অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-১৭

0
870

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ১৭

সকাল এগারোটার দিকে লিভিং রুমে সবাই বসে আছি। বাবা কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন বলে ডেকেছেন সবাইকে। বেশ খানিকক্ষণ নিরব থাকার পর গলা পরিষ্কার করে বাবা বললেন,
“হৃদিতা, তোর ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে কবে?”
“অনেক দেরী আছে বাবা। কেন?”

মা ধীর কন্ঠে বললেন, “শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাকি পড়া শেষ করতে পারবি না?”
আমি চমকে তাকালাম মায়ের দিকে। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহ! থামো তো।”

আমার দিকে ফিরে বললেন,
“একটা ভালো প্রস্তাব এসেছে তোর জন্য। এখনই বিয়ে করতে বলছি না। ওরা দেখুক তোকে, তুইও দেখবি। উভয়পক্ষের ভালো লাগলে আর মতের মিল হলে তারপর কথা আগানো যাবে।”

সারারাত কাঁদার পর, রাফিনের সাথে ঝগড়ার পর সকাল সকাল আকষ্মিক শকটা আমি সামলাতে পারলাম না। আমার মুহুর্তেই রাফিনের কথা মনে হলো। নিঃশ্বাস আটকে আসতে লাগলো। গতরাতে রাফিনের সাথে করা ব্যবহারের জন্য গিল্টি ফিল হতে লাগলো। মনে হলো রাফিন আমার সব। ওকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার নেই আমার। ইচ্ছে হলো এক্ষুনি ওর কাছে ছুটে যাই।

বাবাকে শুধু বললাম, “আমার একটু সময় লাগবে।”
“হ্যাঁ, সে তো লাগবেই। সেজন্যই তো আগেভাগে জানিয়ে রাখলাম। তোর সময়মতো তুই মত দিস।”

“আচ্ছা” বলে চলে আসছিলাম। বাবা পিছু ডেকে বললেন,
“আমাকেই বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ফুফি বা মা যে কাউকে বললেই হবে। আর রাজি না থাকলে আমরা চাইছি বলে জোর করে নিজের ওপর কোনোকিছু চাপিয়ে দিস না।”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দ্রুত রুমে চলে এলাম। রাফিনকে এক্ষুনি জানাতে হবে বিষয়টা। ফোন হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলাম। রাফিন দেখা করতে বলেছিলো না? তবে দেখা হলেই বলবো। এবার যদি ওর একটু মতিগতি ফেরে আর কি। আবার ফোন হাতে নিয়ে টেক্সট করলাম,
“বিকেলে কাশবনে মিট করতে চাই।”

রিপ্লাই এলো না। বিকেলে আমি ঠিকই কাশবনে চলে গেলাম। অনেকদিন পর আমার ক্রিকেট টিমকে দেখতে পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম ওদের সাথে। রাস্তার পাশ থেকে সবাইকে একটা করে হাওয়াই মিঠাই ও বেলুন উপহার দিলাম। এরপর সবাই বেশ জোর করলো ক্রিকেট খেলতে। ওদের আমি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললাম যে, আমার আর কখনো ক্রিকেট খেলা হবে না। এটা ছেলেদের খেলা।

এরপর ওদেরকে বিদায় জানিয়ে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। রাফিন তখনো আসেনি। ও আসলো মিনিট দশেক পর। ও এসে বেঞ্চে হেলান দেওয়ার জায়গায় উঠে, বসার জায়গায় পা দিয়ে বসলো। আজও সানগ্লাস পড়ে এসেছে। সেটা মাথার ওপর সুন্দরভাবে আটকে রাখতে রাখতে বললো,
“আসবে না বলার পরও আসার কারণ?”

আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
“ভালোবাসা উপচে পড়ছে না যদিও, ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিল বলে এসেছি। তার আগে তোমার কি কথা সেটা বলো?”

“আমার আসলে কোনো কথা নেই। সেদিন মেজাজ প্রচুর খারাপ ছিল তাই আঙ্কেল-আন্টিকে নিয়ে কথা বলে ফেলেছি। যেটা আমার একদমই করা উচিত হয়নি। আ’ম স্যরি ফর দ্যাট। দ্যাট’স ইট।”

“ওহ। আর কোনো কথা নেই?” খানিকটা আশা নিয়ে জানতে চাইলাম। যেহেতু স্যরি ফিল করেছে হয়তোবা আমার কথার মর্মও বুঝেছে।

ও মাথা নেড়ে বললো,
“নো, নাথিং।”
“আর বিজনেসের ব্যাপারে কিছু ভাবলে না?”
“ওহ নো, প্লিজ! এই টপিকটা আর তুলো না। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আবার উল্টাপাল্টা বলে বসবো, তুমি রাগ করে বসে থাকবে। আবার ফোনের পর ফোন করে ডেকে আনতে হবে। ভাল্লাগে না এসব।”

“কল না করার ব্যবস্থা করলেই তো হয়।”
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “মানে?”
“যদি একই ছাদের নিচে থাকি তাহলে তো এত টেনশন করা লাগে না।”

“আবার ঘুরেফিরে এক কথা।” উপরে তাকিয়ে চোখ উল্টে বললো রাফিন।
“ওকে লাস্ট কুয়েশ্চন। তুমি বিজনেস করবে না এটাই ফাইনাল তো?”
“করবো না তা না, করবো, বাট পরে। তার আগে একটা কথা…”
“কি?”
“না থাক, পরে বলবো।”
“এই পরে পরে করতে করতে না জানি আমিই ততদিনে হারিয়ে যাই।”

ও ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।
“কই হারাবে?”
“অজানায়। একবার হারালে কিন্তু আর পাবে না। শিউর থাকো।”
“আচ্ছা হারালে তখন দেখা যাবে। আর আমি কাউকে খুঁজি না। যার দরকার সে-ই আমাকে খুঁজে বের করে।”
“তোমার কাউকে দরকার পড়ে না?”
“উঁহু।”

আমি গলার স্বর যথেষ্ট নরম করে বললাম,
“আচ্ছা, যদি আমার বিয়ে হয়ে যায়?”
“করে নিবে।” অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বললো রাফিন। ওর বলার ধরণে আমি কেঁপে ওঠে সোজা হয়ে বসলাম।

আমার চোখ লাল হতে শুরু করেছে। কান্নার আগমুহূর্তে যেমন হয়। কোনোমতে বললাম,
“করে নিবো?”
”হুম”
“বাট আমি তো তোমাকে চাই।”

রাফিন থমথমে চেহারায় বললো, “সবসময় আবেগ খাঁটে না মিস আরোহী।”

“বিবেক খাঁটিয়েই তো বলছি। তুমি যদি বিজনেস শুরু না করো, বিয়েও হবে না। আমার তো তখন অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। অলরেডি…”

“বললাম তো, বিয়ে হয়ে গেলে করে নিবে।”
“কিহ?”
“হুম। তোমার বাবা-মা রাজি থাকলে আর আপত্তি কিসের?”
“মানে কি? তোমাকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে করবো?”
“আল্লাহ যার জন্য তোমাকে বানিয়েছেন তাকেই তো করবে। আমি মানা করার কে?”
“তাই বলে চেষ্টাও করবে না?”

“কি চেষ্টা করবো হ্যাঁ? তুমি বলো কি চেষ্টা করবো আমি? আমি চেষ্টা করলেই কি আল্লাহর বিধান বদলে যাবে?” বেশ রেগে বললো রাফিন।

“চেষ্টা করবে বলতে ক্যারিয়ার গড়বে, বিজনেস করবে। যদিও যার রিযিক তার কাছে। তুমি বিজনেস না করলেও আমার রিযিক থেমে থাকবে না ইন শা আল্লাহ। তাই বলছি, বিজনেস না-ও যদি করো তাহলে আমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাও।”
“পারবো না। আমি আগ বাড়িয়ে কোনোকিছুই করতে পারবো না। তুমি যদি ভেবে থাকো, অন্য আট দশটা বয়ফ্রেন্ডের মতো আমি তোমার বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বলবো, ‘বাবা, আমার তো চাকরী নেই। বাবার সম্পত্তি আছে অনেক। দয়া করে আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিন।’ সেরকম হলে তুমি খুব ভুল ভাবছো। এত লো মেন্টালিটি আমার না৷ আমার যোগ্যতা দেখে মেয়ের বাবারা আমার কাছে আসবে। আমি কারো কাছে যাবো না। নো, ইম্পসিবল!”

হাহ! খুব হাসি পেল ওর কথা শুনে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
“কত যে যোগ্যতা তোমার জানা আছে। শত শত মেয়ের বাবারা আসবে তোমার কাছে সেই আশায় বসে আছো। এদিকে আরেকজন মেয়ে যে তোমার অপেক্ষায়, তোমাকে পাওয়ার জন্য বসে আছে তাকে পায়ে ছুঁড়ে ফেলছো। এতই যদি যোগ্যতা থাকতো তাহলে এখনই সেটা প্রমাণ করতে। তুমি না যাও, অন্তত তোমার যোগ্যতা দেখে বাবাকে তো তোমার কাছে পাঠাতে পারতাম। এখন কি যোগ্যতা আছে তোমার? কি দেখিয়ে আমি বাবাকে পাঠাবো?”

“পাঠিও না। পাঠাতে বলছে কে? আফটারঅল, আমি বিয়ে করবো সেটাইবা তোমায় কে বললো?”

“তাহলে আমাদের সম্পর্কের মানে কি?”
“কোনো মানে নেই। আমরা জাস্ট বন্ধু।”
“হোয়াট? এতদিন পর তুমি এটা বলছো?”
“আগেও বলেছি। তুমি কানে তোলোনি। কেন আগে বলিনি, তুমি বরং রিলেশনটা ব্রেক করে দাও? পরে আবার আমার কাছে এই সময়গুলো ফেরত চাইলে আমি কি দিবো তোমাকে? বলিনি বলো?”

একটা দীর্ঘশ্বাস আকাশপানে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
“সত্যিই বিয়ে করে নিবো?”
“সেটা তোমার ইচ্ছে।”
“অক্কেহ!” বলে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম আমি।

রাফিন একটাবারও আমায় পিছু ডাকলো না। যেতে যেতে নির্মলেন্দু গুণের একটা উক্তির কথা খুব মনে পড়তে লাগলো।

“আমি চলে যাবো। এত দূরে যাব যে আর কখনো ফিরে আসবো না। আমাকে বিদায় দিতে পারার আনন্দে,
তুমি কি তখন কাঁদবে আমার জন্যে?”

কখনোই না। রাফিন কাঁদবে আমার জন্য? হাহ! হাস্যকর! এরচেয়ে হাস্যকর কথা আর হয় না। এই উক্তি আমার জন্য না। আমার জীবনে কখনো ভালোবাসা আসেইনি। অবৈধ সম্পর্ক তো, আল্লাহ মুখ ফিরিয়ে ছিলেন আমার দিক থেকে। যেখানে আল্লাহর ভালোবাসা নেই, সম্মতি নেই সেখানে ভালোবাসা কোথা থেকে আসবে? আমিই বরং ভুল জায়গায় ভালোবাসা খুঁজতে গিয়েছিলাম। ক্ষনিকের দুনিয়ায় মানুষের ভালোবাসাও ক্ষনিকের। লোক দেখানো, নামমাত্র ভালোবাসা। পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন তো বিয়ে। যেটাকে রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্ধেক দ্বীন বলেছেন। হায় আফসোস! কোথায় ভালোবাসা খুঁজে চলেছিলাম এতদিন যাবৎ?

বাসায় এসে সরাসরি বাবাকেই জানালাম,
”বাবা, পাত্রপক্ষকে আসতে বলো। তোমাদের ডিসিশনই আমার ডিসিশন।”

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here