#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ২৪
রমজান মাস শেষ হয়। এই পুরোটা মাস আমার কেটেছে ইবাদতে। পুরোদমে মিশে গিয়েছিলাম নামাজ-দোয়ার সাথে। ঘর থেকে বেরুনোও বন্ধ করে দিলাম৷ বেরুলেও হাত মোজা, পা মোজাসহ বোরখা-নিকাবে আবৃত্ত হয়ে বেরোই। একদিন কিছু বই কিনতে বাবার সাথে বাইরে গিয়েছিলাম। সেদিন বৃষ্টি ছিল খুব। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম গাড়ির অপেক্ষায়। যাত্রী ছাউনিতে অপেক্ষা করছিলাম। তুমুল বৃষ্টি হওয়ায় একটাও গাড়ি রাস্তায় দেখা যাচ্ছিলো না। যা-ও এক-দুটো আসছিলো সেগুলোও চোখের পলকে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখলাম কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে কি যেন খাচ্ছে। খাবারের প্যাকেটটা শার্টের নিচে ঢুকিয়ে রেখেছে যাতে খাবার ভিজে না যায়। আমার বেশ অবাক লাগলো। বাবাকে বললাম,
“ওরা তো চাইলেই ছাউনির নিচে এসে খাবারটা খেতে পারতো তাই না বাবা?”
“প্যাকেটটা যখন হাতে পেয়েছে তখন হয়তো এতদূর আসার তর সয়নি ওদের। কয়দিনের অভুক্ত কে জানে?”
বাবাকে বেশ আশাহত দেখালো।
আমি বললাম, “বাবা, ওদের দায়িত্ব যদি আমি নিই তুমি কি বাঁধা দিবে?”
বাবা অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। পরক্ষনেই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুই দায়িত্ব নিবি কেন?”
“কারণ ওদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।”
“ওরা ওদের মতো ভালো আছে। আর তোর যদি বেশি ইচ্ছে হয় হাতে কয়েকশো টাকা দিয়ে দে। আরও বেশি ইচ্ছে হলে একবেলা রেষ্টুরেন্ট থেকে খাইয়েও আনতে পারিস।”
“না বাবা, ওরকম না। আমি ওদেরকে বাসায় নিয়ে যেতে চাই।”
“কিহ? পাগল নাকি? ওদের মধ্যে অনেকেই আছে যাদের অভ্যাস হচ্ছে চুরি করা। তুই ঘরে নিয়ে গেলি আদর করে পরদিন দেখা গেল মূল্যবান জিনিস নিয়ে ওরা পগারপার।”
“বাবা, ওরা অভাবে পড়ে চুরি করে। অভাব না থাকলে তো চুরি করবে না।”
“অভাব থাকবে না? মানুষের আবার চাহিদার শেষ আছে নাকি? অভাবে পড়ে ওদের স্বভাবই নষ্ট হয়ে যায়। শোন, এসব টোকাই ছেলেগুলো গল্প-উপন্যাসেই ভালো হয়৷ বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। তুই যদি এখন আমার কথাগুলো বইয়ের পাতায় পড়তি তাহলে আমাকে তোর ভিলেন মনে হতো বুঝলি?”
“বাবা প্লিজ, সব বুঝলাম তো। আচ্ছা শোনো না, আমি ওদেরকে ঐ যে আমাদের বাইরের ঘরটা আছে না ওখানে রাখবো। পরে ওদের জন্য অন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করবো।”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তোর অত সামর্থ্য আছে?”
“বাবা, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে নিজের অল্প সামর্থ্যের মধ্যে থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করে সেই সর্বোত্তম। ধরো, তোমার কাছে অঢেল সম্পদ আছে। তার থেকে তুমি অনেক কিছু দান করলে। দান করার পর তুমি যে সওয়াবটুকু পাবে তারচেয়ে বেশি পাবে যখন তোমার কাছে দুই দিরহাম রয়েছে কিন্তু তার থেকে এক দিরহাম তুমি দান করে দিলে। সেটাই আল্লাহর কাছে অধিক গ্রহনযোগ্য হবে।”
“আচ্ছা রে মা বুঝলাম। তোর মাকে রাজি করাতে পারলে তবেই…”
আমি খুশি হয়ে সামনে তাকাতেই দেখি ছেলেগুলো নেই। হতাশ হতে গিয়েও হতাশ হলাম না৷ কারণ মুমীনরা কখনো হতাশ হয় না, সবসময় সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে। আমিও ভরসা রাখলাম।
বাসায় এসে মাকে জানাতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে মা রাজি হয়ে গেলেন৷ গরীব-দুঃখীদের প্রতি স্বভাবতই মায়ের অনেক টান। পরদিন গিয়ে অনেক খোঁজার পর ছেলেগুলোকে খুঁজে পাই আমি। প্রথমে ওরা আসতে কিছুতেই রাজি হয় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমরা কোথায় থাকো?”
“আকাশের নিচে, মাটির উপরে।” পাঁচবছর বয়সী একটা ছেলে জবাব দিলো।
আমি মুচকি হেসে বললাম, “সে তো আমিও থাকি। আবাসস্থল মানে বাড়ি কই তোমাদের?”
“আমাদের তিনকূলে কেউ নেই, বাড়ি কোত্থেকে আসবে?” আটবছর বয়সী ছেলেটা কথা বললো।
আমি ওদেরকে নিয়ে গিয়ে গাছতলায় বসলাম। সাথে করে খাবার নিয়ে এসেছি। ওদেরকে খেতে দিয়েছি। মোট সাতজনের ছোট্ট একটা দল। দুজন মেয়ে বাকীসব ছেলে। আমি প্রথমে সবার চেয়ে বড় মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার নাম কি?”
“কুলসুম।” খাওয়া থামিয়ে বললো মেয়েটি।
“বাহ! খুব সুন্দর নাম। কে রেখেছে নামটা?”
“জানিনা। কেডায় জানি রাখছিলো।”
“খুব সুন্দর আর অর্থবহ তোমার নামটা৷ আমাদের প্রিয় নবীজীর মেয়ের নামও কুলসুম, জানো?”
মেয়েটা দু’পাশে মাথা নাড়লো। আমি বললাম,
“আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে?”
“ইচ্ছা তো করতাছে বিশ্বাস করি কিন্তু বারবার তো ঠকতে মন চায় না আপা।”
আহারে! ছোট্ট এই জীবনে কতবার যে ছোট্ট শিশুগুলোকে ঠকতে হয়েছে। পৃথিবীর মানুষগুলো এত নিষ্ঠুর কেন?
আমি বললাম, “তুমি নিশ্চিন্তে আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি তোমাদেরকে ঠকাবো না, কথা দিলাম। যাবে আমার সাথে?”
কুলসুম কিছু বলার আগেই আট বছর বয়সী ছেলেটা এসে বললো,
“আপা, ছবি তুলবেন না?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “কিসের ছবি?”
“খাবার দিলেন যে আমাদের? খাবারশুদ্বা ছবি তুলে নিবেন না?”
আমার মনটা তাৎক্ষণিক বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেল। সত্যিই পৃথিবীর মানুষগুলো স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। একটু শো-অফ করবে বলে কত কিই না করে। অথচ এগুলো যদি আল্লাহর জন্য করতো কতশত সওয়াব যে আমলনামায় যুক্ত হতো!
আমি ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
“না বাবু, আমি কোনো ছবি তুলতে আসিনি। তোমাদেরকে দেখে ক্ষুদার্থ মনে হয়েছে তাই খাবার দিতে এসেছি।”
সবাই বেশ অবাক হলো মনে হলো। হয়তো আগে কেউ এভাবে বলেনি। ওদের ক্ষুধা হয়তো কারো চোখে পড়েনি৷ আমি বললাম, “তোমাদেরকে কিছু কথা বলবো?”
সবাই উৎসুক হয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম, “পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তাই ক্ষুধার্ত, দরিদ্র ব্যক্তিকে খাবার দানের মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী বান্দা হিসেবে গণ্য হতে পারি। ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাবার দানকারী ব্যক্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ পাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে আমরা তোমাদের খাবার দান করি, তোমাদের নিকট এর কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না।’ (সুরা দাহর, আয়াত : ৯)।
সেদিন বৃষ্টির সময় দেখলাম তোমরা খোলা আকাশের নিচে বসে কি যেন খাচ্ছো। দেখে আমার এত খারাপ লাগলো ইচ্ছে করলো তখনই আমার বাসায় নিয়ে গিয়ে তোমাদের খাওয়াই। আমি তোমাদেরকে খাওয়ানোর বদলে তোমাদের কাছে কিচ্ছু চাই না৷ তোমাদেরকে ক্ষুদার্ত দেখেছি বলে খাইয়েছি এর বেশি কিছু না।”
কুলসুম বললো, “আপা, আপনে কিছু মনে কইরেন না। আমরা তো জন্ম থেকেই ঠকতে ঠকতে আসছি এজন্য এখন আর কাউরে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আমরা আপনেরে বিশ্বাস করছি আপা। বিশ্বাস করেন।”
কুলসুমের গালে হাত রেখে বললাম,
“আমি কিছু মনে করিনি কুলসুম। আচ্ছা তুমি যেহেতু বলছো আমাকে বিশ্বাস করেছো তাহলে আমার একটা কথা রাখবে?”
“বলেন আপা।”
“তোমরা আমার সাথে আমার বাসায় যাবে?”
ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আমি বললাম,
“আমি তোমাদেরকে স্কুলেও ভর্তি করে দিবো। তোমাদেরকে আর কষ্ট করে খেঁটে খেতে হবে না।”
ওরা নিজেরা কিছুক্ষণ আলোচনা করে বললো,
“আপনার সাথে যাওয়াই যায়। আপনের মতো করে কেউ আমাদেরকে ভালোবেসে খাওয়ায়নি আপা। আমরা যাবো আপনার সাথে।”
আমার এত খুশি লাগলো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ছোট একটা ছেলে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় আমাকে বললো,
“আপা, তুমি বললা না ঐদিন বৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখছো, আসলে সেদিন বস্তি থেকে আমাদেরকে বাইর কইরা দিছিলো। কই থাকবো বুঝতাছিলাম না৷ আল্লাহ ছাড়া কেউ আছিল না আমাদের। আল্লাহই তোমারে পাঠাইছে আমাদের কাছে। তুমি অনেক ভালা।”
আমি ওদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। একরাশ আনন্দ নিয়ে ওদের সাথে বাড়ি ফিরছি। ভালোবাসা যে কতরকমের হয় আজ বুঝতে পারছি৷
হঠাৎ একটা হাদীস মনে পড়লো আমার৷
মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘দয়াশীলদের ওপর দয়াময় আল্লাহ দয়া করে থাকেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪১)
বাসায় আসতে আসতে ওদের সবার পরিচয় জেনে নিলাম। সবার বড় কুলসুম। ওর বয়স দশ। এরপর যথাক্রমে মাহফুজ, রায়হান, আবরার, আবির, ফাহিম ও ঝিলি। ওদের বয়স যথাক্রমে আট, সাত, নয়, পাঁচ, ছয় ও চার। ঝিলি বয়সে সবার চেয়ে ছোট। একদম কিউট একটা ফুটফুটে মেয়ে।
বাসায় এসে মা, বাবা ও নাকীবকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মা সবচেয়ে বেশি আদর করলেন ওদের৷ দুপুরে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালেন। ঝিলিকে তো নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। বাবা-মা দুজন একসাথে গিয়ে ওদের জন্য চার সেট করে কাপড় কিনে নিয়ে এলেন, জুতো, স্যান্ডেল থেকে শুরু করে চিরুণি পর্যন্ত সব কিনে আনলেন। প্রায় পাঁচ হাজার টাকার শপিং করে তবেই ফিরলেন দুজনে। বাবা তো বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে ঝিলি ছাড়া সবাইকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থাও করে ফেললেন। তবে কুলসুম ও মাহফুজের ভর্তি হতে একটু বেগ পোহাতে হবে। ওদের বয়স একটু বেশি বলে। সেটাও বাবা নিজে গিয়ে ম্যানেজ করবেন বলে জানিয়েছেন।
আমি ছোটফুফিকে ব্যাপারটা জানালাম। শুনে খুব খুশি হলেন ফুফি। আমি ওদের ভরনপোষণের জন্য কিছু একটা কাজ করতে চাই বলার পর ফুফি বললেন,
“আল্লাহর কাছে চাও। আল্লাহর তো দিতে বাঁধা নেই তোমার চাইতে এত আপত্তি কেন? বিশাল বিশাল চাওয়া তুমি মানুষের কাছে না চেয়ে আল্লাহর কাছে চাও। অন্তর লাগিয়ে দোআ করো। কবুল না হয়ে যাবে কোথায়? শুধু কবুলই না অতি শীগ্রই তোমার চাওয়া-ও পূরণ হবে ইন শা আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহকে ডাকো।”
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️