হৃদয়_মাঝে ( প্রথম পর্ব ) #ঈপ্সিতা_মিত্র <১>

0
730

#হৃদয়_মাঝে ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
হিয়ার ছোট্ট একতলা বাড়িটায় আজ সকাল থেকে ভীষণ তোড়জোড় | বাবার এই অসুস্থ শরীরের মাঝেও একটা হাসি লেগে আছে মুখে | যদিও নিজে বাজার দোকান করতে পারছে না ! কিন্তু মা কে মুখে মুখে যতটা সম্ভব ইন্সট্রাকশন দিয়ে হেল্প করা যায় , সেটাই আপ্রাণ চেষ্টা করে করে যাচ্ছে মানুষটা | আর মা , সকাল থেকে একা হাতে মিষ্টি আনা থেকে বাজার করা , তারপর ক্লান্ত শরীরটা নিয়েও রান্নাঘরে ছোটা , সব করছে এক নাগাড়ে | হিয়াও এর মাঝখানে একবার যেতে গিয়েছিলো রান্নাঘরে , মা কে সাহায্য করার জন্য , কিন্তু মা একটা বাটি অব্দি এগিয়ে দিতে দেয়নি ! সোজা নিজের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে ওকে | আজ ছেলের বাড়ি দেখতে আসবে ! আজকে রান্নাঘরে এসে কালিঝুলি মাখলে হয় না কি ! হিয়া কথাটা শুনে অবাক হলেও মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি মায়ের ! বলতে পারেনি একটু রান্না করলে ওর চোখ মুখ বসে যাবে না ! বা ওকে দেখতে খারাপও হয়ে যাবে না | আসলে এই একটা দিন মা ওর কোনো যুক্তি শুনবে না , হিয়া জানে এটা | বিয়ে নিয়ে তো মনে মনে কম ভাবনা ছিল না বাবা মার ! কিন্তু উপায়ও ছিল না কিছু | বাবার প্রাইভেট চাকরি | রিটায়ারমেন্টের পর ভেবেছিলো জমানো টাকা দিয়েই হিয়ার বিয়েটা দেবে ভালোভাবে | ছেলে দেখাও শুরু করবে | কিন্তু সব ভাবনাই থমকে গেলো কিডনির রোগটার জন্য | ডায়ালিসিস , ট্রিটমেন্টের খরচ , ওষুধের খরচেই সব জমানো টাকা প্রায় শেষ ! আর এই হাসপাতাল বাড়ি করতে করতে রিটায়ারমেন্টের দু বছর পরেও হিয়ার জন্য ছেলে খোঁজা আর সম্ভব হয়নি | আর কোন ছেলেই বা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করবে ! কথাগুলো ভেবে ওই জীর্ণ শরীরে হিয়ার বাবা অনেকদিন গুমরে গুমরে দিন কাটাতো ! মা টাকার চিন্তা , মেয়ের চিন্তা নিয়ে অন্ধকার মুখে ঘুরে বেড়াতো বাড়িটায় | কিন্তু সেদিন বাবার বন্ধু অনিন্দ সেনগুপ্ত আসার পরই ওদের সমস্ত চিন্তা যেন এক নিমেষে শেষ বলে মনে হলো ! বাবার কলেজ লাইফের বন্ধু অনিন্দ জেঠু অনেকদিনই চন্দনগর ছেড়ে ব্যবসার কারণে কোলকাতানিবাসী | প্রচুর টাকাও করেছে এই ইম্পোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা থেকে এরপর | সে যখন প্রায় ত্রিশ বছর বাদে জগৎধাত্রী পুজোয় চন্দননগর এসেছিলো মায়ের দর্শনে , তখন পুরোনো বন্ধুর খোঁজ নিতে নিজে থেকেই হাজির হয়েছিল হিয়াদের বাড়ি | তারপর হিয়ার মতন মিষ্টি শান্ত একটা মেয়েকে দেখে ওনার যেন হঠাৎই পছন্দ হয়ে যায় নিজের ছেলে প্রিয়মের জন্য | যদিও হিয়ার বাবা নিজের শরীর , টাকা পয়সার অবস্থা সব কিছুর কথাই একদম স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল অনিন্দবাবুকে | কিন্তু সেইসব কথা শুনেও উনি ওনার কথা বদলাননি | উল্টে হিয়ার বাবার ওই ভাঙা শরীর দেখে নিজের মুখে কথা দিয়ে গেছেন যে যদি হিয়ার পছন্দ হয় , তাহলে প্রিয়মও কখনো এই বিয়ে নিয়ে কোনো আপত্তি করবে না | যাইহোক , এইসবের মাঝেই আজকে দেখতে আসার দিনটা ঠিক হয়েছে হিয়াদের বাড়ি | ওর মা বাবা তাই নিজেদের যত টুকু সামর্থ সবটা দিয়েই আজকের দিনটাকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে মনের মতন করে | ওদের ওই রং ওঠা বাড়িটার বসার ঘরটা কেও সাজিয়েছে নতুন টুকটাক ফুলদানি , কুশন কভার দিয়ে | হিয়া যদিও অনেক বলার পরও নিজের জন্য কোনো নতুন শাড়ি কেনেনি আজ | মায়েরই একটা শাড়ি পরে সেজেছে ও| তবে চন্দননগরের সেরা দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আসা হয়েছে ছেলের বাড়ির জন্য | ওদের তুলনায় হিয়াদের বাড়ির অবস্থা ভীষণ সাধাৰণ হলেও হিয়ার বাবা মা কোনো কমতি থাকতে দেয়নি আয়োজনে |

যাইহোক , সেইদিন এইসব কিছুর মাঝে ঠিক সন্ধ্যে ছটার সময় হাজির হয়েছিল অনিন্দবাবু নিজের ছেলে সমেত | সঙ্গে ওনার বড়ো ছেলে , তার বৌ ,আর ছোট্ট বাচ্চাটাও এসেছিলো | প্রিয়মের মা অনেকদিন আগেই মারা গেছে আসলে ! তাই ছোট্ট এই সংসারে মা এর জায়গাটা খালিই আজ পর্যন্ত | এইসব টুকটাক কথার ভিড়েই হিয়া এসেছিলো বসার ঘরে | খেয়াল করেছিল আড়চোখে প্রিয়ম কোনার সোফাটায় চোখ নামিয়ে বসে আছে চুপচাপ | ফটোতে সেদিন যেরকম দেখেছিলো , সামনাসামনিও একই দেখতে ! তাই চিনতে হিয়ার অসুবিধা হয়নি কোনো | যাইহোক , সেদিন সবার সঙ্গে টুকটাক আলাপ পর্ব সাড়ার পর হিয়াকে প্রিয়মের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার জন্য অন্য একটা পাশের ঘরে পাঠানো হলো এরপর | ওদেরও তো একে অপরকে একটু চেনা জানা উচিত ! কিন্তু এই মুহূর্তে হিয়ার বেশ অস্বস্তি হতে শুরু করেছে যেন | আসলে এই সম্বন্ধের বিয়ে নিয়ে প্রথম থেকেই মনটা ঠিক তৈরী ছিল না ! যেই ছেলেটাকে কোনোদিনও চিনলো না , জানলো না , তার সাথে সারা জীবন কাটানোর কথা ভাবাটা এক আলাপে ভীষণ কঠিন | তবে আজ এই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসার একমাত্র কারণ হলো বাবা মা | ওরা দুজনে বড্ডো আশা নিয়ে এই সম্বন্ধে হ্যাঁ বলেছে | আর অনিন্দ জেঠু ভালো মানুষ বলেই ওদের বাড়ির অবস্থার কথা জেনেও বিয়ে দিতে চায় নিজের ছেলের সঙ্গে হিয়ার ! সবটা মিলিয়েই হিয়া মনে মনে নিজেকে বুঝিয়েছিল প্রিয়মের ব্যাপারে | আর এই বিয়েটা হলে সব থেকে শান্তি পাবে ওর বাবা | এই রকম অসুস্থ শরীরে ডাক্তার এমনিতেও বলেছিলো কোনো রকম মেন্টাল স্ট্রেস না নিতে | এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে হিয়া সেদিন চুপই ছিল প্রিয়মের সামনে একলা ঘরে | তবে ওর নিঃস্তব্ধতার মাঝেই সেই ব্ল্যাক ফ্রেমে মোরা চশমার ছেলেটা নিজে থেকে বলে উঠলো একটা অন্য কথা ,

—————– ” তুমি এই বিয়েটাতে না বলে দাও প্লিজ |”

হিয়া যেন স্তব্ধ ঘরে একটা কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো হঠাৎ ! ও মাটি থেকে চোখটা তুলে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকালো এবার | এই মুহূর্তে প্রিয়মও যেন নিজেকে তৈরী করছিলো ! একটা অচেনা মেয়েকে নিজের সবটা বলার জন্য ! আসলে আজ এই মুহূর্তে আর কোনো উপায়ও নেই | সব দিক থেকে ফেঁসে গেছে ও | তাই কিছু কথা সাজিয়ে বললো ,

————– ” বাবা তোমার বাবাকে কথা দিয়ে দিয়েছে বলে আমাকে এখানে আসতে হলো তোমাকে দেখতে ! বিশ্বাস করো , আমি ইচ্ছে করে তোমাকে এইরকম অকোয়ার্ড একটা সিচুয়েশনে ফেলতে চাইনি ! আমি আসলে লাস্ট দু বছর হলো একটা মেয়ের সঙ্গে রিলেশনে আছি | আমাদের কোম্পানির এমপ্লয়ি ছিল অরুনিমা | কিন্তু বাবার জানি না কেন মনে হয় যে অরুনিমা জাস্ট টাকার জন্য বিয়ে করতে চায় আমাকে ! আসলে একটু মর্ডার্ন মেয়ে | ডিস্ক নাইটক্লাস এইসবে যায় বলে বাবার একটা স্টিরিওটিপিক্যাল চিন্তাধারা হয়ে গেছে অরুণিমাকে নিয়ে | যদিও এখন ও কলকাতার একজন খুব নামি মডেল ! তবে বাবা আমাদের বিয়েটা দিতে চায় না বলেই তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা ফিক্সড করেছে | ইভেন আমাকে তো ব্ল্যাকমেল করেই এখানে নিয়ে এসেছে , যে যদি আমি তোমাকে বিয়ে করতে না বলি , তাহলে বাবা নিজের বিজনেস , প্রপার্টি সব কিছু থেকেই আমাকে বাদ দিয়ে দেবে | তবে আমি জানি ,তুমি নিশ্চই সবটা জেনে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না ! তুমি তো যেচে পরে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করবে না , যার অলরেডি একজন গার্লফ্রেন্ড আছে | যাইহোক , প্লিজ সবাই চলে গেলে তুমি তোমার মা বাবাকে এটা বলবে যে তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি | বলবে আমি রেগুলার ড্রিংক করি ! ক্লাবে যাই | অন্য সব নেশাও করি | আমি খুব খারাপ একটা ছেলে | তুমি আমার সঙ্গে কথা বলেই সবটা বুঝেছ | দেখবে , তোমার মা বাবাও আর জোর করবে না এই বিয়েটার জন্য তারপর | আর সরি , এই সম্বন্ধ দেখতে আসার ড্রামাটা আমাকে করতে হলো তাই |”

কথাগুলো যেন এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিলো প্রিয়ম সেদিন , আর হিয়া নিশ্চুপভাবে শুনেছিলো ওর বাবা মায়ের সব স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার গল্পটা ! বুঝতে পারছিলো না যে সময় এইরকম একটা সুন্দর মজা করতে পারে জীবনের সঙ্গে ! অনিন্দ জেঠু নিজের ছেলেকে ব্ল্যাকমেল করে নিয়ে এসেছে ওকে শুধু একবার দেখতে ! এতটা সত্যি জেনে কি করবে হিয়া এখন ! কি উত্তর দেবে বাবা মা কে ! কিছুতেই যেন ভেবে পাচ্ছিলো না আজ | শুধু এই সকাল থেকে সাজানো গোছানো সুন্দর দিনটা কিরকম এলোমেলো লাগছিলো চোখের সামনে ওর | মনে হচ্ছিলো ওর বাবা মা যেই তাসের ঘরটাকে খুব যত্ন করে বানাচ্ছিল সকাল থেকে , সেটা এক মুহূর্তে কেউ এসে ভেঙে দিলো ! ছন্নছাড়া করে দিলো তাসগুলোকে |

<২>

সেদিন এরপর হিয়া মুখটা অন্ধকার করেই বসার ঘরে ফিরেছিল | এর মাঝে বাড়ির লোকেদের মধ্যে অনেক কথাই হয়েছে | হিয়া আসার পরেও বিয়ের ডেট নিয়ে , আচার অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছিলো ! কিন্তু সেইসব হিয়ার কান অব্দি পৌঁছোচ্ছিলো না যেন ! ভেবে পাচ্ছিলো না সবাই চলে গেলে মা বাবা কে ঠিক কি ভাবে প্রিয়মের কথাগুলো বলবে ! কিভাবে বিয়েতে না করবে ! সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই রাত নেমে এসেছিলো ওদের ওই ছোট্ট শহরটায় | হিয়া ভেবেছিলো খাবার টেবিলে বসে সত্যিটা বলবে বাবা মা কে | না , ওর পছন্দ হয়নি প্রিয়মকে , এইসব বানানো গল্প না | যেটা সত্যি , সেটাই বলবে | শুধু বাবা মা কে রিকোয়েস্ট করবে প্রিয়মদের বাড়িতে যেন ওরা ওই মিথ্যে বানানো গল্পটা বলে , যে হিয়ার প্রিয়মকে ভালো লাগেনি | আসলে হিয়া চায় না , ওর জন্য কারোর লাইফে কোনো ঝামেলা , কোনো অশান্তি হোক | যে যাকে ভালোবাসে , তার তো সেই মানুষটার সঙ্গেই জীবন কাটানো উচিত | এখানে তো কোনো অন্যায় নেই ! এইসব ভেবেই সেদিন রাত দশটার সময় ডাইনিং টেবলিবের সামনে এসেছিলো হিয়া | কিন্তু কিছু বলার আগেই হঠাৎ সবটা বদলে গেল হিয়ার সামনে | বাবা চেয়ার থেকে আচমকা বুকে হাত দিয়ে মাটিতে পরে গেলো সেই রাতে | হিয়ার কিছুক্ষণের জন্য যেন চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেলো | বুঝতে পারছিলো না হঠাৎ কি হলো ! সন্ধ্যে থেকে তো ঠিকই ছিল ! তাহলে কি ডাক্তার আগেরবার চেকআপের সময় যেই ভয়টা দেখিয়েছিলো সেটাই হলো ! কিডনির প্রব্লেমের জন্য পেটে জল জমে বুকে চাপ তৈরী হচ্ছিলো ! সেই থেকেই কি হার্ট এটার্কটা হলো ! হিয়ার মাথা কাজ করছিলো না ঠিক এই সময়ে | তাও কোনো মতে নিজেকে সামলে মায়ের সঙ্গে হসপিটালে এসেছিলো বাবাকে এডমিট করতে | তবে ওর মনের আশঙ্কাটাই সত্যি হলো | মাইনার হার্ট এটার্কই হয়েছিল বাবার | আসলে কিডনির এমন অবস্থা যে ডায়লিসিসেও আর বিশেষ কাজ হচ্ছে না ! কিডনি চেঞ্জ করার একটা অপসন আছে | তবে অতো টাকা হিয়াকে বিক্রি করলেও মনে হয় পাওয়া যাবে না ! আর ঠিক মতন ডোনার পাওয়াও তো মুখের কথা না ! আর সব থেকে বড়ো কথা হিয়ার বাবার শরীরের অবস্থা এমন না যে এতো বড়ো একটা অপারেশন সহ্য করতে পারবে ! ডাক্তার আজ এই শেষ কথাটাও বলে দিলো ওদের | সঙ্গে কিছুটা সময় বেঁধে দিলো | ওর বাবা কতদিন এই রোগটার সঙ্গে সারভাইব করে বাঁচতে পারবে ওদের সঙ্গে , সেই সময় | না , এরপর আর কিছু শেষ হওয়ার মতন বাকি ছিল না ! শরীর যেন ছেড়ে দিয়েছিলো হিয়ার | মায়ের এলোমেলো চেহারা , নিঃস্ব দুটো চোখ দেখে সবটা খালি হয়ে গিয়েছিলো আশেপাশে | মনে হচ্ছিলো এই একটা রাত ওদের ছোট্ট সুন্দর ফ্যামিলিটার শেষ ডেকে আনলো ! মেয়াদ ধরিয়ে দিলো হাতে, কতদিন ওরা তিনজন একসঙ্গে থাকতে পারবে , তার | কিন্তু এই মুহূর্তে মা যেন হসপিটালের কোরিডোরটায় রাখা ফাঁকা বেঞ্চটাতে বসে আপন মনেই বলে উঠলো হিয়াকে ,

————— ” তোর বিয়েটা যদি ঠিক না হতো ! তোর বাবা এই শেষ দিনগুলোতে খুব চিন্তায় থাকতো জানিস | ভাগ্যিস অনিন্দদা এসেছিলো সেদিন | অন্তত একটা দিকে তো শান্তি পেলো লোকটা ! তোর বিয়েটা দেখে যেতে পারবে |”

কথাগুলো কেমন ঘোরের মধ্যে বলেছিলো সেদিন মা | কিন্তু সেই সময় মায়ের মুখে অদ্ভুত একটা শান্তি ছিল | অনেক ক্লান্ত একটা দিন কাটানোর পর সামান্য একটু শান্তি | না , হিয়া পারবে না এই শান্তিটাকে এই মুহূর্তে শেষ করে দিতে মা বাবার | পারবে না বলতে কখনো সত্যিটা এই পরিস্থিতিতে, যে বিয়ে করতে চায় না প্রিয়ম | একবার জীবনে স্বার্থপর হতেই হবে ওকে | একবার অন্যের কথা ছেড়ে নিজের বাবা মার্ কথা ভাবতে হবে হিয়াকে | আর সারা জীবন তো থাকবে না প্রিয়মের সঙ্গে ! বাবা তো আর বেশিদিন নেই ! আজ তো এই কঠিন সত্যিটা জানতে পেরেই গেছে হিয়া | শুধু বাবার এই বেঁচে থাকার দিনগুলো থাকবে হিয়া প্রিয়মের জীবনে | তারপর নিজে মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়ে আলাদা হয়ে যাবে | প্রিয়মকে ওর স্বাধীন জীবনটা ফিরিয়ে দেবে আবার | কিন্তু এই মাঝের কটা মাসের জন্য এই বিয়েটা করতেই হবে হিয়াকে | বাবাকে শেষ দিনগুলোতে শরীরের কষ্ট পেতে হলেও মনের কষ্ট পেতে দেবে না হিয়া | কথাটা ভেবেই ভেজা চোখে নিঃস্তব্ধ হয়ে রইলো আজ মায়ের সামনে ও | কিছু না বলে রাজি হয়ে গেলো একটা ভাঙা বিয়ের সঙ্গে নিজেকে জরিয়ে ফেলার জন্য |

<৩>

তবে এইসবের দুদিন পরে প্রিয়মের যেন একটা ধাক্কা লেগেছিলো খবরটা শুনে , যে হিয়া বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছে ! মাথায় আসছিলো না মেয়েটাকে এতো করে বোঝানোর পরেও কি করে এমন একটা ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি হলো যার একটা গার্লফ্রেন্ড আছে ! যে নিজে ওকে বিয়ে করতে চায় না ! কিভাবে হ্যাঁ বললো মেয়েটা ! কিছুতেই ঠিক বুঝতে পারছে না ও | কিন্তু একটা কথা ও নিজে ঠিক করে নিয়েছে ,কিছুতেই এই বিয়েটা করবে না প্রিয়ম | ও ভালোবাসে অরুণিমাকে | আর এই ফিলিংসটা এতটা স্বস্তা নয় যে কিছু টাকা আর প্রপার্টির জন্য শেষ হয়ে যাবে ! বাবা যদি চায় , তাহলে আলাদা করে দিক নিজেদের থেকে ! এই বিজনেস , বাড়ি সব কিছু থেকে | কিন্তু তাতে ও না খেয়ে দিন কাটাবে এরকমও তো না ! ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে , তারপর এম.বি.এ পড়েছে প্রিয়ম | এক্সপিরিয়েন্স আছে কাজের | একটা চাকরি ও ঠিক নিজের জন্য পেয়ে যাবে | তারপর অরুণিমাকে নিয়ে আবার শুরুর থেকে শুরু করবে সব কিছু | এইসব ভেবেই গিয়েছিলো সেদিন অরুণিমার ফ্ল্যাটে ওকে নিজের ডিসিশনটা বলতে | কিন্তু অরুনিমা সবটা শুনে কেমন ওর ভাবনার বাইরে কিছু অন্য কথা বলে উঠলো ,

————– ” তুমি এতো স্টুপিড প্রিয়ম ! রিয়ালি ! মেয়েটা একটা গেম খেললো , আর তুমি সেসব কিছু না বুঝে একেবারে নিজের বিজনেস প্রপার্টি সব ছেড়ে চলে আসার কথা ভাবছো ! আমি তো মেয়েটাকে সরল ভেবেছিলাম | কিন্তু যেই মেয়ে বিয়ের আগে এতো কিছু জেনেও বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় , সে একটা মাস্টার পিস্ ! আর তুমি বোকার মতন এই মেয়ের জন্য নিজের প্রপার্টি ছেড়ে দেবে ! ”

কথাটা শুনে প্রিয়ম ঠিক বুঝতে পারেনি অরুণিমার কথা গুলো | ও অবাক হয়েই বলেছিলো , ———- ” তাহলে কি করবো ? বিয়ে করবো ওকে ?”

প্রশ্নটা শুনে অরুনিমা স্ট্রেট কাটই উত্তর দিয়েছিলো ,

————— ” হ্যাঁ , বিয়ে করবে ওকে | ও যেমন তোমাকে তোমার প্রপার্টি , টাকা পয়সার জন্য বিয়ে করছে , সেরকম তুমিও নিজের বিজনেস প্রপার্টির জন্য ওকে বিয়ে করবে | ”

কথাটার উত্তরে প্রিয়ম এবার বেশ জোরেই বলে উঠলো ,

————- ” পাগল না কি তুমি ! আমি তোমাকে ভালোবাসি | আমি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে যাবো কেন ! আমাদের কি হবে তাহলে ? ”

অরুনিমা তখন আলতো হেসে প্রিয়মকে জরিয়ে ধরে বলেছিলো , ————– ” আমি ওকে বিয়ে করতে বলছি , তার মানে এটা না কি যে আমাকে ছেড়ে দিতে বলছি তোমায় ! আমরা তো অলওয়েজ একসাথেই আছি , আর থাকবোও | তার জন্য আমি বিলিভ করি না বিয়ে নামের কোনো সোশ্যাল স্টেটাসের দরকার এখন আমাদের | আর তুমি ওই হিয়া বলে মেয়েটাকে বিয়ে করে কিছুদিন পর ডিভোর্স দিয়ে দেবে | আর যদি ও ডিভোর্স দিতে না ও চায় , হোয়াটস দ্যা বিগ ডিল ! তুমি যেরকম আমার সাথে আছো সেরকমই থাকবে | ও তোমার লোক দেখানো বৌ হবে জাস্ট ! কিন্তু থাকবে তুমি আমারই সাথে | আর আরো একটা কথা , বিয়ের পর ওকে খুব ভালোভাবে নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দেবে | তোমার লাইফে যে ওর একচুয়ালি কোনো জায়গা নেই , এটা বুঝিয়ে দেবে | তাহলে দেখবে , ও নিজেই একদিন চলে যাবে | তোমার ডিভোর্স পেতে কোনো অসুবিধা হবে না | আর সব প্রোপার্টিও তোমারই হবে |”

কথাগুলো এতো সহজভাবে বলে গেলো অরুনিমা যে প্রিয়ম কিরকম নির্বাক হয়ে গেলো যেন | এতটা প্র্যাকটিক্যাল অরুনিমা ! ও নিজে নিজের ভালোবাসাকে অন্যের সঙ্গে বিয়ে করার কথা বলছে ! কথাটা ভাবতেই অরুনিমা কেমন নিজে থেকেই উত্তরটা দিয়ে দিলো , ———— ” প্রিয়ম , তুমি নিশ্চই ভাবছো আমি কিভাবে তোমাকে অন্যের সঙ্গে বিয়ের কথা বলছি ! একটা মেয়ে হয়ে এইভাবে ভাবছি কি করে ! কিন্তু আমি চাই না তুমি তোমার লাইফে কিছু হারাও যেটা তোমার রাইট ছিল | এই বিজনেস , টাকা পয়সা সব কিছুর ওপর রাইট আছে তোমার | আর এই বিজনেসটার জন্য তুমিও কম পরিশ্রম করো না ! তাহলে একটা স্টুপিড ইমোশনের জন্য সব ছেড়ে আসবে কেন ? আর আমাদের রিলেশনটা এতটা উইক না যে কোনো থার্ড পার্সন এসে সেটাকে শেষ করে দেবে | আর এটা যদি সে ভেবে থাকে , তাহলে তাকে ভুল প্রুভ করাটাই আমাদের উচিত | তাই না ?”

না , প্রিয়ম আর এরপর ‘না’ বলতে পারেনি অরুণিমাকে | বরং নিজের মনটাকে শক্ত করেছিল | একটা জোরের বিয়ের সঙ্গে নিজেকে জরিয়ে ফেলার জন্য |

তারপর আর এক মাসের মধ্যেই হিয়া আর প্রিয়মের এই না চাওয়ার বিয়েটা হয়ে গেছিলো | মন্ত্রোচ্চারণ , শুভ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ওরা দুজনেই কম্প্রোমাইজ করেছিল পরিস্থিতির সঙ্গে, একটা ভাঙা সম্পর্কে জরিয়ে | আসলে হিয়ার বাবার শরীরে অবস্থার কথা ভেবেই অনিন্দবাবু তাড়াতাড়িই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিল এতো | আর এর মাঝে হিয়া তবে অনেকবার প্রিয়মকে ফোন করে , ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে বলতে চেয়েছিলো ওর বিয়ের আসল কারণটা ! কিন্তু প্রিয়ম ওকে আর কোনোভাবেই রেসপন্স দেয়নি কোনো | এই মেয়েটার কোনো কথায় আর ভুলবে না ও ! যার জন্য ওর লাইফে এতো কমপ্লিকেশন তাকে অকারণে বিয়ের আগে একটা দিনও দেখতে চায়নি প্রিয়ম | ওর কথা শোনা তো অনেক দূরে থাক | যদিও বাবা , আর ফ্যামিলির বাকি সবার মুখে শুনেছে হিয়ার বাবার শরীরে অবস্থার কথা | কিন্তু তাতেও প্রিয়মের মন নরম হয়নি আর | মনে হয়েছে সবটা নাটক | হয়তো বাবা মা মেয়ে তিনজনে মিলে এরকম বড়োলোক ভালো ফ্যামিলিতে নিজেদের ইনক্লুড করার জন্য এইসব নাটক করেছে এই মাঝের দিনগুলোতে |অরুনিমাই আসলে হিয়াকে ঠিক চিনেছে ! টাকার লোভ ছাড়া মেয়েটা লাইফে আর কিছু বোঝে না | মাস্টার পিস্ই হিয়া |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here