সিন্ধু ইগল – (৯)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
জাদুর মনে আসলে চলছে কী? জীবনটাকে একদম হাতের তালুতে নিয়ে দিন পার করছে সে। তার জীবনের গ্যারান্টি বলা যায়, এই আছে তো এই নেই। এরপরও সে জায়িনকে নিয়ে কীভাবে ভাবতে পারে? আবার কিছুক্ষণ পূর্বে বলা কথার অর্থ কী? ও কি কোনো সিক্রেট প্ল্যান করছে? কিন্তু সিক্রেট প্ল্যান করার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে তো জাদু নয়! সে পুরোদমে মাধুর ওপর নির্ভরশীল। প্রচণ্ড ভয়ও পায় সে মাধুকে। সব কিছুতে সে দক্ষ হলেও বুদ্ধিমত্তাতে সে সব সময়ই মাধুর কাছে শিশু।
মাধুর কিছু একটা এলোমেলো লাগছে জাদুর ব্যাপারে। সাঁঝ নামার পূর্বেই সে বাংলোর দিকে রওনা দিলো আবার। জাদুর ভেতরে আদৌ কোনো পরিকল্পনা চলছে কিনা তা আজ সে যে-কোনোভাবে জেনেই ছাড়বে। প্রয়োজনে জাদুর সব থেকে দুর্বল বিন্দুতেই আঘাত করবে।
এসব ভেবেই বাংলোতে এসে পৌঁছল। তখনই ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল ওর। স্ক্রিনে ভেসে উঠল জাদুর নামটা। মেসেজ ছিল, ‘আমার ডক্টর জায়িন। হয়তো ও-ই পারবে আমার সমস্যার ট্রিটমেন্ট দিতে।’
দু’তিনবার পড়ল মাধু মেসেজটা৷ এবার তার মনের সন্দেহটা দূর হলো জাদুকে নিয়ে।
২২
অসুস্থ থাকাকালীন হঠাৎ-ই জায়িনের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর থেকে মেজাজ খিটখিটে ভাবটা তার যেন আরও বেড়ে গেছে। কাজে নেমে পড়েছে সে গত তিন দিন আগেই৷ টানা দশদিন সে বিছানাতে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছিল। তাই পুরোপুরি সুস্থ হবার পূর্বেই সে চলে আসে ঢাকা। প্রেমিকাদের সঙ্গেও দিনগুলো তার ভালো চলছে না৷ শরীরের চাহিদা পূরণের সময় যেন প্রচণ্ড রাগ আর আক্রোশ নিয়ে ওদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। যার ফলে একটু আধটু আহতও হয়ে পড়ে ওরা। বিষয়টা এমন, অন্য কারও প্রতির রাগ ওদের ওপর প্রয়োগ করে সে।
কেবিনে বসে হাতের ফাইলপত্র ঘাটাঘাটির মাঝেই লন্ডন থেকে রেজার কল আসে। প্রায় পনেরদিনের বেশি হলো রেজা সেখানেই অবস্থান করছে এখনো। এই পনেরদিনের মাঝে তেমন কোনো খবরই দেয়নি সে জায়িনকে। তাই হঠাৎ রেজার কল আসাতে জায়িন হাতের সমস্ত ফাইল ফেলে অতি দ্রুত রিসিভ করল। রেজা কথা বলার পূর্বেই জায়িন ব্যতিব্যস্ত সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘গত চারদিন ধরে তুমি আমাকে কল করোনি কেন রেজা? তুমি জানো কী পরিমাণ টেনশন হচ্ছিল আমার তোমাকে নিয়ে?’
রেজা একটু হাসল, বলল, ‘টেনশন তো আপনাকে নিয়ে আমার করার কথা স্যার। আজকে আমি আপনার পাশে থাকলে কোনোভাবেই এমন একটা ক্ষতি হতে দিতাম না আপনার। আমি একদম ঠিক আছি। আপনার লোকেরা আমাকে দারুণ ট্রিট করছে। সত্যিই প্রশংসনীয়।’
কিছুটা আশ্বস্ত হলো জায়িন। বলল, ‘কতদূর এগোলো কাজ? না কি আরও সময় লাগবে?’
-‘আমি চাইছি পুরোপুরি তত্ত্বানুসন্ধান করে তারপর আপনাকে ডিটেইলস জানাব।’
-‘আমার ধৈর্য হারাচ্ছে রেজা।’
-‘আমি আপনাকে অস্থির হবার সুযোগ দেবো না স্যার। যতটুকু এই মুহূর্তে আপনার জানা জরুরি, ঠিক ততটুকুই জানাব। পুরোটা জানার জন্য সত্যিই আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আমি এমন কিছু জানাতে চলেছি এখন, যা আপনি কল্পনাও করেননি। ধাক্কাটা সামলানোর জন্য শক্ত হতে হবে আপনাকে।’
এক গ্লাস পানি এক নিমিষে শেষ করে জায়িন আদেশ করল, ‘শুরু করো। আমি রেডি।’
-‘প্রথম কথা, আপনার ধারণাই সঠিক। সিলেট ওদের জন্মস্থান, বাসস্থান, কিছুই নয়। ঢাকার উত্তরাতে জন্ম ওদের৷ এক্সাক্ট লোকেশন আমি আপনাকে মেসেজ করে জানাব। এরপর বাকিটা আপনাকেই খোঁজ নিতে হবে ওখানে গিয়ে।’
-‘এটা আমার জন্য ধাক্কা নয় রেজা।’
রেজা এ কথায় হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার স্যারকে মেয়েটা একদম খেয়ে নিয়েছে।’ তারপর শান্ত গলায় জানাল, ‘আপনি পাশের বাড়িতে মৃত্যু নিয়ে বসবাস করছেন। আফসোস, আপনার বোকারানিই আপনার মৃত্যুর কারণ। আমার এখন একটাই চাওয়া, ওদের খতম করা ছাড়া আর কিছু ভেবেন না ওদের মাঝের কাউকে নিয়ে।’
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখজোড়া বুঁজে নিলো জায়িন, বলল, ‘সম্পূর্ণ শেষ করো কথা।’
-‘জাদু, মাধু, এগুলো ওদের ফেক নেম। ওদের সম্পূর্ণ বায়োডাটাই ফেক আবার বলা চলে রিয়্যালও। মানে দেশে থাকতে আমরা যে বায়োডাটা দেখেছি ওদের, সেটা আপনার বোকারানির ক্ষেত্রে রিয়্যাল। শুধু নাম ছাড়া। সুয়োরানি-দুয়োরানির গল্প শুনেছেন স্যার? এদের সাথে এই গল্পটা আংশিক যায়। এখানে একজন দুয়োরানি। কিংবা হতে পারে দু’জনই দুয়োরানি। ওরা দু’জন লন্ডন থেকেও কেউ কারও সাথে ছিল না। আমি যাকে বোকারানি ভাবছি তার গল্পটাই আগে বলি।’
-‘কিন্তু তার আগে ওকে ভাবিজান বলে ডাকো।’
-‘এরপরও স্যার?’
-‘হুঁ।’
-‘ভাবিজানের লন্ডনে আসার পর থেকে পড়াশোনার সময়টা অনেক স্ট্রাগলের মধ্যে শেষ হয়েছে। একই দেশে থেকেও দু’বোন দু’প্রান্তে থেকেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক ছোটোখাটো, বহু কষ্টের কাজ করে নিজেকে চালিয়েছে ভাবিজান। আপনার শালীসাহেবা থাকত ওদেরই আপন চাচার কাছে। সেক্ষেত্রে ওর সব কিছুর দায়িত্ব ওই চাচা নিলেও ভাবিজানের দায়িত্ব পুরোপুরি তিনি নেননি। ভাবিজানকে পছন্দ করতেন না বলে। কারণ, ওনার গায়ে ক্রিমিনালের তকমাটা লেগে যাওয়ার জন্য। আঠারো বছর বয়সে লন্ডনে আসেন ভাবিজান। তবে দুঃখের বিষয় আসার দিন এয়ারপোর্টেই পুলিশ এসে ভাবিজানকে অ্যারেস্ট করে। টানা ন’মাস জেলে ছিলেন। ওনার আপনজনদের বিশ্বাস ভাবিজান সত্যিই সন্ত্রাসবাদী। কিংবা ওদের গুপ্ত সহচর। ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল তা সত্য নাকি মিথ্যা এ বিষয়ে সঠিক তথ্য স্বয়ং ভাবিজান ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। আর এই অভিযোগ ওনার বিরুদ্ধে কেন ছিল তার বিস্তারিত আমি আপনাকে জানাব আরও কিছুদিন পরে। তবে এখনকার ইনফরমেশন অনুযায়ী উনি সিরিয়াসলিই ভয়ঙ্কর মাপের একজন টেরোরিস্ট। আর ওনার বোনও। উনি যাদের সঙ্গে হোস্টেলে থাকতেন, ওরা প্রত্যেকেই ছিল অ্যাডিক্টেড। ভাবিজানকেও এক সময় ড্রাগস নিতে ওরাই জোর করে। আর তারপর উনি এমন পর্যায়ের অ্যাডিক্টেড হন, যে নেশাদ্রব্য পাবার জন্য মানুষও মার্ডার করেছেন। খুনী হিসাবে আপনার থেকেও ভয়ঙ্কর উনি। আর খুনগুলোও উনি আপনার থেকেও নিঁখুতভাবে করে ডেডবডি ভ্যানিশ করে দেন। দু’বোনের মধ্যে বুদ্ধির তারিফ পাবার যোগ্য উনি। তবে শুধু নেশার জন্যই খুন করেননি ভাবিজান। যে-কোনো প্রয়োজনেই এখন অবধি বহু মার্ডার করেছেন। যা হিসাব করে বলা মুশকিল৷ ওনাকে যারা চিনে, তারা কেউ কেউ ওনাকে সাইকো গার্ল বলছিল। আপাতত ভাবিজানের গল্পটা এখানেই শেষ করলাম। এখন মজার বিষয় বলি। জাদু, মাধুর যে চাচা লন্ডনে থাকতেন, তিনি মার্ডার হয়েছে ছ’মাস আগে। আমার ইনভেস্টিগেশন মতে খুনটা মাধু করেছে। কিন্তু বাকি সবার জানামতে খুনী জাদু। এসবের মাঝে সব থেকে মজার বিষয়টা কি জানেন স্যার? পুলিশ জাদু আর মাধুর বিরুদ্ধে খুনের দায়ে কোনো প্রমাণই যোগাড় করতে পারেনি। কারণ, জাদু, মাধু, দু’জনেই সাংঘাতিক কিলার। যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দু’জনকে চিহ্নিত করাও মুশকিল। যেমন, দুজনেই অ্যাডিক্টেড। দুজনেই সেম বিষয়ে পড়াশোনা করেছে। দুজন আলাদা জায়গায় থাকলেও কখনো কখনো ওরা নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করত। তা কেউ ধরতেও পারত না। ওদের স্বভাব, রুচি, অভ্যাস, প্রায় সবই এক। মূলতঃ ওরা এক রাখে। শুধু একটা ক্ষেত্রেই মিল নেই। সেই অমিলটা আমি বলতে চাই না স্যার। আমি চাই সেটা আপনি খুঁজে বের করেন। যেহেতু আপনি একজনকে আমার ভাবিজান করবেন বলে ভেবেই নিয়েছেন। সবশেষে লাস্ট একটা কনফিউশন ক্লিয়ার হয়নি আমার। আপনাকেও কনফিউজড করে দিই একটু৷ ভাবিজানের পরিবর্তে মাঝে মাঝে আপনার শালী এসে থাকত ওনার হোস্টেলে। আর ভাবিজান তখন লাপাত্তা। তো সেইক্ষেত্রে ফাইটিং লাইফ লিড হয়তোবা দুজনেই সমান সমান কাটিয়েছে।’
-‘তাহলে শেষমেশ কী দাঁড়াল? দু’জনেই তো দুয়োরানি হয়ে গেল। কিন্তু আমার বোকারানি তো দুয়োরানি ছিল না। আমার জানামতে সে সব সময়ই ভীষণ আদরের ছিল।’
-‘এটাই তো আপনার জন্য কনফিউশন স্যার। এদের দু’জনের মাঝে আপনি যাকে আপনার বোকারানি ভাবছেন, সে কি সত্যিই আপনার বোকারানি?’
জায়িনের থমথমে চেহারাটা একটু মলিন হয়ে উঠল৷ তবে রেজাকে বলল সে, ‘আমার এই চোখ ভুল চেনে না রেজা। তারপরও আমি তো মানুষ। ভুল আমার হতেও পারে। কিন্তু ওদের সঙ্গে তাহলে আমার এবার গেম খেলতে হবে?’
-‘সেটা তো হবেই। স্যার? যাকে ভালোবেসেছেন, তাকে জেলে দিতে কষ্ট হবে না?’
জায়িন একটু হেসে বলল, ‘তোমার দেশে ফেরার তীব্র অপেক্ষায় আছি রেজা। জলদি কাজ শেষ করে ফিরে এসো।’
বলেই কলটা কেটে দিলো। এই মুহূর্তে ভীষণ অস্থির লাগছে ওর। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গায়ের কোর্টটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। অনেকগুলো দিন হলো তার সব থেকে প্রিয় মানুষটিকে দেখে না সে। মানুষটির প্রতি আর রাগ পুষে রাখবে না আজ। সে অসুস্থ হবার পর সেই মানুষটি মাত্র একবারই তাকে দেখতে এসেছিল। এরপর একটু ফোন করেও তার খোঁজ নেয়নি। এই একটা কারণেই জায়িনের মন, মেজাজ খারাপ হয়েছিল এ ক’দিন। কিন্তু আজ রেজা যা বলল, এরপর আর থাকা সম্ভব নয় ওই প্রিয় মানুষটিকে না দেখে। হোক তার জন্য সেই মানুষটি বিপজ্জনক। নিজেকে আত্মরক্ষা করার মতো ক্ষমতা তারও আছে। তবু আর দূরে থাকা সম্ভব নয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়ারও বাকি আছে যে তার।
২৩
রাত বাজতে চলল দশটা। রাতের খাবার তৈরি করতে মাধু মাত্র রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল। আর জানালা দিয়ে দেখতে পেল তার বোনের ভয়ঙ্কর চেহারাটা। কুড়াল হাতে নিয়ে বিরতিহীন গাছের মোটা গুড়িতে কোপ দিয়ে চলেছে। হয়তো প্রতিজ্ঞা করেছে, আজ রাতেই গুড়িটা কেটে কেটে কাঠের টুকরো করে ফেলবে। সারা শরীরে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে জাদুর। এত বেশি কায়িক শ্রম করতে পারে জাদু! যা দেখেই মাধু হাঁপিয়ে ওঠে।
গ্যাসে মাত্রই কড়াইটা রাখল মাধু। আর অমনি কলিংবেল বেজে উঠল। ব্যাপারটা ভীষণ আতঙ্কজনক। কারণ, জাদুর সঙ্গে যারা মিটিং করতে আসে বা তার সাথেও তার কোনো কলিগ দেখা করতে আসার আগে অবশ্যই আগাম জানান দিয়ে আসে। রান্নাঘরের সর্বশেষ ক্যাবিনেট থেকে পয়েন্ট ৩২ ক্যালিবারের রিভালবারটি বের করে নিয়ে মাধু একবার জানালা দিয়ে বোনের দিকে তাকায়। আপাতত জাদু নিরাপদ স্থানেই আছে। বাংলোর পেছনটাতে তাকে সহজে চোখে পড়বে না। তারপর এগিয়ে যায় সে সদর দরজার সামনে। ডোর-হোলে জায়িনকে দেখে সে অবাক ছাড়া কিছু হতে পারল না এই মুহূর্তে। ৫০০ গ্রাম ওজনের ওই আগ্নেয়াস্ত্রটি দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে দরজা খুলে দিলো। মুখে টানটান একটি হাসি ধরে বিস্মিত সুরে জায়িনকে বলে উঠল, ‘জায়িন মাহতাব! আপনি কি সত্যিই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?’
জায়িন মৃদু হাসল। ক্লান্ত চেহারা তার। পরিপাটি চুলোগুলো কেমন এলোমেলো যেন। মাধু তাকে ভেতরে আসতে বলে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এল।
-‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আপনি এসেছেন!’
জায়িন সোফাতে বসতে বসতে বলল, ‘আসা কি বারণ?’
-‘একদমই তা নয়। যেখানে আমরা আপনাদেরকে বারবার নিমন্ত্রণ করেও আনতে পারি না, সেখানে না বলেই এমন সারপ্রাইজ দিলেন। তাই বিষয়টা খুব চমকে দেওয়ার মতোই।’
জায়িন তার মৃদু হাসি বজায় রেখে মাধুর দিকে শান্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল, ‘খুশি হননি?’
-‘কী যে বলেন না! খুশি হবো না কেন? এখানে আমাদের দু’বোনের চেনাজানা আর আপন বলতে তো আপনারাই। আপনার শরীরের অবস্থা কেমন এখন? জাদুর কাছে গত দু’দিন আগে জেনেছিলাম আপনি কাজে যোগ দিয়েছেন ইতোমধ্যেই।’
জাদুর নামটা শোনা মাত্রই জায়িনের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি এখন। তো শুধু আপনাকে দেখছি যে? ও কই?’
মাধু হাসতে হাসতে বলল, ‘ওকে দেখতে হলে আপাতত আপনাকে উঠতে হবে। দেখার পর ওকে নাও চিনতে পারেন। বিধ্বস্ত অবস্থা এখন তার।’
-‘কেন? চেহারা বদলে ফেলেছে না কি? আমি বারবার কনফিউজড হয়ে যাই বলে?’
মাধু হাসতে হাসতেই জবাব দিলো, ‘সেটা সম্ভব হলে আমিই পরিবর্তন করতাম আমার চেহারা। আপনাকে তো ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কোল্ড ড্রিংকস দিই? তারপর আড্ডা হবে। রাতের খাবারটাও কিন্তু আজ খেয়ে যেতে হবে।’
জায়িন হেসে বলল, ‘এত রাতে এসেছি যখন না খেয়ে যাব না।’
-‘আমার রান্নার হাত কিন্তু ভালো নয়। আগেই বলে রাখছি। পাছে বাড়িতে গিয়ে দুর্নাম করবেন না যেন।’
জায়িন ফিচেল হেসে বলল ওকে, ‘দুর্নাম করে নিজের ক্ষতি নিজেই কেমন করে করি?’
-‘নিজের ক্ষতি হবে কেন?’
জায়িন এবার মিটিমিটি হেসে বলল, ‘শেষমেশ আম্মা যদি এক রান্না খারাপের বাহানায় বউ করতে না চায়? তাহলে কি ক্ষতি হবে না আমার?’
জায়িনের থেকে এমন একটা কথা শোনার জন্য মাধু মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল সে। আর তার চেহারাটা দেখে জায়িন তখন হো হো করে হেসে উঠল। তারপর সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে মাধুর দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন, আপনার বিধ্বস্ত চেহারার বোনের কাছে যাই৷ তার কাছে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। যতগুলো দিন অসুস্থ ছিলাম, প্রতিটা দিনই আমাকে দেখতে এসে আমার একঘেয়েমি সময়টাকে আনন্দপূর্ণ করে রেখেছিলেন তিনি। আবার বাসায় ফিরে কলেও কথা বলেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।’
মাধুর মুখটা হঠাৎ কেন যেন ভার হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। মেকি হেসে জায়িনকে বাংলোর পেছনটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনারা কথা বলুন। আমি কোল্ড কফি নিয়ে আসছি। সঙ্গে আর কী খেতে চান বলুন তো। মানে ডিনার রেডি হতে একটু দেরি হবে।’
-‘যেটা আপনি খুব ভালো বানাতে পারেন।’
বলেই চলে গেল। মাধু ওর যাবার দিকে কয়েক সেকেণ্ড নীরবে চেয়ে থাকল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ানোর পূর্বেই ওকে চমকে দিয়ে জায়িন হঠাৎ ঝড়ের গতিতে ওর খু্ব কাছে এসে দাঁড়াল। ভয় পেয়ে মাধু দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতেই জায়িন তার দু’হাতের বন্ধনীর মাঝে ওকে আটকে রেখে হুমকির সুরে বলল, ‘খাবারের স্বাদ যেন আমার মুখে লেগে থাকে এমনভাবে বানাবেন, ওকে?’
মাধু বোকা বনে নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইল জায়িনের দিকে। আর জায়িন কতক্ষণ অমন গম্ভীর অভিব্যক্তিতে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠে দূরে সরে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘রিল্যাক্স, আপনার চমকে যাওয়া চেহারাটা দেখার লোভ হলো আবারও। আর তা দেখাও হয়ে গেছে। বেশ লাগে কিন্তু আপনাকে এমন চেহারায় দেখতে। বাই দ্য ওয়ে, আমরা তো এখন পরিচিত। আপনি আপনি থেকে তুমি তুমিতে কি আসতে পারি?’
মাধু নিজেকে সামলে উঠে বলল, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে কেন নয়?’
উত্তরে জায়িন তার আকর্ষিত হাসিটা দিয়ে এবার সত্যিই চলে গেল জাদুর কাছে। এই বাড়ির পেছনটাতে আগে লাইট ছিল না। তাই জায়গাটা তেমন দেখা হয়নি জায়িনের। বেশ কিছু বড়ো বড়ো মেহগনি গাছ লাগানো আছে এদিকটাতে। ধীর পায়ে জায়িন হেঁটে এসে দাঁড়াল জাদুর পেছনে। দূরত্ব খু্ব বেশি নয় ওদের মাঝে। কোনোদিনে হুঁশ নেই জাদুর। গুড়িটাতে একের পর এক কুড়াল বসিয়ে যাচ্ছে সে। পরনে তার স্লিভলেস কালো একটি টপস আর লেগিংস প্যান্ট। টপসের গলাটা বেশ বড়ো বলে পিঠের অনেকখানি বেরিয়ে আছে। ঘামে মাখা ফর্সা পিঠটার মাঝে লম্বা দু’টো আঘাতের কালচে দাগ চোখে পড়ছে স্পষ্ট। দাগদু’টো দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি পুরোনো নয় এই আঘাত। এই দাগ দেখে জাদুকে ডাকার কথা ভুলেই গেল জায়িন। গভীর দৃষ্টিতে দাগদু’টো দেখতে দেখতে হঠাৎ সেখানে ছুঁতে ইচ্ছা করল ওর। ইচ্ছাটা দমিয়েও রাখল না। খুব আলতোভাবে দাগ দু’টোর ওপর আঙুল ছুঁইয়ে বলে উঠল, ‘মারাত্মক আঘাত এটা।’
কুড়ালটা গুড়িতে আটকে রেখে চমকে ফিরল জাদু। আর তখন জায়িন আরও একবার আঁতকে উঠল জাদুর বুকের বিভাজনের বেশখানিক ওপরে আরও একটা দাগ দেখে। সারা শরীরে যেন তখন বিদ্যুতের শক খেলে গেছে জায়িনের। জাদুর পরিবর্তে অন্য কোনো নারী হলে আজ ওই দাগের পরিবর্তে নিশ্চিত ওর চোখ আটকাত বুকের বিভাজনে। কিন্তু জাদুর ক্ষেত্রে তা হলো না। আহত চোখে চেয়ে রইল সে, ওর দাগটার দিকে।
জায়িনের অমন স্থির চাউনি দেখে জাদু কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়ল। ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ঘাসের ওপর থেকে শার্টটা কুড়িয়ে নিয়ে গায়ে ঢুকিয়ে নিলো দ্রুত। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বাচ্চাদের মতো হাতটা প্যান্টে মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে দাঁড়াল জায়িনের সামনে। জায়িন স্তম্ভিত হয়ে দেখতে থাকল তখন জাদুর সরল হাসিটা আর তার হাত মোছার কাণ্ড। ওর দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার আগমন আনএক্সপেক্টেড ছিল।’
জায়িন বিনা সঙ্কোচে হাতটা ধরে কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘কিন্তু তুমি খুশি হওনি।’
-‘তুমি নিজেও জানো না আমি কতটা খুশি হয়েছি।’
কথাটা শুনে জায়িন ধীরে ধীরে জাদুর খুব কাছে এসে দাঁড়াল।
এভাবে হঠাৎ করে জায়িনের কাছে আসাতে মাধুর মতো জাদু একটুও অপ্রস্তুত হলো না। বরং হাসিটা আরও প্রশস্ত হলো ওর। যেন খুশি উপচে পড়ছে ওর চেহারায়। কিন্তু সমস্যা একটাই। জায়িনের ধারাল দৃষ্টিজোড়াতে চোখ মেলে রাখতে পারল না সে। দৃষ্টি ঝুঁকিয়েই লাজুক লাজুক হাসতে থাকল। মৃদুস্বরে জায়িন প্রশ্ন করল, ‘ক্যান আই টাচ ইয়্যু?’ তখনো জাদুর হাতটা জায়িনের হাতের মুঠোয়। তাই জাদু এবার শব্দ করে হেসে বলল, ‘ঘরে ঢুকে পড়ে ঘরে ঢোকার পারমিশন চাওয়া?’
জাদুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে জায়িন একটুও হাসতে পারল না। বরং তার ভেতরে ভেতরে কীসের জন্য যেন রাগের জন্ম নিচ্ছে। চোখদু’টো বুঁজে ফেলে সেই রাগকে বুকের মধ্যেই আপাতত চেপে রেখে এবার শান্ত দৃষ্টি মেলল। তবে সেই দৃষ্টি জাদুর চেহারায় নয়। ওর গলার বেশ খানিকটা নিচের সেই দাগটিতে। সেদিকে চেয়ে থেকে আচমকা ঝুঁকে পড়ে সেখানে গভীরভাবে চুমু খেয়ে বসল জায়িন। অত্যাধিক বিস্ময় এবার জেঁকে ধরল জাদুকে। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জায়িন ততক্ষণে জাদুকে দু’হাতের মাঝে জড়িয়ে ধরে আরও কতগুলো চুমু খেল ঘনঘন। জড়িয়ে রাখা অবস্থাতেই জাদুর কাঁধের ওপর মাথাটা ফেলে বলল, ‘স্যরি, এই স্পর্শের জন্যই অনুমতি চাওয়া।’
রান্নাঘর থেকে মাধু সবটাই দেখতে দেখতে হঠাৎ থমকে গেছে সে। এই মুহূর্তটুকু দেখার পর এখন আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। ট্রেতে করে কফি আর পাস্তা নিয়ে লনে চলে গেল। তারপর ঘরে এসে কণ্ঠ একটু উঁচু করে জাদুকে ডেকে বলল জায়িনকে নিয়ে লনে চলে আসতে।
_________