অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-২৩

0
619

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২৩

পরদিন সকালে রিয়াদের মেসেজের রিপ্লাই দিলাম।
ও বললো, “মিট করে সামনাসামনি বলি সব?”
“আচ্ছা। তাহলে শাওনদেরসহ ডেকে নিই? মিট যখন করবো একসাথেই করি।”
রিয়াদ সোজা না করে দিলো। বললো,
“কাউকে ডাকার দরকার নেই। তোকে তেকেছি তুই একা আসবি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় মিট করবি?”
“কলেজ ক্যাম্পাসে।”

বিকেল চারটার দিকে ও এসে আমায় ড্রপ করে নিলো। কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে বসলাম আমরা। রিয়াদকে দেখার পর অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে একটা কথায় বেরুলো,
“তোর এই অবস্থা কেন?”

রিয়াদের চোখগুলো লাল হয়ে আছে। চোখ ফোলা ফোলা। কেঁদেছে নাকি সারারাত? উসকোখুসকো চুল। কতদিন চুলে হাত দেয়নি কে জানে!

“আমার ভীষণ দিশেহারা লাগছে।”
“কিন্তু কেন? কি এমন হয়েছে?”
“আমি একজনকে ভালোবাসি কিন্তু বলতে পারছি না। বলার আগেই সে বোধহয় হারিয়ে গেছে।”

এবার আমি দিশেহারা বোধ করতে লাগলাম। আমি নিজের সম্পর্কই ছিন্ন করে এলাম হারাম বলে। এখন আবার রিয়াদের হারাম রিলেশনে হেল্প করতে হবে নাকি?

“পুরো ঘটনা খুলে বল। তারপর নাহয় বুঝবো।”
রিয়াদ গলা খাঁকারি দিয়ে কাশলো। শার্টের টপ বোতামটা খুলে নিলো। চোখ-মুখ মুছে বলা শুরু করলো,
“আমি একজনকে ভালোবাসি৷ একতরফা! যেদিন ওকে প্রথম দেখি সেদিন থেকে কারণে অকারণে ওকে দেখতে মন চাইতো। দেখতে মন চাইলেই ওকে নিয়ে ঘুরতে চলে যেতাম।”

“এই না বললি তাকে ভালেবাসি বলিসনি? তো ঘুরতে নেওয়ার মানে কি?”
“আমাদের তো রোজই কথা হতো। তারপর একসময় ফাইনাল এক্সাম হয়ে যাওয়ার পর আমাদের দেখা হওয়া কমে যেতে থাকে। একপর্যায়ে পুরোপুরি থেমে যায়। ওকে না দেখতে পেয়ে আমার অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি হৃদি। রাতের পর রাত আমার ঘুম হয় না। আমি মরে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে বাঁচা।”

রিয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। আমার ভীষণ অবাক লাগলো। ভালেবাসা মানুষকে এত অসহায় করে তোলে কেন? রিয়াদের সাথে পরিচয়ের পর থেকে ওকে আমি কক্ষনো কাঁদতে দেখিনি। কাঁদা তো দূর আমাদের মধ্যে সর্বদা হাসিমুখে থাকা মানুষটা ও।

“মেয়েটা কে দোস্ত? মনে তো হচ্ছে আমাদের ভার্সিটির কেউ।”
“আমাদের ক্লাসেরই।”
“আমাদের ক্লাসের? কে? নাম বল?”
“তুই…” বলে সামনে কাউকে দেখে থেমে গেল রিয়াদ।

আমিও ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেদিকে তাকালাম। আমাদের ক্লাসমেট সোহা দু’প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। ওর সাথে আগে কখনো তেমন কথা হয়নি৷ টুকটাক পড়াশোনার ব্যাপারে কিংবা দেখা হলে কুশলাদি পর্যন্তই।

সোহা এসে আমার পাশে বসে মিষ্টি করে হাসলো। রিয়াদকে দেখলাম সোহাকে দেখার পর থেকে ও কেমন চুপসে গেছে। সোহা আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো,
“ভাবলাম কারো সাথে শেয়ার করে খাবো। বাট তোমরা তো দুজন বসেই আছো। চেনা কাউকে একা পেলাম না।”
“তুমি হঠাৎ কলেজে?”
“এমনিই ঘুরতে এলাম।”

আমি রিয়াদের দিকে তাকালাম। ওর দৃষ্টি, নড়াচড়া সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, সোহাকে দেখে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে ও। একটু আগেও তো ঠিক ছিল। ও যাকে ভালোবাসে মেয়েটা কোনোভাবে সোহা নয়তো? ‘তুই’ বলে থেমে গিয়েছিল কেন তখন? নাকি ‘তুই’ বলার পর থেকে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। মেয়েটা কি…? না থাক, আগ বাড়িয়ে ভেবে লাভ নেই। বরং একটা পরীক্ষা করা যাক।

আমার ঝালমুড়ির প্যাকেটটা রিয়াদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “তুই খা। নিকাব করে আছি তো খুলে খেতে পারবো না।”

সোহা ‘না, না ’ বলে একপ্রকার জোর করেই প্যাকেটটা রিয়াদকে দিতে দিলো না৷ বললো,
“আমারটা থেকে বরং ও খাক। আমার সাথে শেয়ার করবে রিয়াদ?”

রিয়াদ সোহার দিকে একপলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। তারপর নিজ থেকে খেলো সোহার প্যাকেট থেকে। না দেখে খেতে গিয়ে জিহ্বায় মরিচ লেগে যায় ওর। হু হা করে মুহুর্তেই চোখ ভিজিয়ে একাকার করে ফেলে। সোহা ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাথা চাপড়ে দেয়। আমি আঁড়চোখে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর অভিনয়টা ভালোই ধরতে পেরেছি। বোকা সোহাটা ওর অতি কেয়ারিংয়ের দরুণ ধরতে পারেনি।

আমি বললাম, “সোহা, ওর বোধহয় আইসক্রিম খেলে ভালো লাগবে।”
আমার বলতে দেরী হলো কিন্তু সোহার যেতে দেরী হলো না। ও ছুটে বেরিয়ে গেল। আইসক্রিমের দোকান থেকে ঘুরে আসতে কমপক্ষে পনেরো মিনিট লাগবেই৷ সোহা যেতেই রিয়াদকে বললাম,
“বল বল, তোর পরের কাহিনি বল? মেয়েটা কে ছিল?”

রিয়াদ হু হা করতে করতে আমার দিকে তাকালো।
“আমার এত ঝাল লেগেছে আর তুই কাহিনী শুনতে চাইছিস?”
“অভিনয় ওর সাথে করিস, আমার সাথে না। এটা প্যাকেট ঝালমুড়ি। এখানে কোনো কাঁচা মরিচ থাকার কথাই না। ঝালে একদম মরে যাচ্ছিস যেন।”

রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আমাদের সামনের বাসায় থাকতো মেয়েটা। রোজ আমরা একসাথে ভার্সিটি আসতাম, যেতাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমাদের দেখা হওয়া কমে গেল। বারান্দায় যা-ও একটু দেখা হতো সেটাও একসময় বন্ধ হয়ে গেল। ওরা বাসা বদলে আরেক জায়গায় চলে গেল। এরপর শুধু ফোনে কথা হলো অনেকদিন। এখন সেটাও বন্ধ হওয়ার যোগাড়। ওকে অনবরত পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে আর আমি এখনো “ভালোবাসি” বলতেই পারলাম না।

“মেয়েটা কে সেটা তুই আমাকে পরে বলবি। আগে আমার সাজেশন শোন৷ তোর বাবা মা তো তোর পছন্দকে জীবনেও না বলবে না। তুই সরাসরি ঐ মেয়ের বাসায় প্রস্তাব পাঠাবি৷ তার আগে বাবা-মাকে কিভাবে মানাবি বলি৷ তুই বলবি, আমি নিজের নফসকে হারাম থেকে দূরে রাখতে, অবৈধ সম্পর্কে না জড়িয়ে বৈধ সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে চাইছি৷ যাতে আমার দৃষ্টির যথাযথ হেফাজত আমি করতে পারি। বুঝলি?”

“সত্যি এটা বলবো?”
“তো কি বলবি আর? এটার জন্যই তো বিয়ে করতে চাইছিস। তাছাড়া মেয়েটার বাবাও তোকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না কোনোমতেই। তোর তো কোনো দিকে কমতি নেই তাই না?”

“জানি না কি হবে। তবে আমি জানতাম তুই কোনো না কোনো সলিউশন দিবিই দিবি৷ এজন্যই হন্য হয়ে তোকে খুঁজছিলাম। থ্যাংক ইউ দোস্ত। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“মোস্ট ওয়েলকাম। আচ্ছা শোন, তোকে আমি হালাল রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি এরপর একটা হারাম রাস্তা তোর নিজ হাতে বন্ধ করে দিতে হবে।”
“কি সেটা?”
“আজই তোর সাথে আমার শেষ কথা। আর কখনো আমি তোর সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো না, তোর সাথে কথাও বলতে পারবো না।”

রিয়াদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। একপর্যায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“মানে?”
“আমি তোর সাথে কথা বলছি এতে আমার যেমন গুনাহ হচ্ছে, তোরও হচ্ছে। আমাদের উচিত বন্ধুত্বের নামে অবৈধ মেলামেশা থামিয়ে দেওয়া। শোন রিয়াদ, তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস আমি তোর সাথে শত্রুতা করে কিংবা তোর প্রতি কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে কথা থামিয়ে দিচ্ছি এমনটা কিন্তু না। শুধুমাত্র গুনাহ, আর আল্লাহর ভয়ে।”

রিয়াদ হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ওকে আরও ভালোভাবে বোঝাতে বললাম,
“তোদেরকে বলেছিলাম না আমার বয়ফ্রেন্ডের কথা। যাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি৷ গতরাতে তার সাথে শুধুমাত্র গুনাহের কারণে সব সম্পর্কের ইতি টেনেছি৷ যদি বৈধভাবে ও আমার কাছে আসতে পারে তো আসবে নাহয় আমাদের আর কখনো কথাও হবে না, দেখাও হবে না৷ সব যোগাযোগ চিরতরে বন্ধ থাকবে।”

রিয়াদ অনেকক্ষণ পর বললো, “তোর এত পরিবর্তন কিভাবে হলো? যদিও এটা খুব ভালো দিক আমি বুঝতে পারছি।”

“হেদায়েত দোস্ত, হেদায়েত। হেদায়েতের সৌভাগ্য সবাই পায় না। আমি বড়ই ভাগ্যবতী৷ আল্লাহ আমাকে সেই সৌভাগ্য দিয়েছেন। আমি চাই না হেলায় ফেলায় হেদায়েত হারাতে।”

রিয়াদ মাথা নাড়লো। আমি বললাম, “নিজের নফস ও দৃষ্টিকে হেফাজতে রাখিস। আর হ্যাঁ এবার বলতো, মেয়েটা কে?”

“সোহা…” বলে আবার সামনে তাকিয়ে থেমে গেল ও।
সোহা হন্তদন্ত হয়ে এসে রিয়াদকে আইসক্রিম দিলো। রিয়াদ আইসক্রিমটা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সোহা, বাসায় যাও। আমার ঝাল চলে গেছে।”
“মানে?”
সোহা বোধহয় এটা আশা করেনি। এতদূর থেকে কষ্ট করে আইসক্রিম আনার পর রিয়াদের ব্যবহারটা ওর সহ্য হলো না৷ আমি নিজেই হতবাক মুহুর্তেই ওর পরিবর্তন দেখে।

রিয়াদ বললো, “যেতে বলেছি যাও। বিয়ের প্রস্তুতি নাও।”
সোহা কি বুঝলো কে জানে। খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে চলে গেল ও।

আমি রিয়াদকে আস্তে করে বললাম,
“বিয়ের পর ঠিক এরকম একটা আইসক্রিম নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আজকের দিনের জন্য স্যরি বলে দিবি। ব্যস! রাগ উবে যাবে।”

রিয়াদ আমার দিকে না তাকিয়েই মুচকি হাসলো। খানিকটা আমার দিকে ফিরে বললো,
“তোকে বিয়েতে দাওয়াতও দিতে পারবো না?”
“দরকার নেই তো। তোরা সুখে থাকলেই হলো। আমি নাহয় তোদেরকে দোয়ায় রাখবো। আর দাওয়াতের চেয়ে তুইও বরং আমায় দোয়ায় রাখিস।”

“অবশ্যই। আচ্ছা, বিয়ে হয়ে গেছে এমন একটা মেসেজ তো অন্তত দিতে পারি?”
“আচ্ছা ঠিক আছ মেসেজ দিস। আমি সিন করবো বাট রিপ্লাই পাবি না কিন্তু। এটার জন্য আবার মন খারাপ করতে পারবি না।”
“আরে না, এটুকুতেই আমি খুশি।”
“যাই তাহলে?”
“হুম।”

চলে আসছিলাম। পেছনে ফিরে তাকাতে গিয়েও তাকালাম না। আমি জানি রিয়াদও আমার দিকে তাকিয়ে নেই। আমার এক কথায় ও মুহুর্তেই দৃষ্টির হেফাজত করতে শুরু করে দিয়েছে। আমার চেয়ে ভালো কে জানে, রিয়াদ আমার কত ভালো বন্ধু ছিল? সবসময় সব কাজে সাপোর্ট দিতো আমাকে। আজ অবৈধ বলে ওকে ত্যাগ করতে হচ্ছে আমাকে। আমার এক কথাতেই সব মেনে নিলো ও। এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। মনে মনে এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম যে,
“যাক! আরও একটা হারাম সম্পর্কের ইতি ঘটলো।”

বাসায় এসে আবার দু’রাকাত তওবার নামাজ পড়লাম। অতীতের গুনাহের সমাপ্তি টানলাম। হারাম সম্পর্কের বোঝা পুরোপুরি নেমে গেছে কাঁধ থেকে আলহামদুলিল্লাহ।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

[ বি.দ্র: উৎসাহ হারিয়ে অনেকটা অগোছালোভাবে লিখেছি আজকের পর্বটা। এই উপন্যাসটা আমাকে আর টানছেই না। এত নিরুৎসাহিত আর আশাহত হচ্ছি প্রতিটা পর্ব পোস্টের পর। আর কয়েকদিন এরকম নিরুৎসাহিত দিন চললে হয়তো “অগত্যা তুলকালাম” দেওয়া থেমে যাবে।
আবার হতেও পারে, ফেসবুকে দেওয়া এটাই আমার শেষ এবং অসম্পূর্ণ উপন্যাসে পরিণত হবে… 💔 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here