রাত ২টা। চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে দু’একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। হঠাৎ ঘুমের মাঝে কোনো মহিলার ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো আরিবার। সে ভয়ে কেঁপে উঠলো। সে কান্নাটা যে প্রথম শুনছে এমনটা নয়। সে প্রায় শোনে। কে কাঁদছে? পেতনি নয়তো? তাকে কি ডাকছে? এসব ভেবেই আরও ভয় পেল সে। সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলো। আবার ভাবলো তার মা বা কাকিমনি কাঁদছে নাতো? তারা ছাড়া মহিলাই কে? যে দু’ একটা কাজের মহিলা তারা তো নিচ তলায় থাকে। কান্নাটাতো দোতলা থেকেই পায়। কেউ কি এই কান্না শুনতে পায়না? সে আর ভাবতে পারছেনা। এর রহস্য তার জানতে হবে। মনে মনে সে ভয় পাচ্ছে তবুও খুব সাবধানে খাট থেকে নেমে আস্তে করে দরজা খুলে রুমের বাহিরে এলো। নাহ তার মায়ের রুম থেকে তো আওয়াজ আসছেনা। না তার কাকার রুম থেকে। সে ভাবলো আরশ ভাইয়ার রুমে কি তাইলে কোনো মেয়ে আছে? আরশ ভাইয়ার প্রতি এসে জমালো একরাশ ঘৃণা। তবুও মূল কারণ জানার জন্য সামনে আগালো। নাহ! আওয়াজ তো এই রুম থেকেও আসছেনা আরও সামনে থেকে আসছে। সে করিডর দিয়ে ভয়ে ভয়ে যাচ্ছে। সে খেয়াল করে শুনলো কান্নাটা স্টোর রুম থেকে আসছে। ভয়ে তার গা হীম হয়ে গেল। স্টোর রুমে আর যাই হোক মানুষ থাকতে পারেনা। ওই রুমে তো দিনেও মানুষ ভয়ে যায়না এই রাতে যাওয়া তো অসম্ভব। সে কি করবে ভেবেই পাচ্ছেনা। চলে আসতে থাকলে যদি পিছন থেকে টেনে ধরে? সে আর ভাবতে পারছেনা। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকছে।
“এখানে কি করোছ?”
হঠাৎ কারো ডাকে চমকে চোখ খুললো আরিবা। পিছনে ফিরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো–
“ভাইয়া তুমি? আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
“হ্যাঁ আমি। কোনো এখানে কি অন্য কারো আসার কথা ছিলো?”
আরশ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। আরিবা একটা জোর পূর্বক হাসি দিয়ে বললো –
” না না ভাইয়া। অন্য কেউ আসবে কেনো? তোমারি আসার কথা।”
“ওহ আমার আসার কথা? তুই জানলি কি করে?”
সত্যি তো কি বলতে কি বলে ফেললাম? ভাইয়াকে কি জবাব দিবো? সত্যি টা কি বলবো? নাহ তাহলে উল্টো আমাকে নিয়েই হাসবে।
“রিবা! সত্যি করে বল? কি করছিলি এখানে?”
আরিবার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে আরশ জিজ্ঞাসা করলো।
আরিবা ভাবলো কি বলা যায়। আমি তো মিথ্যাও বলতে পারিনা ধরা খেয়ে যাই। কেনো যে ছোটো থেকে মিথ্যা বলার প্রাক্টিজ করলাম মায়েই জানে। মা সত্যি বলে আমার কোনো যোগ্যতাই নাই। আর এই লোকটাকে তো মিথ্যা বলাও যাবে না ঠিক ধরে ফেলে। আল্লাহ জানে এ পেটে থাকতো কাকিমনি কি খাইছে যে এত বুদ্ধিমান হইছে। থাক আরিবা এত চিন্তার কিছু নাই নো চিন্তা অনলি ডু ফূর্তি তুইও বুদ্ধিমতী বানিয়ে একটা বলে দে। আরিবা ভাবনার মাঝেই নিজেকে বাহবা দিতে লাগলো।
“কিরে? কথা কানে যায়না? কি জিজ্ঞেস করছি?”
হঠাৎ আরবের ডাকে ভাবনা থেকে বের হয়েই তারাহুরা করে বলে দিল–
“ভাইয়া পানি খেতে আসছিলাম।”
আরশ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো–”তাই নাকি রে?”
“হ্যাঁ ভাইয়া, দেখছো না কি গরম পরছে পিপাসাতো লাগবেই।”
আরশ দু’পা আরিবার দিকে এগিয়ে এসে বললো–
“আমার জানা মতো পানিতো নিচ তলায় ডাইনিং এ থাকে। কোন শুভাকাঙ্ক্ষী দোতলার করিডোরে তোর জন্য পানি রেখে গেছে?”
যাহ গেল! যা ভাবছি তাই। হায় আল্লাহ এবার কি বলবো? এমন মিথ্যা বললে তো ধরা খাবই। রিবা রে রিবা আজ তুই শেষ। সব মায়ের জন্য কেনো আমায় মিথ্যা বলা শিখাইলোনা? আজ বেঁচে ফিরি তো মাকে বনবাসে পাঠিয়েই ছাড়বো। আবার আরশের ধমকে ভাবনা থেকে বের হয়ে বললো –
“ভাইয়া সত্যি পা..”
কথাটা শেষ করতে দিলোনা তার আগেই আরশ চেয়াল শক্ত করে বললো–
“রিবা! তুই জানোছ আমি মিথ্যা কথা একদম সহ্য করতে পারিনা। সোজাসুজি বল ? কার সাথে দেখা করতে আসছিলি?”
আরশের রাগে ভয় পেয়ে কেঁদেই দিল আরিবা। তাতে আরশের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই প্রচন্ড রাগে তার মাথা ঠিক নাই। সে তার এক হাত কোমরে গুজে অন্য হাতে তার চুল মুঠ করে ধরে এদিক ওদিক তাকিয়ে তার রাখটা কন্ট্রোল করতাছে। একটু জোরে শ্বাস ছেড়ে আবারো জিজ্ঞাসা করলো–
“সত্যি বল?”
আরিবা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো–
“সত্যি, তিন সত্যি, বাবার কসম।”
আরশ চমকে তাকালো। তার মানে আরিবা সত্যি বলছে। আর যাই হোক আরিবা তার বাবার কসম কেটে মিথ্যা বলবেনা। কারন সে তার বাবাকে অনেক ভালোবাসে।
“ভাইয়া সত্যি পিপাসা লাগছে।”
আরিবার ডাকে আরশের ধ্যান ভাঙলো। আরিবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো –
“রুমে যা! আমি পানি নিয়ে আসছি।”
আরিবার আসলেই এখন পিপাসা লাগছে। ওই কান্না আবার আরশের রাগ দুটো মিলিয়েই সে ভয় পেয়েছে। স্টোর রুমের দিকে গভীরভাবে একবার তাকিয়ে আরিবাও আরশের পিছে পিছে চললো। আরশ সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর ভাবছে রিবা তার থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে কিন্তু কি লুকাচ্ছে?
আরিবা ভয়ে ভয়ে তার রুমে এসে লাইট অন করে সোফায় বসলো। এর মধ্যেই আরশ গ্লাস হাতে সোফায় বসে ওর হাতে গ্লাস টা এগিয়ে দিলো। আরিবা আরশের দিকে এক নজর ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পানিটা খেতে লাগলো।
আচ্ছা ওর কি হয়েছে এমন ক্লান্ত লাগছে কোনো? ওকে ক্লান্ত দেখে আমার এত খারাপ লাগছে কেনো? আরশের ভাবনার মাঝে আরিবা এমন কথা বললো যা ও ভাবতেই পারেনি আরিবা এমন জিনিস এখন চাইবে। আরশের কি খুশি হওয়া উচিত? নাহ সে আর ভাবতে পারছেনা।
————————
চাঁদ পৃথিবীর সব সৌন্দর্যে মধ্যে অন্যতম। চাঁদের আলোয় মুখোরিত চারদিক। এই প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো যুগ যুগান্তর ধরে মানুষের মন কেরে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত এই সৌন্দর্য উপভোগ করে। কবিরা ভালোবেসে এ নিয়ে হাজার হাজার কবিতা, উপন্যাস, গান ইত্যাদি ইত্যাদি লিখছেন। আরশ ভেবে পায়না এই মেয়েটাও কি কবিদের মতো চাঁদকে নিয়ে ভাবছে? কবি হতে চায়? আরিবা তখন তাকে বলছিলো ওর ঘুম আসছেনা ও ছাদে যেতে চায়। আরশ যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল। ওতো অনেক দিন ধরে এটাই চাইতো তার পিচ্চির হাসি মাখা মুখটা জ্যোৎস্মা রাতে দেখবে, অনেক গল্প করবে। কিন্তু আরিবা এসেই যে মুখ ভার করে চাঁদের দিকে তাকিয়েছে চাঁদকে নিয়ে ভাবতে আর আসে পাশে তাকানোর নাম নিচ্ছে না। এদিকে যে একজন তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সেতো প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে গেছে। যদি সে একটু পাশে তাকাতো তাহলেই দেখতে পেত একজন তার মাঝে হারিয়ে গেছে তাকে নিয়ে করছে গভীর সমীকরণ। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আরিবা পাশে তাকালো দেখল আরশ তার দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে ভাবছে। সে একটু অস্বস্তি বোধ করলো। তবুও নিজেকে ঠিক করে আবার চাদের দিকে তাকালো। হঠাৎ তার মনে হলো, ভাইয়া কি ওই সময়ের কথা ভাবছে? এত ভাবলে তো আমি ধরা পরে যাব তাই আরিবা ওর ভাবনায় ব্যঘাত ঘটাতে বললো–
“ভাইয়া চাঁদের থেকে কি মানুষ সত্যিই সুন্দর?”
হঠাৎ কথার শব্দে আরশ ধ্যান ভেঙে আরিবার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। সে এতক্ষন আরিবার দিকে তাকিয়ে ছিল তা আরিবা দেখে ফেলেনি তো? আরশ এসব ভেবে একটু অস্বস্তিতে পড়লো তবুও বললো–
” হ্যাঁ, সত্যি। ”
” কিভাবে ভাইয়া? চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখো চাঁদ টা কতো সুন্দর। মানুষ কখনো এত সুন্দর হয়?”
“আমাদের নিজেদের মধ্যে সৌন্দর্যের নূন্যতা থাকলে আমরা জগতের সৌন্দর্য রাজ্যে প্রবেশাধিকার পাই না।”
” ভাইয়া আমি কি এত্তগুলা বড় যে আমার সাথে গম্ভীর কথা বলো?”
“তুই কি ছোটো নাকি? তুই তো হলি বলদ। আফ্রিকান বলদ। না হলে ঠিক বুঝতে পারতি। হ্যাঁ রে! তুই না ক্লাস টেন এ পড়ছ? তাইলে এটা বুঝছ না কেন? বুঝেছি নকল করছোছ পরীক্ষায়।”
আরিবা রেগে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকালো। নাহ সে আর এর সাথে কথাই বলবে না। এ শুধু তাকে পচানোর পলিসি খোজে। এদিকে আরশ খুব খুশি হলো যাক মেয়েটাকে অবশেষে রাগানো গেলো। সত্যি রাগলে আরিবাকে অনেক সুন্দর লাগে। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মেয়েরাই যে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এই বিষয়ে আরশের কোনো সন্দেহ থাকলো না। আরিবা এমনিতেও বাচ্চা গাল ফুলালেতো আরও লাগে। আরশ আবশেষে বললো –
“শোন! যদি কেউ নিজেকে ভালো বাসতে না পারে অন্যকে ভালো বাসবে কিভাবে তেমনি এটাও। আমারা নিজেদের সৌন্দর্যে আগে মুগ্ধ হই তারপর প্রাকৃতিক দৃশ্যে!”
” তাহলে ভাইয়া অনেকে যে বলে আমি তোমাকে আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি ওটা?”
“আরে বোকা! কোনো মানুষ যাকে খুব ভালোবাসে তাকে ঘিরেই সে সব সুখ অনুভব করে।সে সব সময় চাইবে তার ভালোবাসার মানুষ টা ভালো থাকুক। কল্পানায় বাস্তবে সব জায়গায় তার বিচরণ, তাকে ছাড়া তার বাঁচা খুব কষ্টের তাই এসব বলে। আর যদি সে বেঁচেই না থাকে তো অন্যকে ভালোবাসবে কিভাবে বোকা? তাছাড়া আমরা…
এক সেকেন্ড তুই এই কথাটাই কেনো বললি?”
আরিবা বুঝতে পারলো না। অগত্যা সে জিজ্ঞাসা করলো–
” কোন কথা ভাইয়া?”
” ওই যে মানুষ বলে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি ওটা? কোন ছেলে বলছে?”
আরিবা আমতা আমতা করে বললো–
“কেউ বলেনি ভাইয়া। এটাতো কমন কথা”
“তোর চোখ বলে তুই মিথ্যাবাদী”
আরিবা এবার ধরা খাওয়া চোরের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। আরশ আবার বললো–
“এদিক ওদিক তাকালেই আমি বিশ্বাস করে নিব? বল কে ছেলেটা? এত সাহস কি করে পেলো ওই জানোয়ারটা? ক্লাস টেন এ পড়া মেয়েকে এসব বলে!”
রাগে চেয়াল শক্ত হয়ে এলো আরশের। ওই ছেলের কলিজা কত বড় তার দেখতেই হবে। ওর নিজের কেনা সম্পত্তিতে দখলদারী করবে কার সাহস এত?
“ভাইয়া আমিতো বড়ই। আমার ফ্রেন্ডরাও প্রেম করে। ডেটিং এ যায়।”
এমনিতেই আরশ রেগে আছে তার উপর আরিবার এই কথা। সে যেনো স্থীর থাকতে পারলোনা। আরিবার দুই বাহু খামছে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো–
“ওহ! তুই বড়! প্রেম করার শখ জাগছে? স্কুলে প্রেম করতে যাছ? তার থেকে ভালো কাল কাকাকে বলবো যেনো তোকে বিয়ে দিয়ে দেয়।”
আরশের রাগে আরিবা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে তার উপর সে হাতেও ব্যাথা পাচ্ছে। তাই সে কাপা কাপা গলায় বললো–
“নাহ ভাইয়া ভুল হয়েছে আমি এসব বলতে চাইনি। তুমি বুঝতে ভুল করছো।”
“তাই নাকি? আমি এখন বুঝতেও ভুল করি?”
আরিবা এবার সত্যি সত্যি শব্দ করেই কেঁদে দিল। আরশ আর যাই হোক আরিবার কান্না ও দেখতে পারেনা। তাই সে ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে আসতে বললো–
” রাত অনেক হইছে। ঘুমাতে যা। কাল দেখবো এসব।”
আরশ আরিবাকে একা রেখে চলে গেলো। আরিবা ওখানে দাড়িয়ে আরশের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
সূচনা পর্ব
চলবে…….
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আমার লেখায় ভুল থাকলে আমায় শুধরে দিবেন। যেহেতু আমি নতুন লেখিকা। গল্পটা রহস্য ভাবে লিখতে চাচ্ছি জানিনা কেমন হয়েছে। আপনাদের ভালো লাগলে লিখবো। ধন্যবাদ)