অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-১৪

0
718

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ_ইফফাত

পর্ব ১৪

পরপর দুদিন আমি রাফিনের সাথে কোনো যোগাযোগই করলাম না। বাসা থেকেও বের হইনি। বাসায়ও শান্তি পাচ্ছিলাম না। প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের ঝগড়া অসহ্য লাগছিলো। বাবা-মা আজও বুয়াকে নিয়ে ঝগড়া করছে।

আজকে সকালের ঘটনা।
বুয়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। ছোটফুফি অবাক হয়ে বললেন,
“উনি কে ভাবী?”
“আমার হেল্পিং হেন্ড।” মা বলেন।

ফুফি মাকে একপাশে নিয়ে এসে বললেন,
“ভাবী, রাসূল সা. এর সেই তাসবীহ কি তোমার জানা নেই? ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার…”
“আমি জানি দিশা। এই কথা তোমরা সবাই জনে জনে বলেছো আমাকে।”

দূর্ভাগ্যবশত কথাটা বাবা শুনে নেয়। ছোটফুফি কিছু বলার আগেই বাবা বললেন,
“ওকে ওসব বলতে যাস না। যারা জেনেও মানে না তাদেরকে কিছু বুঝিয়েও লাভ নেই।”

“তোমার তো আমার সুখ সহ্য হয় না।” মা বললেন।

আমি রুমে বসে ‘প্রিয়তমা’ বইটা পড়ছিলাম। আর ওদের এসব কথা শুনছিলাম। কথাটা শোনামাত্রই বই হাতে বেরিয়ে গেলাম। বাবা-মাকে বইটা দিয়ে বললাম,
“এটা আমার না তোমাদের দুজনের পড়া উচিত। রাসূল সা. উম্মুল মুমিনীনদের সাথে কিরকম বিহেইভ করতেন আর উম্মুল মুমিনীনগণ কিরকম বিহেইভ করতেন সবটা তোমাদের দুজনের জানা উচিত। আর হ্যাঁ, শুধু জানলেই হবে না মানতেও হবে।”

ছোটফুফি মুচকি হেসে বললেন,
“এটা তুই এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছিস। তবে হ্যাঁ, তোর পড়া হলে তবেই ওদেরকে দিস।”

“দিবো তো ঠিক আছে। দেখা যাবে, বইটা কে আগে পড়বে সেটা নিয়েও ঝগড়া লেগে যাবে।” মুখ বাঁকা করে বললাম আমি।

সাথে সাথে মা বললেন, “অবশ্যই আমি আগে পড়বো।”
“তুমি কেন? তোমার তো বই পড়ার অভ্যাস নেই। আমি আগে পড়বো।” বাবা বললেন।

ফুফির দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললাম,
“ব্যস! হয়ে গেল।”
”তুই যা, আমি হ্যান্ডেল করছি।” ফুফির সরল উক্তি।

আমিও চলে এলাম রুমে। ডুবে গেলাম “প্রিয়তমার” অতল গহ্বরে। বইটা যত পড়ছি তত অবাক হচ্ছি৷ রাসূল সা.এর স্ত্রী ছিলেন ১১ জন। অথচ তিনি কারো মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। সমতা বজায় রেখে সমান ভালোবাসতেন। একজন উম্মুল মুমিনীনের কাহিনী পড়লে মনে হয় প্রিয়নবী হয়তো ওনাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। উনিই হয়তো প্রিয়নবীর একমাত্র স্ত্রী। পরক্ষনেই পরবর্তী স্ত্রীর কাহিনী পড়তে গেলেও সেইম কথা মনে হয়। কি আশ্চর্য! কত মহান হৃদয়ের মানুষ তিনি। একটা হৃদয় দিয়ে সবাইকে কত সুন্দরভাবে, সমতা বজায় রেখে, কারো মনে কষ্ট না দিয়ে, কোনো ভেদাভেদ না করে কি অপরূপ জীবন কাটিয়েছেন। আর উম্মুল ম
মুমিনীনগণও রাসূল বলতেই পাগল ছিলেন। কত সুন্দর তাঁদের ভালোবাসা। কত পবিত্র।
বইটা পড়তে পড়তে আমি রাসূলের প্রেমে মশগুল হয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল সা. কে ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফেনা তুলেছি। বাট অন্তর দিয়ে কতটা ভালোবাসি তা কখনো অনুভব করা হয়নি। কেন ভালোবাসি বলি তাও অনুভব করিনি। এখন ভাবছি, কত দূর্বল ঈমান আমার। বইটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, এই মানুষটাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। মানুষটাকে শুধু মুখে ভালোবাসি বললেই হবে না। অন্তরের অন্তস্তল দিয়ে অনুভব করতে হবে। আমি দিনরাত বইয়ে ডুবে রইলাম। দুনিয়াদারী ভুলে গেলাম। বইটা পড়ার পর রাসূল সা. যেভাবে দিন কাটাতেন সেভাবে দিন কাটানোর চেষ্টা করলাম। বই পড়ার ফাঁকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে মিসওয়াক করলাম, ওযু করলাম উত্তমরূপে। দিল লাগিয়ে নামাজ পড়লাম। আগে কখনো এভাবে নামাজ পড়া হয়নি। জাস্ট পড়তে হবে বলে পড়েছি। হুটহাট দুটো সিজদাহ দিয়ে উঠে পড়েছি। সিজদাহর মর্ম কি তাও হয়তো বুঝিনি।

একরাতে বইটি পড়তে পড়তে একপর্যায়ে বইয়ের ওপর ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি রাসূলের প্রেমে এতটাই মজে গেলাম যে রাসূল সা. কে বই পড়ার সময় যেভাবে কল্পনা করছিলাম ঠিক সেভাবে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

স্বপ্নটা ছিল এমন, মসজিদে নববীর চারপাশে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা কুঠির। একেকবার একেক কুঠিরে স্ত্রীদের সাথে খোশ গল্পে মশগুল প্রিয় রাসূল। হেসে হেসে কথা বলছেন স্ত্রীদের সাথে। কি সুন্দর দৃশ্য!

ছোট স্বপ্ন ছিল। ঘুম ভামতেই আমি ছুটে গিয়ে ছোটফুফিকে স্বপ্নটা বললাম। ফুফি সাথে সাথে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত দান করুক।”

আমি ফুফির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফুফি মাথায় হাত রেখে বললেন,
“হেদায়েত পাওয়া কোনো সহজ বিষয় না। যে কেউ চাইলেই হেদায়েত পায় না। আবার অনেকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে। আমার আশা আছে তোমাকে নিয়ে। হালকা গাইড পেলেই ইন শা আল্লাহ তুমি সফল হবে। হবেই। তবে হ্যাঁ, হেদায়েত পাওয়ার পর আবার হারিয়ে ফেলো না যেন। তাহলে এরচেয়ে চরম হতাশার আর কোনোকিছুই হবে না।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমি আমার প্রিয় রাসূলকে পুরোপুরি অনুসরণ করবো ফুফি। যিনি আমাদের ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে এতকিছু করেছেন তাঁকে তো ভালোবাসতেই হবে। তাঁর কথা তো রাখতেই হবে।”
“ইন শা আল্লাহ।”

“আচ্ছা ফুফি, আমাকে আরও কিছু বই দিও তো এরকম। পড়তে খুব ভালো লাগছে।”
“খুব বেশি বই তো সাথে করে আনিনি। তবে আরেকটা বই নিয়ে এসেছি। ”মুহস্বানাত” নাম। মেয়েদের জন্য খুবই উপকারী একটা বই। ওটা পড় আপাতত। আমি বাড়ি গিয়ে আরও কিছু বই তোকে পাঠিয়ে দিবো ইন শা আল্লাহ।”

“আচ্ছা।”

ফুফি খুশিমনে চলে গেলেন। আমিও খুশি হয়ে চলে গেলাম নিজের রুমে। মনের মধ্যে কেমন যেন শান্তি কাজ করছে। ইসলামিক বইয়েও এত আনন্দ পাওয়া যায়? জানতামই না!

বিকেলে নাকীব জোর করে ওর ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“ধরো তো আপু। তোমার জিনিস তুমি সামলাও। এত প্যারা আর ভাল্লাগে না।” বলেই সে চলে গেল।

রাফিন ফোন করেছে। অথচ রাফিনের সাথে এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বারবার মনে হচ্ছে, ও আমার জন্য বৈধ না। ওর সাথে কথা বললে রাসূল সা. অসন্তুষ্ট হবেন। আর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হবেন। আমার স্রষ্টাকে অসন্তুষ্ট করার রাইট আমার নেই।

রাফিন ফোন করেই যাচ্ছে। ও কখনো দুবারের বেশি ফোন করে না। বাধ্য হয়ে রিসিভ করলাম। সাথে সাথে ধমক।
“কি সমস্যা তোমার? এত দাম বেড়ে গেছে? কি মনে হয় তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি কান পেতে আছি? আমার টাইমের ভ্যালু নেই?”
“কি আশ্চর্য! আমি বলেছি তোমাকে ফোন করতে? আর একজন স্ক্রু ঢিলা মানুষের সাথে তোমার মতো ভালো মানুষ কেন কথা বলবে? হোয়াই? নো নিড!”

রাফিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এরপর মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“স্যরি!”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “ইটস ওকে।”

কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
“কাশবনে এসো, কথা আছে।”
আমার তখন কি হলো জানি না। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“আমি বেরুতে পারবো না।”
“কেন পারবে না? নাকীব তো বললো তুমি ফ্রী আছো। সারাদিন ঘরে বসে থাকো।”

“হুম বাট ছোটফুফি আছে বাসায়।”
“নো প্রবলেম। নাকীবের সাথে বেরিয়ে এসো কিছু একটা বলে।”
“আমি মিথ্যে বলতে পারবো না। এটা রাসূলের সুন্নত বিরোধী।”

রাফিন বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বললো না। তারপর বললো,
“এখন যে আমার সাথে কথা বলছো এটা কি রাসূলের সুন্নত বিরোধী না?”

এবার আমি চুপ করে রইলাম। ও বললো,
“লিসেন আরোহী, ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। কথাটা শেষ করতে দাও। এরপর তুমি না চাইলে আর কোনো সুন্নত বিরোধী, আল্লাহর বিরুদ্ধে যায়, আল্লাহর নিষেধ আছে এমন কোনো কাজ আমি করবো না। এটলিস্ট, তোমার সাথে তো না-ই।”

আমি ঠোঁট কাঁমড়ে বললাম, “আমি আসছি।”

আমি আসলে এখনো প্রিপেইড না রাফিনকে ছাড়ার জন্য। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আরে আশ্চর্য! আমি রাফিনকে ছাড়ার কথা ভাবছি কেন? ওকে বিয়ে করে নিলেই তো হয়। আল্লাহ বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই বিয়ে করে নিতে। রিযিকের ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ তায়া’লা করবেন। তবে আর বাঁধা কিসের? রাফিনকে বিয়ে করে নিবো।
কথাটা ভেবে খুশি হতে গিয়েও ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। রাফিন রাজি হবে তো বিয়ে করতে? আর বাবা-মা? বাবা-মা যদিও কোনো ব্যাপার না আমার কাছে। রাফিনকে রাজি করাতে পারলে বাবা-মাকে রাজি করানো দু’সেকেণ্ডের ব্যাপার। তাছাড়া নাকীব ও ছোটফুফি তো আছেই ম্যানেজ করার জন্য। বহু আশা নিয়ে কাশবনে ছুটলাম। না জানি কি বলে রাফিন? আল্লাহ রক্ষা করো আমাকে।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here