#প্রেমমানিশা(২১)
সবেমাত্র সানার ক্লাস শেষ হয়েছে। অনেকদিন পর আবার ক্লাস করতে পেরে আনন্দিত সানাহ্। পড়াশুনায় সে বরাবরই ভালো। স্কুল জীবনে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল। তবে এখন সময়ের প্রভাবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার তীব্র চাপে টপ করাটা আর হয় না। ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া তো কম কঠিন নয়। পড়তে পড়তে আর মুখস্ত করতে করতেই দিন পেরিয়ে যায়। ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া আর আর্টসের ইতিহাস বিষয়ের সাল মুখস্ত করার মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পায় না সানাহ্।
যদিও অনার্স লেভেলে পড়া খানিকটা কঠিন হয়ে উঠে তবে সানাহ্ এখনও তার বুদ্ধিবলে সেরা স্টুডেন্ট। টপ করতে না পারুক, তার নাম সবসময় টপ থ্রিয়ের মধ্যে থাকবেই। এটা তার চিরাচরিত গন্তব্য। অবশ্য এর জন্য ভার্সিটি মহলে সে বেশ ঈর্ষণীয় বটে।
সানার অতি মাত্রায় সুন্দর রুপ আর তার ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের জন্য কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে ভার্সিটি লাইফের সফর অব্দি তার পাওয়া প্রপোজালের শেষ নেই। প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে প্রপোজাল আসে কিন্তু ভার্সিটি মহলে সকলেই তার ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তার নির্লিপ্ত গলায় রসকষহীন ভাবে ‘ সরি, আই ক্যান্ট একসেপ্ট ইট ‘ বলার জন্য সকলেই তাকে আড়ালে এক অন্য রকমের উপাধি দিয়েছে। খুবই বিশেষ সেই উপাধি ‘ callous ‘ ।
যেই মেয়ে মেয়ে হয়েও তার মাঝে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিন্দু মাত্র কোনো আকর্ষণ নেই সে নিঃসন্দেহে ক্যালেস ছাড়া কিছু নয়। সানাহ্কে যারা ভার্সিটির লাইফের প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেখেছে তারা নিজেরাই অবাক। একটা মেয়ে কি পরিমান ক্যালেস হলে এতগুলো ছেলের আকর্ষণীয় প্রস্তাব নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দিতে পারে।
সানার স্বভাব সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। সানাহ্ যে যেকোনো ধরনের সম্পর্কের প্রতিই উদাসীন সেটা তার বন্ধু মহল দেখলেই বোঝা যায়। ভার্সিটি লাইফে আজ পর্যন্ত কোনো বন্ধুই সে জুটাতে পারেনি কিংবা চেষ্টা করেনি। ভার্সিটি লাইফে যেখানে বন্ধু বানানো ডান হাতের খেলা সেখানে সানার একটাও বন্ধু না থাকা সবাইকেই অবাক করেছে। সাথে সবাই এটাও বুঝেছে যে সানার কোনো বন্ধু আদো জীবনে সম্ভব না।
বন্ধু না থাকার দরুন সানাহ্ বরাবরই বাড়ি থেকে ভার্সিটি আর ভার্সিটি থেকে বাড়ি একাই আসা যাওয়া করে। তার যাতায়াতের মাধ্যম হলো রিক্সা। বিকেলের মেঘলা পরিবেশে ভার্সিটি থেকে ফিরতে সময় হালকা রোদ গায়ে মেখে একলা ফিরে আসাই যেন সানার জন্য পরম আনন্দের ব্যাপার। এই আনন্দ সে কারোর সঙ্গে ভাগ করতে রাজি নয়।
সানাহ্ তখন সবে ক্লাস করে বের হচ্ছিল। হঠাৎ নজরে পড়লো বিল্ডিংয়ের করিডোরের শেষ মাথায় ফারহান ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। একবার মনে হলো চিৎকার দিয়ে ডাকলে হয়তো ফারহান শুনতে পাবে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এমনটা করলে সবাই ওদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এছাড়াও কাজটা তার এথিক্সের বাইরে হয়ে যাবে। তাই সানাহ্ নিঃশব্দেই পথ চলতে লাগলো। উদ্দেশ্য হুট করে ফারহানের সামনে গিয়ে তাকে চমকে দিবে।
তবে সানার আর চমকে দেওয়া হলো না। তার দৃঢ় পদক্ষেপ থেমে গেছে। ফারহানকে ফোন রেখে ম্যাডাম রিয়াশার সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। রিয়াশার সঙ্গে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছে ফারহান। কী সুন্দর তার হাসি। বাহ্ দুজনকে কি সুন্দর মানিয়েছে ? আচ্ছা কার সঙ্গে ফারহানকে বেশি মানায় ? সানার সঙ্গে নাকি রিয়াশার সঙ্গে। রিয়াশার সঙ্গেই ভালো মানানোর কথা কারণ তারা একসময় কলেজ লাইফের বন্ধু ছিল আবার দুজন তো সমানে সমানে।
এতকিছু ভেবে সানার আর ফারহানের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করলো না। ফারহানের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ভার্সিটি গেটের দিকে হাঁটা ধরলো। উদ্দেশ্য ভার্সিটির সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়ি যাবে। বিকেলের মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে বাড়ি যাওয়ার মজাই আলাদা। যেই ভাবা সেই কাজ।
সানাহ্ ধীর পায়ে হেঁটে ভার্সিটির বাইরে চলে এলো। বাইরে আসতেই চোখের সামনে ধরা পড়লো অগণিত খালি রিকশা। এর মধ্যে একটা রিক্সা বেছে নিয়ে বললো ‘ ধানমন্ডি লেক ‘ । সানার কথা শুনে রিক্সাওয়ালাও প্যাডেল চালালো। প্রথমে ভেবেছিল বাড়ি যাবে কিন্তু হঠাৎ মনে হলো একটু একা একা কোথাও ঘুরে আসা যাক। নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটানোও হবে আবার লেকের স্বচ্ছ ধারাও দেখা হবে।
রিক্সা ধানমন্ডি লেকে এসে থামতেই সানাহ্ রিক্সা ভাড়া দিয়ে রিকশাওয়ালাকে মুক্ত করে দিলো। টাকা হাতে নিয়ে রিকশাওয়ালা পান খাওয়া ৩২ পাটি দাত দেখিয়ে হেসে চলে গেলো। সানাহ্ সেই দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার গন্তব্যে হাঁটা ধরলো।
ধানমন্ডির এক অন্যতম টুরিস্ট স্পট হলো ধানমন্ডি লেক। ধানমন্ডি লেক আসলেই চারদিকে শুধু মানুষদের আনাগোনা চোখে পড়ে। সবাই যে যার যার মতো ব্যস্ত। কেউ নিজের পরিবার নিয়ে তো কেউ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। আবার কিছু কিছু হিন্দু দম্পতিও এসেছেন একটু ঘুরে বেড়ানোর। সকলের মুখেই কত সুন্দর হাসি।
মাঝে মাঝে নিজের আশেপাশে এত হাসতে থাকা মানুষদের দেখে সানার মনে হয় এই পৃথিবীতে একমাত্র সেই অসুখী। কিন্তু সত্য তো এটাই অনেকেই মুখোশের আড়ালে নিজেদের দুঃখকে লুকিয়ে রেখে মুখে ফুটিয়ে তুলে নকল হাসি। প্রত্যেকটা মানুষেরই দিনশেষে কোনো না কোনো দুঃখ থাকে।
এই জগতে সকলেই একা সে তার যতই আপনজন থাকুক। সারাদিন ঘর, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, স্বামী নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্ত্রীও দিনশেষে একসময় একা। মানুষ যেমন একলা পৃথিবীতে আসে তেমনি একলা জীবন কাটিয়ে আবার একলাই ফিরে যায়। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একলা থাকাটাই মানব জাতি। কেউ কেউ কাছের মানুষ থেকেও একলা আবার কেউ কেউ না থেকেই একলা।
যাহ এরকম ইমোশনাল কথাবার্তা সানার ভাবতে ইচ্ছা করছে না। মাইন্ড ডাইভার্ট করা দরকার। সানাহ্ মাথা থেকে সব আজাইরা চিন্তা ভাবনা ছেড়ে সেতুর দিকে এগিয়ে গেলো। ধানমন্ডি লেকে একটা সেতু আছে। সেই সেতুতে দাড়িয়ে ধানমন্ডি লেক দেখতে আরও চমৎকার লাগে। সেখানকার দৃশ্য আসলেই চমৎকার।
সানার মনে হচ্ছে সে আস্তে আস্তে তার মামণির মতো হয়ে যাচ্ছে। তার মামণিও এরকম নীরবে নিভৃতে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করত। যখনই সুযোগ পেত একলা ঘুরতে চলে যেত। অবশ্য কখনও কখনও ছোটো সানাহ্কে নিয়েও যেত। তার মামণি সুযোগ পেলেই প্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করত। আজ সেসব অতীত।
আজ অনেকদিন পর রাস্তার ধারে যেখানে বাচ্চাগুলোকে শেষবারের মত দেখে গিয়েছিল সেখানেই এসেছে অতসী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অলি গলি চিপা চুপা খোজার পরও তাদের খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় অতসীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এতগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কোথায় গেলো ? এতগুলো আস্ত মানুষ কি করে কর্পূরের মত উবে গেলো ?
অতসীর অনেক চিন্তা হচ্ছে কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। কথাগুলো কি দাদুকে জানাবে ? নাহ্ দাদুকে জানালে যে দাদু চিন্তায় পড়ে যাবে। উফফ অতসী ভাবতে পারছে না। ওর মাথা কাজ করছেনা এতগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কোথায় গেলো। এসব ভাবতে ভাবতেই অতসী ফুটপাতের উপর থাকা চেয়ারে মাথা চেপে বসে পড়লো। সকালে রোদ পড়ায় মাথা ধরেছে।
হঠাৎ অতসী খেয়াল করলো রাস্তার ওই পাড়ে বিল্টু দাড়িয়ে আছে। সাথে সাথে অতসী লাফিয়ে উঠে বিল্টুকে ইশারা করলো সে ওখানেই আসছে বিল্টু যেন দাড়ায়। বিল্টু অতসীর ইশারা বুঝলো কিনা কে জানে তবে ওখানেই দাড়িয়ে রইলো। অতসী কোনোমতে রাস্তা পার করে বিল্টুর কাছে গেলো। হাপাতে হাপাতে বিল্টুর কাধে হাত রেখে বলল ‘ তোরা সবাই কোথায় উধাও হয়েছিস ? ‘
‘ আমাদেরকে ঐযে একটা ভাইয়া আছে না যে রোজ আসতো সে একটা আশ্রমে নিয়ে গেছে। তোমরা কি যেন বলো ওটাকে ? হুম এনজিও… ওখানে। ওখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। ‘ বিল্টু বললো।
‘ কিহ, উনি বললেন আর তোরাও রাজি হয়ে গেলি ? তোদের না আমি বলেছি আমাকে না বলে কিছু করবি না ? তাহলে তোরা কেন রাজি হয়েছিস ? ‘ অতসী রেগে গিয়ে বললো। একটা স্বল্প পরিচিত দুই দিনের মানুষ এসে তার কাছের মানুষদের এভাবে করুণা দেখিয়ে নিজের দিকে টেনে নিবে সেটা কিছুতেই মেনে নিবে না অতসী। মানুষটার সঙ্গে অতসীর অনেক খাতির থাকলেও অতসীর কাছে বিল্টু,ময়না, সন্ধ্যা ওদের থেকে কেউ বেশি না।
‘ রেগে যাচ্ছ কেন দিদি ? কী করে বলতাম তোমাকে বলো ? এতদিন তো আমরা আর ভাইয়া তোমার জন্য কত অপেক্ষা করলাম কিন্তু তুমি এলেই না। ভাইয়া রোজ এসে জিজ্ঞেস করতো তুমি এসেছো নাকি ? কিন্তু শেষে যখন তোমার কোনো খোঁজ নেই তখন পরশুদিন ভাইয়া আমাদের ওই এনজিওতে নিয়ে গেলো আর বললো প্রত্যেকদিন তুমি যেই সময় আসো সেই সময়ে এসে যেন দেখে যাই তুমি এসেছ কিনা। দেখা হলে এই চিরকুটটা দিতে বলেছে। ‘ বলে বিল্টু অতসীর দিকে একটা কালো খাম এগিয়ে দিল।
অতসী বিনা বাক্য ব্যয়ে খামটা হাতে দিল। আসলেই তো সে কাউকে না জানিয়েই আসা এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছিলো। তাই ওই মানুষটাকেও দোষ দেওয়া যায় না। এখন চিরকুটে কি লিখেছে সেটা পড়তে পারলে শান্তি। অতসী চিরকুট খুলে দেখল আবারও একই ভাবে কালো কাগজে শুভ্র রঙে রঙ্গিন কালি দিয়ে লিখা ‘ এতদিন আসোনি কেন ? আমি আর ময়না,বিল্টু ওরা তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করি। কিন্তু তারপরই মনে হলো থাক না কাগজের সম্পর্কগুলো কাগজেই সীমাবদ্ধ। দরকার কি তাকে টেনে হিচড়ে বের করে আনার। যখন সময় হবে তখন আপনিতেই বেরিয়ে আসবে।
তুমি আসছ না বলে আমি নিজেই বিল্টু, ময়না ওদের থাকার একটা পার্মানেন্ট জায়গা ঠিক করে দিলাম। বাচ্চাগুলোকে একা এভাবে রাস্তায় থাকতে দেওয়াটা সেফ না। তার থেকে আমি যেখানে ওদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছি সেটা ওদের থাকার জন্য পারফেক্ট। তোমার দেখতে ইচ্ছা করলে বিল্টুকে বলো। বিল্টু তোমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে এনজিও দেখিয়ে আনবে। আবারও কথা হবে…. ‘
চিরকুটটা পড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে চিরকুটটা নাকের কাছে নিয়ে চিরকুটের গন্ধ নিলো অতসী। মনে হচ্ছে চিরকুটের গায়ে মানুষটার গন্ধ লেগে আছে। হয়তো মানুষটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটকেও পারফিউম দিয়েছিলো। এবার নিজের গন্ধ নেওয়ার কাজে ইস্তফা লাগিয়ে বিল্টুকে বললো ‘ তোদের ভাইয়া তো বললো তোকে বলতে । তুই নাকি এনজিওর রাস্তা চিনিস ? ‘
অতসীর কথা শুনে মুখে হাত চেপে হাসলো বিল্টু। কথা তার ভাইয়া ঠিকই বলেছে। বিল্টু আসলেই জায়গাটা চিনে। বিল্টু মানুষ হিসেবে খুবই প্রখর জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন। যা একবার দেখে তাই মনে রাখে। বিল্টু বললো ‘ হ্যাঁ চিনি তো,তুমি আমার সঙ্গে চলো। ‘
বিল্টু আর অতসী হাঁটছে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে কৌতূহল বশত অতসী বললো ‘ তোরা এতদিন যেখানে ছিলি সেখান থেকে এনজিও যেতে কতক্ষন সময় লাগে ? ‘
‘ এই তো পাঁচ মিনিটের রাস্তা, এই যে এসে গেছি ‘ বলে বিল্টু আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল অতসীকে। বিল্টুর ইশারা অনুসরণ করে সামনের দিকে চোখ দিতেই অতসীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। অস্ফুটে বলে উঠলো ‘ এটা তো দাদুর এনজিও ‘
বিল্টু অতসীর কথা পুরোপুরি শুনতে না পারলেও শেষের কয়েকটা কথা তার কানে ঠিকই পৌঁছেছে। বিল্টু সেটা শুনে বললো ‘ হ্যাঁ দাদুর তো, এই এনজিও নাকি ভাইয়ার দাদুর। প্রণয় ভাইয়া নিজে বলেছে, ‘
এবার আর অতসীর বুঝতে বাকি রইলো না সেই চিরকুট দেওয়া মানুষটা প্রণয় নিজেই। অথচ অতসী এতদিন বুঝতেই করেনি মানুষটা প্রণয়। প্রণয় নিজেও হয়তো জানেনা যাকে সে চিরকুট দেয় সে তারই স্টুডেন্ট অতসী। কিন্তু অতসী ভেবে পাচ্ছে না পৃথিবীটা কি এতই ছোট ? সেই ঘুরে ফিরে প্রণয়ের সঙ্গেই সে প্রণয় বাঁধালো। নাকি এটা তাদের টক ঝাল মিষ্টি প্রতিশোধের শুরু মাত্র ?
‘ দিদি ভিতরে যাবে না ? ‘ বিল্টু অতসীর হাত টেনে বললো।
‘ হুম চল ‘ বলে অন্যমনস্ক হয়ে এনজিওতে ঢুকলো। এনজিওতে ঢুকতেই তার দেখা হলো লিজার সঙ্গে। লিজা হলো এনজিওর অ্যাকাউন্ট্যান্ট। জালাল সাহেবের তৈরি করা এই এনজিও হাজার হাজার বাচ্চার ভরণপোষণের দায়িত্বে আছে বলে এর অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোও নেহাৎ বড় নয়। সেই কারণেই মূলত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে যতগুলো পোস্টে কাজ হয়ে থাকে সেগুলো এই এনজিওর মধ্যেও হয়ে থাকে।
একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আর জনকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার কারণে জালাল সাহেবকে সরকার একটা মোটা অংকের টাকা দেয় যেটা জালাল সাহেব এনজিওর কাজেই লাগান। অতসী কয়েক বছর ধরেই এই এনজিওর সঙ্গে যুক্ত তাই লিজার সঙ্গে তার ভালই সখ্যতা। অবশ্য লিজা তার বড় কিন্তু দুজনকে একসঙ্গে দেখলে কেউ তা ধরতেই পারবে না।
লিজা তো অতসীকে দেখে বেশ খুশি। দৌড়ে এসে অতসীকে জড়িয়ে ধরে বললো ‘ কতদিন পর এলে অতসী ? আমার কথা মনে পড়ে না ? জানো আমি তোমাকে কত মিস করেছি ? ‘
অতসী লিজাকে জড়িয়ে ধরে লিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ অনেক পেরা দিয়ে গেলাম এতদিন। এই কয়দিনে কত ঝড় যে গেলো তুমি ভাবতেও পারবে না। ‘
অতসীর কথা শুনে লিজা ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো ‘ আচ্ছা তাহলে তুমি আমার কেবিনে গিয়ে বসো। ওখানেই কথা বলবো। ‘
লিজার কথা শুনে অতসী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বিল্টুকে বললো ‘ তুই এখন যা…. আমি একটু পড়ে এসে তোদের সঙ্গে দেখা করবো। এখনই কাউকে বলিস না যে আমি এসেছি ‘
বিল্টু অতসীর কথা শুনে “ আচ্ছা দিদি ‘ বলে চলে গেলো।
অতসী লিজার সঙ্গে লিজার কেবিনে এসে লিজাকে বললো ‘ লিজা দরজাটা একটু লাগিয়ে দাও। ‘
লিজা অতসীর কথা মতো দরজা লাগিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো আর অতসী ওর মুখোমুখি ডেস্কের সামনে থাকা চেয়ারে বসলো।
‘ চেহারার একি অবস্থা করেছ ? এরকম হলো কি করে ? আর এতদিন এলে না কেন ? ‘ অতসীর দিকে তাকিয়ে বললো।
‘ আর বলো না। প্রথম কতদিন সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা গেলো। এরপর তো আমার আপাইয়ের বিয়ে ঠিক হল। বিয়ের ঠিক হওয়ার পরপরই আপাই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লো। আর অসুস্থ হলে তো জানোই সে কি করে । ‘ অতসী মলিন গলায় বললো ।
অতসীর কথা শুনে লিজা অবাক হয়ে বললো ‘ উনি কি আবার পালিয়ে গেছেন ? এবার কে ফিরিয়ে এনেছে উনাকে ? নাকি নিজেই ফিরে এসেছেন ? এর আগেরবার তো নিজেই ফিরে এলেন। ‘
‘ হুম পালিয়ে গেছিলো, তবে এবার দুলাভাই ফিরিয়ে এনেছে। নাহ নিজে ফিরেনি। ওর যে জেদ.. দুলাভাই জোর খাটিয়ে ফিরিয়ে এনেছে। ওর জন্য ভাইয়া এক সপ্তাহ চাকরি বাকরি ছেড়ে শুধু ওকেই খুঁজেছে। ‘
‘ বাহ তোমার আপু তো দেখি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। বিয়ের আগেই বর সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে ফিরিয়ে আনলো। মনে হয় তোমার আপুর বিবাহিত জীবন সুন্দর হবে। তা তোমার আপুর হবু শাশুড়ি রেগে যাননি ? না মানে তার ছেলেকে দিয়ে তার হবু ছেলের বউ এত কষ্ট করালো। ‘ লিজা হাসতে হাসতে বললো। অতসীর বোন অবশেষে সুখী হতে চলেছে জেনে তার খুব ভালো লাগছে। ওই মানুষটা তার কাছেই বড়ই চমৎকার। একটু পাগলাটে কিন্তু তার কথাগুলো ওর ভালো লাগে অবশ্য সে কখনো সানাহ্কে সরাসরি দেখেনি। শুধু অতসীর কাছেই শুনেছে।
‘ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালে কি হবে ? নিজের ভালো তো একেবারেই বুঝে না। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে আর আপাই বুঝে না। এটা ঠিক যে আপাইয়ের কপাল ভালো যে ফারহান ভাইকে পাচ্ছে। নাহলে আপাইয়ের যা স্বভাব তাতে ওর কপালে বর জুটত না। আন্টি কিছু বলেননি। উনি তো দিদিকে অনেক ভালোবাসেন। আসলে আন্টি আমার মায়ের বন্ধু। ‘ অতসী বললো।
‘ যাক তাহলে তো ভালই। ‘
‘ লিজা আমাকে একটা হেল্প করবে ? তোমার হেল্প আমার দরকার। ‘ অতসী অনুরোধের সুরে বলল।
‘ কি হেল্প ? এভাবে বলছো কেন ? তুমি বললে কি আমি হেল্প করবো না ? ‘ লিজা ভ্রু কুচকে বললো।
‘ বিল্টু,ময়না ওদের যেই মানুষটা নিয়ে এসেছিল আমি চাইনা সে জানুক আমি কে। আমি চাইনা সে জানুক আমিই বিল্টুর অতস দি। মোট কথা আমি উনার কাছ থেকে আমার পরিচয় লুকাতে চাই। আমি চাই না সে আমাকে জানুক,চিনুক। এর জন্য আমার তোমার হেল্প লাগবে। তুমি প্লিজ সবাইকে বলে দাও যেন কাইন্ডলি কেউ আমার নাম বা পরিচয় উনার সামনে না নেয়। প্লিজ ডু ফর মি.. ‘ অতসী অসহায় হয়ে বললো।
‘ ঠিকাছে সেটা তো বলবো কিন্তু তুমি কেন চাচ্ছো তোমার পরিচয় লুকাতে ? ওই মানুষটা কে যে তুমি তার কাছ থেকে তোমার পরিচয় লুকাতে চাও ? আমি যতটুকু জানি উনি জালাল স্যারের নাতি তবে আমি উনাকে দেখিনি। আমি পরশু একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ‘ লিজা অবাক হয়ে বললো।
‘ সরি লিজা কিন্তু আমি তোমাকে আসল সত্যিটা বলতে পারবো না। প্লিজ তুমি জানতে চেওনা। তুমি শুধু একজন বন্ধু হিসেবে আমাকে সাহায্য করো। এর জন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো। ‘ অতসী আবারও অনুরোধ করে বললো।
‘ আচ্ছা আচ্ছা আমি জানতে চাইব না। আমি সবাইকে বলে দিবো যেন কেউ তোমার কথা না বলে। ‘ বলে অতসীকে সান্ত্বনা দিলো লিজা।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….
( ১৭,১৮ জন গল্প পড়লেন অথচ কেউ একবারও বললেন না আমি একুশ নাম্বার পর্ব দেইনি। এক আপু যদি আগের পর্বের লিংক না চাইতো তাহলে হয়তো খেয়ালও করতাম না। আপনারা যে গল্পটা একেবারেই পছন্দ করেন না বুঝতেই পারছি। সমস্যা নেই, গল্পটা এমনিতেও বড় হবে না। আর ষোলো পর্ব আছে মানে ৩৭ নাম্বার পর্বেই গল্প শেষ হয়ে যাবে। শুরু যখন করেছি শেষ তো করবই। )