#অজানা_আলোর_খোঁজে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫
– আবির হলো…..
বলেই রুকু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধুম করে কেঁদে দিল। রুকুর কান্না যেন তানভীরের মনের অস্বস্থি বাড়িয়ে দিল। তানভীর কাঁপা হাতে রুকুর কাঁধে হাত দিতেই রুকু নিজেকে সামলে নিয়ে দুহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
– আবির হলো আমার বয়ফ্রেন্ড। কলেজে যখন প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম সেদিন খেয়াল করলাম একটা লম্বা সুঠাম দেহীর একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে দেখেই বেশ ভালো লেগে গেছিল। ছেলেটার দিকে যেন চোখ আটকে গেছিল।কিন্তু বাবা পশে থাকায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না। এরপর জানতে পারলাম ছেলেটার নাম আবির আর আমাদের ক্লাসমেট নেহার বড় ভাই। আবিরের প্রতি একটা ক্ষুদ্র ভালো লাগা থেকে নেহার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলি। নেহাকে আবির কলেজে দিতে আসতো আর আমি আবিরকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতাম। মনে মনে ভাবতাম এ যদি আমার পথ চলার সঙ্গী হত মন্দ হত না। তবে আমি কলেজ যেতাম খুব কম।বলা যায় পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিতাম শুধু। ক্লাস করেছি হাতে গুণা কয়েকদিন।
কথাটা শোনে তানভীর দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়ে বলল
– ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট ছিলেন তাই তো?
তানভীরের কথা শোনে রুকু রাগে গজগজ করে বলল
– ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ড মোটেও ছিলাম না। তবে বাসা থেকে ক্লাস করতে দিত না।
তানভীর কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল
– ক্লাস করতে দিত না কেন? অমা! কি বলেন? আমি তো জানতাম বাসা থেকে ক্লাস করার জন্য সবাই প্রেসার দেয়। আর আপনি উল্টা কথা বলছেন।
– হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমার পরিবার ঐরকম না। পরিবারের কাহিনি নাহয় আরেকদিন বলব।
– আচ্ছা ঠিক আছে পরে কী হয়েছে বলুন।
রুকু দম নিয়ে দমটা ছেড়ে বলল
– কলেজে একদিন ক্লাস টেস্ট দিতে গেলাম। সেদিন নেহা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল
– ভাইয়া তোকে দিয়েছে।
নেহার কথাটা শোনে বেশ চমকে গেছিলাম। আবির চিঠি দিয়েছে শোনেই মনে রোমান্টিক অনুভূতি জাগতেছিল। চিঠিটা ব্যাগে নিয়ে পরীক্ষা শেষ করেই চিঠিটা খোলার জন্য মন আনচান করতেছিল তবে বাবা সাথে ছিল তাই চিঠিটা খুলতে পারিনি। বাসায় এসেই দরজা লাগিয়ে চিঠিটা খোললাম। চিঠিটায় লিখা ছিল
“শব্দহীন এক ভালোবাসার মায়ায় পড়ে গিয়েছি। যেখানে তোমাকে নিয়ে ঐ নীল আকাশের চাঁদটা অবলোকন করতে চাই। যেখানে ভালোবাসার রঙ্গিন চাঁদরে তোমাকে মুড়িয়ে নিয়ে চন্দ্রহীন রাতের তারা ভরা আকাশের বিশালতায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। সাঁঝের আকাশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে তোমাকে নিয়ে উড়ে বেড়াবার স্বপ্ন দেখব। হবে কি আমার পথ চলার সাথী।”
চিঠিটা পরার পর একটা অদ্ভূত অনুভূতি জেগেছিল। পছন্দের মানুষের কাছ থেকে এমন চিঠি পাওয়াতে আবেগটা যেন বেড়ে টইটুম্বর হয়ে গেছিল। ইচ্ছা করছিল তখনেই কল করে বলে দিই যে আমি আপনার পথ চলার সাথী হতে চাই। কিন্তু আমি মোবাইল ব্যাবহার না করায় সেটা আর করতে পারলাম না। পরদিন যখন পরীক্ষা দিতে যাই তখন নেহাকে বললাম আমি আবিরের প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু আবিরের সাথে কথা বলার মতো কোনো উপায় নেই। নেহা আমার কথা শোনে বলল
– কথা বলার সুযোগ নেই কেন শোনি।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম
– আমার তো মোবাইল নেই।
নেহা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল
– তুই চিন্তা করিস না আমি দেখতেছি ব্যাপার টা।
তারপর নেহা ব্যাপারটা আবিরকে বলল। রুকু কথাটা বলে হাতে থাকা মোবাইলটা তানভীরকে দেখিয়ে বলল
– এই যে এই মোবাইলটা আবির নেহার মাধ্যমে পাঠাল।তারপর আবিরের সাথে পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে শুরু হলো আমার কথা বলা।বেশ ভালো জমে গিয়েছিল আমাদের প্রেমটা। কিন্তু মাস তিনেক পর আবিরের চাহিদাগুলো বাড়তে লাগল।বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে থাকল।আমি মোটেও এসবে অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আবির এসব বিষয়গুলো নিয়েই পড়ে থাকত।যার দরুণ আবিরের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। বেশ কষ্ট লাগত। প্রথম ভালোবাসা তো ছাড়তেও পারতাম না। অদ্ভূত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম।
“মায়া বড়ই খারাপ জিনিস। একবার কাউকে ধরে বসলে সেটা থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন।”
মায়া নামক ব্যাধির যদি কোনো ঔষধ থাকত তাহলে হয়তো সেটা হাজারও মানুষ খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত।
যাইহোক যার কারণে আবিরের সাথে কথা বলা বাদ দিতে পারতাম না। আবিরকে দেখতাম সবসময় আমাকে প্রয়োজন হিসেবে ব্যাবহার করতে চাইত। আমি মোটেও তাকে পাত্তা দিতাম না এসব ব্যাপারে। তবে ওকে মায়ার জন্য ছাড়তেও পারতাম না। একের পর এক হুমকি দিত। আমাকে বলত আমার ছবি ইডিট করে নেটে ছড়িয়ে দিবে। এসব নানা ধরণের ব্ল্যাকমেইল বলা চলে। এর মধ্যে আমার পরিবারে ঘটে চলে একের পর এক অদ্ভূত কাহিনি যার কারণে মন খারাপ বশত যদি তার সাথে কথা বলতে চাইতাম তাকে কাছে পেতাম না। তাই একটা সময় আমি বিষয়টা গুটিয়ে ফেলি। তার কাছ থেকে নিজেকে বের করে আনি। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি।
বলেই রুকু চুপ হয়ে গেল। তানভীর তখন মনোযোগ দিয়ে এক পলকে তাকিয়ে রুকুর কথা শোনছিল৷ রুকুকে থেমে যেতে দেখে তানভীর বলে উঠল
– কি ব্যাপার থেমে গেলেন যে। তারপর কি হলো।
রুকু সশব্দ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
– তারপর থেকে আবির আমার প্রতি বেশ সিরিয়াসনেস দেখায়৷ বুঝায় সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি তো জানি কুকুরের লেজ ঘি দিয়ে মালিশ করলেও সোজা হবে না। এদিকে তার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ভালোবাসা কাজ করে না যেটা কাজ করে সেটা হলো এক অযাচিত মায়া। তাই বারবার আবির বিরক্ত করে ফোন দিয়ে। আর আমার তখন বেশ কষ্ট হয়।
তানভীর হালকা নিঃশ্বাস নিল। নাক দিয়ে যেন তানভীরের গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে এখন। কি বলবে বুঝতে পারছে না এদিকে মাথায় মাইগ্রেনের ব্যাথা তো আছেই। একটা হাই তুলার সাথে সাথে দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের হা করা মুখের সামনে তুড়ি বাজাতে বাজাতে বলল
– তা নাহয় আবিরের ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু মাথায় ঢুকছে না আপনি বাসা থেকে কেন পালালেন। আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো কোনো প্রমিকের জন্য বাসা থেকে পালিয়েছেন। কিন্তু এখন বিষয়টা উল্টো লাগছে। আমাকে একটু খুলে বলবেন কি হয়েছে?
রুকুও তখন বেশ ক্লান্ত। খাটের দিকে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বলল
– বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। তবে আমার সাথে যা হয়েছে সেটা আমার কাছেই বেশ অদ্ভূত লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় বিষয়টা দুঃস্বপ্ন। জানি না এমন কেন করেছে আমার পরিবার। এতে তাদের কি স্বার্থ সেটাও জানি না।
তানভীর চোখগুলো বড় বড় করে বলল
– কি এমন কথা যে বিশ্বাস করতে পারব না।
বলেই রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল রুকু একটা ডায়রি বের করে তানভীরের দিকে বাড়িয়ে আছে। তানভীর অবাক চোখে রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল
– ডায়রি দিয়ে কী করব আমি?
রুকু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল
– এটাতে সব লিখা আছে। আপনি পড়ে নিন।
কথাটা শোনে তানভীর রুকুর হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে পড়তে লাগল। যতই ডায়রিটা পড়ছিল তানভীরের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামের আকৃতি বাড়ছিল। সেই সাথে তানভীরের শ্বাসকষ্টের সমস্যাটাও বেড়ে গিয়েছিল। ঘামটা গড়িয়ে গড়িয়ে বেয়ে কানের পাশ দিয়ে নামছিল। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ব্যাপক ভাবে চেপেছে। সহ্য করতে পারছে না আর। এরকম পরিবারও এ যুগে আছে তা যেন মানতে তানভীরের বেশ কষ্ট হচ্ছে। ডায়রিটা পড়া শেষে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল।মাইগ্রেন এমন একটা ব্যাথা একবার চেপে ধরলে ঔষধেও কাজ করে না। এ মুহুর্তে তানভীরের বেশ মাইগ্রেনের ব্যাথাটা চেপে ধরেছে। তাই চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। মিনেট ত্রিশ এভাবে থাকার পর তানভীরের মনে হলো এখন বেশ স্বাভাবিক এবং ভালো লাগছে। তাই তাকিয়ে রুকুর দিকে খেয়াল করে দেখল রুকু শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। অর্ধেকটা শরীর মোঝের দিকে ঝুলে আছে বাকি অর্ধেক খাটে। তাই রুকুকে ধরে খাটের উপরে তুলে দিল। হাত পা বেশ ঠান্ডা দেখে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে রুকুর শরীরে জড়িয়ে দিল। ঠিক এ মুহূর্তে মনে হলো কেউ একজন কেবিনের দরজা ধাক্কাচ্ছে। তানভীর ভাবল হয়তো লিয়াকত সাহেব এসেছে তাই উঠে কেবিনের দরজা খুলল।দরজা খুলে দেখল একজন অল্প বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করল মহিলার চুলগুলো হালকা কুকরা চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা এবং পরনে লাল পেরে গেরুয়া রঙ্গের শাড়ি পড়া। তানভীর মহিলাকে দেখে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
– আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। কে আপনি?
তানভীরের কথা শোনে ওপাশে থাকা মহিলাটা বলল
– আমি মোনালি। আর আমাকে চেনার কথাও না। একটা বিষয় জানার জন্য কেবিনটায় নক করেছি।
তানভীর হালকা হেসে বলল
– কী জানতে চান বলুন।
মোনাালি একটা ছবি বের করে তানভীরের দিকে ধরল। তানভীর ছবিটা দেখে চমকে গেল। কারণ এ আর কেউ না রুকুর ছবি। তানভীর চমকে গিয়েও চমকানোর ছাপটা মুখে প্রকাশ না করে মোনালিকে বলল
– এ ছবিটা কার? আমাকে দেখাচ্ছেন কেন?
মোনালি নিজের চশমাটা ঠিক করতে করতে বলল
– মেয়েটাকে চেনার কথা না তবে আশে পাশে কোথাও কী দেখেছেন? আমি খেয়াল করলাম মেয়েটা এ লঞ্চে ঢুকেছে। আমার সাথেই এসেছিলা তবে মাথায় একটু সমস্যা আছে তো তাই হুট করে কোথায় যে গেল বুঝতে পারছি না।
তানভীর মুখটাকে কাচুমাচু করে বলল
– আপনার জন্য তো আমার সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হবে।
মোনাালি একটু কপট রেগে বলল
– মানে?
তানভীর খিক করে হেসে বলল
– আমার স্ত্রী একটু বেশি সন্দেহবাদী উঠে যদি দেখে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কোনো মেয়ের খু্ঁজ নিচ্ছেন তাহলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না।
এটা বলার সাথে সাথে মোনালি বলে উঠল
– আচ্ছা সরি।
এমন সময় রুকু ওমাগো বলে চিল্লানি দিয়ে উঠল। খেয়াল করল রুকুর গলাটা ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা গলার চিৎকার শোনে তানভীর মোনালিকে বলল
– আচ্ছা যাইহোক মেয়েটাকে চিনি না। আমি গেলাম। আমার বউ হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে। আমাকে না পেলে বেশ ভয় পাবে। কচি মেয়ে বিয়ে করলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়।
বলেই দরজাটা লাগিয়ে খেয়াল করল রুকু ভয়ে কাঁপতেছে। রুকুর কাছে যেতেই রুকু তানভীরের হাতটা ধরে বলল
– তেজস্বিনী এসেছিল তাই না?
তানভীর হালকা দম নিয়ে বলল
– তা তো বলতে পারব না কে এসেছে তবে আপনার খুঁজ নিতে এসেছিল।
তানভীরের কথা শোনে রুকু ফিসফিস করে বলল
– আমি ঘুম থেকে দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করলাম তেজস্বিনী দাঁড়ানো। তাই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। কী করব আমি। আমাকে বাঁচান।
বলেই কাঁদতে লাগল। এমন সময় দরজায় আবার খটখট আওয়াজ আসতে লাগল। দরজার আওয়াজ শোনে রুকু তানভীরের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল
– নিশ্চয় তেজস্বিনী এসেছে। দয়াকরে খুলবেন না।
তানভীর বুঝতে পারছিল না কী করবে। তানভীর রুকুকে একটু আশ্বাস দিয়ে বলল
– আপনি চাঁদরটা গায়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুন দেখি কে এসেছে। তেজস্বীনি আসলে আমি বাকি ব্যাপারটা মেনেজ করে নেব।।।
বলেই রুকুকে শুইয়ে দিয়ে চাঁদর মুড়িয়ে দিয়ে ঢেকে দিল। এদিকে তানভীরে হার্টবিটের স্পন্দর যেন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। হার্টবিটের স্পন্দর বেড়ে চলার এ প্রক্রিয়াকে মেডিকেলের ভাষায় পালপিটিশান বলে। তানভীরের এখন মনে হচ্ছে হয়তো তার এমুহূর্তে এ রোগটার দেখা মিলেছে। তবুও নিজের মনে সাহস জুগিয়ে দরজাটা খুলতেই…
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)
গ্রূপে আমার লিখা আরেকটা নতুন গল্প দেওয়া হবে।গল্প সম্পর্কিত আপডেট পেতে কমেন্টে দেওয়া গ্রূপ লিংকে ঢুকে গ্রূপে জয়েন করুন।