অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৩১

0
630

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৩১

সকাল থেকে ব্যবসায়ের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অবশেষে দুপুরের কিছু আগে ঝামেলা মিটলো। এসে নামাজ-দোয়া শেষে ধুমসে ঘুমালাম। ঘুম ভাঙলো আছরের পর। ঘুম থেকে উঠে রাফিনের জন্য খারাপ লাগতে শুরু করলো। আমার এরকম মাঝেমাঝেই হয়। দুপুরে ঘুম ভাঙার পর হঠাৎ কার জন্য যেন মনটা পুড়ে খাঁক হয়ে যায়। কিন্তু কার জন্য এত খারাপ লাগে, এত মন পুড়ে বুঝতে পারি না। তবে আজ খারাপ লাগছে রাফিনের জন্য। যতটুকু পড়েছি ওর ডায়েরি ততটুকুতে অজস্র ভালোবাসা বিদ্যমান। অথচ সেসব আমি কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনি। এমনকি ও নিজেই আমাকে কখনো সেসব বুঝতে দেয়নি।
রাফিনের ভাবনা বাদ দিয়ে উঠে বসে ঘুমের দোয়া পড়লাম। “আলহামদুলিল্লাহিল্লাযী আহ্ইয়া-না- বা‘দা মা আমা-তানা- ওয়া ইলাইহিন্ নুশূর।”

“হামদ-প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য, যিনি (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাদেরকে জীবিত করলেন, আর তাঁরই নিকট সকলের পুনরুত্থান।” [১]

আছরের নামাজ পড়ে যিকির-আযকারে মশগুল হলাম। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ‘ হিসেবে বর্ণনা করেছেন,

“কোনো গোষ্ঠী যারা যিক্‌র করছে, তাদের সাথে ফজরের সালাতের পরে সূর্য উঠা পর্যন্ত সময় বসা আমার কাছে ইসমাঈলের বংশধরদের চার জন দাস মুক্তির থেকেও বেশি প্রিয়।অনুরূপভাবে কোনো গোষ্ঠী যারা যিক্‌র করছে, তাদের সাথে আসরের সালাতের পরে সূর্য ডুবা পর্যন্ত সময় বসা আমার কাছে চার জন দাস মুক্তির থেকেও বেশি প্রিয়। [২]

রাতে ছাড়া অন্যসময় ডায়েরি পড়ার কোনো সুযোগ নেই আমার৷ আবার রাতে ঘুম না হলে সারাদিন ক্লান্ত লাগে। তাই আজ ডায়েরি পড়া হলো না। রাতেও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে এরপর ফজর সালাত ও কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার শেষে অবশেষে ডায়েরি নিয়ে বসলাম আবার।

এবারের শিরোনাম “পুনরায় পথচলা”।
সে তার পরদিনও এলো না কাশবনে। এর পরদিন এলো। আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম তার জন্য। কিন্তু সে বুঝতেই পারতো না। তবে কাশবনে সে প্রায়ই ক্রিকেট খেলে আর আমি তার খেলা দেখি আড়ালে দাঁড়িয়ে। খেলা শেষে অতর্কিত সামনে পড়ে যাওয়ার ভান করে তার সামনে চলে যেতাম। কয়েকদিন যাওয়ার পর আর লুকিয়ে থাকতে হয় না। সে নিজেই আসে কথা বলতে। এভাবে প্রতিদিনই তার সাথে কথা হতে লাগলো এবং একপর্যায়ে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। কিন্তু সম্পর্কের কোনো নাম তখনও হয়নি। সেসময়ও আমি কল্পনা করতে পারিনি যে, এই মেয়েটাই, মিস পিছলাবতীই আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবেসে আপন করে নিবে। আমার শুধু মনে হতো, ও না ভালোবাসুক আমার পাশে থাকলেই চলবে। কিন্তু ও আমার ভালেবাসাকেও ছাপিয়ে দিয়ে আমার চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে আমাকে।

নামহীন সম্পর্কের পথচলার কোনো একপর্যায়ে মনে হলো তারও হয়তো আমারই মতো কোনো ভাবনা আছে মনে। আমরা স্রেফ একই পথে চলার পথিক নই, আরও বেশি কিছু হতে পারি। বস্তুত, আমি তাকে শুধুমাত্র সঙ্গী হিসেবে চাইনি। শুধুমাত্র কাছে আসতেই বন্ধুত্বের কিংবা বিকেলের সুন্দর সময় কাটানোর সঙ্গী হিসেবে অযুহাত দেখিয়েছি। ভাবলাম, এবার নামহীন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে প্রপোজ করে ফেলি।

বহুবার গিয়েছি ওর সামনে প্রেমিক হয়ে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারিনি মনের কথা। কত শতবার প্র্যাকটিস করেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ওর সামনে গেলেই খেই হারিয়ে ফেলি। মুখ ফুটে বলতে পারিনা কখনোই। মনে হয়েছে যদি রিজেক্ট করে দেয়? বন্ধুত্বটাও হারিয়ে ফেলি? এভাবে কেটে যায় দিনের পর দিন। অবশেষে একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হওয়ার হোক। আজ প্রপোজ করবোই।

সেদিন ও এলো। যথারীতি ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে মাঠে হাজির হলো। আমিও সরাসরি ওর সামনে গিয়ে বললাম,
“ব্যাট রাখো, আজ খেলা ছাড়ো।” সে অবাক হলো খানিকটা, বললো, “কোথাও যাবো আমরা?”

আমি উপর-নীচ মাথা নাড়ালাম এবং আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে কাশবনের গহীনে, শুধুমাত্র আমাদের দুজনের রাজত্ব যেখানে সেখানে ওকে নিয়ে এলাম।হারিয়ে ফেলার প্রচন্ড ভয় সাথে একরাশ আশা নিয়ে দুরুদুরু বুকে একগুচ্ছ কাশফুল হাতে ওর সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পড়লাম।
সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমরা কখনো বন্ধু নই, শত্রুও নই। বেস্টফ্রেন্ড, ক্লোজফ্রেন্ড কিছুই নই আমরা। আমাদের সম্পর্কের আসলে কোনো নামই নেই। আমি এই সম্পর্কের নাম দিতে চাই, আরোহী। আমার চলার পথে, আমার বাইকের পেছনের সিটে, আমার পুরো জীবনে একমাত্র তোমাকে আরোহণ করাতে চাই। তোমাকে আমি আমার আরোহী বানাতে চাই। আমার একান্ত আরোহী। যার ওপর সব অধিকার শুধু আমার থাকবে। যে-ই আরোহীকে আমি অন্যকারো সাথে আরোহন করতে কখনো দেখতে চাই না। যে-ই আরোহী সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবে, আমার সাথে আরোহণ করবে। আমার সাথে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করবে আর সারাক্ষণ শুধু আমার মনে বিরাজ করবে। তুমি আমার হৃদয়ের আরোহী হবে, প্লিজ?”

প্রপোজ করা শেষ হতেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কি বলবো ভেবেছি আর কি বলেছি? এতদিন ধরে খাতায় লিখে, নোটপ্যাডে লিখে যে লিখা মুখস্ত করেছি তার একবিন্দুও আমি বলতে পারিনি। যা বলেছি সবটা মন থেকে বলেছি। মনে যা ছিল তাই মুখ ফুটে বলে দিয়েছি। আরোহীর চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার ভয় হতে লাগলো। এক্ষুনি হয়তো বলবে, কিসব বকছো আবোল-তাবোল? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আরোহী আমার হাত ধরে ফেললো। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, আরোহীর হাত তিরতির করে কাঁপছে এবং সেই কাঁপা হাতে আমার হাত ধরে কাঁপা কন্ঠে ও বললো,
“আমি শুধু তোমার আরোহী হতে চাই। আর কারো না। কারো আরোহী হওয়ার আগে তোমার হৃদয়ে ঠায় দাও আমায়।”

সেই মুহুর্তটা শুধু আমাদের ছিল। শুধুই আমাদের দুজনের। আমার মনে হয়েছে, তখন আকাশ থমকে গিয়েছিল, পাতা ঝরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পাখিরা ডাকাডাকি থামিয়ে দিয়েছিল, কাশফুলগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছিল, বাতাস স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ঘাসফড়িংগুলোও উড়ন্ত অবস্থায় থেমে গিয়েছিল। আমরা দুজনও ক্ষনিকের জন্য একে-অপরের চোখে হারিয়ে গিয়েছিলাম।

আমি দ্রুত আরোহীর হাত শক্ত করে ধরে ফেললাম। এমন ভাব যেন, আমার ধরতে আর একমুহুর্ত দেরী হলেই অন্যকেউ ধরে ফেলবে। হাত ধরে দাঁড়িয়ে বললাম,
“তুমিই আমার হৃদয়ের আরোহী, হৃদিতা আরোহী!”

তখন থেকে মিস পিছলাবতী হয়ে গেল আমার হৃদয়ের আরোহী।

এতটুকুতেই “পুনরায় পথচলা” শিরোনামের লেখা শেষ। আমার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। হৃদয়টা যেন এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে। আমি বুকে হাত চেপে রাখলাম। রাফিনের ভালোবাসার গভীরতা আমি কখনো টের পাইনি। ওর ভালোবাসা যে এতটা গভীর ছিল ও আমাকে কখনো বুঝতেই দেয়নি। আমার এতদিনকার ধারণা ছিল, রাফিন নামকাওয়াস্তে আমাকে ভালোবাসে। একবার হৃদয়ে ঠায় দিয়ে ফেলেছে বলে দায় থেকে ভালোবাসে৷ হয়তো বলতে পারছে না ছেড়ে যাওয়ার কথা, আবার ছেড়ে গেলেও কিছু মনে করবে না এই টাইপ ভালোবাসা। কিন্তু… কিন্তু ও আমাকে শুধু প্রপোজ করবে বলেই না কত কান্ড ঘটিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করেছে, নোটপ্যাডে লিখেছে, খাতায় লিখেছে শুধুমাত্র আমায় প্রপোজ করবে বলে? আমায়? এই আমায়?

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এত ভালোবাসা ছিলো তোমার মনে? হায় আফসোস! সবটাই ছিল হারাম। যদি সবটা আবার ঘটতো আমার জীবনে, হালাল রূপে! যদি হালাল ও উত্তমরূপে রাফিনকে পেতাম জীবনে। আজ ডায়েরির লিখাগুলো পড়ে আমার একটুও আফসোস হচ্ছে না বা খারাপ লাগাও কাজ করছে না। বরং অনুশোচনার দগ্ধ অনলে জ্বলছি আমি। কেন করেছিলাম এই পাপটুকু? একটা সময় প্রপোজ করার সেই মুহুর্তটা ছিল আমার জীবনের সেরা মুহুর্ত। কিন্তু এখন সেই মুহুর্তটা মনে করে আনার মনে একটুও পুলকিত বোধ হচ্ছে না। ঐ যে বললাম, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হচ্ছে সেটা রাফিনকে ভেবে নয়। কঠিন গুনাহ করেছিলাম অথচ পাপবোধ জন্মায়নি মনে এই ভেবে। কতটা নিকৃষ্ট ছিলাম আমি সেটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠছে। রবের কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি তিনি সঠিক সময়ে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। সঠিক পথ দেখিয়ে ইসলামের পথে নিয়ে এসেছেন। আরও যদি চলতো, এভাবেই যদি অবিরাম চলতে থাকতো আমাদের সম্পর্কটা আর আমরা কেউ যদি সম্পর্ক চলাকালীন মারা যেতাম! কি পরিণতি হতো আমাদের? ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। ইয়া রহমান! আপনি সত্যিই দয়ালু্। এত অবাধ্যতার পরও হেদায়েত দিয়েছেন আমায়। অথচ আপনার কাছে কখনোই আমি তা চাইনি। কৃতজ্ঞতায় পরম প্রিয়, মহান রবের সিজদাহ্য় অবনত হলাম।

রেফারেন্স:
[১] বুখারী ফাতহুল বারী ১১/১১৩, নং ৬৩১৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১

[২] আবূ দাউদ, নং ৩৬৬৭। আর শাইখ আলবানী, সহীহ আবি দাউদ ২/৬৯৮ তে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। হাদীসটি হাকিম সংকলন করেছেন, ১/৫৬[২] আর শাইখ আলবানী একে সহীহুত তারগীব ওয়াত-তারহীবে সহীহ বলেছেন ১/২৭[৩] আর তিনি একে নাসাঈ, তাবারানীর দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন এবং বলেছেন, তাবারানীর সনদ ‘জাইয়্যেদ’ বা ভালো।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here