হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
০৫.
একছুটে হিমির জন্য বরাদ্যকৃত ঘরে এসে ঢোকে অথৈ। হিমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অথৈয়ের এমন হঠাৎ আগমনে চমকে উঠলো সে। অথৈ হাঁপাচ্ছে। চোখে মুখে ক্লান্তি, অসহায়ত্ব। বেনি করা চুলের অনেকাংশ খোলে গেছে। হাত গালে গলায় লেগে থাকা চুল সরালো সে। নীল রঙা আয়রণ করা জামার ভাজ ভেঙে কুঁচকে গেছে। হিমি কিছু বললো না। খুব ভালোভাবে নিরক্ষন করলো অথৈকে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে খাটের কোনায় এসে বসলো অথৈ। হিমি তাকে অনুসরন করে কাছে এসে দাঁড়ালো।
“আমি বিয়ে করবো না হিমি আপু।”
হিমি গোল গোল চোখে তাকালো। অথৈ তাড়াহুড়া করে বললো,
“কাউকে বলো না প্লীজ। আমি শুধু তোমাকেই বলছি।”
হিমির চটজলদি প্রশ্ন,
“আমায় কেনো বলছিস?”
“তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো? এ বাড়িতে একমাত্র তুমিই যে আমাকে বুঝো। প্লীজ।”
হিমি হাই তুলে হাত টানটান করে বসে বললো,
“পাম দেয়া বন্ধ কর। বিয়েতে আপত্তি কি সেটা বল!”
অথৈ জবাব দেয় না। মাথা নুইয়ে হিমির প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। হিমি বিরক্তি নিয়ে আবারও প্রশ্ন করে। অথৈ উত্তর না দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলতে থাকে,
“প্লীজ বাঁচিয়ে দাও আমায়। আমি এই বিয়ে করবো না।”
হিমি কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে। বলে,
“বাঁচিয়ে দাও মানে? বিয়েটা কি কোনো মৃত্যু খাদ না কি? যে তুই মরে যাবি!”
“তুমি বুঝছো না আপু। আমি এই বিয়ে করবো না।”
“এই বিয়ে?” (এক ভ্রু উচিয়ে)
অথৈ ঢোক গিলে। হিমি রাগি গলায় বলে,
“এই বিয়েতে কি সমস্যা তোর? বার বার এই বিয়ে এই বিয়ে করছিস কেনো?”
অথৈ আমতা আমতা করে বললো,
“আমি ওতসত জানি না। তুমি হয় বিয়েটা আটকাও নয় ভেঙে দাও।”
হিমি সন্দিহান গলায় বললো,
“তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস? না কি ছেলে পছন্দ হয় নি?”
অথৈ ঝট করে বলে দিলো,
“আরে ধুর! ছেলেটাকেই তো দেখি নি। বিয়ে কি করে করি? তোমাকে যা বলছি করো না! ভেস্তে দাও বিয়েটা। আর কাউকে বলো না যেনো আমি এসব করতে বলেছি!”
হিমি ব্যাপারটা বুঝে যায় এবার। ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
“বিয়ে ভাঙতে হলে মামানিকে বল। আমি এসবে নেই। পরে দেখা গেলো এ বাড়ি থেকে লাত্থি মেরে বের করে দেয়া হলো আমায়। একটা বাড়ি তো কমে যাবে বল!”
অথৈ জানে হিমির কথায় দম আছে। কিন্তু সে কি করবে? এই লোকটাকে বিয়ে করে যদি জীবনটা তছনছ হয়ে যায় তার! তখন? হিমি একমনে বললো,
“পাত্র কলেজের টিচার। মানুষ হিসেবে ভালো। নম্র, ভদ্র, বড়দের সম্মান করে। আগে কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো না। স্কুল থেকে ভার্সিটি লাইফ অব্দি কোনো খারাপ রেকর্ডও নেই। টিচার হিসেবেও ভালো তবে স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে স্ট্রীক্ট! তাও খুব বেশি না কিছুটা। পারিবারিক ছেলে। সবদিক দিয়ে ভালো বুঝলি!”
অথৈয়ের দিকে ঝুঁকে বললো,
“দেখতেও ভালো একদম তোর ওই বরুণ ধাওয়ানের মতো!”
অথৈ চোখ তুলে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তুমি এতোকিছু কি করে জানলে?”
হিমি সটান খাটে শুয়ে পরে। মাথার নিচে দু হাত রেখে জোড়ালো গলায় বলে,
“বোনের বিয়ে আর আমি ছেলের ঠিকুজি গোষ্ঠী জানবো না? তা হয় না কি? সব খবর আছে আমার কাছে।”
অথৈ মনে মনে হিমির কথাগুলো থেকে চিত্র বানাতে থাকে। হবু বরের চিত্র। যাকে সে দেখে নি। একুশ শতকের মেয়ে হয়েও মাকে বলতে পারছে না, ‘মা! আমি ওনাকে দেখবো। ছবি আছে? ওনার সাথে ব্যক্তিগত কথা বলতে চাই। বিয়ের আগেই’। তবুও আক্ষেপ নেই তার। হিমি যখন বলেছে ছেলে দেখতে শুনতে ভালো তবে ভালো। খারাপ হওয়ার চান্সই নেই। অথৈকে অন্যমনস্ক দেখে হিমি প্রশ্ন করে,
“বিয়ে করবি না তো?”
অথৈ চমকে উঠে। কি বলবে ভেবে পায় না সে। একটু আগেই তো বিয়ে করতে চাইছিলো না এখন কি করে বলে সে বিয়ে করবে? কি করে বলবে, সে ছেলেটাকে রাগি, কর্কশ কন্ঠের ব্যক্তি মনে করে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলো? অথৈর চেহারা দেখে হিমি দুষ্টু হাসলো। কন্ঠ যথাসম্ভব রাগি করার চেষ্টা করে বললো,
“যা গিয়ে ঘুমা। কাল মামানির সাথে কথা বলবো আমি।”
অথৈ কেঁপে উঠে। প্রত্যুত্তর না করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। হিমি বড় গলায় বলে,
“লাইট অফ করে যা।”
অথৈ ফিরে আসে। লাইট বন্ধ করে চলে যেতে নিয়ে হুট করেই বলে উঠে,
“আমি বিয়ে করবো।”
হিমি হাসলো। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো খাটে শোয়া হিমির চোখে মুখে পরে। হিমি উঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করে দোহার নাম্বারে। দু বারের মাথায় ফোন রিসিভ করে দোহা। হিমি জানতে চায় সোহিনী কেমন আছে। দোহা জানায় ভালো আছে। এখনো দূর্বল তবে অনেকটাই ভালো। কিছুটা নয় বরং অনেকটাই শান্ত হয়েছে সে। হিমি ফোন কেটে বালিশে মাথা রাখে। গতকাল দুপুরেই সোহিনীকে বাসায় ফিরিয়ে এনেছে হিমিরা। দেখভালের জন্য দোহা থাকছে তার সাথে। হিমি চোখ বোজে। সবাইই সুখী। হিমিও সুখী। তবে বাইরে থেকে। ভেতরটা তো খালি। সুখের অস্তিত্ব নেই সেথায়। সেই ছোট্টবেলা থেকে এবাড়ি ওবাড়ি করছে সে। নিজের বলতে কিচ্ছু নেই, কেউ নেই। বাবাও না।
________________
চোখে আলো লাগতেই ঘুম ছুটে যায় হিমির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। হাই তুলে ঘড়ির কাটায় চোখ বুলায়। দরজার বাইরে থেকে কেউ ডাকছে তাকে। হিমি ধীর গলায় বলে,
“ভেতরে আয় মিশু!”
মিশ্মি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। হিমি উঠে দাঁড়ায়। মিশ্মি তাড়া দিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।”
“খাবো না আমি।”
মিশ্মি শান্ত গলায় কারন জিজ্ঞাসা করলে হিমি বলে,
“ওবাড়িতে যেতে হবে। তাড়া আছে।”
“খেয়ে যাও। টেবিলে সব রাখা।”
মিশ্মির কথার জবাবে কিছু বলে না হিমি। আলমারি খোলে জিন্স আর শার্ট হাতে তুলে। ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,
“আমাকে এই ভোর বেলা দেখলে কারো দিনটাই মাটি হয়ে যেতে পারে। বেরুতে হবে আমায়। তুই যা।”
মিশ্মি দাঁড়িয়ে রয়। হিমির কথায় একটুকুও অবাক হয় না সে। এসব তো নিত্যদিনের রুটিন। হিমি যখন তখন যাওয়া আসা করে, কখনো এখানে কখনো ওখানে। কখনো বন্ধুদের সাথে বাইরেই খাওয়া দাওয়া করে সে। কোনোদিনও পানি না খেয়েও দিন কাটায়। হিমির চাল চলন ছেলেদের মতো। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে যেমন রোজ ছুটতে থাকে টিউশন, ভার্সিটি, বন্ধুমহলে ঠিক তেমনি হিমিও ছুটে। শুধু পড়াশোনা করে না সে। দুবছর আগেই স্বইচ্ছায় পড়াশোনা থামিয়ে দিয়েছে। মিশ্মি লম্বা শ্বাস টেনে কাথা বালিশ গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে যেতে নিলে ঘরে ঢোকে অথৈ। চোখে মুখে উপচে পরা খুশি তার। মিশ্মি ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এতো সকাল উঠে পরলি?”
“হিমি আপু কই?”
মিশ্মি ওড়না ডান কাধে তুলে নিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হতে গেছে। ওবাড়িতে যেতে হবে না কি। এখন খাবে না বলছে।”
অথৈর মুখটা ছোট হয়ে যায়। মিশ্মি আদুরে গলায় বলে,
“কি হয়েছে?”
“আমার কিছু জানার ছিলো তো। এখন চলে গেলে জানবো কখন?”
“কি জানার ছিলো?”
মিশ্মি অবাক হয়া গলায় বলে। অথৈ লাজুক হেসে বলে,
“তুই বুঝবি না। আসি আমি।”
মিশ্মি ভ্রু কুঁচকে অথৈয়ের যাওয়ার দিকে তাকালো। গর থেকে বেরুতে নিলে রিংটোনের আওয়াজ পেয়ে পেছন ঘুরে সে। বেড সাইড টেবিলে রাখা হিমির মুঠোফোন তুমুল ধ্বনি তুলে বাজছে। মিশ্মি ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিলে ভেতর থেকে হিমি বলে উঠে,
“ফোনটা তোলে বলে দে আমি একটু পরই আসছি। বড়মা হবে হয়তো!”
হিমির কথা মতো ফোন ওঠায় মিশ্মি। ওপাশের কন্ঠ শোনে চমকে উঠে সে। স্মিত গলায় বলে,
“কে বলছেন?”
“আমি ডাক্তার তাহির! চেনেন নি?”
মিশ্মি জবাব দিলো না। তাহির নিজ থেকেই বললো,
“আসলে সোহিনীর খবর নিতে কল করেছিলাম। উনি ভালো আছেন এখন? কাল হাসপাতালে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি আপনারা ডিসচার্জ করে নিয়ে গেছেন। অনেক খোঁজে কল লিস্টে আপনার নাম্বার পেলাম। হিমি? শুনছেন? হ্যালো!”
চলবে,,,,,,,,,