#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৯
💝
রাত ১০.৩০। আরশ একটু আগেই বাড়ি ফিরেছে। আরিবা তাড়াহুড়ো করে আরশের রুমে গেলো। যে করেই হোক জানতে হবে আরশ জাহিদ কে মেরেছে কিনা? আরিবা ওর রুমে ডুকতেই দেখলো আরশ রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে, তারমানে আরশ গোসল করতেছে। আরিবা সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ আরশের ফোন বেঁজে উঠলো। আরিবা পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। ভাবলো হয়তো আরশের কোনো ফ্রেন্ড কল দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর আবার কল এলো। এত রাতে কে কল করতে পারে? আরিবার মনে সন্দেহ হলো। ফোন হাতে নিতেই দেখলো ‘মিস লেনা’ লেখা। আরিবা রেগে গেলো। দাঁতে দাঁত চেঁপে স্বল্প স্বরে বললো–” বাহ প্রেম করা হচ্ছে? আবার মিস লেনা দিয়ে সেভ করে রেখেছে। তোর প্রেম করা আমি ছুটাবো দাড়া। শালা হারামী! ” ফোনটা আবার বাজতেই আরিবা রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো। ওপাশ থেকে লেনা মিনছিং (ঢং করে কথা বলাকে মিনছিং বলে) করে বললো।
“স্যার কল ধরতেছেন না কেনো? আপনাকে খুব মনে পড়েছিলো তাই কল দিলাম। আমি কি আপনাকে বিরক্ত করলাম স্যার!”
লেনার ঢং করে বলা কথা শুনে আরিবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। “আর মেয়ে পেলোনা আরশ ভাইয়া? বেজে বেজে এই ঢংগি টাকেই বেছে নিলো। ছিঃ কি রুচি? ছেরি তোর চুল ছিরে তোকে বুড়িগঙ্গায় চুবাবো। দাড়াও আরশ ভাইয়া প্রেম করা ছুটাচ্ছি।” মনে মনে এসব বলেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে রাগি গলায় বললো।
“এই তুই কোন জঙ্গলের পাবলিক রে? এত রাতে কোনো বিবাহিত ছেলেকে কেউ কল দেয়? এই সময় সে ব্যস্ত থাকে এটা জানোস্ না?”
আরিবার কথা শুনে লেনা অবাক হলো। ওর জানা মতে আরশ তো অবিবাহিত। কিন্তু এটা কে? লেনা আকাশ পাতাল ভেবে বললো।
“এই আপনি আমাকে তুই তুই করে বলছেন কেনো? আরশ স্যার বিয়ে করেনি আমি জানি। কে আপনি?”
“আপনি কিছুই জানেন না। আমাদের গোপনে বিয়ে হয়েছে। আরশকে জিজ্ঞাসা করেন। দাড়ান ওকে ডাকি!”
আরিবা বেলকনিতে গিয়ে মিথ্যা মিথ্যা করে ডাকলো।
“এই তুমি কই? আসো তো! কে যেনো কল করছে।”
এগুলো বলতেই কেউ ওর হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। আরিবা তাকিয়ে দেখলো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে দাড়িয়ে আছে। “সব শুনে ফেলেনি তো? এবার কি হবে?” আরিবা মনে মনে এসব ভাবছে। আরশ ফোনটা নিয়ে লেনার সাথে হেসে হেসে কথা বলতে লাগলো। আরিবার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো। কতক্ষন বিরক্ত নিয়ে কপাল কুচকে দাড়িয়ে রইলো। তবুও আরশের কথা শেষ হচ্ছে না। ও হেসে হেসে কথা বলছে। আরিবা রাগি চোখে আরশের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে বিড়বিড় করে বললো। “ইশ কি হেসে হেসে কথা বলে? খুশি উতলে পড়ছে। কই আমার সাথে তো কখনও এমন করে কথা বলেনা? তোর খুশি আমি ছুটাবো। ওই লেনা দেনা কে যদি বুড়িগঙ্গায় না চুবাইছি তো আমিও আরিবা না। হুহ”। আরিবা আরও ১০ মিনিট দাড়িয়ে রইলো তাও আরশের কথা শেষ হচ্ছেনা। তাই আরিবা রাগ করে চলে গেলো। আরশ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফোনটা রেখে দিলো। ও এতক্ষন লেনার সাথে কথা বলছিলো না। শুধু আরিবাকে দেখিয়ে এ্যাক্টিং করেছে ওকে জেলাস ফিল করানোর জন্য। আরশ আরিবার ছরির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বললো–মায়াপরী তুমিও আমায় ফিল করো। আমার পাশে কাউকে সহ্য করতে পারবেনা। তোমাকে শায়েস্তা করার পথ আমি পেয়ে গেছি।” একথা বলেই আরশ নিজের কাজে লেগে পড়লো।
—————————–
আরিবা বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই ঘুম আসছেনা ওর। জাহিদের অবস্থা কে ওমন করছে তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আরিবা নিজেও চেয়েছিলো জাহিদের শাস্তি হোক। কিন্তু এতটা নির্মম হোক সেটা চায়নি। জাহিদের জীবনটাই মিথ্যে হয়ে গেলো। দু হাত দিয়ে জীবনে কিছু করতে পারবেনা। যে জাহিদের এই অবস্থা করেছে সে কতটা হিংস্র তা ভেবেই আরিবার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। কে এমন করতে পারে? আরশ করেছে? আরশ কেনো করবে? আমার হাত ধরেছে তাতে এত নির্মম হতে পারেনা সে। তাহলে কি বিজনেস জনিত দ্বন্দ্ব? আরিবা আর ভাবতে পারছেনা। ভাবতে ভাবতে ওর মাথা ধরে যাচ্ছে। তাই চুপ করে শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ যেতেই একটা মেসেজ আসলো। “২ মিনিটে ছাদে আয়” আরশের মেসেজ টা দেখেই আরিবা বিশ্ব বিরক্ত নিয়ে কপাল কুচকালো। ওর লিখতে ইচ্ছা হলো। “আমি কি তোর টাকায় কেনা গোলাম যে যখন যা ইচ্ছা হুকুম করবি? তোর এত ছাদে থাকতে মন চায় তুই থাক না, আমায় ডাকোছ কেনো? তোর লেনা দেনা কে ডাক।” এসব লেখার ইচ্ছা থাকলেও লিখল না। কথা বললেই কথা বাড়বে। আরশের সাথে কখনও কথায় বা যুক্তিতে পারবেনা ও। শুধু শুধু মেজাজ খারাপ করার দরকার নাই। তাই ফোনটা সাইডে রেখে দিলো।
দুই মিনিটের জায়গায় তিন মিনিট হয়ে গেলো। আরিবাকে আসতে না দেখে রেগে গেলো আরশ। রাগ নিয়ে আবার মেসেজ পাঠালো। মেসেজের শব্দ আসতে ফোন নিয়ে দেখলো আরশ লেখছে। ” ভালো ভাবে বলছি ছাঁদে আয়। আমি নিচে গেলে কিন্তু খারাপ হবে!” আরিবা মেসেজটা পরে রেখে দিলো। পরক্ষনেই ভাবলো আরশ এলে ওকে মারতেও পারে। তাই তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠলো। ওড়নাটা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো। অগত্যা তাড়াহুড়ো করে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
ছাঁদে পা রাখতেই অবাক হয়ে গেলো আরিবা। পুরো ছাঁদ বেলুুন আর ক্যান্ডেলে ভরপুর। মাঝখানে ছাউনির মতো সাদা কাপরে ঘেরা একটা জায়গা। তার মাঝখানে একটি টেবিল। টেবিলটা খুব সুন্দর করে বেলুন আর ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো। টেবিলের উপর একটা বড় সাইজের কেক রাখা। আরিবা এসবের সৌন্দর্য দেখতেই ব্যস্ত হঠাৎ করে পিছন থেকে আরশ বলে উঠলো।
“HAPPY BRITHDAY. HAPPY BRITHDAY TO YOU RIBA. MANY MANY HAPPY RETAINS OF THE DAY”
আরশের কন্ঠ শুনে আরিবা পিছনে তাকালো। দেখলো আরশ হাতে তালি দিচ্ছে আর ওকে উইশ করছে। ও নিজেই ভুলে গিয়েছিলো আজ ওর বার্থডে। আরশ মনে রেখেছে আবার উইশ করেছে। আরশের উপর রাগ আরিবার মুহুর্তেই চলে গেলো। ওর ভাবনার মাঝেই আরশ ওর কাছে এসে বললো।
“কিরে ভাবনারানী? এখানে দাড়িয়েই থাকবি নাকি কেকটা একটু কাটবি। আরে আমার ক্ষিদে পেয়েছে।”
আরশের কথা কথা শুনে আরিবা ঠোঁট উল্টালো। পরক্ষনেই হাসি দিয়ে বললো।
” আমার জন্মদিনের কথা তোমার মনে আছে ভাইয়া?”
আরশ বিরক্ত ভাব নিয়ে বললো।
“মনে থাকবে না আবার? তুই এই দিন পৃথিবীতে এসে আমার সব জিনিসে ৮০% ভাগ বাসাইছোছ। আবার আমাকে জ্বালিয়ে কয়লা করেছিস। প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমায় জ্বালাচ্ছিস্। এই দিন কি ভোলা যায়?”
আরিবা আরশের কথা শুনে ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো। কোমরে হাত দিয়ে ছোট ছোট চোখ করে বললো।
“ইস বললেই হলো? আমি তোমাকে একটুও জ্বালাইনি, উল্টো তুমি আমাকে জ্বালাইছো। জ্বালাতে জ্বালাতে কয়লার খনি বানিয়ে ফেলছে।”
“বড় রা কখনও জ্বালায় না। বড় রা উপদেশ দেয়। এটা জ্বালানি মনে হলে কার কি?”
“হ্যাঁ আপনি তো বুইড়া খাটাশ!”
“এই কে বুইড়া! আমার বয়স অনলি ২৬ বছর বুঝলি?”
আরিবা কিছুই বললো না, জানে ও কখনই আরশের সাথে কথায় পারবেনা। তাই চুপ করে টেবিলের কাছে চলে গেলো। নভেম্বর মাসের শেষের দিক হালকা বাতাস বইছে। বাতাসে সাদা পর্দাগুলো উরছে। আরিবার খুব ভালো লাগছে। আরিবা পর্দাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরছে। আরশ আরিবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্যান্ডেলের মৃদু লালচে আলোয় ওর মায়াপরিকে অনেক সুুন্দর লাগছে। এ যেনো আরেক মুগ্ধতা নাম। একেক জায়গায় ওর মায়াপরীর ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য্য দেখা যায়। আরশ গভীর ভাবে পর্যাবেক্ষন করছে ওর মায়াপরীকে। ঘুম ঘুম চোখে এলোমেলো চুলে আরিবাকে অমায়িক লাগছে। আরশ আরিবার দিকে তাকিয়েই গাইতে লাগলো।
“সারারাত ভোর চোখের ভিতর স্বপ্নে তোমার আনাগোনা
নেমে আসে ভোর থাকে তবু ঘোর
হাওয়ায় হাওয়ায় জানা শোনা।
তুমি দেখা দিলে তাই মনে জাগে প্রেম প্রেম কল্পনায়
আমি তোমার হতে চাই এটা মিথ্যে কোনো গল্প নয়।”
আরশকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরিবার খুব লজ্জা লাগছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আরিবা। নিচের দিকে তাকিয়েই আরশের গান শুনতে লাগলো। খুব সুন্দর আরশের কন্ঠ। আরিবার কন্ঠও সুন্দর। আরিবার মনে হচ্ছে আরশ ওকে ভেবেই গানটা গাইছে। আরশের গান শুনে ও ঘোরে চলে গেলো।
” ছুয়েছো হৃদয় আমার প্রেমেরি আবীর মেখে
ডুবেছি তোমার মাঝে নিজেকে আড়াল রেখে
ছুয়েছো হৃদয় আমার প্রেমেরি আবীর মেখে
ডুবেছি তোমার মাঝে নিজেকে আড়াল রেখে
তুমি আছো ভাবনাতে পুরোটাই একটু আল্প না।
আমি তোমার হতে চাই, এটা মিথ্যে কোনো গল্প নয়।”
গান শেষ হতেই আরিবার ধ্যান ভাঙলো। ও অন্যদিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। আরশ আরিবার অস্বস্তি বুঝতে পারলো। তাই স্বাভাবিক ভাবে ওর সামনে এসে বললো।
“রাত অনেক হইছে কেকটা কেটে রুমে যা! অনেক ঠান্ডা পড়ছে, অসুস্থহয়ে পরবি।”
আরিবা আরশের দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক হাসি দিলো। অগত্যা চুপচাপ কেকটা কেটে আরশকে খাইয়ে দিলো। আরশ আবার আরিবা খাইয়ে দিলো। আরশ কিছু না বলে আরিবা শরীর ঘেঁষে ওর পিছনে দাড়ালো। আরিবার শরীর কেঁপে উঠলো। আরশ আরিবার চুলগুলো আস্তে আস্তে সড়াতে লাগলো। আরিবা আরও কেঁপে উঠলো। যত চুল সরাচ্ছে ও ততই কেঁপে উঠছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।
” ভাইয়া কি করছো?”
আরশের কোনো হেলদোল নেই। ও নিজের কাজে ব্যস্ত। আরিবার চুল সরিয়ে ওর গলায় একটা চেইন পরিয়ে দিলো। আরিবার কানে কানে বললো।
” আমার নিজের টাকায় কেনা উপহার। পছন্দ হয়েছে?”
আরিবা আস্তে করে ওর গলায় হাত দিলো। মাথা নিচু করে দেখলো সুন্দর একটা পেনডেন্ট। চারদিকে সাদা পাথর বসানো। মাঝখানে আরশ লিখা। অপর পাশও সেইম। শুধু আরশের স্থানে আরিবা লিখা। আরিবা খুব খুশি হলো। হাসি মুখে বললো।
“থ্যাংস! অনেক সুন্দর হইছে।”
আরশ আরিবার কানের কাছে এসে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো।
“সামান্য উপহারে পরিবর্তে যদি এমন ভুবন ভোলানো হাসি
উপহার পাওয়া যায় তবে, আমি নিত্যদিন উপহার দিতে রাজি। এই হাসিটা শুধুই হাসি না, কারো কারো জন্য ঔষধের চেয়েও উপকারি ঔষধ। যা পান করলে
মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগ স্পর্শ করতে পারবেনা।”
আরশের প্রতিটা কথায় আরিবা কেঁপে উঠছে। চোখ বন্ধ করে আরশকে অনুভব করছে। আরিবা জানেনা আজ ওর কি হয়েছে। আরশকে ওর ভালোই লাগছে আজ। আরশ আবারও বলতে লাগলো।
“তোমার হাসিতে ভুবন হাসে,
হাসে এক যুবকের মন।
তোমার ছোঁয়ায় তুষার গলে
গলে এক প্রেমিকের হৃদয়।
হে মৃদুচন্দ্রিমা তুমি জানো সে কে?
সে তোমার হৃদয়ে বসবাসকারী
এক অস্থায়ী যাযাবর!”
কথাগুলো বলেই আরশ চলে গেলো। আরিবা এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। আরশ কি ইনডাইরেক্টলি নিজেকে যাযাবর বললো? আরিবা আকাশ পাতাল ভেবে নিজের রুমের দিকে আগাতে লাগলো। স্টোর রুমের সামনে আসতেই আরিবা থমকে গেলো। সেই কান্না আবারও? আরিবা ভয়ে ভয়ে আস্তে করে স্টোর রুমের দরজায় কান লাগালো। হ্যাঁ আওয়াজ টা স্টোর রুমের ভিতর থেকেই আসছে। আরিবা আস্তে করে স্টোর রুমের দরজা খুললো, যেনো শব্দ না হয়। আরিবা ফোনের লাইট অন করে ভিতরে মারলো। কিন্তু ভিতরে কাউকেই দেখতে পেলোনা। কিন্তু কান্নার আওয়াজ আসছে। আরিবা আরও অবাক হলো সাথে খুব ভয়ও পেলো। মনে সাহস যুগিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। আওয়াজ টা স্টোর রুমের কোনার এক আলমারির মধ্য থেকে আসছে। আরিবা ভয়ে ভয়ে সাবধানে সামনে এগিয়ে গেলো। আস্তে করে আলমারিটা খুলে ভিতরে লাইট মারতেই ও অবাক হয়ে গেলো।
💖
ইনশাআল্লাহ চলবে…
(কেমন আছেন সবাই? গল্পটা কেমন লাগছে আপনাদের অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং)