হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
দ্বিতীয়_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন
চারিদিকে শুনশান নিরবতা। মেঘের প্রতিটি গর্জনে প্রকৃতিও যেন ক্ষণে ক্ষণে বিষণ্নতার আবেশ ছড়াচ্ছে। মনের বিষাদকে তা যেন আরো কয়েকগুণগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। অনেক্ষণ ধরেই বেলকনির এককোণে দাঁড়িয়ে আবহাওয়ার রং-বদল দেখছে সোহান। দৃষ্টি আকাশের দিকে থাকলেও চোখে এখনো কিছুকাল পূর্বের ঘটনাগুলোই ভেসে চলেছে। কয়েক প্রহর পূর্বের শোনা কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। চারপাশের বৃষ্টির ঝমঝম ধ্বনিও যেন তার কাছে ক্ষীণ। সোহানের কিছুতেই হিসাব মিলছে না। তারিন তাকে ঘৃণা করা তো দূর কখনো তার সাথে রুক্ষ গলায়ও কথা বলেনি। পাঁচবছর আগে এই তারিনই তাকে মন উজার করে ভালোবাসতো। পাঁচবছর আগের এবং পরের তারিনের মাঝে যেন আকাশ-পাতাল তফাৎ। পাঁচবছরে কী এমন হয়েছিলো যার দরুণ তারিনের ভালোবাসা এরূপ ঘৃণায় পরিণত হলো?
সোহান যখন তার ভাবনায় মগ্ন তখনি মিয়াছের কন্ঠস্বরে তার ধ্যান ভাঙ্গলো।
– ‘দোস্ত চল।’
মিয়াজের কথায় বিস্মিত হলো সোহান।
– ‘মানে? কোথায় যাবো?’
– ‘আমরা আজি এখান থেকে ফিরে যাচ্ছি।’
– ‘কেন? আমাদের তো আরো কিছুদিন পর যাওয়ার কথা!’
– ‘প্ল্যান চেঞ্জ হয়েছে। আমরা আজি এখনি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবো না। আংকেল সব ব্যবস্থা করেছেন। ব্যাগপত্র সব গুছানো শেষ। তুই তৈরি হলেই আমরা রওনা দেবো।’
নিজ ঘরে একধ্যানে হাতের ব্যান্ডেজ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে তারিন। ব্যান্ডেজের কিছু অংশ লাল হয়ে আছে। এক ফোটা জল নিরবে ঝরে পড়লো তার উপর। মনে মনে একটি কথাই ভেবে যাচ্ছে তারিন। ভালোবাসায় কি শুধুমাত্র আঘাতই পাওয়া যায়। বুকটা হঠাৎ মোচর দিয়ে উঠলো যেন। আর একটু দেরি হলেও হয়তো সোহানকে সে চিরতরে হারিয়ে ফেলতো। এখনো চোখের সামনে যেন দৃশ্যগুলো ভাসছে।
শরীর কিছুটা ভালো বোধ হওয়ায় ঘুরতে বেড়িয়েছিলো তারিন। অধরাকে বলেই বেড়িয়েছিলো তারিন। অধরা সাথে আসতে চাইলেও তারিন না করলো। বললো, তার একা ঘুরতেই ভালো লাগছে। কেউ সাথে থাকলে তার প্রকৃতির সৌন্দর্য নিহারনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে হোটেল থেকে এতটা দূরে চলে এসেছে খেয়াল করেনি। চারপাশে অন্যদিনের তুলনায় লোক সমাগম তেমন নেই।
কিছুদূর যেতেই রায়হানকে দেখতে পেলো তারিন। প্রথমে রায়হানকে ডাকতে নিলেও পরে সন্দেহ জাগে মনে। কতগুলো গুন্ডার সাথে তলোয়ার হাতে রায়হান কী করছে? দূর থেকেই রায়হানকে অনুসরণ করতে শুরু করে তারিন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হবে কখনো ভাবেনি। তলোয়ারের ঠিক সামনেই সোহানকে দেখতে পেয়ে একমুহূর্তের জন্য তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এসেছিলো। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে ছুটে গেলো সেদিকে। একটুর জন্য যেন প্রাণ ফিরে পেলো।
রায়হান কিছু সময়ের জন্য মেডিসিন কিনতে বাহিরে গিয়েছিলো। ফিরে এসে দেখতে পায় তারিনের হাত থেকে পুনরায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু তারিনের কোন খেয়াল নেই। তারিন আনমনে মেঘলা আকাশ দেখায় ব্যস্ত। হঠাৎ রায়হানের ডাকে বাস্তবে ফিরে তারিন। রায়হান পুনরায় নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
– ‘কেন তুমি সোহানকে বাঁচাতে গেলে? দেখো কত বাজে ভাবে হাত কেটে গেছে তোমার।’
– ‘আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছেনা রায়হান। আমার কিছু সময় একা থাকা প্রয়োজন। প্লিজ, তুমি এখন আসতে পারো।’
রায়হান কিছু বলতে নিলেও তারিন তাকে থামিয়ে দেয়। অগত্যা রায়হানকে ফিরে যেতে হলো। রায়হান বেরিয়ে যেতেই তারিন দরজা লক করে দেয়। ঘরের এক কোণে বসে হাটুতে মুখ গুজে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই তারিন মুখ তুলে তাকায়।
– ‘তুই!’
– ‘হ্যাঁ আমি। কোন সন্দেহ আছে?’
– ‘না, কিন্তু আমিতো দরজা লক করে এসেছিলাম। ভেতরে আসলি কী করে?’
– ‘টিং-টং। এই দেখ এক্সট্রা চাবি। নিরাপত্তার জন্য নিজের কাছে রেখেছিলাম। এখন দেখ কাজে লেগে গেলো!’
তারিন আর কিছু বলল না। অধরা জানে তারিনের মন খারাপ।
– ‘আমাদের তারিন যে এতটা দুর্বল আগে তো জানতাম না। তারিন? তুই তো বলতি কোন পরিস্থিতিতেই ভেঙ্গে পড়তে নেই। তাহলে নিজের বেলায় ভেঙ্গে পড়ছিস কেন?’
তারিন কিছু না বলেই অধরাকে জড়িয়ে ধরলো।
– ‘বাবাকে খুব মনে পড়ছে। এখন যদি বাবা পাশে থাকতো তাহলে নিজেকে এতটা অসহায় মনে হতো না।’
– ‘তারিন! মন খারাপ করিস না। দেখ যা হয় সব ভালোর জন্যেই হয়। আমাকেই দেখ! একমাত্র তুই ছিলি বলেই নিজেকে স্ট্রং রাখতে পেরেছি। আর এখন তুই-ই ভেঙ্গে পড়ছিস!’
– ‘আমি না থাকলেও অপ্সরার জন্যেও তোর নিজেকে স্ট্রং রাখতে হতো। আচ্ছা, অপ্সরা কোথায়?’
– ‘বাহিরে রায়হান ভাইয়ার সাথে খেলছে।’
– ‘ওহ্।’
– ‘দাঁড়া। আমি কফি নিয়ে আসছি। কফি খেতে খেতে দুজনে মিলে আড্ডা দেয়া যাবে। এতে তোর মনও ভালো হবে।’
তারিনকে রেখেই অধরা কফি আনতে গেলো। তারিন উপরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অধরার অপেক্ষা করতে থাকে।
– ‘আমি যাবোনা মিয়াজ।’
– ‘মানে? আমরা সবাই রেডি হয়ে আছি আর তুই এখন বলছিস যাবি না?’
– ‘তোরা চলে যা। আমি এখানেই থাকবো। এখনো অনেক রহস্য উদঘাটন করা বাকি।’
– ‘তোকে আমরা ফেলে চলে যাবো? তাও আজ যা ঘটে গেলো তারপরেও! শোন পাগলামো করিস না। আজ একটুর জন্য মৃত্যু থেকে বেঁচে গেছিস তুই। নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে যেতে পারবোনা আমি। তুই আজ এক্ষুণি আমাদের সাথে ফিরে যাবি।’
– ‘তারিনের এরূপ আচরণের কারণ না জেনে এভাবে প্রাণের ভয়ে চুপিসারে স্থান ত্যাগ করা আমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে কম বেদনাদায়ক নয়। প্রতিমুহূর্তে আমায় তা তাড়া করে বেড়াবে। ফিরে তো আমি যাবোই। তবে আমার সাথে তখন তারিনও থাকবে।’
– ‘তুই এখনো তোর জেদ ধরেই বসে থাকবি তাইতো? ওয়েট আমি এখনি আংকেলকে ফোনে সব বলছি।’
– ‘না, বাবাকে এখনি সব জানাস না। অযথা আমার জন্য চিন্তা করবে।’
– ‘তুই জেদ না ছাড়লে উপায়ান্তর না পেয়ে আমাকে এটাই করতে হবে। তুই এমন একজনের জন্য পাগলামি করছিস যে তোকে কিনা ভালোই বাসেনা।’
– ‘তারিন আমাকে প্রচুর ভালোবাসে মিয়াজ। এবং সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।’
– ‘তারিন তোর সামনেই বলেছিলো সে তোকে ভালোবাসেনা। পরেও তুই এটাই ভাবছিস।’
– ‘তারিনকে আমি খুব ভালো করেই চিনি মিয়াজ। আমি জানি তারিন মিথ্যে বলছে। হয়তো সে কোন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এমনটা বলছে নয়তো এই পাঁচবছরে আমার অজান্তে এমন কিছু ঘটেছে যা তারিনের মনে আমার জন্য তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি করেছে।’
– ‘তুই এতটা সিউর কীভাবে?’
মিয়াজের কথায় সোহান মুচকি হাসি হাসলো।
– ‘তারিন যদি আমায় ভালো নাই বাসতো তাহলে কখনো এভাবে নিজের পরোয়া না করে আমাকে বাঁচাতে আসতো না মিয়াজ। আমি নিশ্চিত কিছুতো এমন হয়েছেই যার জন্য তারিন আমার থেকে দূরে সরে গেছে।’
– ‘তুই জেদ ধরেই থাক।’
সোহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিয়াজ সেখান থেকে চলে গেলো। সোহান স্মিত হাসলো। মিয়াজকে খুব ভালো করেই চিনে সোহান। বর্তমানে মিয়াজ প্রচুর রেগে আছে। এখন সে বাহিরে গিয়ে কিছুক্ষণ একা সময় কাটাবে। রাগ কমার পরেই বাড়ি ফিরবে। মিয়াজ সোহানের খুব ভালো বন্ধু। বিদেশে গিয়ে পরিচিত হবার পর উভয়েই বেশ অবাক হয়। কারণ তাদের উভয়ের বাড়ি একি এলাকায় হওয়া সত্বেও দেশে থাকাকালীন তাদের কখনো দেখা হয়নি। পাঁচবছরের মাঝে তারা অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাদের উভয়ের পরিবারই তাদের যথেষ্ট স্নেহ করে।
অধরা কফি এনে তারিনের সাথে গল্পের আসরে মেতে উঠলো। নানা গল্পগুজবে তারিনের মন কিছুটা ভালো হয়ে উঠে।
রাতে…
তারিন তার ঘরে শুয়ে আছে। তারিনের পাশেই অধরা রয়েছে। আর মাঝখানে অপ্সরা। তারিনের কিছুতেই ঘুম আসছে না। এখানে সে যতদিন থাকবে ততবারই তাকে সোহানের সম্মুখীন হতে হবে। তারিন জানে না কতদিন সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারবে। এখান যেতে যতদ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে পারলেই সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। পরিস্থিতি কতটা বদলে গেছে। পূর্বে সোহানের সাথে একঝলক দেখা করার জন্য অপেক্ষায় থাকা তারিন আজ সোহানের থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। এক বিন্দু জল চোখ বেয়ে বালিশে গড়িয়ে পড়ল। তারিন তার অতীতে ডুব দিলো। পাঁচ বছর আগেও কত হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল ছিলো তার জীবন!
চলবে…