#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৭
💖
ডাইনিং টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে সবাই। আরিবার খাবার খেতে একটুও ভালো লাগছে না, শুধু নেত্রার কথা মনে পড়ছে। অনেকক্ষন ধরে খাবার শুধু নাড়াচাড়া করছে। আরশ তাকিয়ে দেখলো আরিবা খাচ্ছেনা। আরিবাকে ধমক দিয়ে বললো।
“এই! খাচ্ছিস না কেনো? ছোটো বাচ্চাদের মতো নাড়াচাড়া করছিছ। তোকে কি এখন খাইয়ে দিতে হবে?”
আরশের কথায় সবাই আরিবার দিকে তাকালো। আরিবা কিছুই বললো না। মাথা নিচু করে আছে।মি. জাকির মেয়েকে অন্যমনস্ক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন।
“কি হয়েছে মামনি খাচ্ছো না কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে? আমাকে বলো আমি সলভ করে দিবো।”
আরিবা একটু খাবার মুখে দিয়ে হতাশ কন্ঠে বললো।
“আজ নেত্রার বার্থডে ছিলো। এইদিনে কত মজা করতাম। আর আজ ও নেই। অনেক একা একা লাগে। ওকে ছাড়া ক্লাসে একটুও ভালো লাগেনা। আজ ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আন্টি আংকেল অনেক কেঁদেছে। নিদ্র ভাইয়া আগের মতো কথা বলে না, এখনও চুপচাপ, অনেক শুকিয়ে গেছে। নেত্রার নেই এটা এখনও তারা মেনে নিতে পারছেনা। আমার অনেক খারাপ লাগছে তাদের দেখে।”
ওর কথায় সবাই আফসোসের নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। কত হাসি খুশি একটা পরিবার এক ঝটকায় কেমন হয়ে গেলো। মানুষের জীবনে কখন কি হবে কেউয়েই বলতে পারে না। মি. জাকির অসহায় ভাবে বললেন।
“সত্যি খুব খারাপ লাগছে আমার। নেত্রা ছোটো একটা মেয়ে! ওর জীবনের আশা আনন্দ সব কিছুই তো বাকি। কদিন দেখলো এই পৃথিবী? সব চেনা জানা বাকি ওর, কিয়েই বা চিনলো?”
মিসেস আঞ্জুমান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে বললেন।
“ঠিক বলছো। কত হাসি খুশি ছিলো মেয়েটা। আমাদের বাড়ি আসলে কি সুন্দর হেসে কথা বলতো। আমার এখনও মনে পরে।”
মি. আফজাল জাকিরের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“মি. হাসিব সাহেব যখন কান্না করতে ছিলো আমার খুব খারাপ লাগছিলো। আল্লাহ যেনো কাউকে এই কষ্ট না দেয়।”
“কি আর বলার আছে? যার যেখানে মৃত্যু আছে সেভাবে মৃত্যু হবেই। ওর মা আর নিদ্রর অবস্হা অনেক খারাপ ছিলো। নেত্রা খুব আদরের ছিলো তো। এত সুখে থেকেও আত্নহত্যা কেনো করলো আমি এটাই বুঝিনা। তাও আমাদের বাড়ির ছাদে!”
মিসেস তারিন কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ খেতে থাকলেন। সবাই কথা বললেও আরশ কোনো কথাই বলছেনা। মনে হচ্ছে এখানের কোনল কথা ওর কানে যায়নি। আরিবা খাওয়ার মাঝেই আরশের দিকে তাকালো। দেখলো ও মন দিয়ে খাচ্ছে। আরিবা ওর দিকে তাকিয়ে বললো।
“ভাইয়া! তোমার কি মনে হয় ও আত্নহত্যা করেছে?”
আরিবার কথা শুনে একবার মাথা উচু করে ওর দিকে তাকালো। অগত্যা আবার প্লেটের দিকে তাকালো। চামচ দিয়ে খাবার নাড়াতে নাড়াতে বললো।
“আমি কি দেখেছি নাকি যে আমায় জিজ্ঞাসা করোছ?”
আরশ এমন ভাবে কথাটা বললো মনে হচ্ছে ও বিরক্ত হয়েছে আরিবার প্রশ্নে। আরিবা তবুও বললো।
ভাইয়া তুমি তো অনেক কিছু বুঝতে পারো তাই বললাম।”
“আমাকে না জিজ্ঞাসা করে তুই নিজেই ভাব উওর পেয়ে যাবি। আত্নহত্যা না করলে অত উচু রেলিং পেড়িয়ে পরলো কিভাবে?”
আরশ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাটা বললো। আরিবা কিছুই বললো। নিজে নিজেই ভাবতে লাগলো। মি. জাকির আরিবার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ও অন্যমনষ্ক। ওর মন ঘুরাতে হাসি মুখে বললেন।
“মামনি তোমার টেস্ট পরীক্ষা কবে থেকে শুরু?”
“এইতো আব্বু সামনের মাসে।”
আরিবা খেতে খেতে কথাটা বললো। মি. জাকির প্লেটে চামচ দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বললো।
“মন দিয়ে পড়ো তো? ভালো রেজাল্ট না করলে কিন্তু মেডিকেলে চান্স পাবেনা মামনি।”
আরশ খাওয়া রেখে মুখ বাকিয়ে বললো।
“কাকা! তুমি আর মানুষ পেলে না? ও পড়বে মন দিয়ে? সারাবছর আমার বকা খেয়ে পড়া লেখা করে। মেডিকেলে চান্স তো দূরে ও এইচএসসি পরীক্ষাতেও পাস করতে পারবে না।”
আরশের কথা শুনে মি. আফজাল ওর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো।
“এরকম ফালতু কথা বলো কেনো? ওর পিছনে না লাগলে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না?”
“বাবা রাগছো কেনো? ভুল বলিনি তো।”
মিসেস তারিন ওর দিকে তাকিয়ে বললেন।
“আরশ! খাওয়ার সময় কি শুরু করছোছ? এমন অলক্ষুণে কথা কেউ বলে? ঠিক মতো খেতে থাক!”
“আরে আম্মু! না ক্ষেপে ওকে তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করো? কিচ্ছু পারেনা ও। আমি ঠিক বলছিনা কাকিমনি?”
মিসেস আঞ্জুমান কিছুই বললো না। আরিবা এতক্ষণ চুপচাপ রাগে ফোসফোস করতে ছিলো। এখন আর ওর চুপ থাকা সম্ভব না৷ তাই আরশের দিকে তাকিয়ে রেগে চিল্লিয়ে বললো।
“এই তুমি নিজেকে কি মনে করো? তুমি একাই ব্রিলিয়ান্ট? আমারও অনেক টেলেন্ট আছে। আমি মেডিকেলে ভর্তি হয়ে তোমাকে দেখিয়ে দিবো।”
“আমি পড়িয়েছি দেখেই ভালো রেজাল্ট করার কথা বলতাছোছ। আমার মেধার একটু বাতাস পাইছোছ তো।”
“বললেই হলো? কি আমার মেধাবী ছাত্র রে। জগতে তোমার মতো মেধাবী ছাত্র অনেক আছে।”
“অনেক থাকলে কি? তুই তো আর আমার থেকে মেধাবী না।”
আরিবা জানো আরশের সাথে কথায় পারবেনা তাই চুপচাপ খেতে থাকলো। আরশ খাওয়া শেষ করে হাতটা টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছে বললো।
“কাল আমি মেডিকেলে জয়েন করতাছি।”
আরশের কথা শুনে ওর বাবা বললো।
“মেডিকেলে জয়েন করবে? তুমি নিজেই একটা হাসপাতাল তৈরি করো। তাতেই জনগনের সেবা করো। আমাদের টাকা কি কম আছে? এত টাকা থাকতে তুমি অন্যের গোলামী করবে? নো, দিস ইজ টূ মাচ!”
“আব্বু! আমি তোমাদের থেকে কোনো টাকা নিতে চাইনা। আমি আমার টাকায় অফিস দিতে চাই বুঝেছো?”
আরশ কথাটা বলেই উপরে চলে গেলো। কেউ কিছুই বললো না। সবাই ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। সবাই জানে ওকে বলে কোনো লাভ নাই। ও কারো কথা শুনেনা। আরিবা ভেংচি মেরে বললো।
“এমন ভাব নেয় মনে হচ্ছে এই বাংলাদেশে সে একাই ডক্টর। পৃথিবীতে কি আর ডক্টর নেই? শালা হরামী…”
“রিবা চুপ কর! আরশ শুনলে রেগে যাবে। ভালোভাবে কথা বলতেও শিখলি না।”
মিসেস আঞ্জুমানের কথায় আরিবা থেমে গেলো। না হয় আরও কয়েকটা গালাগাল করতো ও। তা আর সম্ভব হলো না। আরিবা ওর কাকার দিকে তাকিয়ে বললো।
“কাকা! আরশ ভাইয়া নাকি হার্ট সার্জেন্ট? তার নিজেরেই তো হার্ট নাই অন্যের হার্টের সার্জারি কি করে করবে?”
ওর কথায় সবাই হেসে ফেললো।
আরিবা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো।
“হাসো! আরও হাসো। তোমাদের সাথে তো দানবের মতো ব্যবহার করেনা। করলে বুঝতে পারতে আসলেই সে হার্ট বিহীন বন্যপ্রানী।”
কথাটা বলেই আরিবা গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকালো। আরশ দোতালায় দাড়িয়ে আরিবার কথা শুনছিলো। ওর কথায় নিঃশব্দে হেসে ফোললো। আরশ জানে ও আসার পর আরিবা কিছু বলবে। সেটাই শুনতে দাড়িয়ে ছিলো।আরিবার গাল ফুলানো দেখে সবাই আবার হেসে ফেললো। আরিবা রাগ করে সিড়ি বেয়ে উপরে দিকে পা বাড়ালো। আরশ আরিবাকে আসতে দেখেই ওর রুমে গিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাড়ালো। আরিবা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগাতেই কেউ ওকে দরজার সাথে চেঁপে ধরলো। আরিবা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যাবে তার আগেই কেউ ওর মুখ চেঁপে ধরলো। আরিবা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।
“আমি হার্টবিহীন বন্যপ্রানী?”
আরশের কথা শুনে আরিবা চমকে চোখ খুললো। চোখ খুলতেই আরশকে ওর একদম চোখের সামনে দেখে থতমত খেয়ে গেলো। আরশ গভীর ভাবে আরিবার দিকে তাকিয়ে আছে। লাইটের আলোতে ওট চেহারাটা আরও উজ্জ্বল লাগছে। এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা চুলগুলো আরিবার সারা মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এতে যেনো ওর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরশের তাকানো দেখে আরিবার শরীরের অজানা এক অনুভুতি হচ্ছে। আরশের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওর তাকানো দেখে আরশ ঘায়েল হয়ে গেলো। আলতো হাতে আরিবার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। আরিবা চোখ বন্ধ করে ফেললো। তা দেখে আরশ নিঃশব্দে হেসে ফেললো। আরশ দু আঙ্গুল দিয়ে আরিবার কপাল স্পর্শ করলো। আরিবা আরও জোরে চোখ বন্ধ করে নিলো। ওর হার্ট জোরে জোরে বিট করতে লাগলো। আরশ দু আঙুল আস্তে করে আরিবার গালের দিকে নামাচ্ছে। আরশের হাত যতই নিচের দিকে নামছে আরিবা শরীর ততই কেঁপে উঠছে। আরশের আঙুল আরিবার গাল স্পর্শ করে ঠোঁটের উপর এসে থামলো। আরিবা ঠোঁট কেঁপে উঠলো। পুরো শরীর হীম হয়ে গেল। আরশ যেনো নিজের মধ্যে নাই। আরিবার স্পর্শে ওর মধুর একটা অজানা অনুভুতি হলো। আরশ আরিবার ঠোঁটে স্লাইড করতে লাগলো। আরিবা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। মনে হচ্ছে ও শ্বাসকষ্টের রুগি। আরশ ওর ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে ঘোর লাগা কন্ঠে বলতে লাগলো।
“যদি তোমায় ভালো না বাসতাম
তবে বুঝতাম না ভালোবাসার মানে।
যদি তোমার রূপে মুগ্ধ না হতাম
তবে বুঝতাম না ভালোলাগার মানে।
যদি তোমায় স্পর্শ না করতাম
তবে বুঝতাম না স্বর্গীয় সুখের মানে।
তুমি অপরূপা, তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী,
তাই তোমার রূপে মুগ্ধ এই আমি।”
এগুলো বলেই আরশ আরিবাকে ছেড়ে দিলো। দরজা খুলে তাড়াতাড়ি চলে গেলো। আরিবা কিছুক্ষণ হীম হয়ে দাড়িয়ে রইলো। পরক্ষনেই কিছুক্ষণ আগের কথা মনে হতে ও নিজের ঠোঁটে হাত দিলো। “কি হলো এগুলো? আর আরশ ভাইয়া কি বলে গেলো? তারমানে সে বুঝাতে চাচ্ছে সে আমায় ভালোবাসে? সাজেকেও এই ব্যবহার করেছিলো। কাল সরাসরি জিজ্ঞাসা করতেই হবে।” আরিবা নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে একমনে এসব ভাবতে লাগলো।
💝
ইনশাআল্লাহ চলবে…
(একটু বিজি ছিলাম তাই নিয়মিত গল্প দিতে পারিনি। সরি গাইস্। এখন থেকে নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করবো। কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং)