#ধূসর_অনুভূতি
পর্ব:১৭+১৮(শেষ পর্ব)
ঝিনুক আর যুথি ভেবেছে মালিহাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা খুব রিয়াক্ট করবে। কিন্তু, তাদের মা রিয়াক্ট করলো না একটুও।বললো,আসছো তুমি?আসো দেখে যাও আমার ছেলের কি অবস্থা করছো…আমি তো তোমাকে অনেক জ্বালাইছি, কষ্ট দিছি। এর জন্য শাস্তি ভোগ করছি খুশি হওনি তুমি? আমার কলিজা পুড়ে যাচ্ছে কষ্টে…..
মা কাঁদতে শুরু করলো।
যুথি এসে বললো,ভাবী তুমি আসবে আমরা জানতামই না।
মালিহা মাথা নিচু করে রইলো।তার খুব বলতে ইচ্ছা করছে,এতো কিছু হয়ে গেলো তোমরা আমাকে জানালে না? কিন্তু কোন অধিকারে সে এই কথা বলবে?
ঝিনুক মেহেদী-কে বললো বাসা থেকে তিতলিকে নিয়ে আসতে।তিতলি এখন আছে পরীদের বাসায়।
মেহেদী অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তিতলিকে নিয়ে ফিরে এলো।
মালিহা তখন পিছন ঘুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তবুও মুখ না দেখেই তিতলি বুঝে ফেললো এটাই তার মা।
তিতলি প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলো।সত্যিই তার মা এসেছে।
সে চিৎকার করে ডাকলো,মামণি…..
যদিও আওয়াজ টা বের হলো খুব আস্তে।তিতলির চোখে পানি টলমল করছে।
মালিহা পিছনে ফিরলো।তিতলিকে দেখে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। মুহূর্তেই চোখের পানি গাল বেয়ে চিবুকে পৌঁছে গেলো।
তিতলি মেহেদীর কোল থেকে নেমে দৌড়ে মালিহার কাছে চলে গেলো।তার ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মালিহাকে জড়িয়ে ধরলো।
তার জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে তার মনের কথা।সে বলতে চাইছে,মামণি তোমাকে আমি আর কোথাও
যেতে দিবো না।আমি তোমার জন্য কত কাঁদছি তুমি জানো?
কিন্তু,মুখে সে কিছুই বলতে পারলো না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মালিহা তিতলির কপালে আর গালে ইচ্ছা মতো চুমু খেতে লাগল।মেয়েটা শুকিয়ে গেছে।মুখটা বড় হয়ে গেছে শরীরের তুলনায়। কি মায়া লাগছে আহারে….
মালিহা নিজেকে সামলে নিলো।বললো,তিতলি তুমি তোমার ফুপিদের কাছে যাও।
তিতলি চোখ বড়বড় করে বললো,কেন তুমি আবার চলে যাবে?
তার চোখ ভর্তি পানি চিকচিক করছে।
মালিহা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না।
তিতলি বললো, আমার বাবার সাথে দেখা করে যাও।বাবা তোমার ছবি নিয়ে রাত্রে বেলা কাঁদতো।তোমাকে দেখলে খুশি হবে…..
মালিহা তিতলির দিকে তাকিয়ে রইলো।এতো ছোট বাচ্চা অথচ কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে…মালিহা মনে মনে “মাশাআল্লাহ” বললো।মায়ের নজর না কি সন্তানের উপর বেশি লাগে. ।
মালিহা বললো,আচ্ছা তোমার বাবার সাথে দেখা করা যায় কি না দেখি। তুমি কান্না করো না মা আমি থাকবো।আর যাবো না।
তিতলি হাসার মতো করে খানিকটা ঠোঁট বাকালো।
মালিহা এগিয়ে গেল সামনে।সে আসলে বাদশার সাথে দেখা করতে চায় না। কিন্তু,তিতলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিলো না।মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব কষ্ট তার দিকে ধেয়ে আসছিল।
তিতলি মেহেদীর কাছে এলো। মেহেদী বললো,তিতলি তুমি আর কেঁদো না তো।এই যে তোমার মামণি চলে এসেছে,বাবাও সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।এখন তো তোমার খুশি হওয়া উচিত তাই না মা?
তিতলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি মামণি চলে যাবে।তোমরা সবাই এতো মিথ্যা কথা বলো কেন?জানো না মিথ্যা কথা বলা পাপ?আমি সব বুঝি। আমি বড় হয়ে গেছি।
মেহেদী চুপ থেকে কথা ঘুরিয়ে বললো,তাই না কি?তিতলি বড় হয়ে গেছে… আমার তো মনে হচ্ছে ছোটই আছে।
তিতলি চোখের পানি মুছে উৎসাহী হয়ে আবার বললো,আমি গল্প শোনা ছাড়াই একা ঘুমিয়ে যাই বুঝেছো?
– ওমা তাই?
– হুম।আমি একাই খেয়ে নেই।কেউ আমাকে খাইয়ে দিতে হয়না।নিজে নিজে জামা পরতে পারি।
– তাহলে তো তুমি আসলেই বড় হয়ে গেছো তিতলি…
– হুম হয়েছিই তো।দেখো না আমি মামণিকে ছাড়াই থাকি।কোনো ছোট বাচ্চা কি তার মামনিকে ছাড়া থাকতে পারে?বলো মেহেদী চাচু…
তিতলি কেঁদে উঠলো।সে আর বাবা মিলে তো প্ল্যান করেছিলো মামণির বার্থডে করবে। সারপ্রাইজ পেয়ে মামণি কত খুশি হবে। কিন্তু, কি এমন কাজ পরলো মামণির যে সে চলে গেলো।তিতলির কথা কি একবারও মনে পরলো না?কখনো ফোনও তো করলো না।মামণি কি জানে বাসায় কারো ফোন বেজে উঠলেই তিতলির বুক কেঁপে উঠতো। দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতো,কে ফোন করেছে ফুপি?
তার মন কত ব্যাকুল হয়ে থাকতো এটা শোনার জন্য যে তার মা ফোন করেছে। কিন্তু,মা তো ফোন করতো না।প্রতিবারই ফুপি বলতো, আমার ফ্রেন্ড ফোন করেছে।তোর এতো জানার দরকার কি তিতলি?
কি ভাবে পারলো তিতলিকে একটা ফোন না করে থাকতে?দাদি যখন মায়ের সব শাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল তিতলি যে কি কান্না কেঁদেছে তখন মামনি তো জানেও না।তিতলি তো মায়ের শাড়িগুলো জড়িয়ে ধরে ভাবতো মাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ঝিনুক ফুপি বা যুথি ফুপিকে জড়িয়ে ধরলে তো তার এতো শান্তি লাগে না যতটা মামণিকে জড়িয়ে ধরলে লাগতো।কেমন একটা মা…মা গন্ধ আসতো।মনে হতো আর কোনো ভূত-প্রেত,রাক্ষস এসে তিতলিকে মারতে পারবে না।মামণিকে জড়িয়ে ধরলে সব ভয় চলে যেতো।কই অন্যদের জড়িয়ে ধরলে তো এমন হয় না?
তাও মামণি চলে গেলো?মামণি তিতলিকে ভুলে গেলো?
তিতলির মনে কত শতশত অভিমান জমে আছে তা কেউ জানে না।কেউ বোঝেও না।
মেহেদী নিজেও তিতলিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
ওদিকে ঝিনুক মালিহাকে বললো,আপনি ভাইয়াকে দেখে আসতে পারেন।ভাইয়া তো আপনার ভার্সিটি লাইফের খুব ভালো বন্ধু ছিল। ভাইয়ার সব বন্ধুরাই ভাইয়া কে এসে দেখে গেছে।আর, ভাইয়া এখন আগের চেয়ে ভালো আছে।
ঝিনুক হয়তো এ কথাটা বলছে কারণ মালিহার বাবা তাদের আর্থিক সাহায্য করেছেন।বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ঝিনুক আরো বললো, ভাইয়ার অবশ্য সেন্স থাকে না।আপনাকে সে দেখতে পারবে না।আর,ভাইয়া তো কাউকে চিনেও না।
মালিহা বাদশাহ কে দেখতে গেলো।জ্ঞান না থাকলেই তার জন্য ভালো। বাদশাহ তাকে না চিনুক।
ডাক্তার বললো, বেশি ক্ষন যেন না থাকে।
মালিহা বেশিক্ষণ থাকবেই বা কি করে….তার কি সেই অধিকার আছে?
মালিহা বাদশার কেবিনে ঢুকলো। বাদশার পায়ের কাছে বসলো। অনেক দূর্বল আর শুকনো লাগছে বাদশার মুখটা।তবে এতোটা যে অসুস্থ সেটা বোঝা যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে ভালোই আছে, ঘুমিয়ে আছে।
হঠাৎ বাদশাহ চোখ খুললো।মালিহার বুকটা কেঁপে উঠলো।মন চাইলো দৌড়ে পালিয়ে যেতে। বাদশার চোখে পরার মতো সাহস তার নেই।
বাদশাহ অস্পষ্ট,জড়ানো স্বরে বলে উঠলো,মালিহা…
ঝিনুক না বলেছিল বাদশাহ কাউকে চিনে না।মালিহা বরফের মতো জমে গেলো।
তার পায়ের সব শক্তি হারিয়ে গেলো।উঠে চলে যাওয়ার মতো শক্তি তার নেই।
খুব অস্ফুট স্বরে বাদশাহ কথা বলতে লাগলো।যদিও মালিহা সবই বুঝতে পারছিলো আর কথাগুলো তার কাছে অস্ত্রাঘাতের মতো লাগছিল।
বাদশাহ বললো,মালিহা আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছি।
মালিহা তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ বাদশাহ বললো, তোমার কি বেবি হবে?
মালিহার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। বাদশাহ বুঝলো কিভাবে?অন্য কেউ তো বুঝলো না।সে তো মোটা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে এসেছে।বুঝাই তো যায় না।
বাদশাহ আবার বললো, তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে,স্নিগ্ধ লাগছে।তিতলি যখন পেটে ছিল তখনকার মতো…মনে আছে?আমরা ভেবেছিলাম তিতলির কোনো ভাই-বোন হলে নাম রাখবো তিতাস?
মালিহা তাকিয়ে রইলো শুধু।সে মনে মনে প্রার্থনা করছিলো,খোদা তুমি আমার মরণ দাও এই মুহূর্তে।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
কিন্তু,খোদা তার কথা শুনলো না।তার মতো খারাপ মানুষের কথা সম্ভবত সৃষ্টিকর্তা শোনেন না।
বাদশাহ বললো,তোমরা ভালো থেকো মালিহা।তোমাকে আর ফারহানকে আমি অনেক বিশ্বাস করতাম। পৃথিবীতে মৃত্যু যন্ত্রনার পর সবচেয়ে বেশি কষ্ট মনে হয় বিশ্বাস ভাঙা।
মালিহা বাদশার পায়ে মাথা রাখলো। বললো,”তুমি আমাকে মাফ করে দাও।আমি নিজেও জানি না আমি এতো বড় ভুল কিভাবে করলাম।”
বাদশাহ বললো, তুমিও আমাকে মাফ করে দাও।আমি বুঝাতে পারি নি আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। আমার নিজের চেয়েও বেশি। ঝিনুক,যুথির চেয়েও বেশি। এমনকি তিতলির চেয়েও বেশি তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু,লাভ কি তুমি তো বুঝো নি…এই ভালোবাসা মূল্যহীন। তুমি ফারহানের সাথে ভালো থেকো।
মালিহা কেঁদে উঠলো।
– না না আমি ভালো থাকতে চাই না।আমি মরে যেতে চাই। তুমি ভালো হয়ে যাবে দেখো। তুমি অনেক ভালো মেয়ে বিয়ে করে সুখে থাকবে।
বাদশাহ কিছু ক্ষন পর জিজ্ঞেস করলো,মালিহা তুমি তো বছরখানেকেরও বেশি সময় ফারহানের সাথে প্রেম করেছো তাই না?তাহলে সেই সময় গুলোতে যে আমাকে ভালোবাসি বলতে,বুকে মাথা রাখতে,হাসতে,কথা বলতে সব কি মিথ্যা অভিনয় ছিল? ভাবলেই আমার যে কি অসহ্য কষ্ট হয়…..সেই কষ্ট খানিকটা অনুভব করলেও তুমি বলতা বাদশাহ তুমি মরেই যাও,বেঁচে থেকে কষ্ট পেও না।
এরপর বাদশাহ একটু দম নিয়ে আবার বললো,মালিহা তুমি চলে যাও।তোমাকে দেখে আমার কষ্ট আরো বাড়ছে।
মালিহা বাইরে বেরিয়ে এলো।মনে হচ্ছে সে কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
চারপাশটা এতো প্রাণহীন কেন?কত মানুষ মরে যায় সে কেন মরে না?
মালিহা দেখলো ঝিনুক,যুথি, বাদশার মা,বাবা,তিতলি, মেহেদী সবাই কাঁদছে।
কিন্তু,সে কাঁদতে পারবে না।কান্না করার জন্য যে অধিকার লাগে সেটা তার নেই। কিন্তু,কষ্ট তো সেও পাচ্ছে।তার বুকটা তো পুড়ে যাচ্ছে।
ফারহান ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে।কারো সাথে দেখা না করেই সে চলে এলো।তিতলির সাথেও দেখা করলো না আর।মালিহার মনে হলো পৃথিবীতে তার চেয়ে দুঃখী ,অভাগা মানুষ আর কেউ হয়না।যে কিনা বেঁচেও থাকবে মরণযন্ত্রনা নিয়ে।এর চেয়ে বড় শাস্তি কিছু হতে পারে? মালিহা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,এতো কষ্ট না দিয়ে আমাকে মেরে ফেলো স্রষ্টা।আমাকে সব ভুলিয়ে দাও।আমি এতো কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।আর,একটা সুযোগ যদি আমি পেতাম শুধু একটা সুযোগ।আমি বাদশাহ আর তিতলিকে ছাড়া কারো দিকে ফিরেও তাকাতাম না। সারাক্ষন ওদের জড়িয়ে ধরে রাখতাম।
মালিহা পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো।
রাত পেরিয়ে ভোর হলো।ভোর বেলাতেই বাদশাহ মারা গেলো।
ডাক্তার শুধু মেহেদী কে খবরটা জানালো।
আর মেহেদী সর্বপ্রথম ঝিনুক কে। বাকিদের অবস্থা করুণ।সে ঝিনুক কে বললো,প্লিজ ঝিনুক তুমি কান্নাকাটি করো না। ভাইয়ার জন্য দুয়া করো।আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসিব করুক। বেঁচে থাকলেই বরং উনি আরো কষ্ট পেতো।এখন উনার সব কষ্টের অবসান হয়েছে।
ঝিনুক ঘোলাটে চোখে মেহেদীর দিকে তাকালো। বললো, ভাইয়া যে এতো অসুস্থ ছিলো বাসার সবাই খুব কাঁদছে আমিই সবচেয়ে কম কাঁদছি।ভেবেছি কেঁদে সময় নষ্ট না করে ভাইয়াকে বাঁচাতে চেষ্টা করি।আজ আমার অফুরান সময়,আজ আমাকে কাঁদতে নিষেধ করো না।
– ঝিনুক তুমি তো তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছো ভাইয়াকে বাঁচাতে। এরপরেও যেহেতু উনি বাঁচেননি বুঝে নাও এটা স্রষ্টারই ইচ্ছা। তুমি প্লিজ কেঁদো না।নিজেকে শক্ত করো।
ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তুমি জানো একদিন আমি আর ভাইয়া মেলায় গেছিলাম।ফিরার সময় হঠাৎ খুব বৃষ্টি শুরু হলো। আমাদের কাছে একটাই ছাতা ছিলো।ভাইয়া আর আমি সেই ছাতা দিয়ে কোনোমতে ফিরলাম।বৃষ্টি ছুঁতে পারলো না আমাদের। কিন্তু বাসায় এসে দেখি বৃষ্টি আমাকে না ছুঁলেও ভাইয়াকে ঠিকই ছুঁয়েছে।আমি খটখটে শুকনা থাকলেও ভাইয়া হয়ে গেছে কাকভেজা। বুঝলাম,ছাতাটা ভাইয়া শুধু আমার মাথার উপরই ধরেছিল।নিজে ভিজে আমাকে শুকনা রেখেছিল। জীবনের সব বিপদের বৃষ্টিতেই সে নিজে ভিজেছে আমাদের ভিজতে দেয়নি। ছাতার মতো থেকেছে।বড় ভাইয়েরা বুঝি এমনই হয়।আজ, আমার মাথার উপরে সেই ছাতা আর নাই।আজ আমি ভীষণ একা হয়ে গেছি। জীবনের সব ঝড়-বৃষ্টি,রোদ,ঘাত
প্রতিঘাতে আমার একাই থাকতে হবে।কেউ বলবে না,আমি আছিতো।তোর চিন্তা করতে হবে না।আহা… এরপরেও তুমি বলছো আমি যেন কান্না না করি?আমি কান্না না করে কি ভাবে থাকবো?
ঝিনুক চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
ঝিনুক কে কাঁদতে দেখে দূর থেকে বাকি সবাই ও বুঝে গেলো সবটা।
সবাই ছুটে এলো। কান্নার রোল পড়ে গেল।নার্স এসে সবাইকে ধমকাতে লাগলো।বের হয়ে যেতে বললো।
ওরা অবশেষে বেরিয়েই এলো। বাদশাহ কে আর একরাশ ধূসর অনুভূতি নিয়ে….
তিতলি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।এও কি সম্ভব?তার মা-ও নাই।এখন আবার বাবাও চলে গেল!
.
১৮.
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেছে। ঝিনুক আর মেহেদীর বিয়ে হয়েছে।তবে, মেহেদী খুব খামখেয়ালি। সারাক্ষন ছবি আঁকা নিয়ে থাকে। ঝিনুক নিজেও ছোট একটা জব করে।কারণ,কখনো মেহেদীর ছবি খুব ভালো বিক্রি হয় আবার কখনো হয়ই না। কিন্তু, সংসার তো চালাতে হবে। ঝিনুক খুব ঝগড়া করে এ নিয়ে মেহেদীর সাথে। মেহেদী শুধু হাসে।বলে,তাও তো তুমি একজন চিত্রশিল্পীর বউ। তোমার গর্ব করা উচিৎ। মেহেদীর কথা শুনে ঝিনুক আরো ঝগড়া করে। কিন্তু,যতোই ঝগড়া করুক মেহেদীকে ছাড়া সে এক সেকেন্ডও কল্পনা করতে পারেনা।তার কোনো দুঃখ নেই,একটা ছোট্ট বাড়ি তাদের। ছোট্ট একটা সংসার। কিন্তু, তবুও তারা ভীষন ভীষণ সুখী।
যুথিরও বিয়ে হয়ে গেছে।যুথির স্বামী বিশাল বড় ব্যবসায়ী,ধনী।স্বামী শ্বশুর, শ্বাশুড়ি,জা,ভাশুর সবাইকে নিয়ে বিশাল সংসার যুথির। সবচেয়ে ছোট ছেলের বউ হিসেবে সবাই ভীষণ আদর করে যুথিকে।যুথির স্বামীও ভীষণ ভালো মানুষ।বাড়িতে যতক্ষন থাকে ততক্ষণ খালি যুথি….যুথি করতে থাকে।
যুথি প্রায়ই ঝিনুকের কাছে ফোনে অভিযোগ করে ,আপু আমার খুব বিরক্ত লাগে জানো সারাক্ষন খালি সে আমার নাম জপ করবে।আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না।কি একটা অবস্থা….
ঝিনুক হাসে।বলে,হ্যাঁ এতে যে আপনি ঠিক কতটুকু বিরক্ত তা আপনার গলার স্বর শুনেই বুঝা যাচ্ছে মহারানী।
যুথিও হেসে ফেলে।একটা সময় সে মেহেদী ভাইয়াকে পছন্দ করতো।ভাবলেও এখন লজ্জা লাগে।মেহেদী ভাইয়ার সাথে ঝিনুক আপু ছাড়া অন্য কাউকে মানায়ই না।যেমনটা তাকে আর তার বরকে মানায়।
ঝিনুকের বাবা-মা তিতলিকে নিয়ে থাকে।মায়ের রাগী স্বভাব এখন আর নেই।বয়স বেড়েছে ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকে দুই স্বামী স্ত্রী।মাঝে মাঝে ঝিনুক আর যুথির বাসায় যায়। বাদশার কথা মনে পরলে স্রষ্টার কাছে হাত তোলে, দোয়া করে।
মালিহা আর ফারহানের সংসারও চলছে। ছোট একটা ছেলে আছে,যার নাম তিতাস।মালিহার মনে পাহাড়সম কষ্ট থাকলেও সে কাউকে বুঝতে দেয় না। ফারহান তো ব্যস্ত থাকে বন্ধু-বান্ধব আর মদ নিয়ে।কে জানে হয়তো মেয়ে নিয়েও।তবে,ফারহান তিতাসকে অনেক ভালোবাসে।মালিহাও তিতাসের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছে।নাহলে,এতো যন্ত্রনা নিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।
আর তিতলি?তিতলি এখন আসলেই বড় হয়ে গেছে।ক্লাস ফোরে উঠে গেছে। খুব হাসিখুশি থাকে সে….আসলেই কি তাই?তিতলির ক্লাসের সবার মা আছে,বাবা আছে। শুধু তার নেই।প্যারেন্টস মিট এ সবার বাবা মা আসে। টিচার রা সন্তানদের বিরুদ্ধে তাদের কাছে নালিশ করে,ভালো গুনগুলোও বলে। শুধু তিতলির বাবা মা আসে না।তিতলি ক্লাসে ফার্স্ট হয় কিন্তু সেই খবর বাবা মা শুনতে পারে না।ক্লাসের অনেকে আড়ালে মজা করে।বলে,জানিস তিতলির মা আরেক লোকের সাথে পালায় গেছিলো। কথাগুলো তিতলির কানে আসলে তার বুক ফেটে যায়। ঝিনুক ফুপি আর মেহেদী চাচু তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু,তারা তো সারাদিন বাইরে কাজ করে।তিতলি তো মন চাইলেও তাদের বাসায় যেতে পারে না।যুথি ফুপির বাসায় গেলেও দেখতে পায় যুথি ফুপি অনেক ব্যস্ত তার সংসার নিয়ে।তিতলির সাথে কথা বলার সময় খুব কমই পায় সে। কিন্তু,তিতলিকে আদর করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, মায়ের আর বাবার মতো কি কেউ হয়?তিতলি লক্ষ্য করেছে সে ভীষণ একা। অনেক আপনজন থাকলেও সে একা। মায়ের কাছে যেতে মন চায়। কিন্তু,মায়ের উপর রাগ হয় ভীষণ। আবার,বুঝতে পারে মায়ের তো আরেকটা সন্তান আছে।সেই সংসারে তো সে আগাছা।সেই সংসার এ তার উপস্থিতি কেউ পছন্দ করবে না। বিরক্ত হবে।
মামার বাড়ি তে যায় তিতলি মাঝে মাঝে।সেখানেও একই বিষয়।মামা,মামির সন্তান আছে।তারা তিতলিকে আদর করলেও নিজের সন্তানের মতো তো আর করে না।
বাবা মা না থাকলে বুঝি সব সন্তানই এমন আগাছা হয়ে যায়?তিতলির বাংলা মিস একবার কথায় কথায় ক্লাসের সবাইকে বলেছিল, পৃথিবীর সব মানুষের আদর-ভালোবাসাও যদি কেউ পায় তবুও জেনে রেখো তার চেয়েও মা-বাবার ভালোবাসা অনেক বেশি।
ক্লাসের সবাই জ্বি মিস…জ্বি মিস বলে চিৎকার করে উঠছিল। শুধু তিতলি কোনো শব্দ করেনি।তার বুকটা কেঁপে উঠেছিল।তিতলি রোজ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ডাইরিতে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে। সেই চিঠি আবার নিজেই কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলে দেয়।প্রিয়,মা-বাবা
মা…বাবা দেখো আমার রোল এক হয়েছে।আজকে বাংলার টিচার আমার হ্যান্ডরাইটিং এর প্রশংসা করেছে।আমি আর আমার বন্ধুরা গোল্লাছুট খেলেছি টিফিন পিরিয়ডে।জানো তোমরা, আমাকে আজকে ইংরেজি স্যার বকা দিয়েছে। আমার খুব কষ্ট হয়েছে।আমি কাউকে বলিনি।ফুপিদের বলে লাভ কি উনারা তো দূরে থাকে।দাদিকে বলেও লাভ নেই দাদি চিন্তা করবে।তোমরা থাকলে তোমাদের বলতাম।মা জানো বিকালে নিতু খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিল তখন সে “মা” বলে চিৎকার দিয়েছিল।আর, সাথে সাথে ওর মা ঘর থেকে ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ফেলেছিল।আমিও তো ব্যাথা পেলে তোমাকে ডাকি মা…কই তুমি তো আসো না। তোমার নাকি আরেকটা সন্তান আছে মা? কিন্তু, আমার তো মা নেই।
বাবা জানো কোথাও তোমার নাম লিখতে এত্তো বেশি আমার কষ্ট হয়।’মৃত: বাদশাহ রহমান’ এটা আবার কেমন নাম গো বাবা? আমি তো তোমার নামের পাশে মৃত লিখতে চাইনা…. স্কুল ছুটির পর সবার বাবা,মা সবাইকে নিতে আসে। শুধু তোমরা আসো না।আমি কি এতোই বড় হয়ে গেছি যে আমার বাবা-মায়ের আদর প্রয়োজন নেই। আমার কি তোমাদের জড়িয়ে ধরতে মন চায়না?আমি তো কোনো পাপ করিনা। মিথ্যা কথা বলিনা। দাদির সাথে নামাজও পড়ি তাও কেন আমার এতো কষ্ট? আমার সব বন্ধুরা বাবা-মায়ের সাথে কত জায়গায় ঘুরে ,ক্লাসে সেসব গল্প করে।আমি শুধু শুনি।আমাকে দাদা ,দাদী,নানি,নানা,ফুপি সবাই ভালোবাসে।তাও, আমি তোমাদের অনেক মিস করি বাবা-মা।আমি একা একা কাঁদি কাউকে বলি না। টিচার বলে ছোট বেলাটাই নাকি আনন্দের, বড়বেলায় অনেক কষ্ট সইতে হয়। কিন্তু, আমার তো ছোটবেলাতেই কষ্ট।জানো আগে আমি দুয়া করতাম তোমরা যেন ফিরে আসো। কিন্তু,তোমরা তো আসোনি। এখন আমি আর তোমাদের ফিরে আসার দুয়া করি না। এখন আমি প্রে করি, পৃথিবীর সব বাচ্চার বাবা,মা থাকুক।সব বাচ্চার বাবা ,মা থাকুক।
ইতি তোমাদের,তিতলি
তিতলি প্রায়ই মনে মনে বলে,মা তুমি না চলে গেলেও পারতে।
ছোট তিতলির মন জুড়ে থাকা অপূর্ণ অনুভূতি গুলোকেই বোধহয় বলে ধূসর অনুভূতি!
……………..(সমাপ্ত)…………..
লেখক: শাপলা
(আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ এতো দিন গল্পটি পড়ার জন্য। অনেকের হয়তো ভালো লাগে নি তার জন্য আমি দুঃখিত।চাইলেই তিতলিকে হাসি খুশি রাখা যেতো কিন্তু ব্রোকেন ফ্যামিলি কিংবা পিতৃ-মাতৃহীন বাচ্চারা কি আসলেই হাসিখুশি থাকে?আর এটা একটা স্যাড এন্ডিং গল্প। যাইহোক, আমিও তিতলির মতো মন থেকে দুয়া করি সব সন্তানের বাবা…মা থাকুক। কেমন লাগলো সেটা কমেন্ট করে জানাতে পারেন।🙂)