‘জুভান আহমেদ’ নামটার সাথে জড়িয়ে আছে এক বিশাল অনুভূতি। জড়িয়ে আছে এক আকাশ ভালোবাসা। আজ তিনি আসছেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে তিনি আসছেন। কত রজনী যে তার অপেক্ষায় ক্ষান্ত হয়েছে তা এক মাত্র তার এই প্রেয়সী আর ঐ আকাশটাই জানে। তবে আজ শেষ হলো সমস্ত অপেক্ষা। দীর্ঘকালের সেই প্রতীক্ষার পর আবারও এক অন্তরীক্ষ ভালোবাসা নিয়ে স্মৃতির কাছে ফিরে আসতে চলেছে তার প্রণয়।
‘লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা পরো, কেমন?’
লজ্জায় রাঙা হলো স্মৃতির ফর্সা গালগুলো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সে। একপলক ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপনার ফ্লাইট কয়টায়?’
ওপাশের ব্যক্তিটি বললো,
‘রাত নয়টায়। কাল সকাল ছয়টার মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছে যাবো।’
স্মৃতি মিষ্টি হেসে বললো,
‘কাল বাবার সাথে আমিও এয়ারপোর্টে যাবো।’
সঙ্গে সঙ্গে ব্রু কুঁচকালো জুভান। কঠিন স্বরে বললো,
‘একদম না। তোমাকে এয়ারপোর্টে আসতে হবে না। মাইক্রো বাসে চড়তে পারো না, উঠলেই বমি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলো। তাই দরকার নেই আসার।’
মুখ কালো করে ফেলল স্মৃতি। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। জুভান ঠোঁট কামড়ে গভীর ভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। যদিও কিছুটা ঝাপসা, তাও যেন মেয়েটার ফুলানো গালগুলো সে দেখতে পাচ্ছে। অল্পতেই বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকা টা যেন তার এক সুরম্য অভ্যাস। আর এই অভ্যাসে নারী জাতি বরাবরই শোভাময়ী।
জুভান তখন গলা ঝেরে নরম গলায় বলে,
‘এত মন খারাপ করার কী আছে? আর তো কিছু সময়ের অপেক্ষা। চলে আসছি তো। এয়ারপোর্ট থেকে তো সোজা তোমার কাছেই আসবো। এখন একটু ঠিক হও তো। সারাক্ষণ খালি গাল ফুলিয়ে রাখো।’
স্মৃতি জুভানের দিকে তাকাল। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
‘মোটেও আমি সারাক্ষণ গাল ফুলিয়ে রাখি না। আপনি বেশি দেখেন।’
জুভান হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ঠিক আছে, এবার তো চলে আসছি। যা দেখার কাছ থেকেই দেখব।’
স্মৃতি যেন কিছু একটা ভেবে লজ্জা পেল। সত্যিই মানুষটা যখন তার খুব কাছে চলে আসবে তখন তো সে লজ্জায় মারা পড়বে। এখনই তো ভাবতে গা শিউরে উঠছে যেন। স্মৃতি জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
‘আচ্ছা, আমি রাখছি এখন। সাবধানে আসবেন।’
‘ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।’
ফোনটা রেখে উঠে দাঁড়াল স্মৃতি। বাইরে বেশ হৈ চৈ। দুবছর পর আবারও বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরছে। এই নিয়ে সকলের আনন্দের যেন শেষ নেই। স্মৃতিরও আনন্দ হচ্ছে। তবে কিছু একটা ভেবে কষ্টও হচ্ছে তার। তবে এই মুহুর্তে সেই কষ্টটাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে এই আনন্দটা। অনেকগুলো দিন পর আবার সে তার ভালোবাসাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাবে। এতদিন চোখ দিয়ে তাকে দেখে গেলেও সেই দেখাতে তার মনের তৃষ্ণা মিটতো না। বরং সে তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলতো। এবার সেই তৃষ্ণা তার মিটবে। তাকে আর তৃষ্ণার্ত থাকতে হবে না। এর চেয়ে আনন্দের কি আর কিছু হতে পারে?
‘কি রে জামাই আসার আগেই দেখছি পটের বিবি সেজে বসে আছিস। রান্নাঘরের কাজগুলো কে করবে শুনি?’
কারোর ঝাঁঝাল গলার স্বরে চমকে উঠে স্মৃতি। পেছনে তাকিয়ে তার শ্বাশুড়ি মা’কে দেখে শাড়ির আঁচলটা টেনে ঘোমটা দেয়। শ্বাশুড়ি তখন কর্কশ গলায় বলে,
‘থাক থাক, আর এত সম্মান দেখাতে হবে না। কতোটুকু সম্মান যে মন থেকে দাও তা আমার জানা হয়ে গিয়েছে। নয়তো কি আর সারাদিন পায়ের উপর পা তুলে বসে থেকে শ্বাশুরিকে খাটাতে? খাটাতে না। বলার আগেই সব কাজ করে ফেলতে।’
স্মৃতি মাথা নুইয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
‘মা, আসলে আমি একটু উনার আলমারিটা গুছাচ্ছিলাম। আমি এক্ষুণি যেতাম কিন্তু তার আগেই..’
‘হয়েছে হয়েছে আর বাহানা দিতে হবে না। আমি সবই বুঝি। যাও এখন, তাড়াতাড়ি গিয়ে ঐদিকটা সামলাও। বাড়ির বড়ো বউ হয়েছো, সব দিকে নজর তো তোমাকেই দিতে হবে। ও হ্যাঁ, আরেক টা কথা, এত কষ্ট করে তোমাকে আর এই রুম গুছাতে হবে না। তুমি হয়তো জানো না, নিধি এসেছে। আর জুভান আসলে নিধির সাথে নিধির রুমেই থাকবে। আর নিধি তার রুম গুছিয়ে নিয়েছে। তাই এসব বাহানা না দেখিয়ে নিচে গিয়ে রান্নার দিক টা সামলাও।’
স্মৃতির সমস্ত আনন্দ নিমিষেই যেন হাওয়ায় মিশে গেল। চোখগুলো ভিজে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু সে কিছু বললো না। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বুক চিরে বেরিয়ে এল তার দীর্ঘশ্বাস। এখন আর কষ্ট লাগে না। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে। জুভান বিদেশ যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে। ছোট খাটো সব ব্যাপারে তার শ্বাশুড়ির এই বঞ্চনা। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। না সামলিয়ে উপায় কোথায়? এই শ্বশুর বাড়ির আশ্রয় ছাড়া তার যে আর ঠাঁই নেই। নয়তো কোন মেয়েটাই বা তার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিবে। সে তো নিয়েছে। কিন্তু এত কিছু মেনে নেওয়ার পরও সে ভালো নেই। আর তাই শ্বাশুরির এত এত গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে একবার সে জুভানকে এসব বলেছিল। ভেবেছিল সে হয়তো বুঝবে। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। সে বুঝলো না। উল্টো তাকে বুঝিয়ে বললো, “মা’র তো বয়স হয়েছে, তাই এমন খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। তুমি একটু মানিয়ে নাও না, প্লিজ।”
সেদিন আর স্মৃতি প্রত্যুত্তর করতে পারেনি। আর এর পর থেকে কোনোদিন সে শ্বাশুরির কোনো কথা জুভানকে বলেও নি। খুব কষ্ট পেলে কেঁদে কেটে মা’র কাছে কল লাগাতো। মা’কেও বলতো, মাও জুভানের মতোই তাকে বুঝাতো, “শ্বাশুড়িরা একটু এমনই হয়, থাক মা, এত কথা মনে নিস না।”
এখন আর সে কাউকেই কোনো অভিযোগ করে না। সে জানে করেও লাভ নেই। সবাই সেই একই কথাই বলবে, “থাক মা, নিজেকে মানিয়ে নে।” তাই সে সত্যি এবার মানিয়ে নিয়েছে।
রান্নাঘরের কাজ শেষে স্মৃতি সকলের জন্য নাস্তা বানিয়েছে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনও এসেছেন অনেক। তাদের আবার একেক জনের একেক পছন্দ। সবার পছন্দ মতো স্মৃতি সব নাস্তা বানায়। একে একে সেগুলো নিয়ে সে ড্রয়িং রুমে যায়। তখন সেখানে একটা মেয়ে এসে বলে,
‘সন্ধ্যার নাস্তা কেউ আট টায় খায় বুঝি? সারাটা দিন করো কী বলতো? সময় মতো একটু নাস্তাটাও বানাতে পারো না?’
‘তা, তুমি বানালেই তো পারো। ভাবির কাছ থেকে তার স্বামীর ভাগ টা নিতে পেরেছো তাহলে তার কাজের ভাগ টা কেন নিতে পারছো না?’
তখনই মেয়েটার গালে কেউ সশব্দে চ*ড় বসালো। সেই চ*ড়ের শব্দে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। স্মৃতি দৌড়ে গিয়ে তার ননদ কে বুকে জড়িয়ে নিল। শ্বাশুরি কে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘মা, আপনি ওকে মারলেন?’
‘হ্যাঁ, মারলাম। তোকে তো আর মারতে পারবো না, তাই ওকেই মারলাম। কী যাদু করেছিস বলতো? আমার মেয়ে সারাক্ষণ শুধু তোর কথাই উঠ বস করে, তাবিজ টাবিজ করেছিস নাকি?’
জারা গাল থেকে হাত সরিয়ে শক্ত গলায় বললো,
‘আমাকে কেউ তাবিজ করেনি, মা। তোমাকে করেছে। তোমার এই প্রাণপ্রিয় নিধি তোমাকে তাবিজ করেছে। তাই তুমি এত অন্যায় করছো। ভাইয়া একবার আসুক, আমি সব বলবো ভাইয়াকে। আর এই মেয়েটার (নিধির দিকে আঙ্গুল তুলে) সাথে যদি আমি ভাইয়ার ডিভোর্স না করিয়েছি তো আমার নামও জারা না।’
কথাটা বলেই জারা হনহন করে উপরে চলে গেল। স্মৃতির শ্বাশুড়ি মারিয়াম আহমেদ তখন স্মৃতির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
‘জুভান আসলেই এই বাড়িতে তোর শেষ দিন হবে। আর যদি বেশি বাড়াবাড়ি করিস তাহলে তোর ঐ আধমরা বাপকে পুরো মরা বানিয়ে ফেলবো। কথাটা মাথায় রাখিস।’
চলবে…
#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
#সূচনা_পর্ব
(ফাইনালি, কিছু একটা লিখলাম। প্রথম পর্ব পড়ে অনেকে হয়তো অনেক কিছু ভাববেন। কিন্তু গাইস, ধৈর্য ধরতে হবে। প্রথম পর্ব পড়ে কিছুই বুঝবেন না। তাই পদ্মফুলের মতোই শেষ পর্যন্ত পাশে থাকতে হবে। আশা করছি ভালো কিছু পাবেন। ধন্যবাদ❤)