#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৬
💝
কোলাহলপূর্ন পরিবেশটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। হাস্যজ্জ্বল সব মানুষের মাঝেই বিরাঝ করছে শোকের ছায়া। সবাই একেক জায়গায় নিস্তব্ধ হয়ে আছে। সবাই অনুভূতি শূন্য। কেউ বুঝতে পারেনি এমন হবে। মাঝে মাঝে এমন কিছুও হয় যা সবার ধারনার বাইরে হয়। হঠাৎ করেই যেনো সব ঘটে গেলো। আরিবা নেত্রার মাথার পাশে বসে নিরবে চোখের জল ফেলছে। ওর পাশে বসে কাঁদছে শান্তা তূর্য শাওন। শব্দ করে কাঁদার মতো শক্তি ওদের শরীরে নেই। চোখ দিয়ে নিরব ধারায় অনর্গল পানি পরছে।
তখন চিৎকার শুনে পিছনে তাকিয়েই নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো আরিবা। পা দুটো অবশ হয়ে আসছিলো ওর। তবুও ধীর পায়ে সামনে আগাতে লাগলো। পার্টির সব কিছু যেনো থেমে গিয়েছিলো। নেত্রা ছাঁদ থেকে পড়ে গেছে। এটা দেখেই সবাই দৌড়ে কাছে গেলো।
নিদ্র থককে অনুভুতিহীন ভাবে দাড়িয়ে রইলো। দৌড়ে নেত্রার দিকে আগাতেও ভুলে গেছে। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ওর বোনের দিকে। ওর বোন? ওর কলিকার টুকরা বোন ছাঁদ থেকে পরে গেছে এটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। আরশ দৌড়ে এলো ভিতর থেকে। নেত্রার মা বাবা এসেই মেয়েকে ধরে চিৎকার করে উঠলেন। মি. জাকির ও মি. আফজাল এম্বুলেন্স খবর দোওয়ার জন্য বলছে। আরশ নেত্রাকে চেইক করলো। পাশে দাঁড়ানো শাহীন জিসানের দিকে এক পলক তাকালো। ওরা অসহায় ভাবে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে আরশের দিকে। ওর নিরবতায় সবাই আরও ভয় পেয়ে আছে। আরশ টলমলে চোখে সবার দিকে তাকালো। জিহবা দিয়ে ঠোঁট টা ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।
“সী ইজ ডেড!”
একথা শুনেই চিৎকার করে বেহুশ হয়ে পরলেন নেত্রার মা। মিসেস আঞ্জুমান ও মিসেস তারিন তাকে ধরলেন। তাদের গায়েও শক্তি পাচ্ছেন না। মেয়ে হারানোর কষ্ট তারা বোঝেন। চারপাশ থেকে অনেকেই বলছে নেত্রা আত্নহত্যা করেছ। না হলে অত উচু রেলিং ডিঙ্গিয়ে পড়লো কিভাবে? কতাটা আসলেই সত্যি। আরশদের রেলিং উচু। ওই জায়গা থেকে পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা নেই। প্রায় মানুষেই কানাকানি করছে হয়তো প্রেম ছিলো। প্রেমিক ছেরে দিছে তাই আত্নহত্যা করেছে। আরশ সবাইকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। নেত্রার বাবা হাসিব সাহেব কান্না ভেজা চোখে মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়ের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ঠুকরে কেঁদে উঠলেন। কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন।
“মা রে! এটা কি করলি তুই এটা? তুই আমাদের ছেড়ে গেলি কেনো মা? তোকে ছাড়া আমরা কি করে থাকবো? এই বাবার কথা একটি বার ভাবলি না?”
এসব বলেই আবারও কেঁদে ফেললেন তিনি। খুব ভালোবাসতেন নিজের মেয়েকে। কে জানতো এত তাড়াতাড়ি তার কলিজা ছেড়া ধন তাকে ফেলে চলে যাবে? আরিবার গাল গড়িয়ে চোখের পানি পরছে। চোখের পানিতে চারপাশ ঝাপসা দেখছে। অনেক কষ্টে সবার ভীর ঠেলে মাঝে প্রবেশ করলো। সামনে যেতেই নেত্রার থেতলে যাওয়া মুখ দেখে শব্দ করে কেঁদে ফেললো। নেত্রার বাবা আরিবাকে দেখেই আরও কেঁদে দিলেন। ওর দিকে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন।
“দেখ মা। কি হইছে আমার মেয়ের? আমার মেয়েটা কথা বলেনা। কিভাবে নিঃশ্চুপ শুয়ে আছে দেখ? আমাকে আর আব্বু বলে ডাকবেনা ও..”
তিনি আর বলতে পারলেন না। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার। আরিবা নিশ্চুপ হয়ে বসে পরলো নেত্রার পাশে। ওর একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর খেলার সাথী। যার সাথে ও সব কিছু শেয়ার করতো আজ সে নিঃশ্চুপ শুয়ে আছে। আরিবার মনে পরে গেলো নেত্রার সাথে কাটানো মূহুর্ত। ওর সাথে কত হাসি কত আনন্দ। আরিবা নেত্রার মাথাটা ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেললো। কান্না কান্না কন্ঠে বললো।
“এই নেত্রা ওঠ বলছি! আমার হাতের থাপ্পড় না খেলে তুই উঠবিনা আমি জানি। না মারতে তাড়াতাড়ি ওঠ বলছি।”
শান্তা কান্না ভেজা চোখে আরিবার পাশে বসলো। ওর কাঁধে হাত রাখতেই ও নাক টেনে শান্তার দিকে তাকালো। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ওদের কান্না দেখে তূর্য আর শাওন নিজেদের আটকাতে পারলোনা। ওদের জড়িয়ে ধরে দুজনে কান্না করে দিলো। প্রানপ্রিয় বান্ধবীর শোকে কাতর হয়ে গেছে ওরা।
সবার সরগোল শুনে নিদ্র নিরব ভাবে হেলেদুলে ওদের দিকে আগাচ্ছে। ওর পা চলছেনা নিজেকে ওর পঙ্গু মনে হচ্ছে। অনেক কষ্টে ওখানে আসলো। সবার অনেক ভীর, সবাইকে ঠেলে ভিতরে গেলো। নিদ্র ভিতরে যেতেই সবাই হতাশ চোখে ওর দিকে তাকালো। আরশ জিসান শাহীন চোখটা মুছে নিজের বন্ধুর পাশে দাড়ালো। হাসিব সাহেব ভেজা চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলেকে এমন নিরব দেখে মুখ চেপে কেঁদে দিলেন। নিদ্র এক দৃষ্টিতে ওর বোনের থেতলে যাওয়া মুখের দিকে তাকালো। ও যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে। না কাদছে, না কথা বলছে। পাথরের মতো নিরব হয়ে গেছে। কথায় আছে অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। মানুষের কষ্ট যখন সহ্য সীমার বাইরে চলে যায় তখন তার ইন্দিয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সে অনুভুতিহীন হয়ে যায়। নিদ্ররও সেই অবস্হাই হয়েছে। ও ভাবলেশহীন ভাবে নেত্রার পাশে বসে পড়লো। চুপচাপ নেত্রার নিথর দেহের দিকে চেয়ে রইলো। আরিবা ওদের ছেড়ে অশ্রুশিক্ত নয়নে নিদ্রর দিকে তাকালো। নিদ্রর কোনো অনুভুতি নেই। একমাত্র বোনের শোকে পাগল প্রায়। নিদ্র খুব ভালোবাসতো ওর বোনকে। এই বোন ওর জীবনের সবথেকে ভালো বন্ধু। ওর সাথি যার সাথে ও সব কিছু শেয়ার করতো। আজ সে না ফেরার দেশে চলে গেলো। নিদ্র আস্তে করে নেত্রার মাথাটা ওর কোলের মধ্যে নিলো। গালে হালকা চাপড় মেরে থেমে থেমে বললো।
“নেত্রা! এই নেত্রা! কি হইছে তোর? এভাবে শুয়ে আছোছ কেনো? উঠে পর!
নিদ্র আর বেশি কিছু বলতে পারলো না। ওর কথা গলায় আটকে গেছে। আরশ নিদ্রর কাঁধে হাত রাখলো। নিদ্রর কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। আরশ ওর পাশে বসলো। ওকে জোর করে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো।
“নেত্রা বেঁচে নেই দোস্ত। বোঝার চেষ্টা কর! না হলে তোর ব্রেনে ইফেক্ট পড়বে। এটুক বোঝ ও বেঁচে নেই। আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।”
নিদ্র ঘাড় ঘুড়িয়ে আরশের দিকে তাকালো। অগত্যা নেত্রার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো।
“নেত্রা! এই নেত্রা! কি বলে ও? ও কি সত্যি বলছে?”
নেত্রা নিঃশ্চুপ। নিথর হয়ে আছে ওর দেহ। নিদ্র ওকে জড়িয়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। ওর চিৎকার পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আকাশ বাতাস জানান দিচ্ছে ওর হাহাকারের কথা। নিদ্র নেত্রাকে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা কারও নেই। সবাই ভোজা ভেজা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সবার মাঝে বিরাজ করছে হতাশা। সবার খুব কষ্ট লাগছে। অনেকেই হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজ গন্তব্যে পা বাড়ালো। পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই শোনা যাচ্ছে নিদ্র আহাজারি আর রোনাজারি।
—————
“কিরে রিবা? চুপচাপ কেনো? মন খারাপ?”
কথাটা বলতে বলতে শান্তা আরিবার পাশে বসলো। শাওন পাশের বেঞ্চে ব্যাগটা রাখলো। বেঞ্চে বসতে বসতে ঢং করে বললো।
“মনে হয় ওর আরশ ভাইয়া বকছে!”
ওর কথায় সবাই হেসে ফেললো। তাূর্য ঠোঁট চেঁপে হেসে বললো।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর তো আবার আরশ ভাইয়া আছে। শুধু আরশ ভাইয়া বকলেই ওর মন খারাপ থাকে। ট্যুরু লাভ!”
কথাটা বলেই ওরা আবার হেসে ফেললো। আরিবা বিরক্তি নিয়ে ওদের দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।
“আজ নেত্রার জন্মদিন। অনেক বছর ধরে এইদিনে আমরা ঘুরতে যাই মজা করি। কত আনন্দ করি। নেত্রার হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা এখনও আমার সামনে ভাসছে।”
আরিবার কথা শুনে সবাই হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। নেত্রার কথা সবার মনে পড়লো। শান্তা অসহায় ভাবে বললো।
“নেত্রা কে খুব মিস করি রে। ও থাকলে আলাদা একটা ভালোলাগে। সবার সাথেই হাসিখুশি থাকতো।”
“ওকে কত বকতাম মারতাম। ও কিছুই বলতোনা। উল্টো হেসে বলতো তোর মাইর না খেলে আমার ঘুম আসেনা।”
কথাটা বলতে বলতে আরিবার চোখে জল এসে পড়লো। আরিবা চোখের কোনের পানিটা মুছে বললো।
“সত্যি ওকে ছাড়া এই ক্লাসটা আমার একেবারে শূন্য লাগে। ওকে কোনো দিনও ভুলতে পারবো না আমি। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যার ভিতরে রাগ ছিলো না।”
তূর্য আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“দোস্ত মন খারাপ করিছ না। আমারা কেউয়েই ওকে ভুলতে পারবো না। তবুও বাস্তবতা মেনে নিতেই হয়। এটাই জীবন।”
শাওন সাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“চল আমরা আজ ওকে দেখতে যাই। মানে ওর কবর যেয়ারত করতে যাই। কবর দেখতে যাওয়া মানেই ওকে দেখতে যাওয়া। আংকেল আন্টিরও ভালো লাগবে।”
ওর কথায় সবাই সায় দিলো। আরিবা উঠতেই দেখলো তমা, জুই আর ওর সাথীরা। তমা এসে বললো।
” আমরাও যাবো চল!”
নেত্রার মৃত্যুর খবর পেয়ে তমা রা গিয়েছিলো। তমাও খুব কেঁদে ছিলো। ওইদিন থেকে তমাও ওদের বন্ধু হয়ে গেছে। তবে শান্তাদের মতো না। আরিবা মুচকি হেসে সম্মতি দিয়ে সামনে চললো।
অনেক দিন পর নেত্রার কবর দেখে আরিবার ওর কথা খুব মনে পরছে। নেত্রার মা বাবা খুব কেঁদলো ওদের দেখে। কিন্তু নিদ্র পুরোটা সময় একদম চুপচাপ ছিলো। একটুও কাঁদেনি। নিদ্র অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মতো হাসে না, কথা বলে না। আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। ওদের বাড়ির কেউয়েই নেত্রার শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আরিবার মাঝে শুধু একটা বিষয় বারবার কড়া নাড়ে। নেত্রা কি সত্যি আত্নহত্যা করেছিলো? ওর জানা মতে তো নেত্রার কারও সাথে প্রেম করতো না। আর না নেত্রার কোনো কষ্ট ছিলো। আরিবা ওর বিষয়ে সব জানতো তাহলে কি করে ওর মৃত্যু হলো? নাকি কেউ হত্যা করেছে? নেত্রার মৃত্যুর পিছনে রয়েছে গভীর রহস্য। সবাই চুপ হয়ে গেলেও আরিবা আকাশ পাতাল ভাবে। ও এর উওর খুঁজে বের করবেই।
💖
ইনশাআল্লাহ চলবে….