#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২৯
💖
গভীর রাত। ঘুমিয়ে আছে সবাই। চারপাশ থেকে কিছু কিছু পোকার শব্দ আসছে। মাঝে মাঝে দু একটা জোনাকি পোকা দেখা দিচ্ছে। এই অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। আরশ এই সৌন্দর্য্য দেখছে আবার চোখ ফিরিয়ে ওর মায়াপরীকে দেখছে। নাহ! ওর কাছে এই সৌন্দর্য্যের চেয়েও ওর মায়াপরীর সৌন্দর্য অনেক বেশি। আল্লাহ যেনে ওকে প্রকৃতির সব লাবন্য দিয়ে সৃষ্টি করেছে। হালকা করে আরিবার গাল ছুঁতে গিয়েও হাত সরিয়ে আনলো আরশ। মনে মনে ভাবলো। “নাহ এটা ঠিক হবেনা। এখন ওকে ছোয়া মানেই ওর ঘুমের সুযোগ নেওয়া। তার থেকে ভালো মন ভরে ওকে দেখি।”
গল্প করতে করতে আরিবা আরশের কাঁধের উপর ঘুমিয়ে পরেছিলো। আড্ডা শেষে আরশ সবাইকে বললো। “তোমরা নিজেদের কটেজে যাও। আমি আরিবাকে বেডে রেখে আসছি।” ওর কথা শুনে সবাই নিজেদের কটেজে চলে গেলো। আরশ আরিবার দিকে তাকাতেই ওর নেশা লেগে গেলো। এই সুন্দর পরিবেশে ওর মায়াপরীকে দেখার নেশা। তাই আরিবাকে নিজের কোলে শুইয়ে দিলো। ও আরিবার কটেজের বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে আছে। আর আরিবাকে দেখছে। একটু পরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো।
“হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী আমার এই পবিত্র ভালোবাসার
যেখানে বারবার সুযোগ পেয়েও নিজেকে সংযত রেখেছি।
প্রকৃতি! তুমি সাক্ষী থাকো আমার জীবন্ত ভালোবাসার
যে ভালোবাসাটা আমি সারাটা জীবন বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
হে জোনাকি! তুমি দেখো আমার যতনে রাখা ভালোবাসা
যাকে আমি সারাজীবন এই বুকে আগলে রাখতে চাই।
হে চাঁদ! তুমি সাক্ষী আছো আমার মনমুগ্ধকর ভালোবাসার
যখন তোমার আলোয় মুগ্ধ হয়েছি মায়াপরীর সৌন্দর্যে।”
——————————-
ভোরের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো আরিবার। আলসামি কেটে নড়তে গিয়ে দেখলো আরশ ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। এটা দেখেই আরিবার আত্মা কেঁপে উঠলো। চিৎকার করে উঠলো আরিবা। ওর চিৎকারে আরশের ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্ত নিয়ে পিটপিট করে চোখ খুললো। ওর চোখে অনেক ঘুম। সারারাত আরিবাকে দেখে একটু আগেই ঘুমিয়ে ছিলো। আরিবার চিৎকারে ওর কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় ক্ষেপে গেলো। আরশ ঘুম থেকে উঠেই ধমক দিয়ে বললো।
“কি হইছে? এমন চিৎকার করে উঠলি কেনো?”
“তুমি এখানে কেনো? আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলে কেনো?”
জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কথাটা বললো আরিবা। আরশ ধমক দিয়ে বললো।
“তুই নিজেই আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ছিলি। সারারাত আমায় ঘুমোতে দেছনি আবার আমায় রাগ দেখাছ? ফাজিল! থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিবো।”
আরশের রাগে আরিবা দমে গেল। তবুও হালকা রাগ দেখিয়ে বললো।
“আমি ঘুমিয়ে পড়লে বেডে শোয়াওনি কেনো?”
আরশ চিন্তায় পরে গেলো। এবার কি বলবে? এবার রাগ দেখিয়ে বললো।
” রাতে ঘুমোতে দেছনি এখন আবার প্রশ্ন? যা এখান থেকে! তোর জন্য সূর্যোদয় দেখতে পারিনি।”
আরিবার সূর্যোদয়ের কথা মনে পরতেই কান্না পেয়ে গেলো। কাল রাতে কত শখ করে রেখেছিলো সকালে হেলিপ্যাডে গিয়ে সূর্যোদয় দেখবে তা আর হলো না। আরশ আরিবার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। আরিবা রাগ নিয়ে ওর মা বাবার কটেজের দিকে গেলো।
আরিবা একটু বের হতেই দেখলো এক জায়গায় ওর মা বাবা কাকা কাকিমনি আছে। ও রাগ নিয়ে ওখানে গেলো। গিয়েই রেগে বললো।
” এখানে বসে ঢং করা হচ্ছে না? আমাকে সকালে ডাকোনি কেনো? কি করছিলে সবাই?”
আরিবার রাগ দেখে মি. জাকির ওর কাছে আসলেন। মেয়ে রেগে গেছে মানেই অনেক কিছু। মেয়ে রাগলে তাকে খুব ভয় পায় মি. জাকির। তাই মাথায় হাত ভয়ে ভয়ে বললো।
“কি হইছে মামনি? আরশ আবার বকছে? ওকে আমি বকে দিবো তুমি রাগ করো না।”
আরিবা ওর বাবার হাতটা মাথা থেকে ঝাড়া মেরে ফেলে দিলো। বুকে হাত বেঁধে অন্য দিকে ফিরে গেলো। সবাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে মেয়ে আর বাবার মান অভিমান দেখছে। আরিবার মা ওকে ধমক দিলেন। তাতে কিছুই হলোনা। উল্টো গাল ফুলিয়ে বললো।
” আব্বু তোমার সাথে আড়ি!”
” কেনো মামনি? কি করছি আমি?”
” আজ সকালে আমাকে ডাকোনি আমি সূর্যোদয় দেখতে পারিনি। মুডটাই খারাপ হয়ে গেলো।”
“মামনি ভুল হইছে সরি!”
আরিবা কিছুই বললোনা। আরও গাল ফুলালো। মি. আফজাল আরিবার দিকে এগিয়ে বললো।
” মামনি! আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমরা শাস্তি পেতে রাজি আছি। ”
মিসেস তারিন ও স্বামীর একমত হলেন। আরিবা হাসি দিয়ে বললো।
“আজ আমরা সবাই অনেক জায়গায় ঘুরবো। সারাদিন ঘুরবো। রাজি সবাই? রাজি থাকলে এক হাত চাপুন.. না মানে এক হাত তুলুন, না থাকলে দুহাত তুলুন।”
সবাই এক হাত তুললো। মি. আঞ্জুমান তাড়াতাড়ি করে বললেন।
“শুধু ঘুরলেই হবে? রাতে কিছু খাছনি খেয়াল আছে? চল আগে খেতে হবে তারপর ঘোরাঘুরি। ”
আরিবা তাড়াতারি চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেস হয়ে একটা জিন্স আর কামিজ পড়লো। সাথে ম্যাচিং হিজাব পড়লো। আরিবার গাউন পড়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু গাউন পড়ে ঘোরাঘুরিটা একটু কষ্টের তাই এগুলোই পড়লো।
আরিবা রেডি হয়ে বের হতেই সামনে আরশকে দেখতে পেলো। হেসে হেসে সজলের সাথে কথা বলছে। ওর হাসি দেখলেই আরিবা গলে যায়। এত সুন্দর হাসি ও আর কারও দেখেনি। আরশের হাসিতে ক্রাশ খাবে সবাই। আরিবা খুটিয়ে খুটিয়ে আরশকে দেখছে। আরশ সাদা একটা শার্ট ইন করে পরেছে। আরশের সুঠাম দেহের প্রতিটা ভাজ বোঝা যাচ্ছে। সাদা শার্টে ওকে বরাবরই খুব সুন্দর লাগে। তাছাড়া ওর সুন্দর বডির জন্য সব পোশাকেই ওকে সুন্দর লাগে। এক হাতে কালো কোর্ট ধরে রেখেছে৷ অপর হাতে সুন্দর একটা ঘড়ি। ফর্সা হাতে ঘড়িটা খুব সুন্দর মানিয়েছে আরশকে। চুলগুলো সুন্দর করে উল্টিয়ে রেখেছে। সাদা বিলাই চোখগুলোতে রোদের কিরন লেগে খুব সুন্দর লাগছে। আরিবা এক ভাবনায় চলে গেলো।
“কিরে এমন ধ্যান করে কার কথা ভাবোছ? দিন দিন কিন্তু তুই খুব ফালতু হয়ে গেছোছ?”
আরশের ধমক শুনে আরিবার ধ্যান ভাঙলো। আরিবার ভাবনার মাঝে আরশ কখন ওর সামনে চলে আসছে ও বুঝতেই পারেনি৷ ও এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে ওর মা বাবার কাছে চলে গেলো।
আরিবারা সাজেকের নামকারা মনটানা রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা করলো। তারপর ওরা লুসাই গ্রামে ঘুরতে গেলো। সেখানে ওরা নানা ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হলো। ওখানে অনেক সময় কাটানোর পর ওরা স্হানীয় একজন গাইড নিলো। তাকে সাথে করে দুই ঘন্টার মতো ট্রেকিং করে কমলক ঋর্না দেখতে গেলো। পাহারের গা গেসে প্রবাহিত এই ঋর্নার সৌন্দর্য মানুষের মন কেড়ে নেয়। সত্যি অপরূপ দৃশ্য এটি। আরিবা পুরাই মুগ্ধ। সারাদিন ওরা সাজেকের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করলো।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো এলো। এসেই আরিবা শাওয়ার নিলো। আরিবার খুব ইচ্ছা ছিলো শাড়ি পড়ে সন্ধ্যা বেলা এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে। তাই ও লাল সিল্কের শাড়ি সাথে নিয়ে এসেছিলো। আরিবা শাওয়ার নিয়েই ইউটিউব আর শাড়ি নিয়ে যুদ্ধে নামলো। ঘন্টা দেড়েক যুদ্ধ করার পরে ও সফল হলো। আরিবা কখনও শাড়ি পরেনি। ও শাড়ি সামলে রাখতে পারেনা তাই কখনও পরে না। আজ পড়লো শুদু পিক তুলেই খুলে রাখবে। আরিবা শাড়ি পড়ার পর অনেক গুলো সেলফি তুললো। পরে মনে হলো ওকে ফুল পিক কে তুলে দিবে? ভাবতেই আরিবা কপাল চাপড়ে বললো। “হায় রে রিবা! তুই সত্যিই গাধী। এবার পিক কে তুলে দিবে?” এসব বলেই তুড়ি মেরে বললো। ” পেয়েছি! আম্মু বা কাকিমনিকে ডেকে আনি।” কথাটা বলেই আরিবা ওর মায়ের কটেজে গেলো। বাইরে দাড়িয়ে ওর মাকে ডাকতেই তিনি ধমক দিয়ে বললেন।
” তোর জন্য আজ কত ঘোরাঘুরি শরীর অসুস্থ হয়ে পরেছে। এখন আবার আসছোছ ঢং করতে? যা এখান থেকে!”
আরিবা ঠোঁট উল্টে বললো।
“আম্মু শাড়ি পড়ছি তো। দুটা পিক তুলবো।”
” তোর দুটা মানেই দুই হাজার। কেউ ভয়েও তোর পিক তুলতে যাবেনা। যে যাবে সে পিক তুলতে তুলতে বেহুশ হয়ে যাবে।”
আরিবা ওর মায়ের ধমক শুনে মিষ্টি করে বললো।
“না আম্মু আজ সত্যি দুটা তুল..”
আরিবার মিষ্টি কথায় ওর মায়েদ মন ভিজলো না। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ধমক দিয়ে বললেন।
“গেলি এখান থেকে?”
আরিবার মায়ের চিল্লাচিল্লিতে আরিবার বাবার ঘুম ভেঙে গেলো। তিনি ক্লান্ত স্বরে বললেন।
“আমরা অনেক ক্লান্ত মামনি! প্লিজ রেস্ট নিতে দাও!”
বাবার অসহায় কথা শুনে ওর কাকিমনির কাছে গেলো। তিনি আরও ক্লান্ত। এসেই ঘুমিয়ে পরছে।আরিবা অসহায় হয়ে আরশের কাছে গেলো। দরজায় দাড়িয়ে বললো।
“ভাইয়া ফ্রি আছো? আমি কি আসবো?”
আরিবার মিস্টি কথা শুনেই আরশের খটকা লাগলো। ফোন টিপতে টিপতে কপাল কুচকে রাগ নিয়ে বললো।
“তুই আবার অনুমতি নেছ কবে থেকে? দরজা খোলাই আছে। আয়!”
অগত্যা আরিবা কটেজের মধ্যে প্রবেশ করলো। আরশ ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো।
“কি ব্যপার? আমার কাছে কি দরকার পরলো তোর?”
আরিবা জোর পূর্বক হেসে বললো।
” ভাইয়া আমার কটা পিক তুলে দাও প্লিজ।”
” তোর পিক তুই তুলতে পারছ ন..”
কথাটা বলতে বলতে আরিবার দিকে তাকিয়েই থেমে গেলো আরশ। আপনা আপনি ওর মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। আরিবার দিকে তাকিয়ে ও হতবাক। ওর শরীরে অজানা বাতাস ছেয়ে গেলো। আরিবাকে কখনও শাড়ি পড়তে দেখেনি। আজ প্রথম দেখছে। একদম অপ্সরার মতো লাগছে। পা থেকে মাথা প্রযন্ত খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। ফর্সা শরীরে লাল শাড়িটা খুবেই সুন্দর লাগছে। আরিবাকে এখন একদম পরিপূর্ণ নারীর মতো লাগছে। হালকা সেজেছে আরিবা। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়েছে। ওকে পাগল করার জন্য এটুকেই যথেষ্ট। আরশ যেনো আর নিজের মধ্যে রইলো না। বেডের উপর ফোনটা রেখে আস্তে করে আরিবার দিকে এগিয়ে গেলো। ওকে এমন দেখে আরিবা ভয় পেয়ে গেলো। ওর হৃদয় অজানা ভয়ে ধুকবুক করতে লাগলো। কিছু বলতে গিয়েও পারলোনা। গলায় দলা বেধে আটকে গেছে। আরশকে আগাতে দেখে ও পিছিয়ে গেলে। একটু পিছাতেই ওর পিঠ বাঁশের দেয়ালের সাথে লেগে গেলো। আরিবা ভয়ে বড় বড় ঢোক গিলতে লাগলো। আরশের সে দিকে খেয়াল নাই। ও তো ওর মায়াপরীর সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। মায়াপরীর সৌন্দর্য দেখায় এতই ব্যস্ত যে ও খেয়াল করেনি ওর মায়াপরী কতটা ভয় পেয়ে আছে। আরশ বেখেয়ালি ধ্যানে আরিবার কাছে গিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো।
“যে সৌন্দর্য্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে
তা কি তুমি কখনও দেখতে পেয়েছো?
আমি এই সৌন্দর্যে আগুনে বারবার পুড়েছি
তা কি তুমি অনুভব করতে পেরেছো?
এই সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছি হাজার বার
তা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
আমি ঘায়েল হয়ে যাই, হারিয়ে যাই তোমার সৌন্দর্যে।
এই সৌন্দর্যে দেখার অধিকার আমার
শুধু এবং শুধুই আমার।
আরশের কথা শুনে আরিবার ভিতরে কেমন যেনো লাগছে। আরিবার মনে হচ্ছে ওর শরীর অবস হয়ে গেছে। ও কথা বলতে ভুলে গেছে। আরশ এসব কি বলছে? এমন করছে কেনো? এই আরশ ওর কাছে আসলেই অজানা!
💝
ইনশাআল্লাহ চলবে…..