ের কাছে বিয়ের জন্য রাজি বলতে গেছোস কেন? কি দেখে রাজি বলছোস তুই? টাকা দেখে? তোর কত টাকা দরকার আমার কাছে এক্ষুনি বল! তবুও তুই কাল সকালের মধ্যে ফোন দিয়ে বলবি তুই বিয়েতে রাজি না।

সাবিহা জোর গলায় ভয়াবহ কিছু বলতে পারছেনা। এমনেই গভীর রাতের মতো পিনপতন অবস্থা তার উপর জোরে চিল্লিয়ে কিছু বললে ওপাশের রুম থেকে সবাই শুনতে পাবে। সাবিহা তটস্থ কন্ঠে বললো,

– আপনি আমাকে কোন্ কারনে তুই তুকারি করছেন? দেখুন আপনি যদি ভদ্রভাষায় কথা না বলেন আমি আপনার মাকে সব কথা বলে দিবো।
– তোর তুইতোকারির মায়রে বাপ! তুই বিয়েতে না করবি এটাই ফাইনাল। আর যদি তেড়িবেড়ি করছোস তোর ওই নেত্রকোণার টুনটুনি মার্কা এলাকায় আমি পেট্রলবোমা ফালামু! আমারে তুই চিনোস না, যদি চিনতি তাইলে বিয়ের জন্য রাজি হতি না। এখন তোরে আমার ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝায়া দিলাম, যদি এরপরেও তুই রাজিফাজি হইছিস তোর কপালে শনি-সোম-মঙ্গল ক্যামনে ঘুরাই দেখিস!

বিশ্রী, অকথ্য, অশালীন কথাবার্তা বলে ফোন কেটে দিলো আয়মান। আজ বহুদিন পর নিজের মুখ খারাপ হলো। এইভাবে গালিগালাজ ওর শোভা না পেলেও সাবিহার কাছ থেকে নিস্তার পাওয়াটা জরুরী। সাবিহা কয়েক মিনিট স্রমতব্ধ হয়ে বসেছিলো। কপালে হাত রেখে ঘুণে খাওয়ার জানালাটা খুলে বাইরে চোখ রাখলো। এই মানুষটার ভাষা এতো বিশ্রী, অসভ্য সেটা কে জানতো? মাথাটা এখনো ভনভন করে ঘুরছে। কানের ভেতর ওই বস্তিওয়ালা শব্দগুলো ঘুরছে। সিক্স প্যাক বডিওয়ালা মানুষটার কথাগুলো এখনো বাঁজের মতো ঠেকছে।

অফিসের ব্যস্ততায় সাবিহার উপর আর ধমকানি চালাতে পারলোনা আয়মান। মেয়েটা একদম ‘উড়ে এসে জুড়ে বসছে’। পূর্ণতাকে সাবিহার ব্যাপারে বলার পর খুশিতে গদগদ হয়ে গেছে ও। এদিকে কাউকেই বুঝাতে পারছেনা সে তার শূণ্য জীবনে আর কোনো মেয়েকে জায়গা দিতে ইচ্ছুক না। এসময় পূর্ব ওকে সব সমস্যার সমাধান যেনো এক তুড়িতেই করে দিলো। জীবনের সেই পবিত্র ফুল যদি সাবিহার মতো শুভ্র মেয়ে হয়ে থাকে এক্ষত্রে বিয়ে করাটাই ঠিক। আয়মান তাও যেনো মানতে নারাজ। কিন্তু পূর্বের বিচক্ষনসম্পন্ন কথাবার্তা শুনে আয়মান স্থির করলো অন্তত মায়ের দিকে তাকিয়ে ওর বিয়েটা করা উচিত। সন্তান উৎপাদন এসব পরের ব্যাপার। আয়মান যেই পযর্ন্ত নিজেকে সাবিহার সাথে মানাতে না পারবে সেই পযর্ন্ত সে ওসবের কাছেও ভিড়বেনা। দরকার পরলে বিয়ের পর আলাদা থাকতেও প্রস্তুত সে।

সাংসদ সদস্য হিসেবে ৩৫০ টি আসনের মধ্যে একটি আসন দখল করলো পূর্ব। বাকি ৫০টি আসন মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। পাঁচ বৎসর মেয়াদ হিসেবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বসার সুযোগ পেলো ঠিকই কিন্তু এখনো কিছু আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম বাকি। জাতীয় সংসদে শপথ গ্রহণ কার্যটা শেষ হতেই পূর্ব নিয়মিতভাবে সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে পারবে। তবে একনাগাড়ে ৯০দিন অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ হারাতে পারে। আবার মৃত্যু, পদত্যাগ এবং অভিশংসন কারনে একজন সংসদ সদস্য তার স্বীয় পদটিও হারাতে পারে। বিভিন্ন কার্যনীতি সম্বন্ধে জেনে পূর্ব শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে আয়মানের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। শিকদার বংশের একমাত্র বউ হিসেবে সাবিহা আসতে চলেছে। যদিও বিয়েটা ঘরোয়াভাবে সাদামাটা তরিকায় হবে। আয়মান ঢাকঢোল পিটিয়ে গান বাজনা দিয়ে বাড়িতে বউ তুলার একদম বিপক্ষে। কোনোরকমে তিন কবুল ও কাগজে সই দিয়ে শিকদার পরিবার এনে দিয়ে খালাস হতে ইচ্ছুক। এরপর সে বিদেশে চলে যাবে এবং ভুলেও সে দেশের ফেরার মতো নাম উচ্চারণ আর করবেনা। সেদিন আয়মানের ওই রূঢ় আচরণ দ্বারা সাবিহা কষ্ট পেয়ে আফিয়ার কাছে ভাসা ভাসা উত্তরে বিয়েতে রাজি না জানিয়ে দেয়। এদিকে সাবিহার বাবা-মা মেয়ের ওমন ঔদ্ধত্য দেখে পারেন না তখনই চড় মেরে গাল লাল করে দেন। আফিয়া আড়ালে নিয়ে সাবিহাকে ঠিক করে জিজ্ঞেস করলে সাবিহা কেদেঁ দিয়ে ওইরাতের জঘন্য কথাগুলো বলে দেয়। আফিয়া থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকলে শেষে সাবিহার কাছে হাতজোর করে ক্ষমা চান। ছেলের অতীতে যতোপ্রকার ঘটনা ছিলো এবং শ্রেয়ার যেই নীতিনষ্ট কাহিনী ছিলো সব খুলে বলেন। সাবিহা চোখের পানি মুছে অবাক হয়ে যায়। শ্রেয়া নামটা ক্যাম্পাসে থাকাকালীন অনেকের মুখেই শুনেছে কিন্তু আয়মানের ভেতরে এক দগ্ধময় অতীত যে শ্রেয়াকে ঘিরে রয়েছে সেটা ও জানতো না। আফিয়া আকুলিবিকুল করে আয়মানকে আগের মতো হাসিখুশি জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য। তার ছেলের জীবন থেকে সকল সুখ ও অনুভূতি শ্রেয়ার লাশের সাথে মাটির নিচে ডেবে গেছে। আফিয়া তার অশ্রুসিক্ত কন্ঠে সাবিহার হাতদুটো ধরে বলেন,

– আমি তোমার কাছে ভীষণ অপরাধী সাবিহা। তুমি আমার ছেলেটাকে আগের মতো ফিরিয়ে আনো। তার জীবনে আমি আর কিচ্ছু চাইনা। শ্রেয়া যেদিন যারা গেলো রুমের দরজা আটকে প্রচুর কেদেঁছে। আমি মা হয়েও বুঝতে পারিনি আমার ছেলেটা কেনো ওভাবে চিৎকার করে কেদেঁছে। আমি নিজের ব্যর্থতা মানতে পারিনা মা। আমার আয়মান তো কারোর ক্ষতি করেনি। ওকে আমি নিজের পেটে রেখেছি। এতো আদর যত্ন করে বড় করেছি কিন্তু ছেলে বলেই হয়তো শ্রেয়ার ঘটনাটা আমি আদৌ ধরতে পারিনি। একটা দুঃখ কি জানো? ছেলে বড় হলে আর বুকে টেনে ঘুম পাড়ানো যায়না। ঠোঁটে চুমু খাওয়া যায় না। একটা মায়ের কত সীমাবদ্ধতা থাকে তুমি একদিন বুঝবে সাবিহা। আমার ছেলেটা আর আগের মতো হাসিখুশি চন্ঞ্চল নেই। রাতের বেলা রুমে গেলে রুমের দরজায় নক করে যাওয়া লাগে। আর ছোট থাকতে আমি কোলে কোলে নিয়ে ঘুরতাম। সেই সন্তান আমার আজ এতো বড় হয়ে গেলো, নিজের সব দুঃখকষ্ট বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখলো। তোমার পাদুটো ধরতেও রাজি আছি, তবুও তুমি এই বিয়েতে না করো না। তোমার মধ্যে আমি শ্রেয়ার বৈশিষ্ট্য দেখেছি। ওর মতো কিছু সুলভ আচরণ দেখেছি। আমার ছেলেকে তুমি বিয়ে করে নিজের মতো গড়ে দাও। ওর ভেতরে কিচ্ছু নেই। একদম খালি। আমার অনুরোধটুকু রাখো মা।

কাউকে কাঁদতে দেখে যারা নিজেরাই হাউমাউ করে কেদেঁ দেয় ওরকম নরম মনের মানুষ হয়তো দুনিয়ায় খুবই কম। সাবিহা কখন যে মনের অজান্তে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ফেলছিলো ওর খেয়াল নেই। আফিয়ার কথা শুনে সে তার কঠোর মনকে কান্না থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আফিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে সাবিহা উঠে গেলো। দরজার কাছে যেতে যেতে ওড়নায় চোখদুটো ভালোমতো মুছে নিলো। এরপর মাথা ঘুরিয়ে সহজাত হাসিতে বললো,
– আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি।

আফিয়া বিছানায় বসা অবস্থায় আরেকবার কান্নার বিষাদে আক্রান্ত হলেন। আয়মানকে স্বাভাবিক করার নিরবযুদ্ধে সাবিহার অংশগ্রহণ দেখে তিনি বিগলিত হয়ে গেলেন। তাড়াহুড়ো করেই সব আয়োজন সাজিয়ে আন্টি পড়িয়ে এলেন সাবিহাকে। আয়মান যখন মতের বিরুদ্ধে সব আচরণ মেনে নিচ্ছিলো তখন আফিয়া যেনো সাহস পেলেন এবার তার ছেলে আগের মতো ফিরবেই। এদিকে ওয়াসিফ ভিলায় পলাশের অবস্থা কিছুটা উন্নতির আলো দেখেছে। প্যারালাইসিস হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় কিছুটা নিস্তার হিসেবে এখন মুখ দিয়ে ঠিকরে ঠিকরে কথা বলতে পারেন। তার ব্যবসাটা পূর্ব খুব ভালোভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন এ খবরও পলাশ ওয়াসিফ পেয়ে খুশি হয়েছেন। একমাত্র তিনি ছেলের ভরসার উপর নিজের ভরসা ছেড়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছেন। পূর্ব ভোটের দিন থেকেই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। মোমিন কিছুদিন লাপাত্তা থাকলেও হুট করে কোত্থেকে যেনো আবার উদয় হয়েছে। মোমিন এতোদিন কোথায় ছিলো তা জিজ্ঞেস করলে বলে,

– ‘ ভাই দেশের বাড়িতে আম্মার কঠিন অসুখ আছিলো, এই কারনে ওইহানে এতোদিন ছিলাম। ‘

পূর্ব ব্যাপারটা খটকা হিসেবে নিয়েছে। যেটুকু তথ্য সে জেনেছে তাতে এটাই ছিলো মোমিন তার গ্রামে যায়নি এবং ওখানকার ত্রিসীমানার কোনো জায়গায় স্থান নেয়নি। কিন্তু মোমিনের বিশ্বস্ততার উপর সন্দেহ করাটা অহেতুক হবে এবং ও শুনলে প্রচণ্ড কষ্ট পাবে দেখে পূর্ব বিষয়টা অতো গুরুত্ব হিসেবে দেখেনি। হয়তো প্রেমবিভ্রাটে ফেসেছে মোমিন, তাই সম্ভবত বলে-কয়ে যায়নি। এখনকার যা যুগ!

.

সকাল থেকে হৈচৈ করে শিকদার বাড়িতে বিয়ের আয়োজন সাজানো হয়েছে। আফিয়া কোনো আত্মীয়স্বজন কাউকেই খবর দেয়ার সাহস পাননি। আয়মান সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে, যদি একটা আত্মীয় বিয়েতে উপস্থিত হয় তাহলে সে চুপচাপ নিরুদ্দেশ হবে। আফিয়া তাই শুনে আর কোনো বিপদ টানতে চাননি। পূর্ব, পূর্ণতা, খোদেজা, কবির, শ্রেয়ার মা শায়লা ও বাবা শফিক, শ্রেয়ার ছোট বোনকে আমন্ত্রণ করেছেন। রাজিবের পরিবার গ্রামে ঘুরতে গিয়েছেন বিধায় তারা অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। পূর্ব দুহাতে আয়মানের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য সব কাজ চটপট করে দিচ্ছে। কাজি, উকিল, শপিং, খাবার, অন্যান্য যতোপ্রকার কাজ আছে সব তাড়া দেখিয়ে সেরে দিচ্ছে। বহুদিন পর পূর্বকে আবারও কাজের মধ্যে তৎপর দেখে মুগ্ধ হলেন খোদেজা। যদিও এখন শীতকাল চলছে তবুও পূর্বের কপাল যেনো ভিজেই থাকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পূর্ণতার দিকে খেয়াল রাখা যেনো পূর্ব ভুলেনা। এসব কিছুই পলকে পলকে লক্ষ করছেন খোদেজা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আয়মানের সামনে কাজি এসে বসলো। মেরুন রঙের শেরওয়ানি, গলায় সোনালী সুতার কাজ। মাথায় মেরুন রঙের পাগরী এবং পাগরীর বামদিকে ছোট্ট একটা পাথরের সোনালী দামী ব্রোন্ঞ্জ। সুক্ষ দাড়িগুলো আজ শেভড, চোখের দৃষ্টি নত হলেও প্রখর, মুখে হাসি নেই একফোঁটা, গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে আয়মান। তারই ডানপাশে কাধে একহাত রেখে বসে আছে পূর্ব। গায়ে কালো রঙের পান্ঞ্জাবী। দুহাতা কয়েক ভাঁজ করে কনুইয়ে গুটিয়ে রেখেছে। সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পড়ুয়া। চুলের স্টাইল আবারও ট্রিম কাট করে কানের দুপাশ থেকে চুল ছেটেছে। পূর্ণতা এই লুক দেখে একবার নিজের দিকে তাকায়, আরেকবার পূর্বের দিকে। এই লোক কি এখন সুন্দর হওয়ার ঔষুধ খাচ্ছে? বয়স তো আর কম হলো না। আল্লাহ্ দিলে মাশাআল্লাহ বত্রিশে পা ফেলেছে। তার মধ্যে এই অবস্থা দেখলে মানুষ আসল বয়স ৩২ কে উল্টে ২৩ বানাতেও দ্বিধা করবেনা। পূর্ণতা না পারতে হঠাৎ ওকে জিজ্ঞেস করে,

– আচ্ছা তুমি কি দিনদিন বুড়ো থেকে কচি হচ্ছো?

পূর্ব এই প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,

– নাউযুবিল্লাহ, ছিঃ! এগুলো কেমন ভাষা?

পূর্ণতা কোমরে দুইহাত রেখে ভ্রুঁকুটি বলে উত্তর দিলো,
– আমাদের মেয়েটা বেঁচে থাকলে তোমার এই অবস্থা দেখে উত্তর দিতে পারতাম। মনকে বোঝাতে পারতাম.. না, ওয়াসিফ পূর্ব মেয়ের জন্য নিজেকে সুন্দর বানাচ্ছে। কিন্তু তুমি কোন্ মন্ত্রীর মেয়েকে পটানোর জন্য এই লুক মারছো বলোতো?

পূর্ব ওর উদ্ভট ধরনের প্রশ্ন শুনে ক্ষুদ্ধ গলায় বললো,

– একেবারে কানে কপালে চড় লাগাবো! তোমার যদি প্রেম-প্রেম পায় কাছে আসো, আদর করে দেই। তবুও ওই নষ্টালজিক কথাবার্তা বলতে এসো না।

পূর্ণতা মুখ কোমর থেকে হাত সরিয়ে মুখ করে বললো,

– উহু, ঠিক লজিক দিলাম তো। বিয়ে হচ্ছে আমার বন্ধুর। আর সেজেগুজে নিজে বর হচ্ছো তা তো চলেনা বস্!
– কি লাগবে তোমার সাথে পরিস্কার বলো। আমাকে বুড়ো বানাতে কি করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে?
– ফ্যাকাশে মার্কা সাদা পান্ঞ্জাবী ছেড়ে একটু স্টাইল করুন কমরেড সাহেব। এখনো তো ব্যাচেলারের মতো লাগে আপনাকে। দয়াকরে কালো রঙের পান্ঞ্জাবীটা পরে ফেলুন। আমি আসছি।

পূর্ণতার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে দেয় পূর্ব। শপিং ব্যাগটা হাতে নিতেই পূর্ণতা রেডি হয়ে চলে যায়। আয়মান এখন কাজির সামনে বসে চুটিয়ে ঘেমে যাচ্ছে। তিন কবুল বলার জায়গায় চার কবুল বলাতে সবাই হেসে দিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। এদিকে পূর্বের ফোনে লাগাতার নানা মানুষের কল আসছে। কিন্তু হুট করে কেনো হুলস্থুল কল আসছে পূর্ব বুঝতে পারছেনা। পূর্ব এমন অবস্থায় ফোনও রিসিভ করতে পারছেনা। কবির আড়চোখে ব্যাপারটা বুঝতে পারলে পূর্বকে তিনি বাইরে যেতে বলেন। পূর্ব দোতলার সিড়ি ধরে নিচে নামতেই কানে ফোন এঁটে যেই কথা বলবে ওমনেই বাইরে থেকে বিকট সাইরেন বাজানোর শব্দ এলো। প্রচণ্ড কৌতুহল হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকাতেই ফোনের বিপরীতে যা বললো তা শুনে পূর্ব হতভম্ব! নূরানীর চিৎকার শোনা যাচ্ছে! সে চিৎকার দিয়ে ‘ পূর্ব ভাই, ও খালাম্মা, পূর্ণতা আপা ‘ বলে গলা ফাটাচ্ছে। পূর্ব একদৌড়ে নূরানীর কাছে যেতেই বাগানে গিয়ে গেটের বাইরে গাঢ় নীলের জীপ দেখতে পায়! নীল পোশাক পড়ুয়া পুলিশের আইজি হাতে লাঠি নিয়ে ফোর্স সহ এদিকে আসছে। নূরানী যেনো পূর্বাশঙ্কায় ভয় পেয়ে হাপিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। পূর্ব জোর গলায় নূরানীকে বলে চলে যেতে। কিন্তু নূরানী ঠায় দাড়িয়ে থেকে অস্থিরচিত্তে ঢোক গিলতে থাকে। পূর্ব এবার ধমকে উঠে নূরানী উপর,

– নূর! তোকে আমি যেতে বলছি!

পূর্বের ওমন আওয়াজে শিউরে কেঁপে উঠে নূর। চোখভর্তি পানি টলটল করা শুরু করে দেয় ওর। এরপর একছুট দিয়ে সে বাগান পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে বাইরে চিৎকার করে বাইরে ডেকে আনে। পূর্ণতা পুলিশের খবর শুনেই শাড়ি ধরে দৌড় দিয়ে বাইরে এসেছে। এসেই দেখে পুলিশের সাথে ছোটখাট তর্কবিতর্ক চলছে পূর্বের। পিছু পিছু বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি চলে এসে দেখে ওই অবস্থা। আয়মান মাথার পাগরী খুলে পূর্ণতার হাতে দিয়ে পূর্বের কাছে চলে যায়। কবির, আনোয়ার দুজনই পুলিশের সাথে নানাপ্রকার কথা বলতে থাকে। পুলিশ কেমন যেনো একগুঁয়ে হয়ে ফোর্সকে এগুতে নির্দেশ দিচ্ছে। ধ্বক ধ্বক করে পূর্ণতার বুকের ভেতর বারি খাচ্ছে! বুকের উঠোনটা শুষ্ক হয়ে কামড়ে আসছে! হাত-পা শীতল হয়ে আসছে অজানা ভয়ে! চোখের দৃষ্টি ব্যকুল হয়ে পুলিশকে বুঝাতে থাকা পূর্বের উপর আটকে আছে। পূর্ব খুব করে যেনো পুলিশকে বুঝাচ্ছে কিন্তু পুলিশ কিছু শুনছেনা। পূর্ণতার মনে হচ্ছিলো ওরা পূর্বকে সুস্থ রাখবেনা। কোনো অঘটন ঘটানোর জন্যই তার এখানে এসেছে। মূহুর্ত্তের মধ্যে কয়েকটা মাইক্রোবাস এসে রাস্তায় ভিড় করে ফেললো। পূর্ব এতোক্ষন যতোটা অস্থির ছিলো মাইক্রোবাস দেখে তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে সোজাসুজি পূর্ণতার দিকে তাকালো! নূরানী এক চিৎকার দিয়ে বললো,

– নূর ওকে ভেতরে নে! তাড়াতাড়ি ভেতরে নে!

পূর্ণতা থম মেরে তাকিয়ে থাকলেও চোখ থেকে নিশব্দে পানি পরছিলো। গেটের বাইরে পুলিশের গাড়ির আশেপাশে সাংবাদিকের মাইক্রোবাস ঘেরাও হয়েছিলো। পূর্ব আরো একবার এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পূর্ণতাকে সরানোর জন্য নূরানীকে আদেশ দিলো। নূরানী ছিটকে আসা কান্নায় কেদেঁ দিয়ে পূর্ণতার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। পূর্ণতা অটলদৃষ্টিতে অশ্রুপূর্ণ চাহনিতে পূর্বের দিকে তাকিয়েছিলো। কালো পান্ঞ্জাবীর মানুষটাকে রূপালী রঙের দুটো হ্যান্ডেক্রাফ পরাচ্ছিলো। সে বারংবার অনুরোধ করছিলো নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে। খোদেজা, আফিয়া, সাবিহা দূর থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ওইটুকু দৃশ্য দেখে। পূর্বকে পুলিশ কেনো গ্রেফতার করছে তিনি কোনোভাবেই আঁচ করার ক্ষমতা পেলেন না। পূর্বকে সবার সামনে দিয়ে পুলিশের গাড়ির দিকে নিয়ে গেলো। সাংবাদিকরা যেনো হন্য হয়ে ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আয়মান মুখ ফিরিয়ে পূর্ণতার অবস্থা দেখার জন্য বাড়ির ভেতরে তাকালো কিন্তু ততক্ষণে নূরানী ওকে একদম ভেতরে নিয়ে গেছে। পূর্ণতার কথা চিন্তা করতেই আয়মানের মনটা ভেঙ্গেচুড়ে আসলো। নিজের বিয়ের দিনে পূর্ণতার জন্য এমন বীভৎস ঘটনা কেনো হলো? আয়মান ঠোঁট কামড়ে নিজের অশ্রুবিদ্ধ আবেগ সংযত করার চেষ্টা করলো। পূর্ব পুলিশের গাড়িতে উঠে বসতেই হঠাৎ আয়মানকে জোরে হাক দিলো। আয়মান তাড়াহুড়ো করে ভিড়টা খাবলে-খামচে সরিয়ে পূর্বের একদম কাছে যেতেই বুঝলো পূর্বের চোখ ভিজে আসছে। সেদিনের মতো হাসপাতালে থাকাকালীন ঘটনার মতো পূর্বের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। আয়মান পূর্বের হ্যান্ডক্রাফ পড়ানো হাতটা চেপে ধরতেই পূর্ব ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

– ওর খেয়াল রেখো আয়মান। তোমার বোনটাকে দেখে রেখো।

পূর্বের কথা শুনে ঠোঁট কামড়ে চোখ কুঁচকে ফেলে আয়মান। ওই মূহুর্তেই ও টের পায় পূর্বের হাতটা ধীরেধীরে আলগা হয়ে ছুটে যাচ্ছে। জড়তা ছেড়ে গাড়িটা চলতে শুরু করেছে অনিকেত উদ্দেশ্যের দিকে।

-‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

( নোটবার্তা : রিচেক দেয়া সম্ভব হয়নি। দেরির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here