বকুলতলা পর্ব-৬

0
1148

বকুলতলা

৬.
তরী তখন নতুন নতুন ঢাকা শহরে এসেছে। কিচ্ছু চিনে না। প্রণয়ের বড় ভাই আবদুল ওকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়েছিল। বিশাল বড় ভার্সিটি! চোখ ধাধানো সুন্দর! তরী বড় বড় চোখে আশপাশটা দেখছিল। মাঠের কাছাকাছি আসতেই দেখলো, একটা লম্বা, চওড়া, সুন্দর মতো ছেলে ক্লান্ত শরীরে ঘাসের ওপর বসে আছে। চোখ বুজে অবিরাম আওড়াচ্ছে, “পানি, পানি, পানি।”

আরেকটু খেয়াল করতেই টের পেল, ছেলেটার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ রক্ত লেগে আছে। ঘর্মাক্ত কপালে গুটি কয়েক ত্যাছড়া আঁচড়। হাত, পা, পরনের শার্ট, জিন্স— সব ধূলোবালিতে মাখোমাখো। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তরী আনমনে নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
ঠিক তক্ষুণি ছেলেটার চোখা দৃষ্টি পরলো তার ওপর। ঘাড় কিঞ্চিত বাঁকানো। কি দারুণ সূক্ষ্ণ চাহনি! ডান ভ্রুটা উঁচিয়ে হঠাৎ-ই বলে উঠলো,
—“এই মেয়ে! পানি আছে?”
ভীতু তরী হকচকালো। এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে নিলো একবার। তারপর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো ছেলেটার দিকে। ছেলেটা সময় নিলো না। ঢকঢক করে প্রায় বোতলের অর্ধেকটুকু পানি শেষ করে ফেললো। এরপর কপাল কুঁচকে বললো,
—“বসো।”
—“জি?”
—“আমার পাশে বসো।”

কণ্ঠে একরাশ বিরক্তির আভাস। তরী বসলো না। নিমিষেই চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো, “আমার বোতলটা দিন।”
ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো এবার। হাত ঝেড়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল দশটা বাজছে। ছেলেগুলোর সঙ্গে হাতাহাতি করার সময় ঘড়ির স্ক্রীন ফেটে গিয়েছিল। ফেটে যাওয়া স্ক্রীন দেখে মনে মনে আফসোস করলো সে। আহ! তার সখের পাঁচ হাজার টাকা দামের ঘড়ি!
তরী তখন কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে আছে। তার বিরক্তি লাগছে। ছেলেটার ব্যবহার ভীষণ অদ্ভুদ। দেখে তো বখাটে মনে হচ্ছে না। তবে মুখের ক্ষতগুলো স্পষ্ট খারাপ ছেলে হওয়ার স্বীকারোক্তি জানান দিচ্ছে। তরী বোতলটা আর নিলো না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলেই ছেলেটা আচমকা প্রশ্ন করলো, “নাম কি তোমার?”
তরী রয়ে, সয়ে উত্তর দিলো, “তরী মোশারফ।”
ছেলেটা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো, “তরী অর্থ কি জানো? নৌকা।”

তরী শুধু তখন এক ঝলক তাকিয়েছিল ছেলেটার দিকে। মুখশ্রীতে যেন আগুনের ফুলকি জ্বলজ্বল করছে। সে আর দাঁড়ালো না। অসহ্য ভঙ্গিতে চলে গেল। তবে যেতে যেতে ছেলেটার উঁচানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল, “মেয়ে, তুমি কোন নদীর নৌকা?”

পরে জানা গিয়েছিল, ছেলেটার নাম মাহাদ। বিকাল বেলা প্রতিদিন তাকে ভার্সিটির গেটের সামনে দেখা যায়। মাহাদের বাইকে বসার ভঙ্গিমাটাও দারুণ। সর্বদা রাজকীয় ভাবসাব নিয়ে থাকে। তাকে ঘিরে থাকে দশ-বারো জন অল্প বয়সী ছেলেপেলে।
মাহাদের যন্ত্রণায় তরী ভার্সিটি আসতো লুকিয়ে লুকিয়ে। তবুও যেন চতুর লোকটির হাত থেকে নিস্তার পেত না। দিনেদিনে মাহাদ যেন কেমন হয়ে উঠে। আগে তরীর সাথে কথা বলতো বুঝে শুনে, ঠাট্টার সুরে। তরী বুঝতো, মাহাদ শুধুমাত্র তার সাথে মজা করার জন্যই এসব করতো। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সেই মজাটা যেন লাগামহীন, বেপরোয়া স্বভাবে পালটে যায়। দিন, ক্ষণ মনে নেই তরীর। মাহাদের পাগলামির শুরুটা তরীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সে তো কখনো কারো ভালোবাসা পায়নি। হঠাৎ আসা এই গাঢ় ভালোবাসাটা তার জন্যে দৃঢ় কালবৈশাখীর ঝড় বইয়ে এনেছিল।

রাস্তাঘাটে আজকে অনেক জ্যাম। আধঘন্টার রাস্তা পেরোতে পুরো একঘণ্টা লেগেছে তরীর। তখন আকাশে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। হলদেটে আভা গায়েব হয়ে ঘন আঁধার এসে হানা দিয়েছে ধরণীতে। তরী ধীর পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। পা থেকে জুতা খুলে জুতার স্ট্যানে গুছিয়ে রাখলো।
আয়েশা খাতুন বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। তরীকে দেখে বাঁকা চোখে তাকালেন।

—“তোমার ভার্সিটি ছুটি দিয়েছে কখন?” আয়েশা খাতুনে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। তরীর সামলে উঠতে সময় লাগলো। চোখ পিটপিট করে বললো,
—“সাড়ে চারটায় মামী।”
—“এখন কয়টা বাজে?”
তরী নজর ঝুঁকালো। মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো,
—“সাতটা।”
আয়েশা খাতুনের নজর টিভির পর্দায় স্থির। এতক্ষণ গম্ভীর গলায় কথা বললেও এবার খানিকটা ঝাঁঝালো শোনালো তার কণ্ঠ, “এটা তোমার নিজের বাসা না যে যখন ইচ্ছা তখন চলে আসবে। টাইম মেইনটেইন করা শিখো। পরেরবার এসব সহ্য করবো না আমি।”

জবাবে তরী ছিল নিরুত্তর। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে মৃদু মৃদু নিশ্বাস ফেলছিল। ওটা কি শুধু ভেতর থেকে আগত উষ্ণ নিশ্বাস ছিল? আটকে আসা দীর্ঘশ্বাস তো একেই বলে।
সালেহা আশেপাশে নেই। হয়তো রান্নাঘরে কাজ করছে। ঘরে শুয়ে বসে থাকতে তরীর ভালো লাগছে না। কোনোমতে চুল হাতখোপা করে নিচে নেমে এলো সে। ডাইনিং টেবিলে প্রণয় বসে আছে। পরনে ডাক্তাদদের এপ্রোন। ফ্রেশ হয়নি বোধহয়। ফোনে কার সাথে যেন খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে। তরী পাত্তা দিলো না অত। মাথা নুইয়ে ফেললো। প্রণয়ও তখন কথা বলা শেষে কান থেকে ফোন নামিয়েছে। শান্ত, স্থবির দৃষ্টি একটুর জন্য আটকে গেছে তরীর নমনীয় মুখপানে। আচমকা শুধালো, “আপনার কি ভীষণ মন খারাপ তরী?”

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

(প্রথমেই দুঃখীত। সারাদিনে এটুকুই লিখতে পেরেছি। বাসায় মেহমান ভর্তি। এসময় আসলে লিখাটা হয়ে উঠছে না। বানানও ভুল থাকতে পারে। হলে, কমেন্টে জাননোর অনুরোধ। কয়েকদিন একটু ছোট পর্বগুলো মানিয়ে নিন। ভালোবাসা❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here