অজানা পর্ব-৬৩

0
1938

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৬৩

💖

ডক্টর আরশকে নিয়ে অপারেশন করতে গেছে প্রায় দুই ঘন্টার মতো। আরিবা আর অপেক্ষা করতে পারছেনা এদিক ওদিক পাইচারি করছে। সবাই চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে। শান্তা নিজের ছেলেকে নিয়ে হাটাহাটি করছে। জিসান নিজের ছেলের পিছনে দৌড়া দৌড়ি করছে। ওর ছেলেটা অনেক দুষ্ট একটুও স্থীর হয়ে বসতে চায়না। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। তূর্য শাওন কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। সজল সবার থেকে বেস দূরে একাএকা বসে আছে। আরশের সাথে অনেক বছর ধরে আছে ও। আরশের জন্য ওর চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। মিসেস তারিন কান্না কাটি করে এখন চুপচাপ আছেন। তার পাশেই বসে আছেন মিসেস আয়শা। আরশের কি হবে সেই ভাবনাতেই অস্থির সবাই। আরিবা অপারেশন থিয়েটারের সামনে পাইচারি করছে আর আল্লাহকে ডাকছে। আরশে কি হবে ও যানে না। তবে এই শেষ চেষ্টা। আরশকে ছাড়া আরিবা কিছুতেই বাঁচতে চায়না। বিষের বোতলটা হাতে শক্ত করে ধরে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো। আপেক্ষা যেনো শেষ হচ্ছেনা। প্রতিটা মিনিট যেনো ঘন্টার মতো মনে হচ্ছে। প্রায় ৪ঘন্টা পর ডক্টর বেরিয়ে এলো। ডক্টর বের হতেই আরিবা তাড়াতাড়ি করে উঠে ডক্টরের কাছে গেলো। ওর পিছনে পিছনে সবাই গেলো। আরিবা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো।

“ডক্টর! পেশেন্ট কেমন আছে? তিনি সুস্থ আছেন তো? আমি কি তাকে দেখতে যেতে পারি?”

ডক্টর মাক্সটা খুলে আরিবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“রিলাক্স মিস আরিবা! আমি তো আগেই বলেছি ৪৮ঘন্টা না যাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছুই বলতে পারছি না। আর হ্যাঁ, পেশেন্টের কাছে এখন যাওয়াটা এলাউ না। আমি আপনাকে অনুমতি দিতে পারছিনা সরি!”

আরিবা অসহায় চোখে ডক্টরের দিকে তাকালো। ডক্টরের কথাটা শেষ করতেই মিসেস তারিন তাড়াহুড়ো করে কান্না ভেজা চোখে বললো।

“ডক্টর আমার ছেলে বাঁচবে তো? আমাকে বলুন আমার ছেলে আমার কাছে ফিরে আসবে”

“দেখুন আমি বারবার বলছি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরলে ভালো। নাহয় কিছুই করার নেই। আমি মিথ্যা সান্টায়ানা দিতে পারছি না। আপনাদের ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে মিসেস চৌধুরী! প্লিজ ওয়েট! আসছি!”

কথাটা বলেই ডক্টর চলে গেলো। কেউ কিছুই বললোনা হতাশ হয়ে সবাই বসে পরলো। আরিবার মন বারবার অশান্ত হয়ে উঠছে। ওর মন বারবার বলছে কি হবে ৪৮ ঘন্টা পর! শরাত্র বেশি হওয়ায় শান্তা শাহীন, জিসান আর তৃনা ওদের ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। আরিবাকে দেখে রাখতে তূর্য আর শাওনকে রেকে গেলো। সবাই যেনো ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে কারো চোখে ঘুম নেই না আছে খাওয়া দাওয়া। রাত ১২টা বাজতে চলেছে আরিবা ও ওর পরিবার সেই সকালে খেয়েচে এর মধ্যে কিছুই মুখে তোলেনি। তূর্য শাওন বারবার খেতে বলছে কিন্তু আরিবাকে কেউ খাওয়াতে পারেনি। আরিবা দেয়াল ঘেসে চুপচাপ বসে আছে। ওকে দেখলে যে কেউ পাগল বলবে। রাত ১০টার দিকে শান্তা আরিবাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে কিন্তু ওরা খায়নি। রাত বারোটার দিকে তূর্য মিসেস আয়শাকে ডেকে বললো।

“দেখুন আন্টি! এভাবে বসে থাকলে তো চলবেনা। আপনাদের কে তো বাঁচতে হবে। সুস্থ থাকতে হবে। সবাই যদি এভাবে ভেঙে পরেন তাহলে কি করে হবে?”

তূর্য কথা শুনে শাওন ও ওর সাথে তাল মিলিয়ে বললো।

“আন্টি আপনি খাবারটা নিয়ে আপনি খান আর আন্টিকে খাইয়ে দিন। আমরা আরিবাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছি।”

মিসেস আয়শা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে চললেন। ফ্রেশ হয়ে এসে প্লেটে একটু খাবার নিয়ে চললো মিসেস তারিনের কাছে। মিসেস তারিন খাবার দেখেই কেঁদে দিলেন। আরশের কথা মনে পরে গেলো তার। ছেলেকে ছাড়া এক বেলা খাবার খেতেন না। আজ পাঁচটা বছর ধরে তার ছেলেকে ছাড়াই প্রতিদিন খাবার খাচ্ছেন। নিজের স্বামীকে হারিয়ে অনেক আঘাত পেয়েছেন। এবার নিজের ছেলেকে হারাতে চান না তিনি। মিসেস আয়শা জোর করে মিসেস তারিনকে একটু খাবার খাওয়ালেন নিজেও অল্প কিছু খেলো। তূর্য আর শাওন আরিবার কাছে গিয়ে বসলো। তূর্য আরিবার চোখের পানিটা মুছে বললো।

“সকাল থেকে কিছু খাছনি এবার একটু খেয়ে নে! তুই না খেলেই কি আরশ ভাইয়া জেগে উঠবে?”

আরিবা কিছুই বলছেনা। ভাবলেশহীন ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। শাওন এক লোকমা খবার তুলতে তুলতে বললো।

“আরশ ভাইয়া জেগে উঠা পর্যন্ত তো তোকে সুস্থ থাকতে হবে নাহলে কি করে হবে বল? এত সময় না খেয়ে থাকলে তোর শরীর খারাপ করবে। তখন যদি তোর চরিং মাষ্টার জেগে ওঠে তো তোর কি অবস্থা হবে? তোকে তো ঠাস ঠাস করে আবার চর দিবে।”

আরিবা এবারও কিছুই বললো না। ওর বিরিয়ানি পছন্দ বলে শান্তা বিরিয়ানী রান্না করে পাঠিয়েছে কিন্তু আরিবা তাকিয়েও দেখছে না। শাওন তূর্য অনেক কষ্ট করে আরিবাকে দু লোকমা খাবার খাওয়ালো। আরিবার খাবার যেনো ওর পেটে যেতেই যাচ্ছে না। মুখ দিয়ে উল্টো বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। মিসেস আয়শা মেয়েকে টেনে উঠিয়ে চেয়ারে বসালেন। রাত বাড়ছে সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে কিন্তু আরিবার চোখে ঘুম নেই। ও অপেক্ষা করছে। আরশের মুখে একবার মায়াপরী ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করাটা কত কঠিন তা আরিবা এই কয় বছরে বুঝে গেছে। অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হতে চায়না। অপেক্ষা করাটা কত কঠিন তা যে করে সেই বুঝে।

—————————————

রাত পেরিয়ে দিন এলো দিন পেরিয়ে রাত এলো। আরশের জ্ঞান ফিরছেই না। আরিবার শরীর যেনো আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে। কিছুই খাওয়াতে পারছেনা ওকে। যতই সময় যাচ্ছে আরিবা ততই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মিসেস তারিনও একেবারে ভেঙে পড়েছেন। সবাই চেষ্টা করেও আরিবাকে একটুও ঠিক করতে পারছেনা। সবাই আরশের সাথে আরিবাকেও হারাবে সেটাই বুঝতে পারছে। আরিবার কোনো দিকেই খেয়াল নেই পাগলের মতো ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। আরশের কাছেও কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা। আরিবা আরশকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ডক্টরকে অনেক রিকোয়েস্ট করেও লাভ হয়নি। এটা অনেক জটিল অপারেশন এতে ৪৮ ঘন্টার আগে কারও প্রবেশ নিষেধ। আরিবা একেবারেই কাূছেনা শুধু ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। মিসেস আয়শা মেয়ের চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন। এত বছর পর মেয়েকে পেয়েও মেয়ের সাথে হাসি খুশি ভাবে কটা বছর কাটাতে পারলো না। হসপিটালে আবার সবাই এসেছে। এই কদিন আরিবা, মিসেস তারিন, মিসেস আয়শা, সজল সব সময় হসপিটালেই ছিলো। তূর্য শাওন মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলো তবে বেশিরভাগ সময় হসপিটালেই ছিলো। প্রায় ৪৬ ঘন্টা হতে চললো। সবাই আরশের আশা ছেড়েই দিয়েছে। সময় শেষ বলে অনেকেই হসপিটালে এসেছে। শান্তা শাহীন, জিসান তৃনা, নিদ্র আর ওর বউ সারলিন ওরা সবাই আবারও এসেছে হসপিটালে। আরিবাকে দেখেই নিদ্রর বুকে ধুক করে উঠলো। আরিবা ও আপন করে পায়নি তাতে কি? ও যেনো ভালো থাকে সুখে থাকে সেটাই চাইছে ও। আরিবার একটু কষ্ট দেখলে ও ঠিক থাকতে পারেনা। সবাই বলছে আরিবাকে হয়তো বেশি দিন ওদের মাঝে পাবেনা। নিদ্রর চোখের কর্নিশ গড়িয়ে জল পরলো। নিদ্র তা সবার আড়ালেই কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিলো। শান্তা এসেই দৌড়ে আরিবাকে জড়িয়ে ধরলো। আরিবাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেললো। নিজের বান্ধবীর এই রূপ যেনো ও দেখতে পারছেনা। আরিবার কোনো হেলদোল নেই। ও কাদছেও না কিছু বলছেও না। শান্তা আরিবার গালে হাত রেখে মাথাটা উচু করে ওর দিকে আনলো। কান্না ভেজা চোখে বললো।

“কি অবস্থা করেছিস নিজের একবার আয়নায় দেখেছিস? কি ছিলি আর কি হয়ে গেলি? আরশ ভাইয়াই তোর সব? আমরা কেউ না? দেখ কতোগুলো মানুষ তোর পাশে আছে! আমি আচি তূর্য শাওন তোর মা কাকিমনি! দেখ সবাই তোর জন্য কত কষ্ট পাচ্ছে। দেখ ভালো করে!”

আরিবা কিছুই বললো না। শান্তা ওর গাল ছেড়ে দিতেই ও আবার নিচের দিকে তাকালো। শান্তা আবার ওর মুখটা উচু করে বললো।

“চুপ করে থাকিস না। কিছু তো বল!”

আরিবা চোখ তুলে শান্তার দিকে তাকালো। মিনমনিয়ে ভাঙা গলায় থেমে থেমে বললো।

“আরশ ভাইয়া! আরশ ভাইয়ার কাছে যাবো।”

শন্তা অসহায় দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। তূর্য আরিবার কাছে এসে বসলো। রাগ নিয়ে বললো।

“এবার আমার হাতে থাপ্পড় খাবি। সেই কাল থেকে একেই কথা বলে যাচ্ছে কত চেষ্টা করছি। ডক্টর তো অনুমতি দিচ্ছেনা৷ আমরা কি করবো বুঝোছ না?”

শাওন এসে আটরিবার পাশে বসে রাগ নিয়ে বললো।

“শুধু আরশ আরশ আর আরশ! আমরা তোর কিচুনা? প্রমান করে দিলি বন্ধুত্ব কিছুই না। ভালোবাসাই সব। মরতে ইচ্ছে করছে? যাহ মর!”

কথাটা বলেই শাওন আরিবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। ওর দেখা দেখি শান্তা তূর্যও ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। অনেকক্ষন কান্নার পর ওরা থামলো। নিদ্রর আরিবার কথা শুনে খুআব কষ্ট হলো। ওর এক পরিচিত ডক্টর আছে এই হসপিটালে। ও তার কাছে গেলো। তাকে দিয়ে বলিয়ে অনেক কষ্টে আরিবাকে ভিতরে যাওয়ার পারমিশন নিলো। আরিবার একটু চাওয়া পূরন করতে পারলে একটু স্বস্তি পাবে ও। আরিবা হাটতে পারছেনা শান্তা ওকে ধরে অপারেশন থিয়েটারের সামনে নিয়ে গেলো। ভিতরে একজন প্রবেশ করার জন্যই অনুমতি দিয়েছে। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশের আশা সবাই বাদেই দিয়েছে আরিবাকে নিয়েও টেনশনে আছে। আরিবা অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে পা ফেলে আরশের কাছে গেলো। আরশের সারা শরীর যন্ত্রে ভরপুর। মুখে অক্সিজেন লাগানো আরিবা আস্তে করে আরশে পাশে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে পরলো। চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। করিবা কাঁপা কাঁপা হতে আরশের চোখে একবার হাত বুলালো। কান্না জরিত কন্ঠে বললো।

“কেনো এমন কষ্ট দিচ্ছো আমায় উঠে পরলে কি হয়? উঠোনা! একবার মায়াপরী বলে ডাকোনা প্লিজ! এক ভুলের শাস্তি কতটা বছর দিবে? কতবার সরি বলবো? কতবার ক্ষমা চাইবো বলো? যদি তখন বুঝতে পারতাম এই ভুল কখনই করতাম না। পাঁচটা বছর ধরে অপেক্ষা করছি তোমার মুখে মায়াপরী ডাক শোনার জন্য। তুমি তো জানো অপেক্ষা করাটা কত কঠিন। তুমিও তো ছোট থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করেছো। আমার মুখে ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্য। আমিও বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তোমার মুখেও ভালোবাসি কথাটা শুনতে পারিনি। চমাূের ভালোবাসাটা কি অসমাপ্তই রয়ে যাবে? কখনও কি এর পূর্নতা পাবেনা? তুমি কি সত্যি উঠবে না? বলো না?”

কান্না জড়ওত কন্ঠে কথাগুলো বলেতেই কথা গলায় আটকে গেলো। আরিবা থেমে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে আরিবার হেঁচকি উঠে গেছে। আরশের কোনো খবর নেই। হেঁচকি উঠা গলায় আরিবা থেমে থেমে আবার বলতে লাগলো।

“তুমি যেমন তোমার মায়াপরীকে ছাড়া বাঁচতে পারবেনা। তেমনি তোমার মায়াপরীও তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারবেনা। সবাই স্বপ্ন দেখে সবার স্বপ্ন পূরন হয়না। অনেকের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তারা কল্পনাতেই সুখি থাকে। সবাই ভালোবাসে সবার ভালোবাসা পূর্নতা পায়না, আমাদের ভালোবাসাও নাহয় তাদের মতোই হবে।”

কথাটা বলেই শব্দ করে কেদে ফেললো আরিবা। কোনো মতে নিজেকে সামলে একটু থেমে বললো।

“তোমার মুখে শোনার সৌভাগ্য আমার হলো না। আমার মুখে ভালোবাসিটা বলে যাই। জানি তুমি শুনবেনা। তবুও বলছি। বুকটা হালকা করি একটু। ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি আমার মি. খবিশ কে! নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। তাইতো তোমার কাছেই আসছি। তুমি ছাড়া এ পৃথিবী অন্ধকার আমার জন্য! তুমি ছাড়া আমি নিঃস্ব!”

কথাটা বলেই আরিবা বিষের বোতলটা বের করলো। আরশের দিকে কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বিষের বোতলটা খুলতে লাগলো।

💝

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

( রি- চেইক করিনি ভুলত্রুটি মাফ করো প্লিজ প্লিজ। কেউ আমায় বকা দিও না আবার। দুই পর্বেই শেষ করে দিবো। কালকেই আসছে মহা পর্ব।😁😁😁😁শুভ রাত্রি গাইস্ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here