#অজানা_আলোর_খোঁজে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬
দরজাটা খুলতেই খেয়াল করল লিয়াকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। লিয়াকত সাহেবকে দেখে তানভীরের মনে প্রশ্ন জাগল মোনালি লিয়াকত সাহেবকে রুকুর ছবি দেখাল না তো?যদি লিয়াকত সাহেবকে রুকুর ছবি দেখিয়ে থাকে তাহলে তো বিপদ হওয়ার সম্ভবনা আছে। কি জানি ছবি দেখিয়েছি কিনা। ক্ষীণ দুশ্চিন্তার ছাপ তানভীরের চোখে মুখে চক্ষুগোচর হলো। হালকা ভয় যেন তানভীরকে ঘিরে ধরেছে এর মধ্যেই লিয়াকত সাহেব একটা কেক আর চিপস তানভীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
– এটা তুমি আর তোমার বিবির জন্য এনেছি। আমি আর তোমার চাচী একটু করিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। মধুমতি বলল তোমাকে যেন এগুলো দিয়ে যাই। একটু আগেই দিয়ে যেতাম তবে একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর কেবিনের দিকে এগিয়ে আসিনি। করিডোরেই দাঁড়িয়েছিলাম দুজন। উনি যাওয়ার পর তোমার জন্য এটা নিয়ে আসলাম।
তানভীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ তারা দুজন ঐ মুহুর্তে কেবিনে থাকলে বিপদের আশঙ্কা হওয়ার সম্ভবনা ছিল। তানভীর নিজের ঠোঁটের ললাটটা প্রশস্ত করে বলল
– এসবের কী দরকার ছিল চাচা। তা চাচী কোথায়?
লিয়াকত সাহেব ফিক করে পান দিয়ে লাল হয়ে যাওয়া তার লাল দাঁতগুলো বের করে বলল
– ঐ তো ঐখানে দাঁড়িয়ে আছে। তা বাবা ঐ মহিলা কে ছিল?
তানভীর কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তবে এদের সামাল দিতে না পারলে পরবর্তীতে যে মোনালি কোনো সমস্যা ঘটাবে না এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই হালকা ভয় ভয় গলায় বলল
– যদি কিছু মনে না করেন তাহলে চাচীকে কী একটু ডাক দিবেন। আমার আপনাদের সাথে একটু কথা ছিল। কথাটা জরুরি বলা যায়।
লিয়াকত সাহেব তানভীরের মুখে ভয়ের ছাপ দেখে কিছুটা অবাক হলো বটে। অবাক হয়ে মধুমতির দিকে তাকিয়ে হাতে ইশারা দিয়ে আসতে বলল। মধুমতি লিয়াকত সাহেবের হাতের ইশারা পেয়েই চলে আসলো। দুজনকে কেবিনে ঢুকিয়ে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি কে বসার জন্য জায়গা করে দিল। দুজনেই বেশ অবাক হচ্ছিল তানভীরের আচঁরণে। এদিকে রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল রুকু চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি অবাক হয়ে বলল
– মেয়েটা এভাবে চাঁদর মুড়ি দিয়ে আছে কেন?জ্বর টর আসেনি তো?
বলতেই তানভীর হালকা গলায় বলল
– নাহ এমন কিছুই হয়নি। তবে একটা সাহায্য চাই করবেন।
লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি বুঝতে পারছিল না তানভীর কি বলবে। ইতস্তত করছিল বুঝার জন্য। তাই বলল
– হ্যাঁ বলো কি সাহায্য চাই।
তানভীর মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিল
– চাচা আপনি একটু আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন না ঐ মহিলাটা কে?
লিয়াকত সাহেব মাথা ঝাঁকানোর সাথে সাথে বলতে লাগল
– হ্যাঁ ঐ মহিলাটা কে ছিল?
তানভীর মুখটা গম্ভীর করলেও কন্ঠটাকে স্বাভাবিক করে বলল
– ঐ মহিলাটা রুকুর খোঁজ নিতে এসেছিল।
তানভীরের কথা শোনে মধুমতি আর লিয়াকত সাহেব দুজনেই হতচকিয়ে বলল
– মানে?
– হ্যাঁ চাচা আমি আর রুকু বিয়ে করে নিছি পালিয়ে। ওকে নিয়ে কুয়াকাটা এজন্য ঘুরতে যাচ্ছি। তবে ওর পরিবারের কেউ জানে না যে রুকু আমার সাথে পালিয়েছে। ঐ যে মহিলাটা এসেছিল ঐ মহিলাটা হলো রুকুর সম্পর্কে খালা হয়। রুকুর খুঁজ নিতে এসেছিল। আপনাদের কাছে যদি আসে তাহলে দয়াকরে বলবেন না রুকু এখানে। কারণ আপনারা রুকুকে দেখেছেন আর কেউ দেখেনি।
বলেই তানভীর হালকা নিঃশ্বাস নিতে লাগল। নিঃশ্বাসটা যেন তার ভারী হয়ে যাচ্ছে ক্রমশে। আঁড়চোখে রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল ততক্ষণে রুকু উঠে বসে রয়েছে। রুকুর দিকে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি তাকিয়ে দেখল রুকু বেশ ভয়ে ভয়ে বসে আছে। রুকুর ভয় দেখে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতির মনে হলো হয়তো তানভীর রুকুকে জোর করে তুলে এনেছে তাই রুকুর মাথায় মধুমতি হালকা হাত বুলিয়ে বলল
– মা তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি অভয়ে বলো পাশের ছেলেটা যা বলেছে সেটা কি ঠিক নাকি তোমাকে জোর করে ধরে এনেছে।
রুকু হালকা ঢুক গিলতে লাগল। গলার স্বরটা ভেঙ্গে মোটা হয়ে গেছে তার। গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে যেন তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। চাইলেও আওয়াজ করতে পারছে না। মনের অজান্তেই যেন সবচকিছু গুটিয়ে ফেলছে। রুকুর অবস্থা দেখে লিয়াকত সাহেব ক্ষেপে গিয়ে বলল
– আমার তো মনে হয় মেয়েটাকে তুমি জোর করে ধরে এনেছ। নাহয় মেয়েটা এমন করবে কেন? মেয়েটার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে ভয়ে আছে।
লিয়াকত সাহেবের কথা শোনে তানভীরের ভেতরটা আঁৎকে উঠল। মেয়েঘটিত কোনো বিপদে পড়বে কিনা সে ভয়ে কাঁপতে লাগল তার ভেতরটা। ধুকধুক করে যেন ভেতরের হার্টবিটটা আওয়াজ তুলছিল। লিয়াকত সাহেব আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় রুকু বলে উঠল
– চাচা ওকে কিছু বলবেন না। আমি ওকে জেনে শোনেই বিয়ে করেছি। আমার মা নেই সৎ মায়ের কাছে মানুষ। সৎ মা আমাকে বেশ জ্বালাত। অযোগ্য একটা ছেলের কাছে তুলে দিচ্ছিল তাই আমি ওর সাথে পালিয়েছি।
বলেই ধুম করে কেঁদে দিয়ে লিয়াকত সাহেবকে বলল
– চাচা দয়াকরে ঐ মহিলাকে কিছু বলবেন না। আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। আপনারও তো একটা মেয়ে আছে আমাকে আপনার মেয়ে মনে করে এটুকু সাহায্য করুন। আর তানভীর আমাকে জোর করে কেন তুলে আনবে বরং সে আমাকে তার জীবনে জায়গা দিয়েছে সেটাই তো আমার বড় পাওয়া।
রুকুর চোখ দিয়ে বেয়ে পড়া শ্রাবণের মেঘ যেন লিয়াকত সাহেবের মনটা গলিয়ে দিল। এদিকে মধুমতি বেশ নরম মনের মানুষ কারও কান্না সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই বললেই চলে। তাই রুকুর কান্না দেখে মধুমতি হালকা কেঁদে বলল
– না রে মা আমরা কিছুই বলব না। তুই কান্না থামা।
লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি রুকুকে সোহাগ করে বুঝাতে লাগল। এদিকে তানভীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি এবার তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
– তোমরা থাকো কেমন। সাড়ে নয়টা বাজে এখনেই জাহাজ ছেড়ে দিবে। আমরা গেলাম। সাবধানে থেক।
তারপর মধুমতি লিয়াকত সাহেবের হাত থেকে চিপস আর কেকটা নিয়ে রুকুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– এটা দুজন মিলে খাও। আরও কিছু লাগলে বলো।
রুকু চোখগুলো মুছতে মুছতে হাত থেকে চিপস আর কেকটা নিয়ে বলল
– আচ্ছা।
লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি চলে গেল। তানভীর দরজা খুলতেই খেয়াল করলো মোনালি করিডোর দিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে। তানভীর আর দেরি না করে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর রুকুর কাছে আসতেই রুকু বলে উঠল
– আমি কী আপনার বউ? আমাকে আপনার বউ হিসেবে পরিচয় দিছেন কেন?
তানভীর কপালটা ভাঁজ করে বিরক্ত গলায় বলল
– তা না হলে আমাকে এতক্ষণে আপনাকে ধরে আনার অভিযোগে জেলে যেতে হত। বুঝেন তো কিছু না শুধু শুধু বকবক করেন। এত প্যারা নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কুয়াকাটা ঘুরতে বের হয়েছিলাম আর এমন হবে কে জানত। অসহ্য লাগছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটাও কমে কমে আবার বাড়ছে। বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ভালো লাগছে না।
বলেই তানভীর চুপ করে খাটে দপাশ করে বসে নীচের দিকে তাকিয়ে রইল। রুকু তানভীরের কথা শোনে মুখটাকে একদম অসহায় করে বসে রইল। মিনেট পনের তারা দুজন এভাবেই বসে রইল। এর মধ্যে জাহাজটা ছেড়ে দিল। বুড়িগঙ্গার ময়লা কালো পানিতে জাহাজটা হেলে দুলে গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। রুকুর নীরবতা দেখে তানভীর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
– আপনাকে ঐভাবে বলা ঠিক হয়নি। সত্যি বলতে আমার হুট করে রাগ উঠে যায়। হুট করে রাগ উঠার একটা বদ অভ্যাস আছে বটে।
তানভীরের এমন কথায় রুকুর ভেতরটায় যেন প্রশান্তির বাতাস বইছে। নিজেকে প্রশান্ত করে ভাঙ্গা গলায় জবাব দিল
– আমি কিছু মনে করেনি। আপনি আমার জন্য যা করেছেন এতেই আমি খুশি।
রুকুর গলাটা ভাঙ্গা দেখে তানভীর ফ্লাস্ক থেকে আরেক কাপ চা বের করে রুকুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– এ চা টা খেয়ে নিন তাহলে গলাটা ঠিক হয়ে যাবে। আর রাতে কি খাবেন বলেন আমি অর্ডার দিব।
রুকু অবাক চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলল
– এখন খাবার কোথায় থেকে আনবেন এখন তো জাহাজ ছেড়ে দিছে।
তানভীর রুকুর কথা শোনে হালকা হেসে বলল
– জাহাজে সব পাওয়া যায়। আপনি কি খাবেন বলুন আমি অর্ডার দিলে সব চলে আসবে।
-ওহ আচ্ছা তাই বলুন। আমি কখনো জাহাজে উঠিনি তো তাই। বাইরে থেকে জাহাজটা দেখলে বুঝা যায় না এতটা সুন্দর ভেতরটা। আমার কাছে কী মনে হয়েছে জানেন।
কথাটা বলেই রুকু কৌতুহলী চোখে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীর রুকুর বলার কৌতুহল দেখে জিজ্ঞেস করল
– কি মনে হয়েছে।
– আমার কাছে মনে হয়েছে এটা যেন একটা তাজমহল।
তানভীর হালকা হেসে বলল
– তাজমহল এর চেয়েও সুন্দর।
রুকু বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করল
– আপনি তাজমহল দেখেছেন?
তানভীর মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল
– আমি অনেক ঘুরাফেরা করি। গতবছরেই পটকাকে নিয়ে তাজমহল দেখতে গেছিলাম। ভ্রমনপিয়াসু বলতে পারেন।
তানভীরের কথা শোনে রুকু কৌতুহলের সুরে জিজ্ঞেস করল
– তাজমহল দেখতে কেমন?
তানভীর কিছু বলতে নিবে এর মধ্যে তানভীরের ফোনটা টুংটাং করে বাজতে লাগল। তানভীর ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা ধরে বলল
– হ্যালো বল কি হয়েছে?
কথাটা বলার পর রুকু খেয়াল করল তানভীর ওপাশের কথাটা বেশ মনোযোগ সহকারে শোনছে। তানভীরের কপাল বেয়ে তখন ঘাম বের হচ্ছে। তানভীরের শ্বাস প্রশ্বাসটা যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তানভীরের চোখগুলো লাল হয়ে যেতে লাগল। চোখের কোণে হালকা পানি জমেছে বলা যায়। ছেলেরা সহজে কাঁদতে পারে না। রুকু বুঝতে পারছিল ওপাশ থেকে কেউ হয়তো তানভীরকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বলছে যেটা তানভীর সহ্য করতে পারছে না। তাই তার চোখ মুখের এমন অবস্থা হয়েছে। এদিকে তানভীর কলটা কেটে চুপ হয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখের কোণের হালকা পানি যেন তানভীরের এখনেই গাল বেয়ে পড়বে। মুহুর্তের মধ্যেই বেশ বিমর্ষ হয়ে গেল। চোখটা হালকা মুছে চুপ হয়ে গেল। রুকু তানভীরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল
– কোনো সমস্যা?
তানভীর রুকুর কথা শোনে হালকা কেঁদে দিল। তানভীরের কান্না দেখে রুকু বুঝতে পারছিল সে হয়তো ভীষণ কষ্ট পয়েছে কিছু নিয়ে। তাই তানভীরকে স্বাত্বণা দিয়ে বলল
– কী হয়েছে বলবেন?
তানভীর নিজেকে স্থির করতে চাইলেও যেন পারছিল না। গলা দিয়ে কথা বলতে গেলেও আটকে আটকে আসছিল। মিনেট পাঁচেক চুপ থেকে রুকুকে জবাব দিল….
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)
প্রতিদিন পর্ব দিলে বড় করে দেওয়া সম্ভব না। গল্প নিয়ে আপডেট পেতে কমেন্টে দেওয়া গ্রূপ লিংকে ঢুকে জয়েন করুন।