সারা শরীরজুরে শিরশির অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো সাদিয়া। গলায়, পেটে, হাটুর কিছুটা উপরে কারোর শীতল হাতের ঠান্ডা স্পর্শে নড়ে উঠলো ও। চোখ দুটো যেন খুলতে নারাজ। সাদিয়ার হাত ক্রোমশ উচু হতে শুরু করে। সাদিয়া অনুভব করছে কারোর শীতল মুখশ্রী। হাতে খোচা খোচা দাড়ি ফুটছে।
– ” ঘুমানোর চেষ্টা করুন।”
কন্ঠটা শুনে সাদিয়ার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এমন শান্ত, স্থীর মিহিকন্ঠ আগে শোনেনি ও। সাদিয়া বারবার চেষ্টা করছে চোখ মেলে তাকানোর কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ সে।
– ” আহা। এমন অস্থির হচ্ছেন কেন? দয়া করে আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি আছি আপনার কাছে। ”
সাদিয়ার বলতে ইচ্ছে করলো ” কে আপনি? বিগত কয়েকদিন ধরে কেন আমাকে এভাবে শান্তি দিচ্ছেন? আপনি কি জানেন না আমার আপনাকে দেখতে ইচ্ছা করে। ” কিন্তু গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। মিহিকন্ঠে সে আবার বলে উঠলো।
– ” জানি তো। সময় আসুক ঠিক দেখতে পারবেন আমাকে। তবে আমার কথা না শুনলে আমি কিন্তু আপনার কাছে আসা বন্ধ করে দিবো। ”
সাদিয়া মনে মনে বললো ” আপনি না আসলে যে আমি মরে যাবো। আপনি যে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছেন। যখন চলেই যাবেন, তখন কেন এলেন আমার জীবনে? ”
– ” সব কেন’র উত্তর খুজতে এসে নিজেকে বিপদে ফেলা নিশ্চই বোকামির লক্ষন। কিছু উত্তর না হয় অজানাই থাক। আর মরে যাওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে? বড্ড সাহস বেড়েছে আপনার। ”
সাদিয়ার অভিমান হলো তার কথা শুনে। হবে নাই বা কেন? সে কে? তার পরিচয় কি? সে কেন আসে? সাদিয়ার এতো খেয়াল কেন রাখে কিছুই বলেনা। একদিন পরপর সাদিয়া অসুস্থ হয়ে যায়, সাদিয়ার শরীরে বিভিন্ন ক্ষত সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র তখন আসে সে। আর সাদিয়ার ক্ষতের মলম দিয়ে চলে যায়। সে কি বোঝে না সাদিয়া তাকে দেখতে চায়। তার সম্পর্কে জানতে চায়।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো নামায পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে দাদুর ঘরে যায় সাদিয়া। ঘরটি বিভিন্ন সূরার ফলক দিয়ে সাজানো। কম করে হলেও ৭টা কুরআন শরীফ আর দুই আলমারি ভর্তি হাদিস আছে। সাদিয়া লাইট জ্বালিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করে।
– ” দয়া করে আমি যতক্ষন না বলবো ততক্ষন কুরআন তিলাওয়াত করে যাবেন। আর কারোর কন্ঠ কানে আসলে সেটাকে গুরুত্ব দিবেন না। এটা আমার অনুরোধ। ”
তার কন্ঠ শুনে অবাক হয় সাদিয়া। ছাদের ওপর চিৎকার চেচামিচির আওয়াজ আসছে। হঠাৎ সাদিয়া শুনতে পেলো তার বাবা তাকে ডাকছে। বাবার গলা শুনে সাদিয়া কুরআন শরীফ সুন্দর করে গুছিয়ে তাকের ওপর রাখে। তারপর ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশে এক ধাপ এগিয়ে আসে। তখনই একটা দমকা বাতাস সাদিয়ার শরীর ছুঁয়ে বাইরের দিকে চলে যায়। সেই সাথে একটা বিকট কান্নার আওয়াজ। সাদিয়ার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। অজ্ঞান হয়ে যায় ও।
সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন নিজেকে বাবার ঘরে দেখতে পায় সাদিয়া। ওর পাশে ঘেরাও করে দাড়িয়ে আছে ওর মা বাবা, মামা, মামি আর ছোট মামাতো ভাই আপন। আপন হেসে ফোন নিয়ে সাদিয়ার কোল ঘেসে শুয়ে গেমস খেলতে শুরু করে। বাকিদের দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা যথেষ্ট চিন্তিত। সাদিয়ার আবছা আবছা সকালের ঘটনা মনে আছে। কিন্তু আপন থাকায় কিছু বললো না ও। কারন আপন এসব শুনলে ভয় পাবে।
রাতে নামায ও দোয়া পড়ে শুয়ে পড়ে সাদিয়া। মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওর। তখনই সেই মিহিকন্ঠ বলে ওঠে।
– ” আমার কথা কেন শুনলেন না আপনি? কেন কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করলেন? ”
– ” আব্বু ডেকেছিলো তাই তো আব্বুর কাছে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনি কে? আপনাকে কেন দেখতে পাইনা আমি? ”
— ” আমাকে অবশ্যই দেখতে পাবেন। আর কয়েকটা দিন যাক। আপনার ১৯বছর পূর্ণ হতে আর ৪দিন বাকি। তারপরই আমাকে দেখতে পাবেন। ”
– ” আবারও মিথ্যা বলছেন? ধ্যাত আপনার সাথে কথাই বলবো না ”
– ” জ্বীন কখনো মিথ্যা বলে না। আমি আসবো আপনার কাছে অপেক্ষা করুন একটু। কিন্তু চিনতে পারবেন তো? ”
– ” আগে আসুন তারপর দেখুন আমি চিনতে পারি কি না। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো আপনি কেন আসেন আমার কাছে? ”
– ” না আসলে খুশি হবেন? আমি কি খুব বিরক্ত করি আপনাকে? ”
– ” নাহ,নাহ। আমি কি এটা বলেছি? আপনি আসলে আমার ভালো লাগে। ”
– ” তাহলে ধরে নিন আপনাকে খুশি দেখার জন্য আসি। তবে প্রথম প্রথম আপনার ভয় দেখার জন্য আসতাম। যখন প্রথম আমার কন্ঠ শুনে কেঁদেছিলেন তখন থেকেই ”
– ” তখন থেকেই কি? ”
– ” সেটা নাহয় আপনার সামনে এসেই বলবো। নিন এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। ”
– ” আপনি কি চলে যাবেন? ”
– ” নাহ। আজ আমি আপনার সাথেই থাকবো। কেন? ”
– ” আমার সাথে থাকবেন মানে? ” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সাদিয়া।
– ” আপনি ঘুমের মধ্যে ভয় পান। আপনার হাত পা কাঁপে। তাই ভাবলাম আজ থেকেই যাই। অন্ততো আপনার ঘুমটা তো শান্তিতে হবে। ”
– ” আপনি থাকলে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো এটা কে বলেছে? ”
– ” ধরে নিন আমি বললাম। এবার ঘুমান। আমি কি আপনার মাথায় হাত রাখতে পারি? ”
– ” অনুমতি নিচ্ছেন হঠাৎ? মনে হচ্ছে আমি অনুমতি না দিলে আপনি আমাকে ছুঁতে পারবেন না। ”
সাদিয়ার কথা শুনে শব্দ করে হাসলো সে। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। ঝুনঝুনির মতো শব্দ, দেওয়ালের সাথে বারি খেয়ে সাদিয়ার কানে এসে বাজছে। সাদিয়া কৌতুক করে বললো।
– ” আমাকে তো অনেক ছুঁয়েছেন। আমি কি আপনাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি জ্বীনহুজুর। ”
সাদিয়া কথা শুনে সে গম্ভির গলায় বললো।
– ” আমার অধিকার আছে আপনাকে ছোঁয়ার। আর কারোর অধিকার নেই আপনার দিকে চোখ তুলে তাকাবার। ”
সাদিয়া নিজের হাতে তার হাতের স্পর্শ পেলো। ও শক্ত করে চেপে ধরলো তার হাত যেন সে চাইলেও ওর কাছ থেকে যেতে না পারে। সে হেসে বললো।
– ” ভয় নেই আপনাকে ছেড়ে যাবো না আমি। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন। ”
লজ্জায় চোখ বুজে নিলো সাদিয়া। চাঁদের আলোয় সাদিয়াকে দেখছে সে। সাদিয়া মিটিমিটি হাসছে আর হাত নাড়িয়ে চেক করছে সে আছে কিনা। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। নামায পড়ে একটা বই নিয়ে বসেছে সাদিয়া। এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে ও। কলেজে পড়ে কিন্তু পর্দাশীল মেয়ে হয়ে থাকার সব চেষ্টাই ওর মধ্যে পাওয়া যায়। কখনো অপরিচিত কারোর সামনে যায় না ও। কারোর সাথে কথাও বলেনা।
সকালে খেতে বসে মামা, আব্বুকে সাদিয়ার বিয়ের কথা বললেন।সাদিয়া একনজর সবার দিকে তাকালো। বিয়ে নিয়ে কোনো কালেই ওর মাথাব্যাথা ছিলো না। তবে আজ ওর বুকে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে।
অবশেষে সাদিয়ার বিয়ে ঠিক হলো। সাদিয়া কিছুই বলেনি। অপেক্ষা করেছে তার জন্য। কিন্তু সেই রাতেও সে আসেনি। পরদিন সকালে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আসে সাদিয়াদের বাড়িতে। সম্ভবত এটাই সেই ছেলে যার সাথে সাদিয়ার বিয়ে হবে। সম্পর্কে ছেলেটা সাদিয়ার মামির বড় ভাইয়ের বড় ছেলে। শেষে কিনা ভাইকে বিয়ে করতে হবে?
– ” আসসালামু আলাইকুম। আসবো আপু? ”
সাদিয়া আর আপন কাগজ দিয়ে গোলাপ ফুল বানাচ্ছিলো। এমন সময় সেই মেয়েটি এসে হাজির। মেয়েটির বয়স ১২-১৩ এর কাছাকাছি। আপনের ৪-৫ বছরের বড়। সাদিয়া সালামের উত্তর দিয়ে ওকে ভেতরে ডাকলো।
– ” তুমি নিশ্চই আমার ভাবি। খুব মিষ্টি তুমি। নাম কি তোমার? ”
– ” সাদিয়া। তোমার নাম? ”
– ” মাশাআল্লাহ আপু। তোমার নামের সাথে তোমার জীবনের মিল হোক এটাই দোয়া করবো। সৌভাগ্যবতী হও তুমি। আর আমি সেহের। সেহের নামের অর্থ জানো? সুন্দর সকাল। ”
সেহেরের কথা শুনে মুগ্ধ সাদিয়া। এইটুকু বয়সেই অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারে মেয়েটা। যেমন দুষ্টু তেমনই মিষ্টি। সারাদিন গল্প করে দুপুরে খেতে আসে সবাই। খাওয়ার মাঝে সাদিয়ার আব্বু বলে উঠলো
– ” আরে মুহিব তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না। ”
মুহিব হাতের ইশারায় ” হয়ে গেছে ” বলে উঠে চলে গেলো।সাদিয়ার রাগ হলো মুহিবের কাজে।এভাবে কেউ বড়দের প্রশ্নের উত্তর দেয়? আর এমন একটা মানুষকে কিনা ওর বিয়ে করতে হবে। খাওয়া শেষ করে সেহের আপন আর সাদিয়া নিজের রুমে গেলো। সেহের বিছানা ঠিক করতে করতে বললো।
-” ভাইয়া দু-তিন দিন কথা বলতে পারবে না। ইত্তকাবের জন্য তাই ইশারায় কথা বলেছে। তুমি কি ভাইয়ার নাম জানো? জানো না নিশ্চই। ভাইয়ার নাম ” ফারহান মুহিব ” যার অর্থ কি জানো? প্রফুল্ল প্রেমিক। ”
সেহের কথাটা বলেই ঠোট চেপে হাসলো। সাদিয়া অবাক হয়ে সেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটা যে প্রচন্ড দুষ্টু তা আগেই বুঝেছিলো ও। তবে এ যে এইটুকু বয়সেই এতো পাঁকা হবে জানা ছিলো না সাদিয়ার। সাদিয়া সবকিছুর মাঝেও তাকে মিস করছিলো। সে আসছে না দুদিন হলো। কাল বিয়ে পরশু সাদিয়ার জন্মদিন। সে কি আসবে না?
রাতে ঘুমের ঘোরে সাদিয়া অনুভব করলো কেউ ওকে জরিয়ে ধরে আছে। তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকালো ও। কোথাও কেউ নেই। তাহলে কি এটা ওর মনের ভুল? তখনই দরজায় খটখট আওয়াজ হলো।
– ” ভাবি আসবো? ”
সেহেরের কন্ঠ শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সাদিয়া। সেহের দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। দরজা লাগিয়ে সাদিয়াকে জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়ে ও।
– ” আসলে একা একা ভয় করছিলো তাই চলে আসলাম। দুজন থাকলে ভয় করবে না। তোমার কি সমস্যা হবে আমি থাকলে? ”
সাদিয়া সেহেরকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,
– ” উহু। ঘুমাও তুমি। কিছু লাগলে আমাকে ডেকো। ”
সেহের কিছু একটা পড়ে নিজের আর সাদিয়ার বুকে ফু দিলো। সাদিয়া চমকে তাকায়।
– ” নাও দোয়া পড়ে নিলাম।এবার শান্তিতে ঘুমাতে পারবো।”
পরদিন ঘরোয়াভাবে মুহিব আর সাদিয়ার বিয়ে হয়। এপর্যন্ত সাদিয়া মুহিবের চেহারা ঠিক করে দেখতে পারেনি। খুব শখ ছিলো ওর বিয়ের সময় পাঞ্জাবি পাগড়িতে নিজের স্বামীকে সবার আগে দেখবে। অথচ দেখতেই পেলো না। যদি ” সে ” হতো তাহলে নিশ্চই সাদিয়ার শখ পূরণ করতো। কিন্তু সেটা যে সম্ভব না। একজন জ্বীন কিভাবে সাদিয়াকে বিয়ে করবে? তাছাড়া সাদিয়া নিজের মা বাবা কে ছেড়ে জ্বীনদের সাথে যেতেও পারবে না। অন্যদের সুখের জন্য যদি নিজের ইচ্ছার বলিদান দিতে হয় তাহলে নাহয় ওইটুকুই দিবে সাদিয়া। তবে এটা না বললেও চলে না যে সাদিয়া প্রতিরাতে তাকে অনুভব করে। ও টের পায় সে ওর কাছেই আছে কিন্তু কোনো স্পর্শ বা অবয়ব দেখতে পায় না।
চলবে?
#মায়াপরি
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#সূচনা_পর্ব