#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫৮
💝
“আরশ”
নামটা শুনেই কেঁপে উঠলো আরিবা। আহত চোখে ওর বাবার দিকে তাকালো। অবিশ্বাস্য স্বরে বিস্ময় নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।
“আব্বু কি বলছো এসব? ভাইয়া তোমাদের মরতে চাইবে কেনো? আর আমাকেই বা মারার জন্য এমন করবে কেনো?আমার সাথেই তার কি শত্রুতা? তুমি ভুল বলছো আব্বু! তোমার গাড়ি তো এক্সিডেন্ট করেছে।”
মি. জাকির মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“আমি মিথ্যে বলছিনা মামনি।। আরশের নামে মিথ্যা কথা বলে আমার কি লাভ বলো? ও তো আমার ছেলের মতোই। আমি ওকে এসব ভাবলেও ও আমাকে ওর বাবার মতো ভাবেনা মামনি। ও আর ওর বাবা মিলে এসব করেছে। কে বলেছে এক্সিডেন্ট করেছে তোমার কাকা তাইনা? সে তো ইচ্ছে করে আমার গাড়ির ব্রেক কেটে দিয়েছে। আরশ ওর বাবাকে এসব বলেছিলো। তাইতো আমি গাড়িতে উঠার পর আরশ কল দিয়েছিলো কথা বলে শেষে বলেছিলো ” গাড়ি ঠিকমতো চালাও কাকা কে বলতে পারে পথে এক্সিডেন্টও হতে পারো। সাবধান!” আমি শুনে অবাক হয়েছিলাম। কখনও তো আরশ এটা বলেনা হঠাৎ কেনো বললো? তখন এর মানে বুঝিনি এখন বুঝেছি।”
আরিবা চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ফেললো। এত আঘাত আর ওর মস্তিষ্ক নিতে পারছেনা। যে মানুষটা ওকে এত ভালোবাসে সে কি করে ওকে মারতে চাইবে? আরশকে ও কত বিশ্বাস করে। আরিবা বিশ্বাস করে আরশ কখনই ওর বিশ্বাস ভাঙতে পারেনা। এটা ও কিছুতেই বিশ্বাস করেনা৷ ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“আব্বু তুমি যা ইচ্ছে বলো। আমি কখনই বিশ্বাস করিনা আরশ ভাইয়া এমন করতে পারে। তুমি নিজেও জানো আরশ ভাইয়া আমায় নিয়ে কত ভাবে। আমায় কত ভাবে প্রটেক্ট করে। সেই তুমি কিভাবে এ কথা বলো?”
মি. জাকির হালকা উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যাথা পেয়ে উহ করে শব্দ করে উঠলো। আরিবা ওর বাবাকে তাড়াতাড়ি করে ধরলো। মি. জাকির শুইতে শুইতে বললো।
“ও আমার প্রপার্টির জন্য এমন করছে। আরশ আর ওর বাবা জানে আমার সমস্ত প্রপার্টি তোমার নামে। তাইতো তোমাকে মারতে চায়। তোমাকে মারলে সব আরশেই পেত। কিন্তু তোমাকে মারতে পারেনি আল্লাহ তোমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। তাইতো ও এবার আমাদের মারতে চাইছে। আল্লাহ আমায় বাঁচালেও তোমার আম্মুকে নিয়ে গেলো।”
কথাটা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মি. জাকির। আরিবা নিজেও ওর বাবাকে ধরে কেঁদে ফেললো। মি. জাকির আবারও কান্না ভেজা চোখে বললেন।
“আমি কতবার বলেছিলাম আন্জু লাফ দাও কিন্তু ও ভয় পেয়েছে। ভয়ে লাফ দেয়নি। আরশ কি করে এমন করতে পারলো! হে আল্লাহ ওদের বিচার করো।”
আরিবা কাঁদতে কাঁদতে বললো।
“আব্বু! ওরা পাপ করলে আল্লাহ ওদের অবশ্যই শাস্তি দিবে। তুমি আর কেঁদো না তোমার শরীরে ক্ষতি হবে।”
মি. জাকির চোখটা মুছে বললেন।
“মা রে! ওরা আমাদের বাঁচতে দিবেনা। ওরা আজ নাহয় কাল আমাদের দু’জনকেই মেরে ফেলবে। আমি নিজে মরতে ভয় পাইনা কিন্তু তোমার কিছু হলে আমি কি করে থাকবো মামনি? ওদের আমি মেরে ফেলবো। তোমার মায়ের লাফ কবর দেওয়ার আগেই প্রতিশোধ নেবো আমি।”
আরিবা চুপ করে রইলো। এর মাঝেই মি. আফজাল, আরশ আর মিসেস তারিন রুমে প্রবেশ করলো। আরশকে দেখেই আরিবার ওর মায়ের মৃত্যুর কথা মনে উঠলো। আরিবা ঘৃনায় চোখ ফিরিয়ে নিলো। কোনো জানি আরশ আর ওর বাবাকে আরিবার একটুও দেখতে ইচ্ছে করছেনা ওর মেজাজ খারাপ লাগছে। মি. আফজাল আহত চোখে আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“মামনি! আর কেঁদো না। কেঁদে আর কি হবে? আল্লাহ যা চাইবেন তা তো কেউ ধরে রাখতে পারবোনা।”
আরিবা ওর কাকার কথা শুনে ঘৃনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। মানুষ কতটা অভিনয় করতে পারে তা ওর জানা ছিলো না। আজ তা দেখলো। আরিবার চোখের পানি শুকিয়ে গালের সাথে লেপটে আছে। মিসেস তারিন কান্না ভেজা চোখে আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
“চিন্তা নেই মা! আজ থেকে আমিয়েই তোর আম্মু! আমায় তোর মায়ের মতো মনে করবি।”
আরিবা মিসেস তারিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। কান্না যেনো ওর আজ বাঁধ মানছে না। এত আঘাত ও আর নিতে পারছেনা। কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে করবে না এটা নিয়েই ও হতাশ। আসলেই বাহির থেকে কাউকে চেনা যায়না। যাকে এত বিশ্বাস করেছিলো যাকে নিয়ে সারাজীবন থাকবে ভেবেছিলো সেই লোকটাই ওর বড় শত্রু। সব লোক দেখানো ভালোবাসা। আবার সেই আগের মতোই ভালোবাসার প্রতি আরিবার বিশ্বাস উঠে গেলো। ওর মা যাকে ছেলের চোখে দেখতো সে তাকে মেরে ফেললো? আরিবা আর ভাবতে পারছে না। এত বেইমানী ও মেনে নিতে পারছেনা। ধপ করেই ওর মাথায় রাগ চেপে গেলো। চোখের পানিটা আস্তে করে মুছে নিলো। ওর বাবার মতো ও নিজেও এর প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। ওর মায়ের ছেলে নেই তো কি হয়েছে? ও নিজেই নিবে এর প্রতিশোধ। নিরবতা ভেঙে আরশ আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“আর কান্না করিছ না। কাকা আপনাকে রিলিজ দিবে বলছে। বাসায় চলেন! কাকিমনির দাফনটা ভালোভাবে শেষ করি। আমি সব খরচ দিতে চাই কাকা প্লিজ।”
মি. জাকির কিছুই বললেন না। আরিবা রাগি চোখে আরশের দিকে তাকিয়ে বললো।
“কোনো দরকার নাই তোমার টাকার। আমার আম্মুর দাফন আমার বাবার টাকায় হবে। কোনো হরাম টাকায় আমার আম্মুর দাফন হবে না!”
আরশ রাগি চোখে তাকিয়ে বললো।
“আমিও সেটাই বলছি। চুপচাপ চল!”
আরিবা আরশের রাগে ভয় পেলোনা। মিসেস তারিন আরিবাকে ধরে নিয়ে গেলেন। মি. আফজাল আর আরশ মি. জাকিরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আরিবার মায়ের লাফ সাজল আর অন্যান্য বডিগার্ডরা নিয়ে যাচ্ছে। আরিবা অনেক ভেঙে পড়লো ওর মায়ের লাশ দেখে। মিসেস তারিন ওকে সামলিয়েছে। এত কষ্টের মাঝেও আরিবা অনেক চেষ্টা করেছে যেনো ওর মায়ের দাফন আরশের টাকায় না হয় কিন্তু আরশও নাছোড়বান্দা। ওর কাকিমনির দাফন ওর টাকাতেই করেছে ও।
————————–
মিসেস আঞ্জুমান মারা গেছেন ১৫ দিন হয়ে গেছে। আরিবা এখনও ওর মায়ের শোক ভুলতে পারেনি। মিসেস তারিনও মাঝে মাঝে মনে করে কাঁদেন। আর কেউ তেমন একটা মনে করেনা সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আরিবা মন খারাপ করে নিজের বেলকনিতে বসে আছে।
“কেমন আছো বিউটি ডল! ”
হঠাৎ নিদ্রর কথা শুনে আরিবা ওর দিকে ঘুরলো। দেখলো মলিন চেহারায় নিদ্র ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরিবা জোর পূর্বক হেসে বললো।
“আলহামদুল্লিলাহ ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? আংকেল আন্টি ভালো আছে?”
নিদ্র মলিন হেসে বললো।
“আছে কোনো একরকম। তোমায় নিতে পারলেও একটু তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারতাম। কিন্তু তুমি বা তোমার পরিবার কেউ রাজি না। আমি আবারও তোমার কাছে এসেছি। প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিওনা?”
নিদ্র কথা শুনে আরিবার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু ও কি করবে? ওর বাবা যেখানে রাজি না সেখানে ও কিছুতেই রাজি হতে পারেনা। তাছাড়া ওর নিজেরও মন নেই। যেখানে মন নেই সেখানে বিয়ে করে কি লাভ হবে? দুজনের কেউয়েই শুখি হতে পারবেনা। আরিবাতো এতদিন মনে আরশকে পুষে রেখেছিলো। এখন এই বিয়ে ভালোবাসার প্রতি মন উঠে গেছে। তাই নিদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো।
“দেখুন ভাইয়া! আমি এখন এসব নিয়ে ভাবতে পারছিনা। আংকেল আন্টির জন্য আপনি অন্য কাউকে নিয়ে আসুন। আমি কখনই এতে মত দিতে পারবোনা।”
নিদ্রর যেটুকো আশা ছিলো তা নিমিষেই ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। এত দিন অনেক কেদেছে। আল্লাহর কাছে অনেক চেয়েছে। আসলে যেটা আল্লাহ দিবেনা সেটা হাজার চাইলেও পাওয়া যায়না। আরিবার কথা শুনে নিদ্র হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। ভিতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো নিদ্র অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো।
“আচ্ছা ভালো থেকো বিউটি ডল! আর কখনো ইচ্ছে করে তোমায় জ্বালাবো না। যদি কখনও কোনো বিপদে পরো আমায় একবার ডেকো চলে আসবো। আমি দোয়া করি তুমি অনেক অনেক সুখে থাকো। আসি বিউটি ডল! ”
কথাটা বলেই পিছনে ঘুরে গেলো নিদ্র। ওর চোখের কর্নিশ গড়িয়ে জল পড়লো। নিদ্র হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছো ঠোঁট কামরে রইলো। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো।
“কিছু জিনিস জীবনে না পাওয়াই ভালো। অন্তত ওর জন্য সারাজীবন আফসোস করার মতো কিছু থাকে।” মনে মনে এসব ভেবেই নিজের উপর তাচ্ছিল্য হাসলো। আরিবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিদ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
—————————-
আরিবা সকাল বেলা নিজের টেবিলে বসে আছে। পড়ার অনেক লস করেছে একটু পড়তে হবে নাহয় কি করে মেডিকেলে চান্স পাবে? আজ থেকে কচিংয়েও যাবে ভাবলো। বইটা সবে মাত্র খুলেছে এর আগেই মি. জাকির এসে বললো।
“মামনি তুমি তো এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করোনা যে আরশ খুন করতে পারে। তাহলে এটা দেখো।”
কথাটা বলেই মি. জাকির একটা ভিডিও ছাড়লো। আরিবা মন দিয়ে দেখতে লাগলো। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আরশ আর মিষ্টার আফজাল বসে আছে। আরশ ওর বাবার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো। ” আগে রিবার মাকে মারতে হবে।” মি. আফজাল বললেন। “দুজনকেই একসাথেই মারবো।” আরশ হেসে বললো। “আচ্ছা তা দেখবো। প্লান বানাতে হবে।” এখানেই ভিডিও শেষ। আরিবা অবাক হয়ে গেলো। যেটুকু বিশ্বাস ছিলো তা ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। গাল গরিয়ে চোখের পানি পরলো। মি. জাকির ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
“এবার বিশ্বাস হলো? আমি আরশের রুমে ক্যামেরা লাগিয়ে ছিলাম তার থেকেই জানতে পেরেছি। আরশ নেত্রাকেও খুন করেছে বুঝেছো? ওইদিন আমরা সবাই বাইরে ছিলাম। আরশ একাই ভিতরে ছিলো বুঝেছো? যা বলছি ভেবে দেখো। আসি মামনি! আমার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
কথাটা বলেই তিনি চলে গেলেন। আরিবা অনেক সময় কান্না করলো। হঠাৎ করে চোখের পানি মুছে নিলো। হাত মুঠ করে রাগটা একটু কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলোনা। পাশে ফল কাটার ছুরিটা হাতে নিলো। ব্যাগে ছুরিটা ঢুকিয়ে রেডি হয়ে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। আরিবা সেখানে না দিয়ে ওদের নতুন বানানো হচ্ছে এমন একটা নিরিবিলি বিল্ডিংয়ে গেলো। ওখানে কোনো জনমানব নেই। বিল্ডিংটাও সম্পূর্ণ করা হয়নি। ওখানে গিয়েই আরশকে ফোন করে বললো।
“হ্যালো ভাইয়া! আমি আমাদের নতুন বিল্ডিংয়ের ছাদে আছি তুমি আসো নাহয় লাফ দিবো এখনি।”
কথাটা বলেই আরিবা ফোন কেটে দিলো। আরশ পুরো এলোমেলো হয়ে গেলো। এটা কি বললো আরিবা? আরশ তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। শুধু সজলকে বলে এসেছে ও কোথায় যাচ্ছে। আরশ পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে ওখানে গেলো। দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলো। আরশ ছাঁদে গিয়ে আরিবকে দেখতে পেলো না। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। হঠাৎ করেই পিছন থেকে কেউ ওর মাথায় ভারী রড দিয়ে আঘাত করলো। আরশের মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। আরশ মথায় হাত দিয়ে পিছনে ফিরতেই অবাক হয়ে গেলো। কিছু বলার আগেই আরিবা ওর পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিলো। আরশ অবাক হয়ে একবার পেটের দিকে তাকালো আরেকবার আরিবার দিকে তাকালো। আরিবা রাগি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরশ কিছুই বুঝতে পারছেনা। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো।
“মায়াপরী….”
কথাটা বলেই আরশ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
💖
ইনশাআল্লাহ চলবে…..
(রি-চেইক করিনি ভুলত্রুটি মাফ করবেন। আমি অনেক অসুস্থ তাও তোমাদের জন্য গল্পটা দিলাম। আমার জন্য দোয়া করবে সবাই।)