#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩১
💖
ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপের সামনে বসে আছে আরিবা। বিষন্ন মন নিয়ে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যস্ত শহরের কোলাহল ওর মনকে করে তুলেছে বিষন্ন। ওর মন এই কোলাহল থেকে একটু প্রাকৃতির ছোয়া চায়। তাই শহরের এই কোলাহল এড়াতে এই মধ্য রাতে চা নিয়ে বেলকনিতে আসছে। আরিবার একাকী থাকতে খুব ভালো লাগে। সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় তখন নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভালো লাগে ওর।
আষাঢ় মাস বাইরে হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রীষ্মের ঝলসানো রোদ থেকে প্রাকৃতিকে একটু সজীবতা দিতেই হয়তো এই বৃষ্টির আগমন। আরিবা চায়ের কাপটা রেলিংয়ের উপর রেখে সামনে হাত বাড়ালো। বৃষ্টির কনাগুলো হাতে স্পর্শ করছে। অতঃপর আরিবার হাত বেয়ে তা নিচে গড়িয়ে পড়লো। আরিবার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। ও খুব ভালো করে এটা উপভোগ করছে। সাজেক থেকে আসার পর এমন মজা পায়নি ও। সাজেকের মতো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ওখান থেকে এসেই পড়ালেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ও। সাজেক থেকে এসেছে প্রায় ছয় মাস। তবুও আরিবা কিছুতেই সাজেকের সৌন্দর্য ভুলতে পারেনা। সাজেকের কথা মনে উঠতেই আরিবার গায়ের পশম নাড়া দিয়ে উঠলো। আরশের কথাগুলো এখনও ওর খুব মনে পড়ে। ও বুঝেনা ওই তিনদিন আরশের কি হয়েছিলো। সাজেক থেকে আসার পর আরশ আর ওমন করেনি। আগের মতো হয়ে গেছে। তবে আরিবার পিছনে লাগে কম। এখন আরশ অনেক ব্যস্ত তাই হয়তো লাগেনা। আরিবা বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে চা খেলো।
চায়ের কাপটা রেখে এসে দোতলায় পা রাখতেই কান্নার আওয়াজ পেলো আরিবা। সামনে আগাতে গিয়েও থমকে গেলো ওর পা। আরিবা খুব ভয় পাচ্ছে। সামনের বার দেখতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পরে গেছিলো। ভিতরে ভয়ংকর কিছু দেখেছিলো। তবে ওর মন কিছুতেই শান্ত হয়না। আরিবা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ও কিছুতেই ভুতে বিশ্বাস করেনা৷ অন্য কিছু হবে হয়তো। কি সেটাই ওর দেখতে হবে। ও নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে গেলো। কাপা কাপা হাতে দরজাটা খুললো। কান্নাটা এখন একটু জোরে শোনা যাচ্ছে। আরিবা ঢোক গিলে মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করলো। স্টোর রুমের ভিতরে লাইট মারতেই ওর গা হীম হয়ে এলো। ভিতরে মনে হচ্ছে কোনো কোনো ভুতের ঘর। মাকড়সায় বাসা বেধে পুরো ঘর আটকে ফেলছে। ধুলোবালি জমে ডাস্টবিন হয়ে আছে।
আরিবা আস্তে করে রুমে পা রাখলো। এই অন্ধকার রুমে এমন কান্নার আওয়াজ খুবেই ভয়ানক। আরিবার খুব ভয় লাগছে। আরিবা ভয়ে ভয়ে পা ফেলছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ধুলোবালি ওর নাকে লাগতেই কাশতে শুরু করলো। তবুও মুখে হাত দিয়ে সামনে যেতে লাগলো। একটু যেতেই মাকড়সার জালে পেচিয়ে পড়ছে আরিবা। বিরক্তি নিয়ে হাত দিয়ে মাকড়সার জাল সরিয়ে সামনে যাচ্ছে আরিবা। আওয়াজ টা অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই একটা আলমারি দেখতে পেলো। আলমারি দেখেই ও ভয় পেয়ে গেলো। ভুতের মুভিতে দেখছে আলমারিতে ভুত লুকিয়ে থাকে। যদিও আরিবা বিশ্বাস করেনা তবুও ওর ভয় লাগছে। খুব মারাত্মক ভয়। গায়ের পশম নাড়া দিয়ে উঠলো। আলমারির কাছে আগাতেই ওর মনে হলো পিছনে কেউ আছে। ভয়ে হাটা থামিয়ে দিলো। বুকের মধ্যে টিপটিপ করছে ওর। চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম নিতে লাগলো। আস্তে করে পিছনে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই। আরিবা এবার আরও ভয় পেলো। আবারও মনে হলো ওর পিছনে কেউ আছে। আরিবা পিছনে ঘুরতেই দেখলো কেউ নেই। ও বুঝতে পারছেনা এটা কি ভ্রম নাকি সত্যি? আরিবা আলমারি খুলতে সাহস পেলো না। হঠাৎ করেই ওর আরশের কথা মনে হলো। এবার ওর আরশকে জানাতেই হবে। ও দৌড়ে বেড়িয়ে এলো। আরশের রুমের দিকে গেলো।
আরিবা দরজা খুলেই দেখলো আরশ রুমে নেই। এত রাতে আরশ কোথায় গেছে এটাই বুঝতে পারছেনা আরিবা। হঠাৎ করেই ওর স্টাডি রুমের কথা মনে পড়লো। ও দৌড়ে স্টাডি রুমের দিকে গেলো। তাড়াহুড়ো করে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ডুকলো আরিবা। দরজা জোরে ধাক্কা দেওয়ায় খুব শব্দ হলো। আরশ বই পড়তে ছিলো। শব্দ শুনে চমকে সামনে তাকালো। সামনে তাকিয় আরিবাকে দেখতে পেলো। আরিবার মুখে ভয় স্পষ্ট, চুলগুলো এলোমেলো কেমন ঘেমে আছে। আরশ ভয় পেয়ে গেলো। বইটা রেখে তাড়াহুড়ো করে আরিবার কাছে আসলো। দুহাতে ওর গাল দুটো আগলে আতঙ্ক নিয়ে বললো।
“এই রিবা! কি হইছে? কে কি কলচে বল আমাকে? ভয় পাইছোছ? কে ভয় দেখাইছে?”
আরিবা খুব ভয় পেয়ে আছে। ভয়ে কথাই বলতে পারছেনা। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কাপা কাঁপা গলায় বললো।
” ভাইয়া! ভাইয়া আমি… ওখানে… ওখানে কান্না..”
আরিবা কিছুই বলতে পারলোনা। আরিবাকে ভয় পেতে দেখে আরশ আরও ভয় পেলো। ওকো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো করে বলতে লাগলো।
“ভয় পাইছ না। আমাকে বল কি হইছে? কে তোকে কষ্ট দিছে বল? আমি তাকে খুন করে ফেলবো। আমি একদম তাকে মেরে ফেলবো। বল আমাকে!”
আরিবাও আরশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর আরিবা একটু ঠিক হলো। আরশ ওকে পাশে বসিয়ে পানি খেতে দিলো। রিবা পানি খেয়ে থেমে থেমে বললো।
“ভাইয়া স্টোর রুমে কেউ আছে।”
আরিবার কথায় আরশ চমকে গেলো। কিছুই বুঝতে পারলোনা ও। কপাল কুচকে আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“মানে?”
“ভাইয়া ওই রুমে কোনো মহিলা আছে। আমি তাকে কান্না করতে শুনছি। সত্যি বলছি ভাইয়া।”
“সত্যি মানে? এই বাড়িতে কাঁদার মতো কে আছে? কে কাঁদবে? আর কাঁদার জন্য এত রুম রেখে ওই রুমে কেউ যাবে কোন দুঃখে?”
আরিবা আশ্বস্ত করে বললো।
“ভাইয়া আজও আমি শুনছি। আমি ওই রুমে গিয়েছিলাম। ওই রুমের আলমারি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। আমি নিজে কানে শুনছি ভাইয়া। ”
আরিবা ওই রুমে গেছে শুনেই আরশ চমকে গেলো। অবাক হয়ে বললো।
“কি! তুই একা এই রাতে ওই রুমে গিয়েছিলি? যদি কিছু হতো? ভয় নেই তোর? কত পোকামাকড় আছে। এত সাহস কই থেকে পাছ তুই?”
শেষের কথাটা আরশ রাগ দিয়ে বললো। আরিবা ভয়ে ভয়ে বললো।
“ভাইয়া সে সব পরে হবে। আগে তুমি চলো তুমিও শুনবে। ভাইয়া আমি নিজ কানে শুনছি।”
দুজনে স্টোর রুমে চলে গেলো। আরিবা গিয়েই অবাক হয়ে গেলো। কান্নার আওয়াজ টা আসছেনা। কি করে হতে পারে? ও তো একটু আগেও শুনে গেলো। এখন কি হবে? আরশ তো ওকে ছেড়ে দিবেনা। আরিবা ভয়ে ভয়ে আরশের দিকে তাকালো। দেখলো আরশ রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরিবা ভয়ে ঢোক গিলে বললো।
“ভাইয়া সত্যি বলছি। আমি শুনছি। না হলে এত ভয় পেতাম বলো? মিথ্যা হলে এত রাতে তোমাকে তো ডাকতাম না তাইনা? গড প্রমিজ!”
শেষের কথাগুলো আরিবা অসহায় মুখ করে বললো। আরশ শান্ত হয়ে বললো।
“যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এই বিষয়ে কাউকে বলবিনা। কারও সাথে আলোচনাও করবিনা। তোর মা বাবা ও বন্ধুরাও না ওকে? মনে থাকবে? আর কখনও কান্না শুনলেও এই রুমে ডুকবি না। ভুলেও না? যা এখন!”
আরিবা আস্তে করে মাথা নিচু করে চলে এলো। রুমে যেতেও ওর ভয় লাগছে। ভয়ে ভয়ে রুমে গিয়েই শান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো ও।
—————————-
“কিরে এই দুপুরে তোর উঠার সময়? আরশের পড়া লেখা শেষ তবুও বই পড়ে সবসময়। আর তুই? নিজের ক্লাসের পড়াই পড়োছ না। এই পড়ায় পাশ জুটবে কপালে? ধরে রিক্সা ওলার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো।”
রাতে এইসব কারনে ঘুম হয়নি আরিবার। তাই সকালে উঠতে পারেনি দেরি হয়ে গেছে। কলেজের টাইম হয়ে গেছে। তাই একসাথে রেডি হয়েই তাড়াহুড়ো করে ডাইনিং টেবিলে বসতে গেলো। হঠাত ওর মায়ের এসব শুনে কপাল কুচকালো। ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
“এত পড়া পড়া কইরো না তো আম্মু। এই যে তোমার আরশ! এত পড়ে দেখেবে কয়দিন পর কানা হয়ে গেছে। তখন তোমার সাধের আরশ চশমা পরে বলবে ‘কাকিমনি কই তুমি? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।’ তখন ভালো হবে। শোনো ভালো একটা উপদেশ দেই তারাতারি বিয়ে করিয়ে দাও তাকে নাহলে মেয়ে পাবেনা। কানার কাছে কে মেয়ে দিবে?”
আরিবার কথা শুনে সবাই ঠোঁট চেপে হাসছে। আরশ রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বললো।
“আমার বিয়ে নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা। জানোছ কত মেয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য লাইন ধরে আছে? এখন বললে ১০০জন চলে আসবে।”
“এহহ বললেই হলো? ভালো করে পরীক্ষা করলে একটাও টিকবেনা। গিয়ে দেখো ওই মেয়ে গুলো সবই হিজরা।”
আরিবার কথা শুনে আরশ কেশে উঠলো। পানি খেয়ে রেগে আরিবার দিকে তাকালো। আরিবা আরশকে পাত্তা না দিয়ে ভাব নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেলো। ওর বাবা আর কাকার দিকে তাকিয়ে বললো।
“আমি ঠিক বলছিনা বাবা?”
মি. জাকির ও মি. আফজাল ঠোঁট চেপে হেসে একসাথে বলে উঠলেন।
” আমার মামনি ভুল বলতেই পারেনা।”
আরিবা আরশের দিকে তাকিয়ে ভেংচি দিয়ে খেতে লাগলো। দু কামড় খেয়েই উটে গেলো। মিসেস তারিন আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া কর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস। পরোটা দুটো খেয়ে যায়।”
“কাকিমনি আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
কেউ কিছুই বললোনা। জানে বললেও খাবে না ও। মিসেস আঞ্জুমান রেগে বললেন।
“খাওয়া দাওয়া করবি কেনো? দিন দিন শুকিয়ে বাস পাতা হবি। তোর খাওয়াও লাগবেনা পড়াও লাগবেনা। কলেজে যাছ কি করতে তুই?”
আরিবা কপাল কুচকে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
“আম্মু আমার আম্মু তুমি তো জানো
মন বসেনা আমার পড়ার টেবিলে।
একদম শাবনুরের মতো।”
কথাটা বলেই আরিবা উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
💝
ইনশাআল্লাহ চলবে…
(রি-চেইক করিনি ভুলত্রুটি মাফ করবেন। এতদিন বিজি চিলাম তাই গল্প দিতে পারিনি। এখন থেকে নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ)