অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-১৮

0
803

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ_ইফফাত

পর্ব ১৮

রাতে খাওয়ার পর নাকীব আমার রুমে এলো। মুচকি হেসে বললো, “তোমার ডিসিশনই ঠিক আপু। বেশ কদিন ধরে ছোটফুফির ইসলামিক বইগুলো পড়ছিলাম। পড়ে বুঝলাম, আমরা কতই না অজ্ঞ। ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। আজ একটা বইয়ে পড়লাম, প্রেম হলো ক্ষনিকের আনন্দ। এটা একধরনের মাতলামি, নেশাগ্রস্ততা। অন্তরে যখন ভালোবাসার তীর বিদ্ধ হয় তখন প্রেমিকের স্মরণ আল্লাহর যিকরকেও হার মানায়। যিনি সৃষ্টি করলেন তাঁর কথা কচিত মনে পড়ে। আর সৃষ্ট জিনিসকে প্রতি মুহুর্তে স্মরণ হয়। নাউজুবিল্লাহ। আপু, তুমি নিজে ভেবে দেখো, উপলব্ধি করো তো আসলেই এরকম হয়েছে কিনা?”

আমি আসলেই উপলব্ধি করলাম, রাফিনকে ভাবতে গিয়ে আমি আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত থেকেছি। দিনরাত ওকে নিয়ে ভেবেছি। সুদূর ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন বুনেছি। অথচ এতকিছুর মধ্যে একবারও আল্লাহকে স্মরণ করিনি। নাউজুবিল্লাহ।

আমি মাথা নাড়ালাম, “হু”
“ইসলাম প্রেমকে এজন্য নিষেধ করেছে, প্রেম যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এটা আবেগের ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রেমের জন্য যুবক-যুবতীর পারষ্পরিক সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা জরুরী৷ এজন্য পর্দা লঙ্ঘন হয়৷ পর্দা লঙ্ঘন হারাম। এটাও আমরা মানতাম না এতদিন। হাদীসে এসেছে, “কোনো পুরুষ কোনো নারীর দিকে তাকালে আল্লাহ তার চোখে শীশা ঢেলে দিবেন। আপু, তুমি হলফ করে বলতে পারবে, রাফিন ভাইয়া কখনো তোমার দিকে তাকায়নি?”

“এটা তো অসম্ভব। না তাকিয়ে রিলেশন করেছে নাকি?” আমি বললাম।
“তাহলে ভেবে দেখো কতগুলো গুনাহ তোমরা করেছো। আপু, এতদিন পর আমরা ইসলামের সঠিক ব্যবহার জেনেছি। আর কিছুতেই কোনো বিধিনিষেধ অমান্য করবো না আপু। কথা দাও?”
“ইন শা আল্লাহ চেষ্টা করবো।”

“আর হ্যাঁ আপু, তুমি যে রাফিন ভাইয়ার জন্য দুটো অপশন রেখেছো আমি জানি৷ তবে তুমি জেনে রাখো, ইফ আল্লাহ সেইড ইট’স হারাম ইউর অপশন্স ডাসন্ট মেটার।”

আমি বুঝলাম। সব কথা বুঝেছি। এখন আমি পুরোপুরি প্রস্তুত হবো রাফিনকে ত্যাগ করতে। সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি না কতটুকু কি করতে পারবো? আল্লাহ সহায় হোন।

.

দু’দিন পর পাত্রপক্ষ এলো। পাত্রপক্ষকে খুব সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করলেন ছোটফুফি। নারী-পুরুষ আলাদা বসার ব্যবস্থা করলেন। বাবাকে দিয়ে ঘোষণা দিয়ে দিলেন, কোনো গায়রে মাহরাম মেয়েকে দেখতে পারবে না। শুধু পাত্র এবং পাত্রের মা, বোন, খালা অর্থাৎ মেয়েরা শুধু মেয়েকে দেখতে পারবে।

পাত্রপক্ষ আসার আগে ফুফি আমাকে ভালোমতো বুঝিয়ে দিলেন পর্দার গুরুত্ব। কার কার সামনে যাওয়া যাবে না সেটাও বলে দিলেন। আমিও মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, ফুফির কথা অক্ষরে অক্ষরে মানবো। কারণ রাফিনকে ছেড়েছি ও আমার জন্য গায়রে মাহরাম, অবৈধ বলে। সেখানে অপরিচিত এসব মানুষের সামনে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। পারলে আমি পাত্রের সামনেও যেতাম না। যেই চেহারা রাফিনকে দেখাতে পারবো না সেই চেহারা বিয়ের আগে অন্য কোনো পরপুরুষকে দেখাতে আমার অসহ্য লাগবে।

আমি শাড়ির সাথে ভালোভাবে হিজাব করে রুমে বসেছিলাম। প্রথমেই এলেন পাত্রের মা এবং বোন। আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। কি পড়ি, কি করি সব জিজ্ঞেস করলেন। ছোটফুফি সর্বক্ষণ আমার পাশে ছিলেন। শেষমুহুর্তে জুস আনতে রুমের বাইরে চলে গেলেন। ঠিক সেই মুহুর্তেই পাত্রের মা তার মেয়েকে বললেন,
“যা, তোর বাবা আর ভাইদেরকে ডেকে নিয়ে আয়। ওরা না মেয়ে দেখতে চেয়েছিলো? মেয়ে দেখতেই তো এসেছে।”
আমি দ্রুত বললাম, “আমি ওদের সামনে যাবো না। প্লিজ ডাকবেন না কাউকে।”

মেয়েটা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়লো। মা আবার তাড়া দিলেন, “যা বলছি।”
মেয়েটা চলে গেল। আসতে দেরী হচ্ছে দেখে পাত্রের মা আমাকে বললেন,
“মা চলো, ওরাও দেখতে এসেছে তোমাকে। ওরা তো দূরের কেউ না। তেমার স্বামীর বাবা, ভাই, কাজিন।”

আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম,
“উনি এখনো আমার স্বামী হননি।”
“হননি তো হবে।”
এরপর মহিলা আমাকে জোর করে টানতে টানতে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন। প্রথমবার শাড়ি পড়ায় বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম আর মহিলা হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ড্রইংরুমে একগাদা ছেলের সামনে গিয়ে থামলেন তিনি। চোখে পানি চলে এসেছে আমার। হিজাব টেনে মুখটা ঢেকে রাখলাম। পাত্রের মা হিজাব ধরে টানাটানি করতে লাগলেন। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। আমার বাড়ির লোকজন সব কোথায়? কেউ কি দেখছে না আমার অবস্থা? বাবা, নাকীব ওরা তো এখানেই থাকার কথা। ওরা কই? মা বা ছোটফুফি কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।

টানাটানির একপর্যায়ে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলো,
“মামী, ছেড়ে দাও ওনাকে।”

কন্ঠ শুনে চোখের পানি বন্ধ হয়ে গেল আমার৷ ঝট করে ফিরে তাকালাম কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে। রাগে লাল হয়ে যাওয়া চিরচেনা সেই চোখজোড়া দেখে থমকে গেলাম আমি। ক্ষণিকের তীক্ষ্ণ রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে হারাম ভুলে আবার ঘায়েল হলাম তার প্রেমে।
সেই কন্ঠস্বরের নির্দেশ এলো আবার,
“যান, ভেতরে যান, কুইক।”

আদেশ পেয়ে মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে হিজাব টেনে দূরে সরে দাঁড়ালাম। ঠিক সেই মুহুর্তে বাবা এলেন ওখানে। নাকীবও এলো। বাবা অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন সবার দিকে। নাকীব আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। এরপর শুনলাম বাবা খুব রেগে কথা বলছেন। রুমে চলে আসায় সব স্পষ্ট শুনতে পেলাম না। কিংবা আমার কর্ণদ্বয়ে কোনো শব্দই আপাতত পৌঁছাচ্ছে না।

ভেতরে গিয়ে থ মেরে বসে রইলাম। ফুফি ধমকে বললেন,
“কতবার মানা করেছি যাবি না। তাও গেলি কেন? কে হয় ওরা তোর? যেতে বললেই যেতে হবে? নাকি টেনে নিয়ে গেছে? বাঁধা দিসনি কেন?”

আমি জবাব দিলাম না৷ সেই শক্তি আমার নেই। আমার মনে এখন বিরাজ করছে শুধুই রাফিন। রাফিন কেন এসেছে? পাত্র কি ও নিজেই? সারপ্রাইজ দিবে বলে সেদিন এত ঝগড়া করলো? কিন্তু ঐ মহিলাকে ও মামী বললো কেন? ফুফি তো বলেছে, মহিলা পাত্রের মা। তবে কি ফুফি ভুল করলো? যদি উনি রাফিনের মা হয় তাহলে তো বাসার কেউই বিয়েটা মেনে নিবে না। রাফিনের পরিবার তো এমন না জানি আমি। তাহলে এরা কারা? রাফিন কেন ওদের সাথে?

ফুফি নিজের মতো বকাবকি করে চলে গেলেন। নাকীব এলো। ওর হাতজোড়া শক্ত করে ধরে কান্নাভেজা গলায় বললাম,
“রাফিন কেন এসেছে?”
“পাত্রের বন্ধু সে।” নাকীবের নির্বিকার জবাব।

আমি ঢোক গিলে নাকীবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো। এই আমি নাকি রাফিনের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিচ্ছি। ওর এক দৃষ্টিতেতেই তো আমার ভেতর-বাহির ওলটপালট হয়ে গেল। আমি কিভাবে অন্যকারো হবো? ইয়া আল্লাহ! রহম করো আমায়। সঠিক পথ দেখাও।

পাত্রের মা আবার এলেন ঘরে। এবার ছোটফুফি ও মা পাশেই ছিলেন। পাত্রের মা এসে বললেন,
“আমাদের ড্রাইভার তোমাকে দেখতে চায়। তখন যে সামনে গেলে না ও তখন ছিলো না। আমাদের অনেক পুরোনো ড্রাইভার। একদম ঘরের সদস্যের মতো।”

আমি, মা এবং ছোটফুফি মহিলার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। আমি ছোটফুফির দিকে তাকালাম। স্পষ্ট দেখলাম রাগে ছোটফুফি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।

রাগী অথচ অত্যন্ত শান্তস্বরে ছোটফুফি বললেন,
“পর্দা করতেও শক্তি লাগে। দৈহিক নয় ঈমানী শক্তি। যেটা আপনাদের নেই। এতক্ষণ অনেক ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা এই পরিবারে আগে কখনো ঘটেনি। তাও ভদ্রতার খাতিরে চুপ ছিলাম। এখন খুবই সম্মানের সাথে বলছি, এই মুহুর্তে, ঠিক এই মুহুর্তে আপনি আপনার দলবল নিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে, আমার বাড়ি থেকে দূর হবেন। এক্ষুনি।”

মহিলা রাগে থমথম করতে লাগলেন। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই মা বললেন,
“যান নিজের ড্রাইভারকে কোলে বসিয়ে রাখুন। যান, যান।”

মহিলা আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। মা ওনাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিলেন না। ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বাবাকে সুন্দর করে ডেকে বললেন,
“ওগো, এই শক্তিহীন, দূর্বল, অবলা প্রাণীগুলোকে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও তো।”

.

সবাই চলে যাওয়ার পর ফুফি আমাকে বললেন,
“মন খারাপ করিস না। শোন, প্রিয় নবী সা. বলেছেন, কাউকে ভালোবাসলে আল্লাহর জন্য ভালোবাসতে। এদের এখনো ক্ষমতা হয়নি আল্লাহর ভালোবাসা বোঝার।সুতরাং ধৈর্য ধর। সবকিছু ভালো হবে ইন শা আল্লাহ।”

মনে মনে বললাম, “আল্লাহর জন্যই তো ভালোবাসতে চাই। পারছি আর কই? সে তো মানছে না।”
এতক্ষণ জমিয়ে রাখা অভিমান, রাগ, ক্ষোভ সব বৃষ্টি হয়ে আমার চোখ বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। নিজেকে এত অসহায় আগে কখনো লাগেনি।

রাফিন সন্ধ্যায় টেক্সট করে। কি টেক্সট করেছে জানি আমি। তাই আর সিন করলাম না। এরপর রাতে ফোন দেয়। পরপর দু’বার কল কেটে দিলাম। ভালো লাগছে না কথা বলতে। রাফিনের ওপর অভিমানটা আরও গাঢ় হচ্ছে। নিজের বন্ধুর জন্য পাত্রী দেখতে আসছে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে। অথচ নিজে পাত্র হয়ে আসতে পারছে না। এমন ছেলের সাথে কথা না বলাই ভালো।

রাফিন আবার টেক্সট করলো,
“এনি প্রবলেম? ফোন ধরছো না কেন?”

সিন করলাম না। আজকে ও গাদা গাদা লোকের সামনে আমার সম্মান হয়তো বাঁচিয়েছে, এজন্য আমার বেহায়া মনে আবার ভালোবাসা উতলে উঠছে। অথচ ওকে বললে বলবে, “এজ আ হিউম্যান আমি এটা করেছি। তোমাকে ভালোবাসি বলে না। তোমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলেও আমি সেম কাজটাই করতাম।”
হুহ। এই কাজ অন্যকারো ক্ষেত্রে করলেও আমি খুশি হতাম। খুশি হতাম এই ভেবে যে, কোনো মেয়ের অসম্মান ও হতে দেয়নি। বাঁচিয়েছে অসম্মানের হাত থেকে। কিন্তু আমাকে বলার সময় তো এগুলো আড়াল করা যায়। ঠোঁটকাটার মতো হরবর করে সব বলে দিতে হবে কেন? মানুষের মন রক্ষা কিংবা খুশি করা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। বিয়ের পরও এমন করবে কিনা কে জানে? রাসূল সা. তো বলেছেন, স্ত্রীকে খুশি করার জন্য মাঝেমধ্যে মিথ্যে বলা যায়। যেমন; বলা যায়, আজ তোমাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। রাফিন কি বিয়ের পরও কখনো এসব বলবে? নাকি ঠোঁটকাটার মতো বলবে, “তোমার মুখটা তেলতেলে দেখাচ্ছে আজ। ঘুম থেকে উঠেছো বুঝি?” হাহ!

আবার টুং করে শব্দ হলো ফোনে। আমার ধ্যান ভেঙ্গে গেল। আকাশকুসুম কল্পনা করছি। রাফিনের সাথে আমার বিয়ে অসম্ভব। বরং আমাদের দূরত্ব বেড়ে যাতে পারে, মিল হওয়া জাস্ট অসম্ভব।

রাফিন এবার ভয়েস রেকর্ড পাঠালো। আমি সিন না করে আর পারলাম না। দ্রুত সিন করে ভয়েস শুনলাম,
“জানতাম ভয়েস রেকর্ড পাঠালে সিন না করে থাকতেই পারবে না। হাহাহিহি!”

আমি রেগে যেতে গিয়েও গেলাম না। কারণ এরমধ্যেই আরও একটা ভয়েস রেকর্ড এসেছে৷ ওপেন করতেই শুনলাম কর্কশ গলায় বড়সড় একটা ধমক।
“পিক আপ দ্যা ফোন।”
আমি লিখে পাঠালাম, “নো নিড!”

রাফিন আরেরকটা টেক্সট করলো, ”আই ওয়ান্ট টু মিট ইউ টমরো! ইট’স ইমার্জেন্সি।”
আমি আবার লিখলাম, “নো নিড!”

আমি জানি রাফিন এখন চূড়ান্ত রেগে যাবে। দু’মিনিট পর দেখলাম ও অলরেডি অফলাইনে চলে গেছে। তারমানে রেগেছে ভীষণ। হুহ! করুকগে রাগ৷ অত রাগের আর ধার ধারি না আমি। আমাকে বিয়ে করে নিতে বলা? করে নিবো বিয়ে৷ হুহ! এখন জ্বলছে কেন? জ্বলুক, জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাক। এতদিন আমি জ্বলেছি এবার নিজে জ্বলেই দেখুক। বুঝুক যন্ত্রণা কতখানি।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here