অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-২৭

0
472

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২৭

মাস দুয়েক পর হঠাৎ আবার একটা প্রস্তাব আসে আমার জন্য। আবার পাত্রপক্ষ আসে৷ এবার বেশ প্রস্তুতি নিয়ে তাদের সামনে গেলাম। ছেলেদেরকে আগে থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু পাত্র আছে মা-বোনদের সাথে। আমি যেতেই আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলো,
“রান্না জানো?”
আশ্চর্য! আমার নাম জানতে চাইলো না, কোয়ালিফিকেশন জানতে চাইলো না, কোথায় পড়ি, কি করি, কিচ্ছু না। ফার্স্ট কুয়েশ্চন, রান্না পারো? নিজের মনেই বললাম, “হোয়াট ইস দিজ? আজব!”

থমথমে মুখে বললাম, “পারি না, মা আমাকে কখনোই রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না।”

ছেলের মা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আর কি পারো?”
“আপনি কি কোনোভাবে ভুল করে কাজের লোক খুঁজতে এসেছেন এই বাড়িতে? দুঃখিত! এখানে কাজের লোক সাপ্লাই দেওয়া হয় না।” কথাটা বলার খুব ইচ্ছে হলেও বলতে পারলাম না।
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম, “কিছুই পারি না।”

ছেলের খালা বললো, “আপা, ছেলে-মেয়ে দুজন নাহয় একা কথা বলুক।”
খালার কথায় আমার হাসি পেয়ে গেল। দুজন আবার একা! হাহা!

যাইহোক, ছেলেটার সাথে আমাকে আমার রুমে পাঠানো হলো। ছেলেটা ঘুরেফিরে আমার রুম দেখতে দেখতে বললো,
“প্রেম আছে তোমার?”
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। প্রথমেই তুমি সম্বোধন। মিনিমাম ভদ্রতাটুকুও নেই। আবার জিজ্ঞেস করছে প্রেম আছে কিনা? আমার নাম-ধামের কোনো মূল্য নেই? আমি কি গুণের আধার হয়ে, ওদের কামলা খাটতে বিয়ে করবো? মগের মুল্লুক নাকি?”

আমি বললাম, “সেই জবাব তো আমি আপনাকে দেবো না।”
“মানে?” বেশ অবাক হয়ে তাকালো ছেলেটা।
আমি সাথে সাথে জবাব দিলাম না। কিছুটা সময় নিয়ে বললাম,
“মানুষকে কখনোই এমন কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত নয় যেটা তার একান্ত গোপন। যদি বলার হয় সে নিজ থেকে বলবে। ধরুন, আমার প্রেম ছিল, আমি তওবা করে নিয়েছি৷ যখন কোনো মানুষ তার অতীত গুনাহ থেকে তাওবা করে ফিরে আসে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। তাই এধরণের প্রশ্ন করাটাই অযৌক্তিক। আমি যে গুনাহ গোপনে করেছি এবং যে গুনাহের জন্য তাওবা করে নিয়েছি সে বিষয়ে প্রশ্ন করাই উচিত না। একজন মানুষ অতীতে কেমন ছিলো তা দিয়ে তার বর্তমান সময় বিবেচনা করা উচিত না। সাহাবাগণ (রাঃ) যখন কাফের ছিলেন তারা পাপাচারে লিপ্ত ছিলেন, তারা যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন সাথে সাথে সকল গুনাহ ছেড়ে দিলেন। একেকজন হয়ে গেলেন আমাদের জন্য আদর্শ। যারা ঈমান আনার পূর্বে ছিলেন হাজারো পাপাচারে লিপ্ত, তারা ঈমান আনার পর হয়ে গেলেন উত্তম আখলাকে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তান।”

ছেলেটা এরপর জঘন্য একটা কথা বললো। ঠিক তখনই আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ছেলেটা বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে, আপনি ভার্জিন তো?”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলাম। এতক্ষণ কাকে কি বললাম? ঠান্ডা মাথায় এই জানোয়ারকে হ্যান্ডেল করতে হবে। আমিও পাল্টা জবাব দিলাম,
“মে বি আপনি না, ঐ যে যেটা বললেন সেটা আর কি! ঐরকম লেভেলের মেয়ে খুঁজছেন? দুঃখিত! এটা পতিতালয় না। যান, পতিতালয়ে যান। আর আপনার মাকে সুন্দর দেখে একজন সেফ এনে দিয়েন। ফার্দার ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে যেন আর রান্নার লোক না খুঁজে। আপনার ব্যবস্থা তো বলেই দিলাম, পতিতালয়…”

রাগে নাকেমুখে ঝাল উঠে গেল ছেলেটার। ওহ হ্যাঁ, একটু আগে তো নুডলস গিলছিলো। বেশ হয়েছে। ছেলেটা বেরিয়ে গেল কাশতে কাশতে। বেরুলো তো বেরুলো, সরাসরি ‘না’ করে দিয়ে একেবারে বাড়ি থেকে বিদায় নিলো।

ছেলেটা বেরোতেই বাসার সবচেয়ে বড় ফুলদানিটা আছাড় মেরে ঝরঝর করে ভেঙে ফেললাম। বাবা-মা, নাকীব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।

আমি রাগে,ক্ষোভে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“তোমরা আর কখনো আমার জন্য পাত্র দেখবে না, কক্ষনো না। দেখতে হলে দ্বীনদার পাত্র দেখো। আমার সামনে যেন কোনো নরপশু আর না আসে। আমি আর কারো সামনে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে পারবো না। আমাকে এই বাড়িতে রাখতে অসুবিধা হলে বলো আমি চলে যাই।”

বাবা-মা দুজনই এগিয়ে এলেন। বাবা বললেন,
“কি হয়েছে? কি বলেছে ছেলেটা?”
“এখন ঐ নোংরা কথা আমি তোমাকে বলবো বাবা? আমি একটু একটু করে ইসলামের পথে আসছি, আমাকে চলতে দাও না আমার মতো। কেন এরকম আজেবাজে ছেলেকে ধরে এনে আমাকে দেখাচ্ছো? আমি এতটাই মূল্যহীন?”

মা তক্ষুনি বললেন, “ঠিক আছে আর কাউকে বাড়ি আনবো না। সব দেখেশুনে তারপর… নায়হ আগে তোর ছবি দেখবে…”
মায়ের কথা কেঁড়ে নিয়ে নাকীব বললো “ছবি দেখবে মানে? মা, ধরো ছবিটা তুমি ছেলেকে দেখানোর জন্য দিলে। তখন ছেলেটার বাবা, ভাই, বন্ধু থেকে শুরু করে সবাই দেখবে। দেখছো না, এখানে এলেও প্রতিবার পাত্রের বাবাদেরকে মেয়ে দেখানোর জন্য মা’রা কেমন করে? তখন ছবিটা শেয়ার হতে হতে কোন পর্যায়ে যাবে ভাবতে পারছো? তাহলে আপুর আর এত লোকের সামনে নিকাবে আবৃত হয়ে যাওয়ার কি আছে? ও তো খোলামেলা ঘুরতে পারে।”

বাবা বললেন, ”ঠিকই তো, ঠিকই তো। এখন থেকে যা করার বুঝেশুনে করবো।”
এরপর নাকীবকে ডেকে বললেন,
“দেখি এদিকে আয়। আমার ছেলেমেয়েগুলো কত বড় হয়ে গেছে। সব বুঝতে শিখে গেছে।”
বাবা-মা দু’পাশ থেকে আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।

মা অস্ফুট স্বরে বললেন, “টবটা কিন্তু শুধু শুধু ভাঙলি। রাগ শয়তানের কাছ থেকে আসে৷ এত রাগ ভালো না। নিয়ন্ত্রণ করতে শেখ।”
বাবা বললেন, “তাই তো। এই প্রথমবার আমার সাথে তোমার কোনো কথা মিললো।”
নাকীব বললো, “হাদীস সবসময় একই হয় বাবা। না মিলে উপায় নেই।” বাবা-মা হেসে ফেললেন আর আমিও৷

আমি নিজ হাতে টবের ভাঙ্গা টুকরোগুলো পরিষ্কার করলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কখনো জিনিস ভাঙবো না।

এরমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। আমার হঠাৎ দাদুর কথা মনে পড়লো। সেদিনের পর থেকে আর দাদুর সাথে দেখা করা হয়নি। দাদু কেমন আছে কে জানে? নাকীবকে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওকে খুঁজতে খুঁজতে শান্তি কুঠিরের বারান্দায় পাওয়া গেল। বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরছে ও। আমি কাঁধে হাত রেখে বললাম,
“কয়েকদিন পর পরীক্ষা, না পড়ে বৃষ্টিবিলাস করছেন আপনি?”
ও চমকে তাকিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো,
“সবাই ঘুমাচ্ছে, একা কি করবো তাই…”
“চল দাদুকে দেখে আসি।”

নাকীব রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বললো,
”আবার?”
“অনেকদিন খোঁজ নেওয়া হয়নি। কেমন আছে কে জানে?”
“রাফিন ভাইয়াকে নিয়ে যাও।”

আমি কটমট করে তাকাতেই ও ফিক করে হেসে ফেললো। সেদিন বিকেলেই আমি ও নাকীব বের হলাম দাদুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির বাইরে পা রাখতেই মাহফুজ ছুটে এলো। সে-ও নাকি সাথে যাবে। মাহফুজকে সাথে নিয়ে চললাম। আমরা আস্তে আস্তে গিয়ে দাদুর জানালার পেছনে লুকালাম। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম রুম ঝকঝকে পরিষ্কার। কোথাও দাদুর ছিঁটেফোঁটা চিহ্নও অবশিষ্ট নেই। আমার বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ওরা দাদুকে কোথাও সরিয়ে দেয়নি তো? নাকি মেরে-টেরে ফেলেছে? উহ! ভাবতে পারছি না।
আমরা অন্য জানালায় গেলাম। ফুফি আরাম করে বসে পান চিবোচ্ছে। আমরা চলে এলাম। আসার পথে নাকীবকে বললাম, “দাদুর খোঁজ নিতে হবে৷ দাদুকে ওরা কোথায় লুকিয়েছে কে জানে?”
মাহফুজ বললো, “আপা, দাদুর বয়স কত হবে আনুমানিক?”
“বয়স তো বলতে পারবো না, অনুমানও করতে পারবো না ঠিক। অত্যাচারের কারণে এমনিতেই দাদুকে বয়স্ক দেখাতো।”
“তারমানে বয়স্ক মতন, অত্যাচারও করতো।” ঠোঁটে তর্জনী দিয়ে মৃদু টোকা দিতে দিতে মাহফুজ কি যেন ভাবলো। তারপর বললো,
“আপা, আমার মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমে রাইখা আসছে। বুড়ো মানুষরে আর কই সরাইবো? ঐ একটা জাগাই তো আছে। বুড়োগো লাইগা বৃদ্ধাশ্রম, বাচ্চাগো লাইগা অনাথ আশ্রম। তয় অনাথ আশ্রমের ভূমিকা কম আমগো…”

নাকীব ধমকে বললো, “মাহফুজ, সুন্দর করে কথা বলো। এসব কি ভাষা? তয়, আমগো… কতবার বলেছি না সুন্দর করে কথা বলবে। ঝিলিকে দেখেছো, কি সুন্দর করে কথা বলে?”

নাকীবকে থামিয়ে বললাম, “ওয়েট! ও উচিত কথা বলেছে। দাদুকে বৃদ্ধাশ্রমেই নিতে পারে। শোন, কাল থেকে আমরা ভালোমতো খোঁজ চালাবো।”
“অকে।”

সেদিন সারারাত জেগে আমি ও নাকীব এই এলাকায় কয়টা বৃদ্ধাশ্রম আছে সেটা খুঁজে বের করলাম। মাত্র একটা বৃদ্ধাশ্রম। ঠিকানাও জোগাড় করে রাখলাম। নাকীব পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকার বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাও সংগ্রহে রাখলো। বলা তো যায় না, এই এলাকা থেকে সরিয়ে দাদুকে অন্য আশ্রমেও রাখতে পারে।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here